বাবার মুখে ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের বর্ণনা – শহিদুজ্জামান (শহিদ)

বাবার মুখে ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের বর্ণনা - শহিদুজ্জামান (শহিদ)

বাংলার নয়নমণি অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জন সমুদ্রের ঐতিহাসিক জনসভায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার কথা বিবেচনার পূর্বশর্ত হিসেবে চারটি দাবি ঘোষণা করেন।

এগুলো ছিল, সামরিক আইন প্রত্যাহার,অবিলম্বে সেনা বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, সেনা বাহিনী সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।তিনি সেদিনের সভায় লাখো লাখো বাঙালির সামনে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের জনসভায় অংশগ্রহণের জন্য কয়েকদিন যাবৎ আমি জনমত সংগ্রহের কাজ করছিলাম। তার পরিণতি হিসেবে ৭ই মার্চ শেরে বাংলা নগর, আগারগাঁও থেকে প্রায় ৬০০০ (ছয় হাজার) লোকের এক বিশাল মিছিল বের করি। ওই মিছিলে আমি নেতৃত্ব দিই।এত বিশাল মিছিল দেখে পাকিস্তানিরা হতভম্ব হয়ে যায়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তিক থেকে এদিন খন্ড খন্ড, কোথাও থেকে বিশাল মিছিল বের হতে থাকে। সেদিন গোটা ঢাকা শহর এক মিছিল নগরে পরিণত হয়। আমি মিছিল নিয়ে সংসদভবন অতিক্রম করার সময় সংসদভবনের সামনে অপেক্ষমান (৯) নাইন ডিভিশন পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে থাকে। ওদের উদ্দেশ্য আমাদের ছত্রভঙ্গ করা। মিছিলটি এতই বিশাল ছিল যে, তা কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গি মিছিলে পরিণত হয়। এদিকে সৈন্যদের এমন অবস্থায় দেখে আতংকে ছত্রভঙ্গ হয়ে মিছিলটি বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। আমি অনেক কষ্টে ওদের নিয়ন্ত্রণ করে আবার মিছিল নিয়ে এগুতে থাকি। ঢাকার অনেক জায়গায়ই সেদিন এভাবে মিছিলগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয়। ওরা আমাদের মিছিল দেখে সহ্য করতে পারছিল না।

রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে আমরা উল্লাসে ফেটে পড়ি। বাঙালির মনে যে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছে তার আজ নবান্নের উৎসব। সবার হাতে হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা, বঙ্গবন্ধুর প্রতিমূর্তি, স্বাধীনতার পোস্টার, প্ল্যাকার্ড। মুখে মুখে ফিরছে শ্লোগান, ‘জয় বাংলা,বাংলার জয়,বঙ্গবন্ধুর ব্জ্র নির্ঘোষ ঘোষণা’ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব,এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।”রেসকোর্সের ভাষনণ সুস্পষ্ট হয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতার দাবি। স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত প্রস্তুতিএদিন থেকেই বাঙালি গ্রহণ করে।বঙ্গবন্ধু এভাবে সতর্কও করে দেন, ‘তোমরা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়।” আপামর বাঙালি বঙ্গবন্ধুর এ আহবানে সত্যিই যথোপযুক্ত সাড়া দিয়ে ছিল। একটা সুশিক্ষিত সুসজ্জিত সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে এরকম খালি হাতের প্রতিরোধ শুরু করে মাত্র নয়টি মাসেই স্বাধীন করেছিল মাতৃভূমিকে। এই বিজয় সম্ভব হয়েছিল প্রবল দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, শোষণ শাষনে তিক্ততা,সর্বোপরি সুযোগ্য নেতৃতের কারনণ।বীর বাঙালি ব্যগ্র গাত্রোত্থানে জেগে উঠলো, প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হলো বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে।

( বাবার বই  ‘রক্তে রাংগা বিজয়’  থেকে নেয়া)

Shahiduzzaman Jowarder

%d bloggers like this: