বিদেশীদের চোখে বাংলাদেশের গণহত্যা

বিদেশীদের চোখে বাংলাদেশের গণহত্যা আফরোজা পারভীন

পূর্ব প্রকাশিতর পর

 

ঠান্ডাপানিতে চুমুক এবং মৃত্যুদন্ডাদেশ

ডাবের পানিতে চুমুক দিতে দিতে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হল। আমাকে বলা হল যে, দু’জন বন্দি হিন্দু, তৃতীয়জন একজন “ছাত্র” এবং চতুর্থজন একজন আওয়ামী লীগ সংগঠক। আর “চোর”টি একটি কিশোর নাম-সিবাসতিয়ান। তাকে ধরা হয়েছে যখন সে তার এক হিন্দু বন্ধুর বাড়ির ঘরের মালামাল নিজের বাড়িতে নিয়ে আসছিল।

পরে সন্ধ্যায় এই লোকদের দেখলাম। এক দড়ি দিয়ে তাদের হাত-পা আলগা করে বাঁধা। সার্কিট হাউজ চত্বরের রাস্তায় ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে। সান্ধ্য আইন বলবৎ হওয়ার কিছু পর, তখন সন্ধ্যে ছ’টা হবে, একদল ময়না তখন কর্কশ কন্ঠে চিৎকার জুড়ে দিয়ে উল্লাস করছিল। সেই সময় হাড়মাংস এক করা ডান্ডা দিয়ে পেটানোর প্রচন্ড শব্দ তাদের উল্লাসে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিল।

হাসি-ঠাট্টায় যারা পুরো মেস অতিষ্ঠ করে তোলে, তাদের মতে বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপটেন আজমত দু’টো বিষয় সুখ্যাতি দাবি করতে পারেন। তার একটি হলো, তিনি নবম ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল শওকত রাজার এডিসি। আর অপরটি হলো তার সহকারিদের উৎকট ও কুৎসিত ঠাট্টা-বিদ্রুপ হজম করার শক্তি।

বোঝা গেল এই গ্রুপের মধ্যে আজমতই একমাত্র অফিসার, যিনি একজনকেও “হত্যা” করতে পারেন নি। এ কারণে মেজর তাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে খোঁচাতে থাকে।

একরাতে বশির তাকে বললো, “আজমত কাল একটা মানুষ পাবে তুমি। দেখবো কীভাবে তুমি তাকে পালাতে দাও। খুবই সহজ ব্যাপার।”

বিষয়টির ওপর জোর দেয়ার জন্য বশির লম্বা চওড়া বক্তৃতা করলো। সে এম এস ও-এর দায়িত্ব পালনসহ সদর দফতরের প্রশিক্ষণ অফিসার। পাঞ্জাবি অফিসারদের মধ্যে একমাত্র তাকেই অনর্গল বাংলায় কথা বলতে দেখেছি। এক স্বশিক্ষিত বিরক্তিকর ব্যক্তি। কণ্ঠস্বরে অহমিকা স্পষ্ট প্রকাশ্যমান।

আমাকে বলা হয়, ওই দিন সকালে এক দাড়িওয়ালা তার ভাইয়ের খোঁজ নিতে বশিরের কাছে আসে। সে কুমিল্লার একজন নামি আওয়ামী লীগ সংগঠক। কয়েকদিন আগে সেনাবাহিনী তাকে আটক করে। বশির তাকে বললো, ‘দড় গ্যায়া’,-পালিয়ে গেছে সে। বৃদ্ধের বোধে এলো না এক খানা ভাঙা পা নিয়ে তার ভাই পালিয়ে গেল কেমন করে। আমার বোধেও এলো না। অতএব, মেজর বশীর আমাকে চোখ টিপে জ্ঞানদান করলো।

রেকর্ডে ‘দড় গ্যায়া’র’অর্থ হচ্ছে “পালাবার সময় গুলি করা হয়।”

আমি আর জানতে পারিনি ক্যাপটেন আজমত কোন মানুষ খুন করতে পেরেছিলেন কীনা। চট্টগ্রামের সত্তর মাইল উত্তরে কুমিল্লা মহাসড়কের ওপর ফেনীতে বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যরা পরিখা খনন করে বসেছিল। এবং এলাকার সবগুলি সেতু ও কালভার্ট ধ্বংস করে দিয়ে তারা নবম ডিভিশনকে অথর্ব করে দেয়। ঢাকার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড জেনারেল রাজাকে তাগিদের পর তাগিদ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা চাইছিল যাতে বিদ্রোহীরা পালাতে না পারে সেজন্য দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল রুদ্ধ করে দিতে। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে যে সব সরবরাহ আটকা পড়ে আছে, চাইছিল সেটা দ্রুত খালাস করে আনতে। কেননা স্থলপথে উত্তরে আসার সড়ক এই একটাই।

বোধগম্য কারণেই জেনারেল রাজা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি ওই এলাকার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে উড়ে আসতেন। ফেনীতে আটকে পড়া ব্রিগেডকে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বক্তৃতা শোনাতেন। স্বাভাবিক নিয়মে ক্যাপটেন আজমত জেনারেলের সঙ্গে ছায়ার মতো ফিরতেন। আমি তাকে আর দেখিনি। যদি অভিজ্ঞতাই নির্দেশক হয়, সেক্ষেত্রে সম্ভবত আজমতকে মানুষ “হত্যার” ব্যাপারে প্রবলভাবে ঘর্মাক্ত হতে হয়েছে এবং আরো তিন সপ্তাহ তাকে রসিকতার শিকার হতে হয়েছে। মে মাসের ৮ তারিখে নবম ডিভিশন ফেনী ও তার আশপাশ এলাকা দখলে আনতে সক্ষম হয়। অবিরাম বোমা ও কামানের গোলা বর্ষণের মুখে টিকতে না পেরে বাঙালি বিদ্রোহীরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়।

নিয়মিত বাহিনীর এক বিরাট সংখ্যক সশস্ত্র বাঙালি বিদ্রোহীর পলায়ন নবম ডিভিশনের সদর দফতরের জি-১ লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসলাম বেগের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বললেন, “ভারত তাদেরকে ওখানে থাকতে দেবে না। দারুণ বিপজ্জনক হতে পারে তাদের জন্যে। সুতরাং, সীমান্তের এপার-ওপার করার অনুমতি যতদিন থাকবে ততদিন তাদের দুর্বহ যাতনা আমাদের ভোগ করে যেতে হবে। ওদের শেষ করা না হলে দীর্ঘদিন তারা আমাদের জন্যে গুরুতর সমস্যা হয়ে থাকবে।”

লেফটেন্যান্ট কর্নেল বেগ গোলন্দাজ ইউনিটের একজন অফিসার। সকলেরই প্রিয়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে চীনা অস্ত্রে সজ্জিত করা হচ্ছিল তখন তাকে চীনে এক সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। বলা হয়, তিনি তার পারিবারিক জীবন নিয়ে গর্বিত। তিনি ফুল ভালবাসেন। গর্ব করে বললেন, তিনি যখন কুমিল্লায় ছিলেন সে সময় চীন থেকে টকটকে লাল একটি বিরাট জলপদ্ম আনিয়েছিলেন। সদর দফতরের সামনের পুকুরটি সেটা অলঙ্কৃত করে রেখেছিল। মেজর বশির তাকে শ্রদ্ধা করতো। অফিসার ধরা পড়লো। তাকে নিয়ে কী করা হবে, এ নিয়ে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। বশির বললো, “যখন অন্যরা নির্দেশের জন্য বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোন করছে তখন তিনি সমস্যার সমাধান করে দিলেন, বললেন “দড় গ্যায়া”।” কেবল লোকটার পা গর্তের বাইরে প্রলম্বিত ছিল।

এপ্রিলের শেষদিকে আমি কুমিল্লায় গিয়েছিলাম। সেখানকায় বিকশিত সৌন্দর্যের মাঝে এই ধরনের ভয়ঙ্কর কথা বিশ্বাস করা দুষ্কর। রাস্তায় দুপাশে কাপের্টের মতো বিছিয়ে থাকা সবুজ ধানের ক্ষেত দিগন্ত ছুঁয়ে গেছে। মাঝে মাঝে লাল রঙের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে রয়েছে। সেগুলোকে ‘গুলমোহর ফুল-জঙ্গলের আগুন’ বলা হয়। পরিপূর্ণভাবে বিকাশিত হতে যাচ্ছে। ফুটকির মতো গ্রামের মধ্যে ফলভারে নত আম আর নারকেল বীথি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষুদ্রকায় ছাগপাল রাস্তার পাশে লাফালাফি করছে। এ সবই প্রাচুর্যের কথা বলে দেয়। “পুরুষ এবং নারীর মধ্যে যে পার্থক্যটা আপনার নজরে আসবে” ওরা আমাকে বলেছিল, “সেটা হচ্ছে সবগুলো ছাগীই গর্ভবর্তী।”

জ্বালাও-পোড়াও এবং হত্যা করাই প্রতিশোধ গ্রহণের প্রক্রিয়া

বিশ্বের সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ এলাকার অন্যতম কুমিল্লা-জেলার প্রতি বর্গমাইলে বসতির ঘনত্ব উনিশ শ’। এখন একটি আদম সন্তানও সেখানে নজরে আসবে না।

“বাঙালিরা গেল কোথা?” কয়েকদিন আগে ঢাকার জনশূন্য পথ দেখে বিস্ময়ে প্রশ্ন করি আমার সহচরকে।

“সবাই গ্রামে চলে গেছে”, এ ছিল তাৎক্ষণিক জবাব। এখন গ্রামাঞ্চলেও কোন বাঙালি নেই। ঢাকার মতোই কুমিল্লা শহরের সব দোকানপাট বন্ধ। লাকসাম পর্যন্ত দশ মাইল রাস্তার দু’পাশের গ্রামগুলো নীরব, নিথর। কৃষক যে ক’জন চোখে পড়লো, তাদের হাতের আঙুলে গোনা যায়।

অবশ্যই সৈন্য আছে শত শত। খাকি পরনে। হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। নির্দেশ হচ্ছে রাইফেল হাতছাড়া করা যাবে না। বলিষ্ঠদেহী এবং গুলি ছোঁড়াতেই যাদের আনন্দ বেশি, এমন জাতের সৈন্যরা অনবরত রাস্তায় টহল দিচ্ছে। যেখানে সেনাবাহিনী, সেখানে একটি বাঙালিও পাওয়া যাবে না।

রেডিওতে বার বার সামরিক আইন আদেশ প্রচার করা হচ্ছে। আর খবরের কাগজে লেখা হচ্ছে, নাশকতামূলক কাজে কাউকে লিপ্ত থাকাকালে পাওয়া গেলে তার মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। কোন রাস্তায় যদি প্রতিবন্ধক পাওয়া যায় কিংবা কোন সেতুর ক্ষতিসাধন অথবা ধ্বংস করা হয় সেক্ষেত্রে ঘটনাস্থলের ১০০ গজ পরিধির সকল বাড়ি ঘর ধ্বংস করে দেয়া হবে। সেখানকার বাসিন্দাদের আটক করা হবে।

শব্দটির চেয়ে তার প্রয়োগ আরো বেশি ভীতিপ্রদ। “শাস্তিমূলক কার্যক্রম” এমন একটি বিষয় যা বাঙালিদের কাছে ভয়বাহ, মহা আতঙ্কজনক।

এর অর্থ যে কী ভয়ঙ্কর সেটা আমরা দেখেছিলাম ১৭ এপ্রিল সকালে হাজীগঞ্জ যাত্রার পথে। শহরটি চাঁদপুর যাবার রাস্তায় পড়ে। হাজীগঞ্জের কয়েকমাইল আগে পনের ফুট দৈর্ঘ্যর একটি পুল আগের রাতে ধ্বংস করে দেয় বিদ্রোহীরা। তারা তখনও ওই এলাকায় সক্রিয় ছিল। মেজর রাথোরের (জি-২ অবপ) ভাষ্য অনুযায়ী সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট তৎক্ষণাৎ সেখানে পাঠানো হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে। দেখা গেল, বিধ্বস্ত পুলের চারদিকের পোয়া মাইল পরিধি এলাকা জুড়ে দীর্ঘ ধুম্রকুন্ডলী আকাশে উঠছে। দ্রুত তক্তা বিছিয়ে পুলটি মেরামত করা হয়েছে। সেটার ওপর দিয়ে আমরা সর্তকতার সাথে আমাদের গাড়ি নিয়ে এগোচ্ছিলাম। গ্রামের ডান দিকে যেতে দেখলাম সেদিকেও আগুনের বিস্তার ঘটছে।

গ্রামের পেছনে দিকে গিয়ে একদল জওয়ান শুকনো নারকেল পাতা ছড়িয়ে আগুনের বিস্তার ঘটাচ্ছে। গ্রামের প্রবেশ পথে নারকেল সারির ভেতর দিয়ে একটি মনুষ্যদেহকে হামাগুড়ি দিতে দেখা গেল। রাস্তার অপর দিকে ধানক্ষেতের মধ্যে অগ্নিসংযোগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি গ্রাম। ডজনের ওপর চাঁচ ও খেড়ো ঘর পুড়ে গেছে। সেনাবাহিনী পৌঁছবার আগে শত শত গ্রামবাসী পালিয়ে গেছে। অন্যরা নারকেল-সারির আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে লোকটার মতো নিঃশব্দে পালাচ্ছে।

গাড়ি এগিয়ে চলতে মেজর রাথোর বললো, “ওরা নিজেরাই নিজেদের জন্যে এনেছে এই বিপাক।” আমি বলি, “অঙ্গুলিমেয় কিছু বিদ্রোহীদের জন্য নিরপরাধ মানুষের ওপর এ এক ভয়ঙ্কর ধরনের প্রতিশোধ।” সে জবাব দিলো না আমার কথার।

কয়েকঘন্টা পর চাঁদপুর থেকে ফেরার পথে হাজীগঞ্জের ভেতর দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম তখন, “হত্যা এবং জ্বালাও-পোড়াও মিশন” এর নৃশংসতার চিত্র আমার সামনে প্রকট হয়ে উঠলো।

ওই এলাকায় বিকেলের দিকে একটি ঝড় বয়ে যায়। আমরা ওই গ্রীষ্মমন্ডলীর ঝড়ের রেশের মধ্যে পড়ে যাই। এক খন্ড বিশাল মেঘ মসজিদের ওপর ভৌতিক ছায়া ফেলেছে। মসজিদের গম্বুজ শহর ছাড়িয়ে ওপরে উঠে গেছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। পেছনে আমাদের অনুগামী খোলা জিপের আরোহী ক্যাপটেন আজহার ও তার চার জওয়ান ভিজে গেছে।

বাঁক নিতেই দেখি মসজিদের বাইরে একটি ট্রাক বহর দাঁড়িয়ে আছে। মোট সাতটি ট্রাক। সৈন্য ভর্তি। রণসাজে সজ্জিত সবাই। বহরের পুরোভাগে একটা জিপ। দু’জন লোক রাস্তার ওপরে শতাধিক সারিসারি বন্ধ দোকানের একটির তালা ভাঙার চেষ্টা করছে। তৃতীয় আরেকজন তত্ত্বাবধানে আছে। কারুকার্য খচিত সেগুন কাঠের দরজায় কুড়াল দিয়ে দু’জনে কেবল কোপ মারতে শুরু করেছে, এই সময় মেজর রাথোর তার টয়োটা থামালো।

“কী করছো তোমরা?” তিনজনের ভেতর লম্বা লোকটি এবং ভাঙার কাজ তত্ত্বাবধানে ছিলো, মুখ ঘোরালো। চোখ কচলে আমাদের দেখলো।

“মটকু নাকি?” গলা চড়িয়ে বললো, “বল দেখি আমরা কী করছি?” গলার স্বর চিনতে পেরে রাথোরের মুখে বিগলিত হাসি দেখা গেল। আমাকে বললো “ও আমার পুরোনো বন্ধু ইফতি।” দ্বাদশ ফ্রনটিয়ার ফোর্স রাইফেলস-এর মেজর ইফতিখার।

রাথোর : “কটা পেলে?” ইফতিখার লাজুক হাসি হাসলো।

রাথোর : “আরে বলোই না, ক’টা পেলে?”

ইফতিখার : “মাত্র বার। খোদার ইচ্ছায় পেয়েছি। পেছন দিক থেকে লোক না পাঠালে ওদের হারাতাম।”

রাথোরের চাপাচাপিতে ইফতিখার বিস্তারিত বললো-কীভাবে হাজীগঞ্জে তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুজির পর বারজন হিন্দু পেয়ে গেল। তারা শহরের উপকণ্ঠে একটি বাড়িতে লুকিয়েছিল। ওগুলোর “ব্যবস্থা” করা হয়ে গেছে। এখন মেজর ইফতিখার তার মিশন দ্বিতীয় পর্ব “জ্বালাও- পোড়াও” তে ব্যাপৃত রয়েছে।

ইতোমধ্যে দোকানের দরজা ভেঙে ফেলা হয়েছে। দোকানের ভেতরটা-আমরা নিজেরাই দেখলাম। এই ছোট্ট প্রতিষ্ঠানের একদিকে লেখা আছে “মেডিকেল অ্যান্ড স্টোর্স”। বাংলা হরফের নিচে ইংরেজিতে লেখা “অশোক অ্যান্ড মেডিকেল স্টোর্স”। নিচে লেখা “প্রপ্রাইটর: এ এম বোস।” মি, বোস হাজীগঞ্জের আর সকলের মতো দোকানে তালা মেরে পালিয়ে গেছেন।

দোকানের ঝাঁপ তুলতেই চোখে পড়ে ছোট্ট একটা শো কেস। পেটেন্ট ওসুধ, কফ সিরাপ, কিছু ম্যাংগো স্কোয়াশের বোতল, নকল সোনার গয়না, রঙিন সুতার রিল এবং ইলাস্টিক নিকারের প্যাকেটে ঠাসা। ইফতিখার সেটায় লাথি মারলো। জ্বালানি করার জন্য হালকা কাঠের শো কেসটি চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেললো। এরপর সে একটি তাক-এ রাখা পাটের তৈরি বাজারের থলি টেনে নামালো। আরেকাটি তাক থেকে কিছু প্লাষ্টিকের খেলনা, এক বান্ডিল রুমাল এবং ছোট্ট একগাদা লাল কাপড় ফ্লোরে নামালো এবং সবগুলো একসাথে জড়ো করে টয়োটায় বসা এক জওয়ানের কাছে একটি দিয়াশলাই চেয়ে পাঠালো। জওয়ানটির মাথায় তখন অন্য ভাবনা। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে সে দোকানের ভেতরে ঢুকলো এবং ছাদের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা একটি ছাতা নামিয়ে আনার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিল। লুণ্ঠন রীতি বিরুদ্ধ ব্যাপার, লোকটাকে সে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিল।

ইফতিখার আগুন জ্বালিয়ে ফেললো। জ্বলন্ত পাটের ব্যাগটি ছুঁড়ে মারলো দোকানের এক কোনায়। দোকানটি জ্বলতে শুরু করলো। এক মিনিটের মধ্যে বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে আগুনের চটপট শব্দ কানে এল। আগুনের বিস্তার ঘটলো বাম দিকে তারপর একটার পর একটা দোকান গ্রাস করতে শুরু লাগলো।

অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে রাথোর ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। গাড়ি ছেড়ে দিল।

পরদিন মেজর ইফতিখারের সঙ্গে দেখা করলাম। পরিতাপের সঙ্গে বললো, “মাত্র ষাটটি বাড়ি পুড়িয়েছি। যদি বৃষ্টি না নামতো, সবগুলোকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতাম।”

মুজাফফরগঞ্জ থেকে কয়েক মাইল আগে একটি গ্রামের কাছাকাছি আসতে থামতে হল। মনে হল, মাটির দেয়াল ঘেঁষে একটি লোক গুটিসুটি মেরে বসে আছে। এক সৈনিক সর্তক করে দিয়ে বললো লোকটা হয়তো ফৌজি স্নাইপার। লক্ষ্যভেদী সৈনিক। লোক পাঠিয়ে সর্তকতার সাথে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সে একটি সুন্দরী হিন্দু তরুণী। বাঙালি মেয়ের স্বভাবজাত শান্ত-স্নিগ্ধ নম্রতা নিয়ে সে বসেছিল। কার জন্য অপেক্ষা করছিল, ঈশ্বরই জানেন। জওয়ানদের একজন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এ ছিল দশ বছর। সে বাজারি বাংলা বলতে পারতো। তাকে বলা হল, সে গিয়ে মেয়েটিকে গ্রামে চলে যেতে বলে আসে। জবাবে মেয়েটি বিড় বিড় করে কী বললো বোঝা গেল না। কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই বসে রইল। দ্বিতীয় বার তাকে চলে যেতে বলা হলো। কিন্তু আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিলেও সে বসেছিল। আমাকে বলা হলো, “কোথাও তার যাবার জায়গা নেই। নেই পরিবার, নেই বাড়িঘর।”

মেজর ইফতিখার সেই সব অফিসারদের একজন, যাকে “হত্যা এবং জ্বালাও-পোড়াও” মিশনের কাজ দেয়া হয়। বিদ্রোহীদের উচ্ছেদের পর সেনাবাহিনীকে হিন্দু এবং “দুষ্কৃতকারী”দের (বিদ্রোহীদের সম্পর্কে অফিসিয়াল বুলি) বাছাই ও ধ্বংস সাধনের স্বাধীনতা দেয়া হয়। এবং এই স্বাধীনতার বলে যে এলাকা থেকে তাদের চললক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয় সেই এলাকার সবকিছুই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় তারা।

 

(চলবে)

%d bloggers like this: