আমি নারী, এই বিশ্ব আমার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র/ সুলতানা রিজিয়া

আমি নারী, এই বিশ্ব আমার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র

অনেক দিন আগে এমন বাক্য সমৃদ্ধ একটি পোষ্টাস্টার পড়েছিলাম। পোষ্টাস্টারের কথাগুলো আজও মনের মাঝে কারণে অকারণে অনুরণন তোলে। নিজের মনের কাছেই উত্তর খুঁজি। চারপাশের জগৎ সংসারে নারীর অবস্থান নিয়ে ভাবি, সত্যিই তো! যুদ্ধ না করে কবে, কোন নারী এই বিশ্বে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে পেরেছে?

কেবল বিশ্বে নয়, আপন ঘরেই তো নারী অহরহ অষ্টপ্রহর যুদ্ধ করেই বেঁচে আছে। সমাজ, সংসার, কর্মক্ষেত্র, রাস্তা ঘাট, এমন কি নারী যে ঘরে তার স্বপ্ন সাজায়, সন্তানদের চোখে কাজল আঁকে, আপন হাতে গোছানো পরিপাটি ঘরদোরে আপনজনদের প্রতীক্ষা করে, সেখানেও কি নারী নিরাপদ? নারী নির্ভার? যাপতি জীবনের পরতে পরতে নারীকে আচ্ছন্ন করে রাখে অবিনাশিী অনিশ্চয়তা, আগামী সকালের অশুভ শঙ্কা, অবসর জীবনের বার্ধক্যের দুর্ভাবনা।

কোথায় নিরাপদ নারী? জন্মের পর থেকে নারীকে তার শৈশব, কৈশোরে বাবা, মার উৎকন্ঠায় বেড়ে উঠতে হয় কখন কিযে হয়, কার নজরে পড়ে, কে কি বলবে এসব নিয়েই বাবা মাা সহ পরিবারের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কন্যা সন্তানের বিদ্যাশিক্ষা সমাপ্তের আগে কিম্বাংবা  পরিনণত বয়সে পৌঁছুানোর পূর্বেই বাবা, মা তাকে পাত্রস্থ করতে তৎপর হয়ে ওঠেন, নয়তো হাপুস নয়নে দিন গুনতে থাকেন কন্যার একটা হিল্লার আশায়। তারা একবারও ভাবেন না তার কন্যাসন্তানটি সাংসারিক ধর্ম পালনের সমর্থ কিনা, যে পরিবেশে তাকে পাঠানো হচ্ছে সেখানে সে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা, সুখী হবে কিনা? আমাদের এই সমাজ সংসারে কত শতাংশ কন্যাসন্তান নিজের বাবা, মার সংসারে শৈশব, কৈশোরের মধুমাখা রংধনু রঙের দিন যাপন করতে পারে? কয়জন কন্যা স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার দোর গোড়ায় পৌছুাতে পারছে? আমরা কতজন অভিভাবক কন্যাসন্তানদের বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি জীবনের পাঠ শেখানোর সুযোগ করে দিতে তার অন্যান্য গুণাবলীর চর্চাকে প্রাধান্য দিচ্ছি? আমাদের তেমন আগ্রহ বা মানসিকতা আছে কি? ভবিষ্যত বংশধর হিসেবে আমরা তো কন্যাসন্তানকে গন্যণ্যই করি না। তাই আমরা আমাদের সংসারে কন্যাসন্তানটিকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠার সময়, সুযোগ এবং অর্থটুকু ব্যয় করতেও কার্পন্যণ্য করি। সব সময় রাখঢাক এর আড়ালে তাদের টেনে রাখি। দায়সারা গোছের একটা দায়িত্ব পালন করে, পাছে লোকে কিছু বালার সুযোগ এড়াতে চেষ্টা করে চলি। এরই মাঝে পাখি পড়ার মতো করে তাকে শেখাই পরের ঘরে সে কি ভাবে, কতটা সহ্য করে, শ্বশুর বাড়ির মানুষদের মন জুগিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে পারবে।

নারী কি ঐ বয়সে নিজের চারপাশের জগত সংসারের ভালো মন্দটা বুঝতে পারে? নারীর বেড়ে ওঠার বয়সে তাকে কেবল শেখানো হয় নিজেকে আড়াল করার, আশপাশকে এড়িয়ে চলার অভিনব কৌশল। সঠিক জীবনতথ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞান, স্বাভাবিক আচরনেণের কোন শিক্ষাই তাদের দেয়া হয় না। শুধুমাত্র ভয়ের আরকে ডুবিয়ে রেখে এটা করো না, সেটা করো না এর পাশাপাশি অবাঞ্ছিত গোপনীয়তার অন্ধকারে রেখে দেয়া হয়। আমরা অনেকেই খোঁজ রাখিনা এই ভয়ের কারণে কতশত নারী জীবনের প্রকৃত পাঠ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, প্রকৃতির স্বাভাবিক ফলাফলের সত্য উদঘাটনে পিছিয়ে পড়ছে। নারী তার স্বাভাবিক জ্ঞানের অভাবে ভালো মন্দের বিভাজন করতে পারে না, ফলে কেউ কেউ না বুঝেই প্রেমের ফাঁদ পাতা ভূুবনে অপরিনণত বয়সে জড়িয়ে পরেড়ে। সেখান থেকেই শুরু হয় তার জীবনের অন্য রকম একযুদ্ধ। ভাগ্যক্রমে যাদের এমন সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয় না, তাদের যুদ্ধটা সোজা সাপটা সমাজ সংসারের সাথে যে কোনো ভাবে জড়িয়েই যায়।

এখন নেই সেই আরবের অন্ধকার যুগ, নেই অশিক্ষার অভিশাপ, পর্দাপ্রথার অবরোধ, আর্থিক দৈন্যদশা। এখন অনেকের হাতের নাগালে তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ স্বাধীনতা। তারপরও নারীর অবস্থান  সেই একই রকম। শিশুকাল থেকে শৈশব, কৈশোরে পিতার শাসনে, বিয়ের পরে স্বামীর অধীনে, প্রবীণ বয়সে সন্তানদের মেজাজ, মর্জিতে নারীকে আমৃত্যু টিকে থাকার যুদ্ধ করতে হয়। আজও সমাজ, সংসারে নারীর ত্যাগ, পরিশ্রম, স্নেহ, মায়া, মমতার কোনো মূল্যায়ন হয় না। পৃথিবীর চরমতম কষ্ট ও অশেষ যন্ত্রণা সহ্য করে একজন নারী তার সন্তান জন্ম দিয়ে মা”এর খেতাব লাভ করেন, জন্মদাত্রী মা তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো হাওয়ায় তিলে তিলে গড়ে তোলেন। সন্তান নিয়ে, সংসার নিয়ে নিত্য নিশি তিনি স্বপ্ন দেখেন। বুকের ঘামে চাষ করেন সংসার নামক সাজানো বাগান, পরম বিশ্বস্ততায় সেই বাগানে ফল, ফুল, সুখ সমৃদ্ধির আশায় ঢেলে দেন জীবনীশক্তি। নিঃশেষে দান করেন প্রেম, প্রীতি, স্নেহ, মায়া ও শ্রম প্রত্যাশিত সুখের জন্য, শান্তির সাথে বাঁচার জন্য। কিন্তু আশা বড়ই দুরূ-আরাশা। নারীর জন্য তো বটেই।

নারীকে আদি- অন্তে সমাজ ও সংসারে কম বেশী সবায় ভোগের সামগ্রী হিসেবেই মনে করে এসেছে এবং আসছে। শাড়ি, বাড়ি, গাড়ি, আসবাবপত্রের মতোই নারীকেও পন্যণ্য  হিসেবেই মনে করা হয়েছে- হয়। একটা সংসারে গাড়ি, বাড়ির মতোই পুরুষের জন্য নারীকেও প্রয়োজন। নারী ছাড়াতো সংসার গড়ে ওঠে না। নারী ছাড়া সংসার!!!অসম্ভব এবং অবাস্তবও। অথচ সেই সংসারের যাবতীয় উপকরণ কিনে আনেন সংসারের পুরুষ কর্তা বা অভিবাবক। সে পুরুষ পিতা, স্বামী, সন্তান বা ভাই যেই হোন না কেনো তিনি তার ইচ্ছা, রুচি এবং নিজস্ব বাজেটকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অধিকাংশ সংসারেই নারীর পছন্দ, কেনার স্বাধীনতা, আর্ধিক সহায়তা থাকে না বললেই চলে।

নারীরা সংসার সাজায় আপন হাতে, পরম মমতায়, যাপিত জীবনের সুখ স্বপ্নের আশায়। তাই বাড়ির চৌহদ্দির পুরোটাই তাদের দৈহিক শ্রমে, প্রাণাধিক যত্নে, পরিচর্যায় দিনে দিনে পল্লবিত, পুষ্পিত, শ্রীমন্ডিত হয়ে ওঠে। সন্তানরাও মায়ের  বুকের ওমে, আদরে, সোহাগে, শাসনে, তোষনে ও দিকনির্দেশনায় আপন জীবন গুছিয়ে নেয়, কর্মময় জীবনে প্রবেশ করে। নারীরা এক অর্থে বংশের ধারক ও বাহক। বংশ পরম্পরায় পুরুষ শুধুমাত্র জন্মদাতা, কিন্তু জীবনকে পেলে পুষে, ধুয়ে মুছে পূতপবিত্রের আরাধনায় বংশলতিকার রশিতে কেবল নারীরাই গিঁট দিয়ে চলেন। বংশের মান, সন্মান, মর্যাদা, রক্ষার্থে সন্তানদের মেধায় যাবতীয় গুণাবলীর বীজ একমাত্র মা’রাই বপন করে থাকেন। অথচ রাত, দিন চব্বিশ ঘন্টা নারীর শ্রমের মূল্যায়ন হয় না। সংসার নামক সীমানায় তার অতন্দ্র ও বিশ্বততাস্ততায় প্রহরার স্বীকৃতিও মেলে না। সংসারের সুখ, শান্তি, প্রেম, ভালোবাসা নারীর জন্য অনেকটা ভয়াবহ চোরাবালি কিম্বাংবা মররীীচিচিকাসম। নারী তার অজান্তেই গভীর গোপন মনে একধরনের তিক্ত ও বিষাক্ত অনিশ্চয়তায় ভোগে। বলা যেতে পারে ভুগতে বাধ্য হন। এটাই বাস্তবতা! আবহমানকাল থেকেই নারীর জীবনে এই অনিশ্চয়তাই একমাত্র কঠিন ও নির্মম সত্য এবং অলঙ্ঘনীয় বাস্তব। যাতে একজন নারী তার আপন সংসার, স্বামী, সন্তান, পরিবার, পরিজনদের কাছে হঠাৎ করেই অচেনা, অপরিচিত হয়ে উঠতে পারেন। স্বামী ইচ্ছা করলেই যেমন সংসার ত্যাগী হতে পারেন, তেমনি তিনি চাইলেই একাধিক মেয়ে বন্ধুর সাথে যুক্তও থাকতে পারেন। আবার না পোষালে তালাকের অজুহাতে স্ত্রীকে সংসার ছাড়া করতেও তাকে বেগ পেতে হয় না। এক্ষেত্রে নারীকেই অপবাদ মাথায় নিয়ে শূন্য হাতে সদর দুয়ার পেরিয়ে পথে নামতে হয়। নারী একবার আপন সংসার থেকে বহিস্কৃষ্কৃত হলে তার ফেরা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে যায়। নারীর জন্য আইনী সহায়তা অনেক সময় ধোঁপে টেকে না। কারণ আইন সবার জন্য সব সময় সমান নয়। নারীর জন্য তো নয়ই। অর্থব্যয়ে, সময়ের দীর্ঘসূত্রিকাকায়, সামাজিক ও পারিবারিক চাপে বিচারের রায় নথিবন্দিই থেকে যায়। খোরপোষশ কিম্বা ভরণপোষনেণের দাবীবি, ওয়াদামাফিক অর্থ (কাবিননামার দেনমোহর) প্রাপ্তির ন্যায্য পাওনাটুকু তখন সোনার হরিণসম সূদূরে মিলায়! জীবনভর সেই সোনার হরিণের আশা একজন নারীকে কেবল তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, আর বীরপুরুষ স্বামী তার প্রাক্তন প্রেমিকা, স্ত্রী, সন্তানদের জননী, সংসার নামক রাজ্যপাট গড়ে দেওয়ার নারীশ্রমিকের পেরেসাশানী তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন! তখনই নারীর জন্য শুরু হয় অন্যরকম যুদ্ধ।

কথায় আছে ভাগ্যবানদের স্ত্রী মরে। এই সব ভাগ্যবানদের জন্য বিয়ের নানান অজুহাত আমাদের সমাজ, সংসারে তৈরিরীই থাকে। নারীর ক্ষেত্রে তেমন প্রয়োজনটা অশালীনই নয়, নিন্দনীয়ও বটে। যে নারী একদা সংসারের সর্বময় কর্তীর্ত্রী ছিলেন, সন্তানদের জন্মদাত্রী ছিলেন, স্বামী অন্তঃ প্রাণ ছিলেন, সেই নারীই তালাকের পরোয়ানায় নিক্ষিপ্ত হন স্বামীর মন থেকে, পরিবার থেকে। অন্য অর্থে সমাজ থেকেও। তখন সেই নারীকে নতুন করে বাঁচার চেষ্টাকে, টিকে থাকার লড়াইকে যে কোনো ভাবে থামিয়ে দিতে, দমিয়ে দিতে, গুঁড়িয়ে দিতে প্রাক্তন স্বামীর বিন্দুমাত্র বুক কাঁপে না। ছলে, বলে, কৌশলে তিনি, অথবা তার কর্তৃক নিযুক্তরা নারীকে হীনতম নরকে পাঠাতে উঠে পড়ে লাগেন!!! এক্ষেত্রেও নারী তার পিতা, মাতা, ভাই-বোন, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ চারপাশ থেকে কোনো শাসান্তন্ত্বনা, সাহস ও সহযোগিতা পান না বললেই চলে। কেনো?

নারীকে নিয়ে আমরা কত ভাবেই না উদাহরনেণে, উপমায় সাজাতে পারি, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথার মালা গাঁথতে পারি, নারীর ভালো থাকা নিয়ে, সুখে রাখা নিয়ে কত শত প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, নারীর নিরাপত্তা দিতে, আর্থিক সহায়তা দিতে (বৃদ্ধ ভাতা, বিধবা ভাতা) প্রকল্প পরিকল্পনা (PP) লিখতে পারি, রাজনীতিও করতে পারি এবং করছিও। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমাদের কতভাগ নারী সামাজিক, পারিবারিক ও আইনগত অধিকার বা সুযোগ পান? নারী উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনার বাজেটের শতকরা কত অংশ নারীদের শ্রমের বিনিময়ে দেওয়া হয়? আমরা কি সে সবের কোনো হিসাব রাখি, না রাখার চেষ্টা করি? হায়, আমাদের সময় কোথায়!!!

আপনারে লয়ে বিভোর যারা তাদের জীবনে যে কখনো এমন ঘনঘোর অমানিশা আসবে না, কে বলতে পারে? তাই আমাদের ভালোটা আমাদেরকেই বুঝে নিতে হবে। সজাগ থাকতে হবে নিজের সুস্থতা, নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য। নারীর জীবন যাপনের কথা ভেবেই আমাদের সচেতনতাকে শাণিত করতে হবে, আর্থিক স্বচ্ছলতাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। আগামী দিনের অনিশ্চয়তার চিন্তা মাথায় রেখে বয়সকালীন শারীরিক জরা, ব্যাধির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে নারীর জন্য প্রয়োজন মানসিক দৃঢ়তা ও স্বাবলম্বিী থাকার নিশ্চয়তা। তাহলেই একজন নারী সত্যি সত্যিই তার প্রত্যাশিত শান্তির সাথে জীবন যাপনের পথ খুঁজে পাবেন। এই প্রত্যাশা শুধুমাত্র একজন নারীর নয় কিম্বাংবা একদিনের জন্য নয়। আপমর নারীসমাজের জন্য ভাবতে হবে এবং সবচেযে বড় কথা আমৃত্যু পরিপূর্ণ রূপে নিজেকেই ভালোবাসতে হবে।

সুলতানা রিজিয়া
সুলতানা রিজিয়া

 

%d bloggers like this: