পতন / শাহনাজ পারভীন
পতন / শাহনাজ পারভীন
আজ যেন কোন কিছুতেই মন বসছে না তানিশার। মনের মধ্যে অনবরত কু ডেকে যাচ্ছে। এই কয়দিন ধরে একই অবস্থা। বাসার টিভিটাও নষ্ট হয়েছিল বেশ কিছুদিন। হঠাৎই বাজ পড়ে নতুন টিভিটা নষ্ট হওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলো তানিশা। মনের দুঃখে তাকে আর অনেক টাকা দিয়ে সারাতে চায়নি প্রথমে। টিভির কাজ মোবাইলেই সেরে নিয়েছে এতদিন। কিন্তু বর্তমানে দেশের যে অবস্থা তাতে আর টিভি না হলে চলছে না। সারাক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে টিভির স্ক্রিন থেকে কখনো চোখ সরাতেও ইচ্ছে করছে না তার। তাই বাধ্য হয়েই অনেক টাকা দিয়ে টিভিটা মেরামত করিয়ে এনেছে। আর ক’টা টাকা যোগ করলেই একটা নতুন টিভি হয়ে যেতো। কিন্তু না, যেহেতু টিভিটা তার ছেলে পছন্দ করে নিজ হাতে কিনে এনে দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছে তাই সে আর এই টিভিটা পাল্টাতে চায় নি। ছেলের স্মৃতি বড় ভালো লাগে। টিভিটা দেখলেই যেন ছেলেকে দেখে ফেলা!
আজ কত দিন হলো ছেলে বাড়ি ছেড়েছে। কবে আর আগের মতো স্থায়ীভাবে বাড়িতে থাকবে? তা আর সম্ভব নয়। পড়া শেষ হলে চাকরিতে ঢুকবে, আরও বড় শহর, দেশে যাবে। এই মফস্বল শহরে কী আর ফিরে আসবে? তার মনটা হঠাৎই উতলা হয়। সে তার স্বপ্নের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরে যারপরনাই ভীষণ খুশি। আর তানিশাও। তার আপন বলতে ওই একটিই ছেলে। অবশ্য এখন মনে হচ্ছে টিভিটা না সারালেই ভালো হতো। আহা রে! তাজা তাজা তরুণ প্রাণ শুকনো ফুলের মতো নিমিষেই রাজপথে ঝরে যাচ্ছে। চোখে দেখা যায় না সে সব। তাদের তো তেমন কিছু চাওয়ার ছিল না, তাহলে কেন এই হত্যা, কেন এই খুন! মনের অজান্তেই দিন রাত কত প্রশ্ন, কত উত্তর একাকি তৈরি হচ্ছে তানিশার মনে।
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পনের বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য জুলাই ছাত্র অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে। পুলিশ বনাম ছাত্র-জনগণ। পুলিশ ছাত্র-ছাত্রীসহ নিরীহ জনগণের ওপর নির্বিচারে অবিরাম ব্রাশ ফায়ার থেকে শুরু করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছে। এমনকি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও গরম পানি বর্ষণ করে যাচ্ছে তাদের ওপর। চিন্তা করা যায়?
বাসায় কেমন একা একা দমবন্ধ অবস্থা লাগছে। বাইরে বেরোলে কেমন হয়? যেমনটি ভাবা ঠিক তেমনটিই-বাসায় পরা সালোয়ার কামিজেই পায়ে একটা পাওয়ারের কেডস, মাথায় একটা হালকা হিজাব জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে তানিশা। কিন্ত এ ভুতুড়ে শহর তার অপরিচিত মনে হচ্ছে। শহরে কার্ফ্যু। রাস্তায় কোন যানবাহন, মানুষজন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এক ভয়ানক নিঃসঙ্গতা তানিশাকে পেয়ে বসে। সে আর বড় রাস্তায় যাওয়ার সাহস পায় না। হাঁটি হাঁটি পা পা করে মোড়ের রাস্তা থেকে বাসায় ফিরে আসার পথ ধরে। মোবাইল চেক করে। নাহ! ইন্টারনেট নাই আজও।
ছেলেটার জন্য বড় অস্থির হয় তার মন। সুযোগ করে একটুখানি টুকটাক কথা হচ্ছে কখনো সখনো, মোবাইলে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না ছেলের চাঁদ মুখখানা। কতদিন দেখেনি সে। তানিশার মনে পড়ে করোনা- সময়ের কথা। তখনো রাস্তায় ঠিক এই অবস্থা ছিল। প্রাতঃভ্রমণের সময়ও কোন কাকপক্ষির চেহারা দেখা যেতো না। মানুষ তো দূরের কথা। তানিশাও অবশ্য ঘরেই হাঁটতো। কিন্তু ডাক্তারের কড়া নিষেধ।
-‘ট্রেড মিলে হাঁটা যাবে না। পায়ের হাঁটু আরও বেশি ক্ষয় হয়ে যাবে। রাস্তায় হাঁটুন। মুখে মাস্ক দিয়ে বাইরে হাঁটুন।’
অগত্যা তাই তার রাস্তায় হাঁটতে বের হওয়া। আহা মনে পড়ে, করোনাদিন তো তাও ভালো ছিল। সরাসরি কারো সাথে দেখা না হলেও মোবাইলে, ভিডিও কলে দেশ- বিদেশে আত্মীয়- স্বজনের সাথে দেখা হতো। কথা হতো। কিন্তু এখন? সব বন্ধ। না সরাসরি, না মোবাইলে। মনের মধ্যে আবারও কু ডাকে। এরই মধ্যে সকল নীরবতা খান খান করে বেজে ওঠে মোবাইল।
-মা, ছোটি, মোটিকে পাঠাচ্ছি। ওদেরকে দেখে রাখো। একটু আদর দিও।
-কিভাবে পাঠাচ্ছো, বাবা?
-আমার বন্ধু রাকিব ওর মামার সাথে এ্যাম্বুলেন্সে যশোর যাচ্ছে। ওর কাছে পাঠাচ্ছি। এখানে ওদের খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হচ্ছে। আমি তো সারাদিন রুমে থাকি না। রাতেরও কোন ঠিকঠিকানা নাই।
-ঠিক আছে তুমি চিন্তা করো না। আমি দেখছি।
ছোটি, মোটি ওর পোষা বিড়াল। মোটিকে দিয়েছে ওর বাড়িওয়ালি আন্টি। তার তত্ত্বাবধানে বাইশটা বিড়াল আছে। মাঝে মাঝেই মোটি তার ছেলে তৌসিফ এর ঘরে ঢুকে পড়তো। ছেলে মোটাসোটা আয়েশি বিড়ালটাকে একটু এটা সেটা খেতে দিতো, আদর করতো। ব্যস। ব্যস, মোটি আর যেতে চায় না।
বাড়িওয়ালা আন্টিও ওটাকে ওর জিম্মায় দিয়ে দিয়েছে। প্রথম প্রথম আন্টি ওদের খাবার দাবার বাথরুম করার গিটার সবই সাপ্লাই দিতো। কিন্তু ইদানিং ওসব আর দেয় না, বিড়ালটাকেই ওকে একেবারে দিয়ে দিয়েছে।
-তুমি একবারে নাও ওটা। তোমাকে দিলাম। যত্ন করে রেখো।
ও আর কিছু বলতে পারি নি। নিজের টাকায় বয়লার মুরগি, এটা সেটা কিনে আনে। যত্ন করে, খাওয়ায়। বিড়ালটা খুব খুশি। এই ঘটনার কয় দিন পর রাস্তায় একটা অসহায় বিড়ালের বাচ্চাকে কান্না করতে দেখে তাকেও সাথে করে এনে মোটির সঙ্গী বানিয়ে দিয়েছে তৌসিফ। প্রথম প্রথম মোটি সেটাকে মেনে না নিলেও এখন দু‘জন দু’জনের প্রাণের বন্ধু।
তানিশা ভাবে, ওরা আসুক, অসুবিধা নেই। ছেলেটা তাহলে স্বস্তিতে বাইরে থাকতে পারবে। আন্দোলনে আন্তরিকভাবে নিয়মিত হতে পারবে। বাসায় ওর নিজেরও তো একটা বিড়াল রয়েছে। সেটাও তানিশা কাকতালীয়ভাবেই পেয়েছে। একদিন সন্ধ্যায় বাড়ির গেটের মুখে বিড়ালটির কষ্টের কান্না চারিদিকে ভারি করে তুলছিলো। খান খান করে ভেঙে পড়ছিলো সন্ধ্যার নীরবতা। তানিশার চোখে চোখ পড়লে বিড়ালটির আকুতি সে আর ফেলতে পারে না। সাথে করে নিয়ে এসেছে বাসায়। রাতে একটু গরম দুধ খেতে দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো বাসার একটি নিরিবিলি ঘরে। কিন্তু বিড়ালটি ব্যথায় সারারাত কান্না করেছে। একটু ঘুমাতে পারে নি, তানিশাকেও ঘুমাতে দেয় নি। তানিশা দেখে বিড়ালটির ব্লিডিং হচ্ছে। হয়তো সে প্রেগন্যান্ট ছিলো। যে কোনভাবেই সেটা মিসক্যারেজ হয়েছে। তানিশা একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দেয়। অপেক্ষা করতে থাকে আলো ফুটবার।
সকালেই পরিচিত পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার বিড়ালটিকে এন্টিবায়েটিক ইনজেকশান পুশ করে। বেশ কিছু খাওয়ার ওষুধ দেয়। তার কান্না থামে, কষ্ট কমে।
তানিশার এই ব্যাপারটা আগে মোটেও ভাবনায় ছিলো না। পশুপাখিও যে মানুষের মতোই মা হয়, তাদেরও বাচ্চা নষ্ট হয়। তাদেরও এমন মায়ের মায়ায় কষ্ট হয়। খুব কাছ থেকে দেখে তানিশার অন্য রকম মায়া হয় বিড়ালটির জন্য। তাই ছেলের ফোনে বিড়াল সংক্রান্ত কথা শুনে সে আর বিরক্ত হয় না। বরং মনে মনে ভাবে, যদি বিড়ালগুলোকে পাঠাতে পারে, তাহলে ছেলের আর পিছুটান থাকবে না। সে নিশ্চিন্তে দেশের এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে নিজেকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে পারবে। আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে পারবে। তাই তানিশার খারাপ লাগে না। বরং ছেলের দায়িত্ববোধ দেখে সে আরও খুশি হয়। মনে মনে ভাবে, একটা সামান্য বিড়ালের জন্য যার এত দরদ, এত দায়িত্ব ও ভালোবাসা, তাহলে মানুষের প্রতি তার দরদ, তার দায়িত্ব কতটা গভীর হতে পারে!
এদিকে অসুস্থ বিড়ালটা ঠিকমতো ঔষধ পথ্য, সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে। ভালোই হলো তানিশার। তার আর মোটি, ছোটিকে নিয়ে আলাদা করে ভাববার অবকাশ থাকবে না। একই সাথে তিনটিকে যত্ন করতে পারবে।
মা বিড়ালটা প্রথম অবশ্য ওদেরকে মেনে নিতে চায় নি। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে মোটি, ছোটির মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। পেটের সন্তানের দরদে তাদেরকে আগলে রাখাছে। নিজে আগে না খেয়ে তাদেরকে খাওয়াচ্ছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে তানিশা অবাক বিস্ময়ে হা হয়ে যায়! আহা! মানুষ, তোমরা এমন কেন? একজনকে মেনে নিতে পারো না কেন, হৃদয়ের আদর দিয়ে আপন করতে পারো না কেন? একজনের ন্যায্য অধিকার কেন দিতে পারো না? কেন, এত মারামারি, কেন এত হানাহানি? কিসের নেশায় এত মত্ত হয়ে আছো? একজন মানুষের চলার জন্য কতকিছু লাগে? একজন মানুষের কতটুকু জমি লাগে? একজন মানুষের কত কত সম্পদ লাগে? তাহলে কেন এত হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি। কেন এত অপশাসন, অপরাধ, মিথ্যা, খুন, গুম, হত্যা, আগুন? কেন এত এত মায়ের বুক খালি করা? কেন এত স্ত্রীর চোখে অশ্রু, কেন এত শিশু সন্তানের বাবা হারানোর বেদনা? কেন এত বোনের বাঘিনী রূপে আবির্ভূত হতে বাধ্য করা। নাহ, আর ভালো লাগছে না তানিশার। এত এত মিছিল, এত এত প্রতিবাদ, রক্তে আগুন ধরানো স্লোগান-
“কারার ওই লৌহ কপাট,
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
যত সব বন্দিশালা, আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা”
সাথে সাথে পুলিশের কঠোর
এ্যাকশন, এত গুলি। যেই পুলিশ মানুষের আস্থার জায়গায় ছিলো, সেই পুলিশই আজ তাদের হন্তারক!
কিভাবে গুলি চালালো আবু সাইদের বুকে, মুগ্ধ’র কণ্ঠস্বর ঝাঁঝরা করে দিলো। ‘এই পানি লাগবে পানি? পানি নেবেন পানি?’
আহা। সে টিভির বাটন চেপে দ্রুত টিভি অফ করে দেয়। গুটি গুটি পায়ে মোটিদের ঘরে যায়। তারা তিনজন আরামে, আয়েশে, নির্ভয়ে, মায়ায়, গুটিসুটি, জড়োসড়ো হয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে তানিশার মনে শান্তি লাগে, এই দৃশ্য দেখে তানিশার চোখে পানি আসে। আহা কতদিন সে এমন শান্তিতে ঘুমাতে পারে নি। কতদিন তার চোখ নির্ঘুম কাটিয়ে দেয় সারারাত। তার ছেলে বাড়ি এলে সেও এমনি ঘুমাবে ছেলের মুখ দেখে, ছেলের বুকে মাথা রেখে। কিন্তু সে আর কবে?…
আবারও টিভির নবে হাত যায় তানিশার। কিন্তু এ কী অবস্থা? এত মানুষ! মানুষ আর মানুষ! এত মানুষ একসাথে এক জনমে দেখা হয় নি তার। কার্ফ্যু অগ্রাহ্য করে রাতের অন্ধকারে সারাদেশ থেকে আগত মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঢাকায় পৌঁছে গেছে। খুব ভোর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শাহবাগ থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মিছিলে সুর ওঠে, আকাশ বাতাস মিলেমিশে একাকার-
“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।”
এই গান শুনে তানিশা তার ছাত্রী জীবনে ফিরে যায়। মনে পড়ে প্রতিদিন অ্যাসেম্বলিতে
বড় দিদিমনি তানিশাকে ডেকে দিদিমনির সামনে দাঁড় করিয়ে দিতো। শিলু, মিনি, দূর্গা আর তানিশা হেড স্যার, বড়দিদিমনিদের সামনের লাইনে দাঁড়িয়ে শপথ বাক্য পাঠ শেষে জাতীয় সঙ্গীত শুরু করতো। ওরা শুরু করলেই ওদের সামনে লাইন করে দাঁড়ানো শ্রেণি নির্ধারিত ছাত্রীরা ওদের সাথে গলা মেলাতো। তখন তানিশার মনে কেমন এক অলৌকিক শক্তি ঘিরে থাকতো। নিজেকে খুব সুখি আর অন্যদের চেয়ে পৃথক হয়ে ঐশ্বরিক আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতো। নিজেকে নিয়ে কতকিছু ভাবতো সে! তারপর জাতীয় সঙ্গীত শেষে যখন লাইন ধরে সকলের আগে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতো তখন যেন ও আবার মাটির পৃথিবীতে নেমে আসতো। ওর মানুষ মানুষ মনে হতো।
আজও যখন লাইন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অসংখ্য শ্রেণি পেশার মানুষ কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জাতীয় সঙ্গীত শুরু করলো, তানিশার মনে হলো সেও যেন ওই লাইনের একজন, ওর কণ্ঠেও মনের অজান্তেই সুর ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজনায় সিনা টান টান হয়ে ওঠে। এক ঐশ্বরিক শক্তি ভর করে ওর উপর। এই ঐতিহাসিক মিছিলে সে শামিল হয় মগজে ও মননে।
সারা বাংলাদেশের মানুষ কি ঢাকায়? কার্ফ্যু উপেক্ষা করে যার যার মতো সবাই পৌঁছে গেছে এই মহামিলনের শুভবার্তার বাহক হিসেবে। কতক্ষণ এভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কেটে গেলো তানিশা তা জানে না। হঠাৎই টিভির স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটি অস্পষ্ট হেলিকপ্টারের ছবি। খুব চেনা কিছু মানুষ। কিছু অচেনা আয়োজন। চৌদ্দটি সাজানো স্যুটকেস। ফিসফাস কিছু শব্দ। বুক ধড়পড় করার কিছু গোপন নিঃশ্বাস। তানিশা নড়েচড়ে বসে। চোখ যায় টিভি স্ক্রলে। অনবরত এক মহা পতনের গল্প সেখানে হাজার সমুদ্রের ঢেউ হয়ে উপচে পড়ছে পুরো বাংলাদেশে। তানিশার কলিজা ধড়ফড় করে ওঠে। বৃথা যায় নি, বৃথা যায় না। এত মায়ের কলিজার টুকরো গুলোর এই চাওয়া বৃথা হবার নয়। এই থকথকে রক্ত, তাজা বুলেটের সামনে বুক পেতে দেওয়া কখনো বৃথা যায় না।
জন্মালে মরতে হয় যেমন সত্যি, তেমনি তিন সত্যি যে- অধিক বাড়লে তার পতন অসম্ভাবী।
‘ঠিকই বলেছো তানিশা। একদম ঠিক।’ নিজের কথায় নিজেই উত্তর দেয়। সবই তো দেখলাম। সূর্যের আলোর মতো সব পরিষ্কার হয়ে গেলো চোখের সামনে। কোনো অস্পষ্টতা, কোন আলো আঁধারির ছায়া নেই এখানে। কিন্তু এত দ্রুত। এত কম সময়ে!
এভাবে যে কারো পতন হতে পারে, এভাবে যে কেউ সবকিছু ছেড়ে হুংকার গিলে খেয়ে নিজেই নিমজ্জিত হতে পারে নিজের সাজানো কেচ্ছায়, তা চোখে না দেখলে, কানে না শুনলে অনুভব করা যায় না, বোঝা যায় না।
তানিশা বোধ হয়, জেগে জেগেই একটু নস্টালজিয়ায় আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলো। হঠাৎই অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে
-হ্যালো, আপনি কি তৌসিফ এর আম্মা?
-হ্যাঁ, আমি তৌসিফের আম্মা? আপনি কে বলছেন? আমার তৌসিফ কোথায়? কী হয়েছে আমার তৌসিফের? আমার আব্বু কোথায়?
একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে তানিশা।
-আমি তৌসিফের বড় ভাই হই। তৌসিফ হাসপাতালে।
-কী বললে? হাসপাতালে? কী হয়েছে আমার ছেলের?
-তেমন কিছু না। একটু… আহত হয়েছে।
মোবাইলের কণ্ঠটা কি একটু কেঁপে উঠলো! বুকের মধ্যে মুহূর্তেই ভুমিকম্প হয় তানিশার।
-সত্য করে বলো বাবা, আমার ছেলে কি নাই? সত্য করে বলো।
-আপনি আসতে পারবেন আন্টি? দেশে তো কার্ফ্যু চলছে। রাস্তায় কোন যানবাহন নেই।
-দোহাই লাগে, সত্যি করে বলো আমাকে, আমার ছেলে কেমন আছে, কী হয়েছে, বাপ?
-আন্টি আপনি চিন্তা করেন না। আমি এ্যামবুয়েন্স কল করে দিচ্ছি। আপনি চলে আসেন।
তানিশা আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে যায়।
আহা্ আমার প্রাণের সন্তান। একমাত্র সন্তান। বহুকষ্ট করে এক হাতে ওকে বড় করেছি, মানুষের মতো মানুষ করতে চেয়েছি। কিন্তু কী দিয়ে কী হয়ে গেলো। তানিশা আর কিছু ভাবতে পারে না, ভর দুপুরেই চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসে যেন।
এদিকে ওঘর থেকে একযোগে মা বিড়ালটি মোটি, ছোটিকে সাথে নিয়ে কঁকিয়ে কেঁদে উঠলো।
Facebook Comments Sync