প্রথম প্রেমপত্র – পল্লভী খান

প্রথম প্রেমপত্র - পল্লভী খান

আমার বয়স তখন বারো পেরিয়ে তেরোতে পড়েছে । ক্লাস ফাইভে ওঠার পর আম্মা একটা ওড়না আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললেন,” আজ থেকে আর তুমি মাঠে খেলতে যাবে না। খেলতে হলে বাড়িতেই খেলবে। এখন তুমি বড় হয়ে গেছো।” আমার তো খুব মন খারাপ! বড়ো হওয়ার জন্যে এতো যে আগ্রহ ছিলো তা দপ করে নিভে গেলো। যাই হোক, পরদিন চাচার বাড়ি যাওয়ার জন্যে বের হয়েছি। বাইরে যতগুলো ছেলে ছিলো, দেখি সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেসের বারান্দায় ওসমান, মুহম্মদ আর আমাদের ভাড়াটে বাড়ির ছেলেটা বসে খুব গল্প করছিলো, হাসাহাসি করছিলো –আমাকে দেখার সাথে সাথে তারা চুপ। সেলিম নামে একটা ছেলে, আমরা একসাথে খেলতাম, খেলতে খেলতে মারামারিও করতাম। আমারই বয়সী। সে দেখি অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কোথায় যাচ্ছেন?

বাইরে খেলাধূলা বন্ধ, বাড়ির মধ্যে মস্তো উঠোন। সেখানে পাড়ার বান্ধবীরা খেলতে আসতো। তবে ছোট বোনদের সাথে শালগাড়িয়া, রাধানগর,রাঘবপুর- হেঁটে হেঁটে যেতাম, আম্মাই পাঠাতেন নানা কাজে। পাশের বাড়ির ফিরোজা খালাআম্মা আমাকে ল্যাংবোটের মতো  যেখানেই যেতেন সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তখন উত্তম-সুচিত্রার খুব নামডাক। তাদের সব সিনেমা তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে যেতেন। খালুজান ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি প্রায়ই মফস্বলে যেতেন। তখন খালাআম্মা  আম্মাকে বলে আমাকে ডেকে নিতেন রাতে থাকার জন্য। আমি পড়ার বই নিয়ে যেতাম। একদিন সকালে বই নিয়ে বাড়ি এসে পড়তে বসবো, বই খুলতেই একটা মোটা ভাঁজ করা কাগজ পড়লো টুপ করে মাটিতে। কাগজটা তুলে খুলতেই মাঝখানে চোখ পড়লো “ প্রেম যে কি জিনিস তাহা হয়তো তুমি জানোনা—” ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা ঘুরে গেলো। সারা শরীর আর মাথা গরম হয়ে ঝিম ঝিম করতে লাগলো! এটা কি প্রেমপত্র ? কার এতো বড় সাহস, আমাকে প্রেমপত্র দেয় ? রাগে আর ঘৃণায় আমি চিঠিটা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে বাইরের পগারে ফেলে দিয়ে আসলাম। সারাদিন খুব অস্থির! আম্মাকে বলা যাবে না। কারণ আম্মাকে ছেলেদের নামে কোন নালিশ দিলেই উলটে আমাকে বকা দিতেন, “কেনো তুই ওদের সাথে ইয়ার্কি মারতে যাস!” যেনো আমারই সব দোষ! কাজেই ঠিক করলাম, আব্বা আসলে আব্বাকে বলবো। তো-আব্বা বিকেলে অফিস থেকে ফিরলে তেড়ে মেরে যাচ্ছি বলার জন্য। হঠৎ মনে হলো-আব্বা যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘কে লিখেছে?’ আমি তো বলতে পারবো না। কারণ ওইটুকু লেখা ছাড়া আমি আর কিছুই দেখিনি। কে লিখেছে ? ওসমান, মুহম্মদ নাকি আমাদের ভাড়াটে বাড়ির ঐ কলেজে পড়া ছোকরাটা ? সারাক্ষণ এই তিনজন গুজগুজ ফুসফুস করে আর হাসাহাসি করে। আমাকে দেখলেই চুপ হয়ে যায়। তারপর ভাবলাম, আব্বা যদি বলেন, ‘কই, দেখি চিঠিটা!’ আমি তো দেখাতেও পারবো না। কি আর করা! কাউকেই আর বলা হলো না। তবে আমি এই তিনজনের সাথে আমার বিয়ের আগে পর্যন্ত কোন দিন কথা বলি নাই। ওদের দেখলেই আমার রাগ আর ঘৃণা হতো,। এরা এতো খারাপ

 

তবে সত্যিই যেদিন প্রেমপত্র পেলাম সেটা এমন। তার আগে ছিল কিচু বকাবকি রাগারাগির ঘটনা যা চিঠি পড়লেই বোঝা যাবে।

 

প্রিয় সুজন, পর সমাচার এই যে, তুমি কেমন আছ ? নিশ্চয় ভাল ! কিন্তু আমি ভাল নেই কথাটা আবার সম্পূর্ণ সত্যও না কেননা ভাল আছি তুমি ভাল আছ বলেই । কত প্রচেষ্টা, কত নিবেদন, কত অনুরোধ, কিছুতেই তোমার মন গলানো গেল না । তুমি কথা বললে না । কেন বললে না সেটা আমার জানার কথা নয় সেটা তুমি ভালভাবেই জান । হয়তবা তোমার সমস্যা ছিল । আমি ব্যাপারটাকে পজিটিভভাবে নিয়েছি । বিশ্বাস কর আমার প্রতিটি মহুরতে স্বাভাবিকতার লক্ষণ নেই । আগের মত কোন কিছুতে মন থাকে না । এটা তারাই বুঝতে পারছে যারা আমার কাছে থাকে । তোমাকে তো তা বোঝানো গেল না । কারণ তুমি বুঝতে চেষ্টা করনি। হয়তো করেছো তা আমার জানা নেই । আমি সত্যি অনেক কষ্টে আছি । কেননা আমি তোমাকে আবেগ দিয়ে নয় মন দিয়ে, হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে ভালবাসি । জীবনের শেষ মহুরত পরযন্ত এভাবে ভালবাসতে চাই । তুমি বলেছ কেন আমি তোমাকে পছন্দ করি ? তুমি কি বলতে পারবে কেন কোন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে পছন্দ করে ! এর ব্যাখ্যা কেউ পারেনি তুমিও পারবে না । যদি পারো আমাকে বোলো, শিখে নিব । হয়তো তুমি বিশ্বাস করবে না যে এটাই আমার জীবনের লেখা প্রথম প্রেমপত্র আর কোন মেয়েকে দেয়া এটাই প্রথম অফার । কেননা আমার ইচ্ছে ছিল জীবনে একজনকেই প্রপোজ করবো আর তাকে পেতে সব চেষ্টাই করে যাব । বাস্তবে তা করার চেষ্টা করছি । তুমি কি পারবে আমাকে একটু হেল্প করতে ? আমি যে তোমার প্রতি উইক, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না । হয়তবা তুমিও । কারণ তোমার তোমার কড়া কথাগুলো হয়তো তারই নিদর্শন । কেননা কারো মনে ভালবাসা বা অমৃত না থাকলে এভাবে গরল উগরে দিত না । আমি জানি সেদিন তুমি যা বলেছ সেগুলো তোমার মনের কথা না এটা শুধু তোমার মুখের কথা । আর আমি জানি অন্তর থেকে কেউ এমন কথা বলতে পারেনা । একদিন না একদিন তোমার জমাকৃত কথাগুলো মুখ দিয়ে বেরোবে । দয়া করে আমি মারা যাওয়ার আগে বোলো।  বললে হয়তো তোমার কথার যথাযথ মূল্য দিতে পারব । আমি তোমার মতের বিরুদ্ধে যাব না বা এমন কিছু করবো না এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি । আমার দিকটা আমি খেয়াল রাখব বাকিটুকু তোমার হাতে । আমি কষ্টের  শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছি । আর কষ্ট দিও না তাহলে পাথর হয়ে যাব । তখন আর কিছুই লাভ হবে না । আমি তোমার জন্য কি করতে পারি তা সময়েই বলে দিবে । সে সুযোগ টা তো দিবে?  আর কথা নয় । দোয়া করি তুমি যেন ভাল থাক কারন তোমার ভাল থাকা না থাকায় আমার ভাল থাকা না থাকা লুকায়িত। দোয়া করবে যেন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারি তোমাকে স্মরণ করে ।

ইতি তোমার  পাখী

%d bloggers like this: