সুন্দরবনের বাঘরাজা/ রিবন রায়হান

সে অনেকদিন আগের কথা । সুন্দরবনে বাস করতো এক বাঘ। বাঘটি ছিল সুন্দরবনের রাজা। সুন্দরবন তখনও সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিশেবে ঘোষিত হয়নি। এমনিতে বনের রাজা হবার কারণে বাঘটির গর্বের সীমা ছিল না। তার উপর আবার সুন্দরবনের রাজা। বুঝতেই পারছো গর্বে তার মাটিতেই পা পড়তো না। বাঘটির বয়স হয়েছিলো। তার  দৈহিক শক্তিও কিছুটা কমেছিলো  বৈকি। বাঘের ছিলো পাইপ টানার নেশা। যৌবনকালে এক শিকারীকে মেরে পাইপটা সংগ্রহ করেছিল সে।

 

একদিন খাবার পর আয়েশ করে পাইপে আগুন লাগাচ্ছিলো বাঘটি। বাঘ মানে সুন্দরবনের রাজামশাই। একটি পাইন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাজটি করছিলো সে। হঠাৎ একটি শুকনো ডাল তার মাথায় এসে পড়ল। মহাবিরক্ত হয়ে রাজা মশাই ওপরের দিকে তাকালো। পাইন গাছের মগডালে একটি সারস পাখি বাসা বানিয়ে ডিম পেড়ে তা দিচ্ছিলো। বাঘ ভাবলো এটা সারসের কাণ্ড। আর যায় কোথায়। বাঘ হুংকার দিয়ে সারসকে বললো

– হা আমি খুব ক্ষুধার্ত, আমাকে একটা ডিম দাও, আমি খাবো। 

-কিছুতেই না। ডিম থেকে আমার বাচ্চা হবে। বাচ্চাগুলোকে আমি বড় করে তুলবো, সারস জবাব দিলো। 

– ভালোয় ভালোয় আমাকে ডিম খেতে দাও নইলে পাইপের আগুন গাছে ধরিয়ে দেবো। তোমার ডিম, বাসা সবই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে বুঝলে, বাঘ বললো। 

বাঘের কথা শুনে সারসের ছোট্ট বুকটা কেঁপে উঠলো। একটা ডিম দেয়া মানে একটা বাচ্চা হারানো! যাক একটা ডিম দিয়েও যদি বাদবাকি বাচ্চাগুলোকে বাঁচানো যায় এই ভেবে সারস বাসা থেকে একটা ডিম নিচের দিকে ছুঁড়ে দিলো। অমনি বাঘ ডিমটি মুখে পুরে মজা করে খেয়ে ফেললো। সারসের ডিমটি খুবই সুস্বাদু ছিল। বাঘ বললো

– আরেকটি ডিম দাও! সারস এখন কি করবে তা ভেবে পেল না। সে কাঁদতে আরম্ভ করলো। এতক্ষণ খরগোশ দূরে দাঁড়িয়ে সমস্ত ঘটনা দেখছিল। বাঘের অন্যায় আবদার শুনে ক্ষেপে উঠছিলো সে। সারসের কান্না শুনে খরগোশ আর থাকতে পারলো না। মনে মনে একটা বুদ্ধি বের করে বাঘের সামনে হাজির হলো। খরগোশ বাঘকে বললো

– রাজামশাই স্লামালেকুম। আপনার শরীর ভালোতো? 

-কি ব্যাপার তুমি এ সময়ে?

– না, মানে আপনি সারেসের ডিম খেতে চাচ্ছিলেন সুস্বাদু বলে। আসলে আমি বলছিলাম কি, এর চেয়েও সুস্বাদু খাবার আমার কাছে আছে। এর থেকেও টেস্টি? 

-কই দেখি, বাঘ আগ্রহভরে দেখতে চাইলো। খরগোশ বললো

– খাবারটি হলো চড়ুইপাখির মাংস। এর মতো টেস্টি মাংস সুন্দরবনের কোথাও নেই। আমি হলাম ক্ষুদ্র প্রাণী। কতটুকু মাংসই বা আমি আপনার জন্যে বয়ে আনতে পারতাম। আর তা দিয়ে আপনার ক্ষিদেও মিটতো না। তাই সঙ্গে করে আনিনি। তবে একটা কথা, আপনি যদি চড়ুইয়ের সুস্বাদু মাংস খেতে চান তাহলে আমার সঙ্গে যেতে হবে। 

-বাঘ বললো, ঠিক আছে। 

সুন্দরবনে তখন এক ধরণের লম্বা লম্বা ঘাস প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো। ঘাসগুলো প্রাকৃতিক নিয়মে এক সময় মরেও যেতো। মরে গেলে শুকিয়ে যেতো। এরকম একটা লম্বা ঘাসের মাঠের মধ্যে শুকনো কাঠের স্তূপ ছিল। খরগোশ বাঘকে সেই ঘাসের মাঠে নিয়ে এলো। ঘাসের মাঠে যেখানে কাঠের স্তূপ তার পাশে এসে চোখ বন্ধ করে বসতে বললো। খরগোশ গিয়ে বসলো শুকনো ঘাসের স্তূপের ওপর। বাঘ বললো

– কই আমার মুখের মধ্যে মাংস ফেলছো না কেন? খরগোশ বললো,

– রাজামশাই জীবন্ত চড়ুই বেশি সুস্বাদু, আপনি একটু সবুর করুন। আমি জীবন্ত চড়ুই এক সঙ্গে অনেকগুলো আপনার মুখের মধ্যে দিচ্ছি, মুখ খুলবেন না কিন্তু। এদিকে খরগোশ করলো কি, শুকনো কাঠের স্তূপে দিলো আগুন লাগিয়ে। আগুন দ্রুত গতিতে কাঠসহ শুকনো ঘাসে শো শো শব্দ করে ছড়িয়ে পড়ল। বাঘ ভাবলো অনেকগুলো চড়ুই এক সঙ্গে তার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে। আগুনের শব্দটা অনেকগুলো চড়ুই পাখি এক সঙ্গে উড়লে যেমন শব্দ হয় তেমনই ছিল। বাঘ চোখ বন্ধ করেই রইলো। এক সময় তার শরীরে গেল আগুন ধরে।

 

আগুনে পুড়ে বাঘ অর্থাৎ সুন্দরবনের রাজামশাই মারা গেল। সংবাদটা কয়েকদিনের মধ্যেই বনের অন্যান্য বাঘের কানে গেল। তারা নিজেরদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো

– আমরা নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী বলে ভাবি। কিন্তু আমাদের রাজামশাই আগুনে পুড়ে মারা গেল। আমাদেরকে অবশ্যই আগুনের ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে। 

সেই থেকে এখন পর্যন্ত বাঘেরা আগুন দেখলে ভয় পায়। (কোরিয়ান লোক কাহিনী)।

রিবন রায়হান
রিবন রায়হান