রাজহংসীর ডানায় সোনার পালক

রাজহংসীর  ডানায় সোনার পালক শামসুল আরেফিন খান

পৃথিবীর দেশে দেশে অতিথির সম্মান  অাদর অাপ্যায়ন ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্যে লালিত হয়ে নিজস্ব  আচার ও সংস্কৃতির সাথে মিশে অাছে। সাধারণভাবে সব অতিথি বরিত হন  স্বাগতিক সংষ্কৃতির স্বতন্ত্র ধারায়।ব্যক্তি ও শ্রেণীভেদে সমাদর সম্মানের মাত্রায় হের ফের   হতেই পারে। বিশেষ অতিথির জন্যে বিশেষ সমাদর । লালগালিচা সংবর্ধনা। বিশেষ বদান্যতা। সব দেশেরই রেওয়াজ।  ঢাকা সফরে এসেছিলেন ইংলান্ডের রানী বিগত শতাব্দির পাঁচ দশকে।তখনই তেজগাঁ বিমান বন্দর থেকে মিন্টু রোড অবধি  সড়কের নজরকাড়া সংষ্কার সম্পন্ন হ’ল।মিন্টু রোডের সুগন্ধা ভবন নতুন সাজে সজ্জিত হ’ল।রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান সশরীরে বিমান বন্দরে উপস্থিত থেকে  রাজকীয অতিথিকে বরণ করলেন।দু’দেশের পতাকায় সজ্জিত হ’ল রাজপথ।রাণীর পদস্পর্ষে ধন্য হবে যে সব স্থাপনা সেখানে দারিদ্র দৈন্যের ক্ষতচিহ্নগুলো ঢেকে দেয়ার সে কী প্রাণান্ত প্রয়াস!   সেই সাথে চুনকামের উপর ঝলমলে আলো দিয়ে বিষাদ ব্যথা বেদনার ছোপ ছোপ কালো দাগগুলোকে নান্দনিক চারুকলায় রুপান্তরের কায়িক তপস্যা। ছেলেবেলার সেই জ্বাজল্যমান স্মৃতি জীবনের এই পড়ন্ত বেলার নস্টালজিয়া ।

মাঝবেলার  আর এক স্মৃতি।  ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপরাষ্ষ্ট্র। ক্ষুদ্র হলেও  জাতিপুঞ্জের সদস্য। প্রজাতন্ত্র বটে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাস। সে দেশের মান্যবর   প্রধানমন্ত্রী শিউ সাগর রামগোলাম সরকারী সফরে এলেন ঢাকায়।মাঘ মাসের রোদেলা দুপুর। পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্যে তৃতীয়, নবীন  বার্তাসংস্থা ‘এনা’র পক্ষ্যে বিমান বন্দরে উপস্থিত আমিই একমাত্র সংবাদকর্মী্ ।সরকারী বার্তা প্রতিষ্ঠান এপিপি পর্যন্ত আসেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একজন সেকশন অফিসার  রাষ্ট্রীয় অতিথিকে বরণ করে সরাসরি সোনারগাঁ হোটেলের ভিভিঅাইপি সূটে আবাসিত করলেন। আমি তাঁদের অনুসরণ করে মাননীয় অতিথির একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলাম। নতুন বার্তা সংস্থার জন্যে সেটা ছিল  এক সুবর্ণ সুযোগ। দেশব্যাপী সব কাগজে ছোট করে হলেও এনার ক্রেডিট লাইনে এক্সক্লুসিভ সংবাদটা ছাপা হ’ল। মানীর মান বাাঁচলো।আমারও স্বীকৃতি বাড়লো। আমার পেশাজীবনের সবচেয়ে ব্যস্ত দিন ছিল সেটা। একদিনে ৯টা  ইভেন্ট কভার করতে পেরেছিলাম বীমা দালালির উপার্জনে কেনা একটা গাড়ীর বদৌলতে। সবাই জানতো ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার নব্য বার্তা সংস্থার জেষ্ঠ রিপোর্টার সবে ধন নীলমনি আমি একাই একশ। পরের দিন সকালের দিকে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশী মেহমানকে সংবর্ধনা জানালেন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।অতিথির আগমন পথে করিডোরের দুপাশে দন্ডায়মান শিক্ষক ছাত্রদের সারিতে আমিও দাঁড়িয়েছিলাম। মান্যবর আমার সামনে এসে থমকে গেলেন। আমাকে দেখিয়ে উপাচার্যকে বললেন,‘ দেখো, এ  আমার বন্ধু’ ।উপাচার‌্য তাঁর কথার মর্ম উদ্ধার করতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘এখানে সবাই তোমার বন্ধু’। মান্যবর আর একধাপ এগিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমি সপ্রতিভ হলাম। তিনি বললেন, ‘তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে আমার দেশে। আমি দেশে ফিরেই তোমাকে আমন্ত্রণপত্র পাঠাবো ’।আমন্ত্রণ  এসেছিল সাগর কন্যার কাছ থেকে। কিন্তু দুচোখে মিলন হ’ল না। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো ।আমিও সেই ঝঞ্ঝায় টালমাটাল হলাম।

দেখতে দেখতে  মুক্তিযুদ্ধের বাত্যাতাড়িত  প্রেক্ষায় উত্তাল একাত্তর পাড়ি দিয়ে    শণিতসিক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সূর্যস্নাত পটভূমিতে  নোঙর করলো ইতিহাসের সোনারতরী্ ।যথা পূর্বং তথা পরং আমি সেই তুচ্ছ সংবাদকর্মী । দেখলাম  মহামানবের আগমন। ১০ মার্চ ৭২। বাঙালি জাতির জনক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে   বহনকারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিমান বিশ্রামের জন্য দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরের মাটি স্পর্স করলো। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের  স্থায়ী ঠিকানা ভারতীয় লোকতন্ত্রের মহামান্য প্রেসিডেন্ট শ্রী ভিভিগিরি বিমানের সিঁড়ির কাছে এগিয়ে এসে ফিনিক্স পাখীর মত জ্বলন্ত আগুন থেকে উঠে আসা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে লাল গালিচায় স্বাগত জানালেন। অনুগমনে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।তাঁর অায়োজনে অনতিদূরে এক সমুচ্চ বক্তৃতা মঞ্চে দাড়িয়ে গণসংবর্ধনার  জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি ও আমার দেশবাসী অসীম কৃতজ্ঞ ভারতের জনগনের কাছে এবং ভারত সরকারের কাছে। আপনাদের অভাবনীয় উদার সহযোগিতায়, আমার ছয়দফার মর্মবাণী যে এক দফা, আমাদের  স্বাধীনতার দাবি, তা পূর্ণতা পেয়েছে। ৩০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়েছে স্বাধীনতার জন্যে।দু লক্ষ নারী দিয়েছে সম্ভ্রম। এক কোটি ঘর হারানো দুর্গত মানুষ ভারতের শরণার্থী শিবিরে প্রাণ বাঁচিয়েছে।আমি ফিরে  আসতে পেরেছি মৃত্যুকূপ থেকে। আমার এখন চার দফা দৃঢ় সংকল্প; ১.গণতন্ত্র ২. সমাজতন্ত্র ৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ৪. ধর্ম নিরপেক্ষতা।সোনার বাংলা গড়বো এই চার মূলমন্ত্রে !’

বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে  যেয়ে বললেন, ‘পৃথিবী আজ দুভাগে বিভক্ত । এক ভাগ শোষকের। আর এক ভাগ শোষিতের। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন  আমি কোন ভাগে ? আমি বলবো, আমি শোষিতের দলে । আমি শোষকের বিরুদ্ধে। আমি শোষিত মানুষের সাথে।’ আমি শোষিত মানুষের পাশে।কিউবা  বিপ্লবের মহানায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্রো বললেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি ।’

 

বঙ্গবন্ধু গেলেন কমনওয়েলথ সম্মেলনে।ইংলান্ডের রানী  জীবনের প্রখমবার গাড়িবারান্দায় নেমে এসে এশিয়ার উদীয়মান  অরুণরবিকে অভিবাদন জানালেন।

বঙ্গবন্ধু  স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সম্মান সম্ভ্রম মান ইজ্জত সমুন্নত করেছিলেন হিমালয়ের উচ্চতায়।কিন্তু দুর্ভাগ্য বাঙালির সে সম্মান  ভূলুন্ঠিত হ’ল। ধূলি ধূসরিত হ’ল সে সম্ভ্রম।বাঙালি বে্ইজ্জত হ’ল পচাত্তর পরবর্তী ইতিহাসের কালো ধোঁয়ার কুন্ডলিতে আচ্ছাদিত হয়ে। হাজার বছরের সংগ্রামে বাঙালি মাথা তুলেছিল ইতিহাসের  মাস্তুল শীর্ষৈ।অবৈধ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বাঙালি পরিচয়টাই মুছে দিলো! বাঙালি হয়ে গেলো ‘বাংলাদেশ ‘।সেই প্রেক্ষায় বাংলাদেশের নব্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে তলব করা হ’ল ভারতে ।পালাম বিমান বন্দরে একজন সেকশন অফিসার  তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর গাড়ি চেপে সরাসরি সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অফিস।কদিন পরেই জানলাম, বাংলাদেশ ভারতের কাছে পাইপলাইনে গ্যাস বিক্রি করবে।গণআন্দোলনের মুখে সেই মেরুদন্ডহীন নতজানু সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হ’ল তাকে। “দেশ আমার , গ্যাস আমার । জান দেবো গ্যাস দেবো না” স্লোগানটা আমার   কলম দিয়েই বেরিয়েছিল্ । স্লোগানে ফেস্টুনে, পোস্টারে, মিছিলে, বিক্ষোভে গণ প্রতিরোধ্। জিয়ার বিরুদ্ধে দেশে প্রথম আন্দোলন।১৯৫৮ সালে সামরিক দানব আইয়ুবের বিরুদ্ধে ছাত্র অবস্থায় নিজের ক্যারিয়ার বিপন্ন করে লড়েছিলাম। এটা আমার দ্বিতীয় একক আন্দোলন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে । কালিগঞ্জের ন্যাশনাল জুট মিল থেকে উৎখাত হওয়া  সিবিএ নেতা আনোয়ারা বেগম তার প্রায় ৩০০ চাকুরিচ্যূত শ্রমিক সাথী নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমাকে চাচা ডাকতো। তার সংগ্রামী শ্রমিক নেতা স্বামীকে জিয়ার গুন্ডারা রাতের অন্ধকারে হত্যা করেছিল। আমি কম্যুনিস্ট নেতাদের মত আন্দোলনের ডাক দিয়েই দাতাগোষ্ঠীর সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়িনি। শহরে বন্দরে শ্রমিক কর্মীদের “গামছা পেতে” জনগনের কাছে ভিক্ষা  চেয়ে তহবিল গড়ার সবক দিয়েছি । তাতেই অর্থাভাব মিটেছে। বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় এতসব সম্ভব হয়েছিল।

চেষ্টা করেছিল জিয়া । কিন্তু শত চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দেশে ফেরার  পথ রুদ্ধ করতে পারেনি জিয়া।

শেখ হাসিনা দেশে ফিরে জিয়ার তাসের ঘর ভেঙে দিলেন।  জিয়ার ঘরের কোনে লালিত কাল কেউটের বিষাক্ত ফনাও   নামিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু তনয়া।বিশ্বসভায় মাথা তোলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  দশ নারী ব্যক্তিত্বের অন্যতম শেখ হাসিনা চীন রাশিয়া ভারত ব্রাজিলের অর্থনৈতিক  জোটে “ব্রীকস” এর অন্যতম অংশীদার, চীন-ভারত রাশিয়ার সমরাস্ত্র যুদ্ধ বিমান সাবমেরিনের  দর্পিত গ্রাহক ও উন্নয়ন সহযোগী, বিশ্বব্যাংকের বুকে বল্লম ঢুকিয়ে মাথা তোলা পদ্মা সেতুর গর্বিত  রূপকার , বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোষাক রপ্তানিকারক , তিরিশ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের অধিকারী খাদ্যবৃত্ত  দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্ণধার শেখ হাসিনা এখন উন্নয়নের আকাশে পাখা মেলা এক দুঃসাহসী আত্মপ্রতয়ী হংসবলাকা।

দক্ষিণ  এশিয়ার ভূরাজনীতির  সব্যসাচী যোদ্ধা শেখ হাসিনা  তাঁর মহান পিতার সার্থক উত্তসূরী ।গর্বিত রাজহংসীর দু’পাখায়  প্রতিনিয়ত সাফল্যের অগনিত সোনার পালক সংযোজিত হচ্ছে। অমিত সাফল্যের সেই রত্নমালা গলায়  পরেই জঙ্গীবাদের হৃদকম্প, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের হার্টথ্রব নেতা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ  হাসিনা ৬ মন্ত্রী ২৫ সচিব ও ৩৫১ সফর সঙ্গী নিয়ে ৭ বছর পর ভারতে সরকারী সফরে দিল্লী উপনীত হন ৬ এপ্রিল অপরাহ্নে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী   শ্রী নরেন্দ্র মোদি সাধারণ নাগরিকের মত দিল্লীর অনিয়ন্ত্রিত যানজট ঠেলে প্রেটোকল ভেঙ্গে বিমান বন্দরে উপস্থিত হন তাঁকে হৃদ্যিক স্বাগতম ও ফুলেল সংবর্ধনা  জানাতে ।পশ্চিম বাংলার মুখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী জানান দিয়েছেন তিনি শেখ হাসিনাকে সম্মান জানাতে দিল্লী যাবেন। তিস্তা চুক্তির অশ্চিয়তা কাটেনি। তবে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও  জ্বালানি এবং সামরিক সহযোগিতা খাতে বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। দুর্বিনীত মমতা তিস্তা পানি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রশ্নে অনমনীয় থাকলে দুদেশের সীমান্ত নিরাপত্তায় নতুন সামরিক সহযোগিতা  চুক্তির স্পর্শকাতর বিষয়টি ঝুলে যেতে পারে বলে শঙ্কায় রয়েছেন পর্যবেক্ষকরা।

শামসুল আরেফিন খান
শামসুল আরেফিন খান

 

 

%d bloggers like this: