জীবন বৃত্তের অন্তরালে – মুশতারী বেগম

মুশতারী বেগম

রাত তখন ১০টা বাজে । হাস্নাহেনা শত কাজের ব্যস্ততায় ছুটোছুটি করছিলেন। ভেবেছিলেন বারান্দায় বসে একটু জিরিয়ে নিবেন।  বারান্দার এক কোনা দিয়ে একটি কদম ফুলের গাছ দেখা যায়, আর দেখা যায় কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। যদিও গাছে এখন ফুল নেই, তবুও মৃদুমন্দ বাতাসে সবুজ পাতার শিরশিরানি শুনতে ভাল লাগে। হঠাৎ টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং আওয়াজে আবারো ছুটতে হল। না, আর নয়। রাত ১১টা বেজে গেছে। ঘুমুতে যাওয়ার আগে বারান্দায়তো বসতেই হবে। নিয়মিত রুটিন। তিনি বারান্দায় বসে একবার গাছগুলোর দিকে আর একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। কপালের উপর থেকে  কিছু চুলের গোছা গাল বেয়ে বুকের উপর পড়ে তাঁকে আবেশময়ী করে তুলল। সুউচ্চ অট্টালিকার ছাদের উপর আকাশে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। মনে হয় শুক্লপক্ষ। কিছুদিন পরেই চাঁদনি রাতের জ্যোৎস্নাধারা ঝিলমিল করবে। ভাবতে ভাবতেই এক টুকরো মিষ্টি হাসি তাঁর ঠোঁটের ফাঁকে খেলা করে গেল। এযে ইট, কাঠ, আর লোহা-লক্কড়ের নগরি। এখানে জ্যোৎস্নাধারা কোত্থেকে আসবে!

ভাবতে ভাবতে ঘূর্ণায়মান মঞ্চের মত একটির পর একটি স্মৃতি তাঁকে একটি বৃত্ত থেকে একটি বিন্দুতে নিয়ে স্থির করে দিল। তিনি গভীর সমুদ্রের অতলান্তে হারিয়ে গেলেন। সবাই বলে হাস্নাহেনা পাহাড়ী মেয়ে। তাঁর নাক চাপা, চোখগুলো ছোট ছোট। তার দেশের বাড়ি কুমিল্লা জেলার বর্ডারের কাছে। জায়গাটা  আগে ছিল ত্রিপুরা জেলার মধ্যে। পাহাড়ের কোলঘেঁষা নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা নান্দনিক একটি ছোট্ট গ্রাম। ঝর্ণার জলধারা, ছোট ছোট ছড়া, পাখির কলকাকলি, সবুজের সমারোহ এই গ্রামকে করেছে অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত। দাদার বাড়িতে বছরে দুবারতো যেতেই হত, আব্বা-আম্মা আর ভাইদের সাথে। পাহাড়ী মেয়ে তিনি। পাহাড় তাঁকে ডাকতো বন্ধুত্বের হাতছানি দিয়ে। ঝর্ণার পানিতে পা ডুবিয়ে বসে গুনগুন করে গাইতেন ‘আমি পাহাড়ী ঝর্ণা, রুম ঝুমু ঝুম নূপুর বাজাই, বাজাইগো রুম ঝুমু ঝুম নূপুর বাজাই..’

সেখানে চাকমা আর হাজং গোত্রের মিলিত একটি গোত্র ছিল। গোত্রটির নাম মনে নেই। সেই গোত্রের ছেলেমেয়েগুলোকে হাস্নাহেনার কাছে অপরূপ লাগতো। মেয়েগুলোর গলায়, খোঁপায়, চুলে, কোমরে সব সময় ফুলের মালা শোভা পেতো। মেয়েরা যখন কোমরে হাত দিয়ে দলবদ্ধভাবে গাইতো ‘হলুদ গদর ফুল (গাঁদা ফুল), রাঙ্গা পলাশ ফুল, এনেদে এনেদে নইলে নইলে বাঁধব না, বাঁধব না চুল..’  নাচের তালে তালে তাদের পায়ের কি অপূর্ব মিলিত ছন্দ। তিনি অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন, আর ভাবতেন গাঁদা ফুল, পলাশ ফুল এনে না দিলে চুলও বাঁধবে না আবার রাঁধবেও না এ কেমন কথা! মিষ্টি এক হাসি তার চেহারায় ঝিলিক দিয়ে চলে যেত। সীমাহীন মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকতেন তিনি। একটি চাকমা যুবক কি সুন্দর যে বাঁশি বাজাত। বাঁশির সুরের গানের কলিগুলো এখনও তার মনে আছে। একটি ছিল, ‘বাজে মাদল বাজে বাজে বাঁশের বাঁশি/ বনে কদম ফোটে/ জাগে চাঁদের হাসি, জাগে চাঁদের হাসি।’ আর একটি ছিল ‘মাতাল হাওয়ায় দোলে মুকুল কলিলো/ ফাগুন চলিয়া বুঝি যায়লো…’ কিশোরী মন আনন্দে ভরে উঠত। সুরের মূর্ছনা তাঁকে আবেশে আবিষ্ট করে দিত। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর শহরে একদিন ফিরে আসতে হত। একবার কোরবানি ঈদ করতে গেলেন আব্বা-আম্মার সাথে সেই গ্রামে। একদিন বাড়ির পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে পা ডুবিয়ে বসে পেয়ারা খাচ্ছিলেন আপন মনে। হঠাৎ দেখেন সেই বাঁশিবাদক চাকমা ছেলেটি একটি ফুল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে হাত ইশারা করে ডাকছে। হাতে অনেকগুলো গাঁদা ফুল।  এতবার হাত ইশারা করছিল যে না যেয়ে পারলেন না। ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। সে হেসে হেসে তার হাতে ফুলগুলো দিলো। কিছু ভাবার আগেই ছেলেটি টুক করে তার গালে একটি চুমু দিয়ে দিল। তার বয়স তখন ১৩/১৪ বছর হবে। তিনি লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন আর ভয় পেয়ে বাড়ির দিকে এক দৌড় দিয়ে ছুটে যেয়ে দাদিকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। বাড়ির সবাই তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলেন। জেরায় পড়ে ভয়ে সত্য কথাটি বলে দিলেন। আর যায় কোথায়, চারিদিক তোলপাড়, নানারকম গুঞ্জন। কাজের লোকেরা ভীত শঙ্কিত হয়ে তার দিকে তাকাচ্ছিল, এই মনে করে যে, না জানি কি হয়। হলোও তাই।

সন্ধ্যায় দাদাভাই বাড়িতে এসে সব শুনে তার  বাইরে যাওয়া নিষেধ করে দিলেন। কিন্তু এর পরিণাম হল ভয়াবহ। তাদের বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে একটি স্বর্ণচাঁপা গাছ ছিল। সেই গাছের একটা ফুলেল ডাল বাড়ির বাইরে পড়েছিল। ছেলেটি রোজ ভোরে এসে সেই গাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাতো।  সে বাঁশি শুনে কিশোরী মনে শুরু হল আকুলি বিকুলি, উথাল পাথাল, কখন তার কাছে ছুটে যাবেন। তিনি উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করলেন। রোজ একই অবস্থা। কিন্তু লাভ হল না। দাদাভাই ব্যাপারটা ধরে ফেললেন । আর একদিন অসহ্য হয়ে তিনি বন্দুক বের করলেন। লোকজন আর সৈন্য সামন্তদের হুকুম করলেন,‘ব্যাটাকে ধরে নিয়ে আয়। দেখি আমার নাতনির সর্বনাশ কি ভাবে করতে পারে! কোথাকার কোন কৃষ্ণ এসেছেন। আমার গোলাপ ফুলের মত নাতনীর সর্বনাশ করতে পারে!’ শেষ পর্যন্ত ছেলেটিকে পিছমোড়া করে বেঁধে আনা হল বৈঠকখানার সামনে।  কিশোরী মেয়ে হাস্নাহেনা বুক ফাটা আর্তনাদ করে কাঁদতে লাগলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘তোমরা ওকে ছেড়ে দাও। ওর কোন দোষ নেই, আমিই ওর কাছে ফুল চেয়েছিলাম।’ কিন্তু কেউ বিশ্বাস করলো না সেই কথা। হাস্নাহেনার আম্মা আর দাদিজান দাদা ভাইয়ের রুদ্ররোষ থেকে সেই যাত্রায় ছেলেটিকে বাঁচিয়েছিলেন। হাস্নাহেনা সারাটা দিন না খেয়ে আর কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিলেন। দাদাভাই ছেলেটির পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার হুকুম করলেন। হাস্নাহেনার আব্বা-আম্মা প্রতিবাদ করে বললেন, ‘না, সেটি ঠিক হবে না, আমরা বছরে কবারই বা বাড়িতে আসি, ছেলেটির জীবনের মূল্য আছে।’

এর পর থেকে দেশের বাড়িতে কমই যাওয়া হতো। কিন্তু তিনি ছেলেটিকে ভুলতে পারছিলেন না। প্রায়ই আম্মাকে বলতেন, ‘চল না আমরা গ্রামে যাই।’ আম্মা বলতেন, ‘কেন?’’ উত্তর ছিল, ‘‘পাহাড়ের কাছে যাবেন। পাহাড় তাঁকে ডাকছে।’’ গিয়েছিলেনও গ্রামে। ঝর্ণার পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে থাকতে পাহাড়ের সাথে হয়ে গেল গভীর সখ্য। ছেলেটি জানতে পেরে তাকে বহুদূর থেকে দেখতো । তিনিও তাকাতেন অসহায় দৃষ্টিতে হৃদয়ের ব্যাকুলতা নিয়ে। কিন্তু কিছুতেই তার কাছে  যাওয়া হল না। কিভাবে সম্ভব, হাস্নাহেনার সাথে থাকত এক বিশাল আকৃতির পাহারাদার। হাস্নাহেনার অসহ্য মনে হত। ওই ব্যক্তি তার আর পাহাড়ের সখ্যের মধ্যেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মন নিয়ে নাড়াচাড়া করার নির্জনতা কোথায়! এর বহুদিন পর তিনি শুনলেন, ছেলেটি সুন্দরী একটি চাকমা মেয়েকে বিয়ে করে বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে গেছে। তিনি কি হাফ ছেড়ে বাঁচতে পেরেছিলেন? পাহাড়কে বার বার এই প্রশ্ন করেও উত্তর পাওয়া যায়নি।

হাস্নাহেনার বিয়ের পর কাজিনরা এই কাহিনি কতদিন তাঁর স্বামীর সামনে বলে ঠাট্টা করতেন। ‘ও তো ছিল রাজকন্যা, ওকে তুলে নিয়ে যায়নি এটাইতো বেশি।’’ এর জন্য তাঁকে অবশ্য অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। এখনও হাস্নাহেনারা ভাই-বোনরা মিলে সেই পাহাড়ী গ্রামে যান। পাহাড় আগের মতোই আকাশের দিকে  সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে। ঝর্ণার পানি কলকল করে নিচে পড়ছে। ভর দুপুরে ‘ বৌ কথা কও’ পাখি মিষ্টি সুরে ডাকছে, ‘ চৈতার বৌগো দাও খান দেও গো।’ নেই কেবল জাঁদরেল দাদাভাই, নেই সেই স্নেহময়ী দাদিজান। আর নেই সেই সুরেলা সুরের বাঁশিবাদক চাকমা ছেলেটি। হায়রে জীবন! তিনি এখনও পাহাড়ের কাছে গিয়ে বসে থাকেন। তাকে ওখান থেকে কেউ সরিয়ে আনতে পারে না। যতক্ষণ থাকা যায় থাকেন। সময়ের খেয়াল থাকে না।

হঠাৎ হাস্নাহেনা স্মৃতির বলয় থেকে নিজের বৃত্তে ফিরে এলেন। পুরোনো একজন কাজের মহিলার মমতাভরা কন্ঠের আওয়াজে, ‘ম্যাডাম আপনি এখনও রাতের খাবার খাননি। খেয়ে শুয়ে পড়ুন, অনেক রাত হয়েছে।’ তিনি ধীর পায়ে উঠে ভিতরে চলে গেলেন নান্দনিক কল্পনার স্মৃতিকে ঝেড়ে ফেলে রেখে।  কাজের মহিলাকে বললেন, তিনি আজ আর খাবেন না। আলতোভাবে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। বিছানা কন্টকপূর্ণ ছিল না সত্যি, কিন্তু ফুলের বিছানাও তো ছিল না অবশ্যই। যদিও তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল একরাশ বেলিফুল, যা তার বালিশের পাশে রেখে দিতেন সব সময়। স্বামী, সন্তান, সংসার আর আশে পাশের সবাইকে নিয়েইতো বাস্তবতা। বাস্তবতা মধুময় কিনা সেটি দেখার সময় কোথায়!!! চাঁদ মামা ঘুম পাড়িয়ে না দিলেও একরাশ রঙিন স্বপ্ন তাঁকে ঘুমের রাজ্যে ডুবিয়ে দিয়ে চলে গেল, আহ্ . . . .  শান্তি!!!

%d bloggers like this: