অস্তিত্ব সংকট

অস্তিত্ব সংকট বেগম জাহান আরা

মাসুমকে বোঝা মুশকিল। হাসি খুশি মানুষ। কিন্তু সিরাজুল বলে, ওর পেটে নাকি জিলেপির প্যাঁচ। কেনো বলে সেই জানে। অথচ ওর সাথেই বেশি দেখা যায় সিরাজুলকে। অনেকে বলে, মাসুম আর সিরাজুল মানিকজোড়। সবখানেই দেখা যাবে দুইজনকে একসাথে। আমারও ভাব আছে ওদের সাথে। একসাথে থাকতে গেলে যেটুকু একান্তই দরকার। গতো সপ্তায় ওকে নাকি মাসুম বলেছে সিরাজকে, তোদের সাকি ভাইয়ের একটু দাদা দাদা ভাব, তাই না রে?
-আমি এতো শতো বুঝি না ভাই। খুব নির্বিকার ভাবে বলে সিরাজ।
-থাক, বাদ দে। এমনি বললাম।
-তোর না এই এমনি এমনি কথা বলাটা একটা রোগ মাসুম।
-ওসব তুই বুঝবি না দোস্ত। দেখিস, একদিন ঠিক টের পাবি।
-পেলে তোকে জানাবো। ঠিক আছে?
-তোকে কিছু বলা মানেই ভুল।
এমন অর্থহীন খুনশুঁটি লেগেই থাকে ওদের।

এইটুকু কথা সিরাজ আমাকে না বলে পারেনি। কেনো বলেছে, তাও বুঝিনি। সত্যি জটিল। গলায় গলায় ভাব দুজনের। কথাটা বলেই আমাকে সতর্ক করে দিয়েছে, মাসুম যেনো না জানতে পারে। মনে মনে হাসি। মাসুম আরও বলেছে, ওদের দুজনের ভাব দেখে নাকি আমি হিংসে করি। মাথা খারাপের কথা! ভাবি, ওদের কি অন্য কাজ নেই? এমন কেনো ওঁরা? কি ভাবে, আর কি বলে, কিছুই বুঝি না আমি।

আমার নাম সাকিবুল ইসলাম। এই দলটার মধ্যে সিনিয়র। আদুভাই ক্যাটাগরির। ছয় বছর ধরে এম.ফিল. করছি। রোজগারের ধান্দায় কাজ এগিয়ে নিতে পারছিনা। সবাই ডাকে সাকি ভাই বলে। তার আগে ব্রেক গেছে দু বছর। এখন তো আট দশ বছ পরেই জেনারেশন গ্যাপ হয়েযায়। তবু কিভাবে যে এদের সাথে আমার ভাব হয়ে গেলো। ওই সিরাজুল, মানে সিরাজই ছিলো হোতা। চা কফির আসরে টেনে নিয়ে যেতো আমাকে। বলতো, আমরা লাকি, একজন সিনিয়র ভাই আছেন আমাদের সাথে। চা শিঙাড়ার দাম দিতে গেলে হাঁহাঁ করে উঠতো। কখনও জোর করে দিয়েছি, কখনও পারিনি। মাসুম খুব এনজয় করতো আমাদের এই জোরাজুরি। কোনোদিন আমাদের খুনসুঁটির ফাঁকে টুক করে সে দাম মিটিয়ে দিতো। সে আবার আমাকে দাদাগিরির মধ্যে ফেলেছে কি দেখে? দুর্বোধ্য!

বোঝা যেতো, মাসুমের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। কিন্তু আমি তো সিনিয়র। কিছু আয় রোজগার আমারও আছে। খুচরো খাওয়া দাওয়ার টাকা আমারই দেয়া উচিত মাঝে মাঝে। বিশেষ করে নতুন ছেলে দুটোর বাড়ির অবস্থা খারাপই মনে হয়। একসাথে থাকলে এসব টের পাওয়া যায়। মহম্মদপুরের বাসাটাও আমিই ঠিক করেছি। চারটা বেড্রুম। দুটো বাথ্রুম। রান্নাঘর, সাথে একটা লম্বা ব্যালকনি। আমরা আটজন থাকি বাসাটায়। ছোটো ভাই নাকিবকে নিয়ে একাই থাকতাম একটা ছোটো বাসায়। সেই বুদ্ধি দিলো, বড়ো বাসা নিয়ে কয়েকজনে মিলে থাকার জন্য। তাতে সাশ্রয় হবে। কথা ঠিক।

মফস্বল থেকে এসে এইভাবে বাসা ভাড়া করে থেকে লেখাপড়া করার চলন খুব বেশিদিনের কথা নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দান এটা। উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসতে হবে। থাকতেও হবে। পর্যাপ্ত হল হোস্টেল নেই। আত্মীয়ের বাসায় থাকা কয়জনের ভাগ্যে হয়? ঠ্যাকায় পড়ে মানুষ বের করে নিয়েছে সমাধান। শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও বাসা ভাড়া করে কয়েকজন মিলে থাকছে আজকাল। তাদের জন্য হল হোস্টেল আরও কম। লেখাপড়া করছে। বন্ধে বাড়ি যাচ্ছে। অনেকেই টুকটাক কিছু করে আয়ের চেষ্টা করে। তারমধ্যে টিউশনই প্রধান। পাশাপাশি বেড়ানো, সিনেমা দেখা, আড্ডা দেয়া চলে। উঠতি বয়সিদের শিক্ষা জীবনে এক ধরনের স্বাবলম্বিতার নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠছে খুব দ্রুত। ভালোই লাগে আমার। প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সাহসী এবং স্বাবলম্বী হচ্ছে।

তো আমাদের বাসায় একটা বুয়াও রাখা হয়েছে। সে সকালে আর বিকেলে রান্না করে দিয়ে যায়। তাতে সমস্যা একটাই। যে আগে খায় সে একটু বেশিই খেয়ে ফেলে। ফলে বুয়াকে বাড়তি দায়িত্ব দেয়া হলো। রান্নার পর বাটিতে বাটিতে তরকারি বেড়ে রাখার কাজটাও সে করতো। বেশ কিছুদিন ভালোই চললো। বুয়ার সাথে চুক্তি, সে খাবার নেবে না। বেতন নেবে শুধু। তবু রাতের খাবার কিছু থাকলে তাকে দেয়া হতো। তরকারি তো থাকতো না, কিছু ডাল ভাত থাকতো মাঝে মাঝে।

কিন্তু বিভিন্ন জায়গার আটজন তরুন অচেনা ছাত্র, একটা বাসায় মিলে মিশে শান্তিতে থাকবে, এটা বেশ কঠিন ব্যাপার। আরও কঠিন হয়, কারও বন্ধু খাওয়ায় সময় এসে গেলে। পান বিড়ির দোকান থেকে দুটো ডিম এনে ভাজি করে সমস্যা মেটানো যায়। কিন্তু বাজার সদাই তো সব এজমালি। তেল লবন মরিচ এবং গ্যাস খরচের হিসেবও রাখতে হয়। দারিদ্রের কালো দিক এগুলো। চা কফি সিঙাড়া উজাড় করার সময় দিলদরাজ ভাব। কিন্তু বাসার এজমালি সম্পদের বেলায় টনটনে। ছেড়ে কথা বলে না কেউ।

প্রতি মাসে বাজারের দায়িত্ব ঘুরে ঘুরে পড়ে ছেলেদের ওপর। ঝামেলা শুরু করলো সাজু। নতুন মুখচোরা ছেলেটা। মাঝে মাঝেই সে দুপুরের মিল বাদ দিতে লাগলো। আগে বলে কয়েও না। ফলে রান্না হয়ে যেতো খাবার। বাধ্য হয়ে বুয়াকে দেয়া হতো সেই খাবার। পরের মাসে সাজু বলে বসলো, গতোমাসের পাঁচটা মিলের টাকা সে কম দেবে। যে খাবার সে খায়নি। সেই খাবারের টাকা সে দিতে রাজি নয়।

সবচেয়ে বেশি রিএক্ট করল মাসুম। বললো, আমি ঠিক জানতাম সাজু এমন একটা কথা বলবে। জটিল ছেলে। মন খুলে কারও সাথে কথা বলে না। যেনো কোন লাটের বাচ্চা। কাল বাড়ির গেটে দেখা হলো, কথাই বললো না। যেনো চেনেই না।

আমি বলি, প্রথমেই এতো কঠিন কঠিন কথা না বলে, আমাদের যৌথ জীবনের বিশয়টা বুঝিয়ে বলা দরকার ওকে।
-সব সময় এতো ভালোমানুষী ভালো না সাকি ভাই, মাসুম বলে।
-ও একটু চুপচাপ ঠিকই। কোনো সমস্যাও তো থাকতে পারে।
-সমস্যা তো আছেই। নিজের সম্বন্ধে তার খুব উঁচু ধারনা।
-সে থাকতেই পারে।
-সবাইকে সে প্রতিযোগী মনে করে। যেনো কি একজন নোবেল লরেট!
-এসব আবার কি কথা?
-ঠিক বলছি সাকি ভাই। একটা মেয়ের সাথে মাত্র পরিচয় হয়েছে, তাকে বলেছে, তার মতো খাঁটি ছেলে নেই এই ক্যাম্পাসে।
-এই সংবাদ আবার কোথায় পেলে মাসুম?
-মেয়েটা আমাদের সেকশনেই পড়ে। সে, মানে চৈতিই বলেছে আমাকে।
-তুমি থামো তো মাসুম। হেসে ফেলি আমি। বলি, একসাথে থাকতে গেলে ছোটো খাটো কতো কিছু হতে পারে। আপোসেই মিটিয়ে নিতে হয় সেগুলো।
-আরও কথা আছে সাকি ভাই, ওর নাকি এখানকার রান্না ভালো লাগে না। বাড়িতে যেনো রোজ মোগলাই খানা খেতো।
-আহা, তুমি এতো রেগে আছো কেনো সাজুর ওপর? ওর কিছু বলার থাকতে পারেই তো। না?
-ও একটু বেশি বেশি কথা বলে। একদিন এমন গর্তে পড়বে না! বুঝবে সেদিন।
-এই বয়সেই রাষ্ট্রচরিত্র পাচ্ছো? হাসি আমি।
-মানে কি, সাকি ভাই?
-কাউকে বাক স্বাধীনতা দিতে চাওনা, এই আর কি। কথা বলতে না দিলে মারামারি করবে।
-না মানে কি, ওর নাক উঁচু নাক উঁচু ভাব আমার একটুও সহ্য হয়না সাকি ভাই।

এই রকমই এরা। হয়তো বিকেলেই দেখা যাবে, কাফেতে বসে বসে কিছু খাচ্ছে দুইজনে মিলে। বুঝতেই পারি না ওদের। মুখে এক, মনে এক, চিন্তায় এক, যাপনে এক। বিচিত্র! কেমন যেনো! আসলেই জেনারেশন গ্যাপ হয়ে গেছে ওদের সাথে। বোকা বোকা লাগে নিজেকে।

যাই হোক, আমি কোনো রকমে ব্যাপারটা সামলে নিলাম। সিনিয়র হলে কিছু দায় এসেই যায়। কিন্তু মাসুমের ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়েই রাখলো। বুঝতে পারলাম না। ও তো সবার সম্বন্ধেই নেতিবাচক কথা বলে। সিরাজ চলে যাওয়ার পর থেকে সাজু হয়েছে চোখের কাঁটা। কারন কি? ওর সামনে কাউকে ভালো বললে তার সম্বন্ধেও একটা কিছু বলবে। এইতো দিলুর সাথে কি ভালো বন্ধুত্ব, অথচ দিলুর প্রশংসা শুনতে পারেনা। শুধু এইই নয়, কারও প্রশংসা শুনলে ও নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নিজে তো কারও সম্বন্ধে ভালো কথা বলেই না। সমস্যা কোথায় ওর?

এটাই কি অস্তিত্ব সংকট ? আইডেনটিটি ক্রাইসিস? সব সসময়ে নিজেকে আক্রান্ত মনে করে। ভাবি, এরা দুনিয়া করে খাবে কি ভাবে? গায়ের চামড়া এতো পাতলা হলে চলে?

কদিন পরে দেখা হলো সাজুর সাথে নিউমার্কেটে। শ্যামলা মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে ঘুরছে। শাড়ি পরলে হয়তো একটু বয়সি লাগতো। সালোয়ার কামিজ পরে আছে। মনে হয় স্রেফ বালিকা। লাউ ডগার মত লিকলিকে শরীর। লম্বা দুটো বেনী পিঠের ওপর ঝুলছে। তাতেই আরও কচি দেখাচ্ছে ওকে।

এড়িয়ে না গিয়ে এগিয়ে এলো সাজু। বললো, সাকি ভাই, এর নাম চৈতি।
-বাহ! সুন্দর নাম তো। হেসে বলি।
চৈতি সালাম দেয়। বলে, সাজুর কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি সাকি ভাই।
হাসে চৈতি। অসাধারন মিষ্টি হাসি। দুপাশে দুটো গজদন্ত চৈতির হাসিকে আরও মোহনীয় করেছে। প্রথম দর্শনেই ভালো লাগে মেয়েটাকে আমার।
-দেশ কোথায় আপনার? আমি জানতে চাই।
লজ্জায় কাঁচু মাচু হয়ে চৈতি বলে, পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারবো একশো বার, কিন্তু আপনার কাছ থেকে ‘আপনি’ সম্বোধন নিতে পারবোনা সাকি ভাই।
– চমৎকার করে কথা বলো তো দেখি। ওরা দুজনেই হাসলো।

সামনেই আইস্ক্রিমের প্রিয় দোকানটা। আমি ওদেরকে আইস্ক্রিম খাওয়াতে চাইলাম। খুব খুশি হয়ে রাজি হলো। বেশ কাটলো সন্ধেটা। আমি তো সাজুর মধ্যে সমস্যা কিছু দেখলাম না। নাক উঁচু তো নয়ই। বরং বেচারার নাকটা দুঃখজনকভাবে বোঁচা। ইচ্ছে করে কিছু সময় কাটিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। কেনো যে মাসুম আবোল তাবোল বলে! পরস্পরকে বোঝার ক্ষমতাও কি কমে গেছে এদের? নাকি কিছু মিন করে বলে না? অবাক লাগে।

বললাম, তোমরা তো মাসুমের সাথেই পড়ো, না?
-একসাথে, কিন্তু এক সেকশনে না, সাজু বলে।
-তাই? মাসুম বলেছিলো, এক সেকশনে পড়ো।
-মাসুম কে, সাজু? চৈতি জানতে চায়।
-ঐ যে ছেলেটা তোমাকে দেখে স্যারের নোট চাইলো, সাজু বলে চৈতিকে।
-চিনতে পারলাম না।
-থাক, চিনতে হবে না।
-আমাদের সাথে একই সেকশনে বসে?
-না, ও বি সেকশনে। একদিন বসেছিলো ভুল করে। ব্যাকব্রাশ করা চুল। বেশ লম্বা।
-এখনও চিনলাম না সাজু।
-আর কি বললে তুমি চিনতে পারবে? বেশ বিরক্ত সাজু।
-রেগে যাচ্ছো কেনো ভাই? চৈতি মিষ্টি করে বলে।
-অন্য সেকশনের ছেলেকে তুমি চিনবে কি করে বলো তো?
-ওর সম্বন্ধে আর একটু বলো না। হয়তো চিনতে পারবো। আফটার অল একসাথে পড়ি তো, না?
-ওকে চিনে তোমার লাভটা কি হবে?
-সবটাতেই তোমার দোকানদারের মতো লাভ লোকসানের হিসেব। এমন কেনো তুমি? অভিমান চৈতির কণ্ঠে। টলোমলো দুই চোখ। খুব অভিমানী মেয়ে বোঝা যায়।
-আমার সব বন্ধুকে তোমার চেনার দরকার নেই, বুঝলে। কেমন শাসন শাসন ভাব।

একটা ভজকট লেগে গেলো। এই আর এক রুপ ওদের। কি থেকে যে কি হয়! হঠাত বাতাসে বদ গন্ধ বয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। কি সুন্দর সময়টা কাটছিলো! ওদেরই ক্লাসমেট মাসুম। ওর নাম নেয়া মাত্র ছিঁড়ে গেলো তানপুরার সবকটা তার। মাসুম আর সাজুর সম্পর্কটা তাহলে ভালো নয়। কিন্তু দেখায় তো অন্য রকম।

অবাক হয় সাকিব। মাসুম এমনভাবে চৈতির কথা বলেছিলো, যেনো তারা দুজন দুজনকে খুব চেনে। কিন্তু মনে হচ্ছে, চৈতি মোটেই চেনে না ওকে। আর সাজু তো প্রায় ছ্যাঁত করে উঠলো। সদ্য মফস্বল থেকে আসা নতুনদের সাথে কথা বলাই বিপদ দেখা যায়। কথায় মেজাজে পরিশীলন বলতে কিছু নেই। ঠাস করে রেগে যায়। স্থান কাল পাত্র কিছুই দেখে না। কবে যে এগুলো নাগরিক ভব্যতাটুকু শিখবে?

বিরক্ত হয় সাকি মাসুমের ওপর। নিজেকে সবজান্তা ভাবে তুলে ধরতে চায়। চরিত্রের এই জিনিশগুলো মাঝে মাঝে অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। আসলে এই সবজান্তা ভাবটাও একরকম হীনমন্যতা। নিজেকে অযথা বড়ো করে দেখানোর ইচ্ছে। অস্তিত্ব সংকটের উতস তো মনের এই ফাঁকা জায়গাগুলোই।

সাপের মত এঁকেবেঁকে যাচ্ছে নিরীহ নিরুত্তাপ দিনগুলো। সাজুকে বেশি দেখা যায় না আজকাল। চৈতিকেও দেখি না। বাবার চিঠিটা নিয়ে আমি বেশ ব্যাস্ত। দুএকটা টিউশন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। পেয়েও গেলাম পটাপট তিনটা। অবসর সময়ের সবটুকু খেয়ে নিলো টিউশন। সামনেই গরমের ছুটি। এবার কে থাকবে বাসার দায়িত্বে, সেটা নিয়ে বসতে হবে। দেখা যাক।

বিশ্রী গরম পড়েছে। ঘুম আসেনা সাকির। মধ্যরাত পার হয়ে গেলো। রুমমেট চুপি চুপি এসে শুয়েছে। টের পেয়েছে সাকি। ভাবলো, ওর কাছে সাজু আর চৈতির কথা জিগ্যেস করবে। ভারি মিষ্টি মেয়ে। হাসিটা আরও মিষ্টি। আবার ভাবছে, কি জানি কি মনে করে, আজকালকার ছেলেমেয়ে। হয়তো বলেই বসবে, গভীর রাতে সাকিভাই চৈতির খবর শুনতে চায়। অনায়াসে বলে ফেলবে এরা। দুবার ভাববে না।

ঘুম ঘুম এসেছিলো। এমন সময় ফোন বাজলো। স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে মাসুমের ছবি। ও তো আমাকে ফোন করে না কোনোদিন! শুয়ে শুয়েই ফোনটা ধরে সাকি।
-হ্যালো, এতো রাতে? কি খবর?
-সাকি ভাই, চৈতি সুইসাইড করেছে। বজ্রপাত হলো কানে।
-কি বলছো? কে বলেছে তোমাকে?
-কাল তুমুল ঝগড়া হয়েছিল দুজনের মধ্যে।
-তুমি এতো কথা জানলে কি করে?
-বন্ধুরা সবাই জানে।
-তুমি জানলে কখন?
-নাজিয়া, চৈতির বন্ধু ফোন করেছিলো আমাকে। গিয়েছিলাম। কথা বলতে পারিনি। কেমন এক অপরাধবোধে মরে ছিলাম। গলাটা ধরা ধরা। কান্না চাপা স্বর।
মুহুর্তে মনে পড়ে সাকির, সেদিন অভিসম্পাত দিচ্ছিলো, কপালে দুর্গতি আছে বলে। আজ সাজুর দুর্দিনে আবার কাঁদছে। কাকে কি বলবে সে?

ধড়ফড় করে উঠে বসে সাকি বিছানায়। কি বলে এইসব? একটু ঝগড়া হলো, কি না হলো, অমনি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে যেতে হবে? জীবন এতোই সস্তা? নিজেকে এরা এতোই ছোটো মনে করে? লেখাপড়া শিখে তাহলে কি হলো? ফেল করলে আত্মহত্যা, টিচার কুকথা বললে আত্মহত্যা, টিচার মা বাবাকে অপমান করলে আত্মহত্যা, ইভ টিজিঙের জন্য আত্মহত্যা, পরকিয়ার জন্য আত্মহত্যা, প্রেমিকের সাথে ঝগড়া হলে আত্মহত্যা, এসবের মানেটা কি? পরাজিত হওয়ার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি, এটুকুও শেখেনি? মা বাবার কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই? তারা শুধু চাহিদা মোতাবেক ভাত কাপড় টাকা দেয়ার গোঁসাই? পাগল হয়ে যাবো।

হাতে ফোনটা তখনও অনলাইনে। স্ক্রিনে মাসুমকে দেখা যাচ্ছে। কিছু বলছে। ভিডিও কল ছিলো।
-সাকি ভাই আপনি একবার আসেন। সাজু আপনাকেই খুঁজছে। কেঁদে ফেলে মাসুম। বলে, সাজুর জন্যে এমন কিছু আমি চাইনি সাকিভাই। সেদিন যা বলেছি, তা ছিলো কথার কথা। বিশ্বাস করেন সাকি ভাই।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে ছেলেটা শিশুর মতো।

বেগম জাহান আরা
বেগম জাহান আরা