ইসলামের ইতিহাসে মহীয়সী নারী : হযরত খাদিজা (রা.) –   আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর দুই পত্নী ছিলেন। একজন বিবি সারা অপর জন বিবি হাজেরা। বিবি সারা- এর গর্ভজাত সন্তানের দ্বারা যে বংশ বিস্তৃত হয় তা হলো ইয়াকুবী, ইউছুফী, ইয়াহুদী, নাসারা, বনি ইস্রাইল। আর বিবি হাজেরার গর্ভজাত সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ.) দ্বারা যে বংশের বিস্তৃতি ঘটে তা হলো বাইজারী, আওয়ামী ওসী, মররহী সমঈ। হযরত ইসমাঈল (আ.) এর বংশধরদের মধ্যে এই বংশের ৫৯তম পুরুষ ফিহির খুব নামকরা ব্যক্তি ছিলেন। ফিহির কুরাইশ নামেও অভিহিত হতেন। এজন্যই পরবর্তীকালে তাঁর বংশধরগণ কুরাইশ বংশ বলে পরিচিতি লাভ করে। হযরত খাদিজা (রা.) এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) উভয়েরই পূর্বপুরুষ হযরত ইসমাঈল (আ.)। উভয়েই কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত খাদিজা (রা.) এর ডাক নাম হিন্দ এবং লকব বা উপাধি ছিল তাহেরা।

হযরত খাদিজা (রা.) আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেন। আরব দেশ তখন নানা পাপাচারে লিপ্ত ছিলো। মেয়েদের তখন জ্যান্ত কবর দেয়া হতো কিংবা গলা টিপে মেরে ফেলা হতো। সে যুগ ছিলো “আইয়ামে জাহেলিয়াত” বা অন্ধকার যুগ। সারা দেশ জুড়ে ছিলো নানা রকম কলহ বিবাদ, হিংসা, দ্বেষ রেষারেষিতে পূর্ণ। দূর্বলের উপর ছিলো সবলের অত্যাচার। এই সময় আরব দেশে মেয়ে জন্মানোকে সকলে খারাপ চোখে দেখতো;মেয়ে জন্মগ্রহণ করলে লজ্জিত হতো। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের সেই অন্ধকার যুগের আরব দেশে খুওয়াইলিদ নামে ধনাঢ্য ব্যক্তির ঘরে হযরত খাদিজা (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। হযরত খাদিজা (রা.) এর মায়ের নাম বিবি ফাতিমা। খাদিজার পিতা খুওয়াইলিদ ছিলেন শিক্ষিত, ভদ্র, বুদ্ধিমান। তিনি বৈশিষ্ট্যে এবং স্বাতন্ত্র্যে অদ্বিতীয় ছিলেন। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। হযরত খাদিজার মা বিবি ফাতিমা ছিলেন সুন্দরী এবং গুণবতী ; এক সৃষ্টিকর্তার উপাসক ছিলেন তাঁরা।

মানুষ ধন-ঐশ্বর্যে সুখ-শান্তির মোহে আল্লাহতালাকে ভুলে যায় কিন্তু খুওয়াইলিদ পরিবার ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁদের মতো পুণ্যবান ও নীতিবান মানুষ খুব কমই ছিলো সে সময়ে। তবে খুওয়াইলিদ পরিবারে এতো ধন-ঐশ্বর্য আর সুখ-শান্তির মাঝেও মনে ছিলো সন্তান না থাকার অন্তহীন দুঃখ! তারা সব সময়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে একটি সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতেন। সেজন্য দান খয়রাত করতেন। অবশেষে আল্লাহতালা অসীম কৃপায় সন্তান লাভ করেন। 

পাঁচশত পঞ্চাশ ঈসায়ী সনের এক শুভ দিনের শুভ সকালে জগত এই বরেণ্য নারী জন্মগ্রহন করেন। তাঁর জন্মের পর তাঁর পিতা খুওয়াইলিদ অকৃপণ হস্তে গরীব দুঃখীকে দান খয়রাত করলেন। আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে উৎসব করলেন, আনন্দ করলেন। খুওয়াইলিদ দম্পতি মেয়ের নাম রাখলেন বিবি খাদিজা। তাঁরা, হযরত খাদিজা (রা.)-কে অতি আদর যত্নের সঙ্গে পালন করতে লাগলেন। বাল্যকাল থেকেই বিবি খাদিজার মধ্যে বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। শিশুকালে বিবি খাদিজা কখনও খামোখা কান্নাকাটি করে কাউকে বিরক্ত করতেন না। খাওয়া-দাওয়া ঘুমানো সবই ছিলো নিয়মমাফিক। শিশু অবস্থা থেকেই নির্দিষ্ট একটি সময় মতোই যেন তাঁর সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত ছিলো। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল মিষ্টি। যখন শিশুকন্যার কথা বলতে শিখলেন, সকলকে ডেকে কথা বলতে শুরু করলেন, যেন সকলে তাঁর সুমিষ্ট কন্ঠধ্বনি আর মধুময় কথাবর্তায় খুশী এবং আনন্দিত হলেন।

হযরত খাদিজা (রা.) এর খেলাধূলায় আকর্ষণ ছিলো না। যে বয়সে শিশুরা খেলাধুলা করে সে বয়সে তিনি তাঁর মায়ের প্রতিটি কাজ নীরবে লক্ষ্য করতেন এবং আয়ত্ব করতে চেষ্টা করতেন। তাঁর মা, বিবি ফাতিমা মাঝে মধ্যে খেলার জন্য তাঁর ক্রীড়ারত সঙ্গীদের মধ্যে ছেড়ে দিতেন কিন্তু তিনি খেলতেন না কখনও। খেলাধুলা ভালো লাগতো না তাঁর। তাঁর যেন মনে হতো খেলাধুলাতে বৃথা সময় নষ্ট হবে; জীবনের প্রতিটি সময় কাজের, শিক্ষার, অভিজ্ঞতা অর্জনের।

হযরত খাদিজা (রা.)-এর এরূপ আচরণ দেখে তাঁর মায়ের গর্ভকালীন স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যেতো। তিনি গর্ভের অষ্টম মাসে স্বপ্ন দেখেছিলেন সাদা পোশাক পরা একজন সৌম্যদর্শন ব্যক্তি তাঁর মাথায় এক হাত রেখে বলছেন, “মা ফাতিমা, এই দুনিয়ায় তুমি মহাভগ্যবতী নারী। ধন্য নারী তুমি। কেন না শীঘ্রই তুমি এমন কন্যারত্ন প্রসব করবে যার তুল্য ভাগ্যবতী এই জগতে আর কেউ হবে না। যার মতো মর্যাদা জগতে কোন নারী পাবে না। তিনি হবেন নারীকুলের মহাগৌরব। নারীকুলের সম্রাজ্ঞীর আসনে বসবেন তিনি। পরিণত বয়সে এমন পুরুষ স্বামীরূপে লাভ করবেন, যিনি মানবকুলের শ্রেষ্ঠ মানব। যার উছিলায় দয়াময় প্রভু আল্লাহ এই বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন।”

ক্রমে ক্রমে হযরত খাদিজা (রা.) বড় হয়ে উঠতে লাগলেন। সেই সঙ্গে তাঁর গুণাবলী ও চরিত্র মাধুরী প্রকাশ পেতে লাগলো। তাঁর প্রতিটি কাজে সংযম সুরুচি এবং পবিত্রতার ছাপ দেখে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন মুগ্ধ হয়ে তাঁকে “তাহেরা” অর্থাৎ নির্মল চরিত্রের অধিকারিণী পবিত্রকন্যা আখ্যা দিলো।

হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন উচ্চবংশীয় পরমা সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতি নারী। সে সময় আরবের আধিবাসিরা বংশ গৌরবের উপর বেশি গুরুত্ব দিতো। একে পরমা সুন্দরী তার উপর শরীফ বংশজাত তাই বয়োঃপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মক্কার তামিনী গোত্রের আবু হাওলা যিয়ারা নামে এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। আবু হাওলা ছিলেন অতি সুদর্শন ও বুদ্ধিমান। শিক্ষাদীক্ষায় ও বিভিন্ন গুণে আকর্ষণীয়। বিয়ের পর তাঁরা পরম সুখেই দিন যাপন করতে লাগলেন। কিন্তু সুখ বেশিদিন থাকেনি। আবু হাওলা বিয়ের কিছুদিন পরই মারা যান। কিন্তু রূপে গুণে ধনেমানে বংশ গৌরবে সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা হওয়ায় পুনরায় বিয়ের কথা চলতে থাকে। ফলে তাঁর পিতা আতীক ইবনে যায়েদ মাখদুমী নামের এক চরিত্রবান যুবকের সঙ্গে পুনরায় বিবাহ দিলেন। কিন্তু এখানেও তিনি বেশিদিন সংসার করতে পারলেন না। একটা মেয়ে হওয়ার পরই দ্বিতীয় স্বামী আতীক ইবনে যায়েদ মাখদুমী মারা যান।

কারও কারও মতে হযরত খাদিজা (রা.) এর তৃতীয়বার সাইফ ইবনে উমাইয়া নামে একজন স্ববংশীয় পাত্রের সঙ্গে বিবাহ হয় এবং সে স্বামীও কিছুদিন পর পরলোক গমন করেন। হযরত খাদিজা (রা.) বারবার বিধবা হওয়ার ফলে মনে ভীষণ আঘাত পান এবং মনস্থির করেন তিনি আর কোন অবস্থাতেই বিবাহ করবেন না। এর মধ্যে তাঁর পিতা একমাত্র মেয়ের বারবার বিধবা হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।

অসুস্থ অবস্থায় ব্যবসায়ের দায়িত্ব পালন করা সম্ভবপর হয় না দেখে একদিন হযরত খাদিজা (রা.) কে ডেকে ব্যবসায়ের ভার বুঝিয়ে দিয়ে বলেন, “মা খাদিজা, তোমার মনের দুঃসহ বেদনা আমি উপলব্ধি করছি। কিন্তু মা তুমি দুঃখ করো না। নিশ্চয় ভবিষ্যতের কোন মহান উদ্দেশ্য আছে। তোমার দ্বারা হয়তো প্রভু কোন বিরাট কার্য সাধন করবেন। আমার ব্যথিত হৃদয় মাঝে যেন বারবার এই কথাই জেগে উঠছে।  স্নেহের খাদিজা, মা আমার তুমি অধৈর্য কিংবা বিমর্ষ হইয়ো না। সাহস ও ধৈর্যে বুক বেঁধে দয়াময় প্রভুর মর্জির উপর নির্ভর করো। আরবের লোকেরা তোমার নির্মল চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তোমাকে “তাহেরা” খেতাবে ভূষিত করেছে। তোমার এ খেতাবের সার্থকতা তুমি মৃত্যু পর্যন্ত বলবৎ রেখো। নিশ্চয় প্রভু তোমায় সাহায্য করবেন। আমি প্রভুর নিকট প্রার্থনা জানাচ্ছি আর তোমাকে আর্শিবাদ করছি।”

খুওয়াইলিদ মৃত্যুর পূর্বে ব্যবসা পরিচালনার যে দায়িত্ব মেয়ে খাদিজা (রা.) এর হাতে অর্পণ করেছিলেন তা খাদিজা (রা.) যোগ্যতার সঙ্গে সুচারুরূপে চালাচ্ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনিই সবকিছুর মালিক হলেন। শুধু পিতার সম্পত্তিরই নয়, মৃত স্বামীদের ধন-সম্পত্তিও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ ধন-সম্পত্তি একত্রিত করে মূলধন বাড়ালেন। অতি অল্পদিনের মধ্যেই পিতার কারবারের চেয়ে তার কারবারের বিস্তৃতি ঘটলো এবং খাদিজা (রা.) এর খ্যাতি শাম, সিরিয়া, ইয়ামেন সব দেশের ব্যবসায়ী মহলে ছড়িয়ে পড়লো।

হযরত খাদিজা (রা.) এর ব্যবসায়ের মূলনীতি ছিল সততা, অতি লোভ পরিহার, স্বল্প লাভে মাল বিক্রি এবং বেশি খরিদ্দার সংগ্রহ। তিনি কর্মচারীদের সেই মতো নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। হযরত খাদিজা (রা.) এর আমলে আরবের ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি রেওয়াজ ছিল ব্যবসায়ীরা নিজেরাই মূলধন দিয়ে বিত্তহীন গরীব এবং অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদেরকে ব্যবসা করতে সুযোগ দিতেন। ওই সকল লোক উক্ত মহাজনদের মূলধন দিয়ে ব্যবসা করে লাভের নির্দিষ্ট অংশ নিজেরা নিতো এবং বাকী লভ্যাংশ এবং মূলধন বিনিয়োগকারীকে ফেরত দিতো। এই ধরনের কারবারকে ‘মোজারাবাহ’ বলা হতো। এই ধরনের ব্যবসাতে ধনবান লোকেরা ব্যবসায় ঝুঁকি না নিয়ে শুধুমাত্র মূলধন বিনিয়োগ করেই লাভ পেতেন এবং গরীব অর্থহীন ব্যবসায়ীগণও মহাজনদের অর্থে ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজেদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে পারতেন।

এদিকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর চাচা আবু তালিবের অবস্থা বেশি সচ্ছল ছিলো না। কারণ তাঁর সন্তান-সন্ততি ছিলো অনেক এবং পিতা না থাকায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) চাচা আবু তালিবের কাছেই থাকতেন। আবু তালিবের সংসার অসচ্ছল হলেও হযরত মুহম্মদ (সা.) এর কোন অযত্ন ছিলো না ওই সংসারে। তবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) চাচার পারিবারিক অসচ্ছলতা দেখে তাকে অর্থোপার্জনে সাহায্য করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্য তখন আরব দেশের প্রধান উপজীবিকা, আবু তালিবও পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যবসাকেই প্রধান জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) চাচাকে সাহায্য করতে মাঝে মধ্যেই ব্যবসা উপলক্ষে চাচার সঙ্গে যাতায়াত শুরু করলেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবসা ক্ষেত্রে সফলতা, অকপটতা ও সদাচারণে দিকে দিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়লো; ব্যবসা ক্ষেত্রে এইরূপ বিশ্বাসী ও নির্ভরশীল লোক সত্যিই দুর্লভ।

ওদিকে আবার হযরত খাদিজা (রা.) এর বার্হিবাণিজ্যের প্রসার ঘটায় তিনি বিশ্বাসী, কর্মঠ এবং অভিজ্ঞ লোক খুঁজছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সততা, সরলতা, সত্যবাদিতা এবং বিশ্বাসের কথা শুনে তাঁকে নিয়োগ করার প্রস্তাব পাঠান। হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিয়োগ  প্রস্তাব পেয়ে চাচার অনুমতি নিয়ে খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসায় যোগ দেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) কাজে যোগ দেয়ার পর ব্যবসায়ে প্রচুর লাভ হতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং গুণগরিমার কথা খাদিজা (রা.) অনেক শুনেছিলেন। তবুও তাঁর যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা ও সততাসহ অন্যান্য গুণ খাদিজা (রা.)কে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি আকৃষ্ট করে। একদিন তিনি স্বপ্ন দেখলেন, আকাশ থেকে দুপুরে সূর্য নেমে এসে তাঁর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছে এবং ঘর থেকে সূর্যরশ্মি বের হয়ে মক্কার সব গৃহ আলোকিত করছে! স্বপ্ন দেখে খাদিজা (রা.) সুপন্ডিত অবাকা ইবার্ণ নওফেলের কাছে বৃত্তান্ত জানতে গেলেন। পন্ডিত বললেন, এই স্বপ্ন দ্বারা এই বোঝা যাচ্ছে যে শীঘ্রই তোমার খুব সৎ ভালো একজন মানুষের সঙ্গে বিবাহ হবে এবং তাঁর গুণে এই মক্কা শহর আলোকিত হবে। হযরত খাদিজা (রা.) এই কথা শুনে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে স্বামীরূপে বরণ করার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করেন এবং এক বিশ্বস্ত আত্মীয়া নাফিসা বিনতে উমাইয়াকে প্রয়োজনীয় কথাবর্তা বুঝিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে পাঠালেন।

নাফিসা কথাবর্তার মাধ্যমে সব কথা হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে বললেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) সেসব কথা তার চাচা আবু তালিব এবং অন্যান্য চাচা আব্বাস ও হামজার কাছে খুলে বললেন। সকলে সম্মত হলেন এবং প্রচলিত রীতি অনুসারে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর চাচা হামজা (রা.) বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে খাদিজা (রা.) এর চাচা আমর ইবনে আসাদ এর সঙ্গে কথাবর্তা বলে দিন ধার্য করলেন এবং নির্দিষ্ট দিনে মোহরানা বিশটি উট ধার্য করে বিয়ে হয়ে গেল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রথমে বিবাহ করতে রাজী হননি। তাঁর মতে যে পুরুষের বিবাহ করার মতো সংস্থান থাকে না তার বিবাহ করা ঠিক নয়। তাছাড়া স্ত্রীর দেনমোহর ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা না করে কোন পুরুষের বিবাহ করাও উচিত নয়।

যাহোক হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং হযরত খাদিজা (রা.) এর শুভবিবাহের কথা শুনে মক্কাবাসীরা আনন্দিত হলো। তবে কুরাইশদের কিছু ঈর্ষাকাতর লোভী যারা খাদিজা (রা.) কে বিবাহ করতে চেয়েছিল তারা রেগে গিয়ে সভা আহ্বান করলো। তারা বক্তব্য দিলো যে “খুওয়াইলিদের মেয়ে খাদিজা (রা.) সর্বপেক্ষা ধনী হয়ে একজন নিঃস্ব যুবক আবদুল্লাহর ছেলেকে বিবাহ করে আমাদের সকলকে অপমান করেছে। এ আমাদের চরম অপমান।” এরপর হযরত খাদিজা (রা.) এর সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখলো না তারা অর্থাৎ একঘরে করলো। হযরত খাদিজা (রা.) ঈর্ষাকাতর ধনী সম্প্রদায়ের দ্বারা সম্পর্কচ্যুত হয়ে মোটেই বিব্রত বা ভীত হলেন না। শুধু এই ষড়যন্ত্রে তাঁর আত্মীয় জড়িত ছিলেন বলে লজ্জিত ও দুঃখিত হলেন। তিনি ভাবলেন কুরাইশদের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে এবং বুদ্ধিমতী এই নারী এক অভিনব উপায় বের করলেন। তিনি এক বিরাট ভোজ উৎসবের আয়োজন করলেন এবং যারা তাঁকে একঘরে করেছে তাঁদের তিনি দাওয়াত করলেন এবং আশ্চর্যের বিষয়, হলো তাঁর সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছেদ করলেও কুরাইশরা না এসে থাকতে পারলো না। তাঁরা এলেন খাবারও খেলেন এবং খাদিজা (রা.) তাদের যোগ্য সমাদর করলেন। খাওয়া শেষে তাঁদের বললেন, “মক্কার ধনিক সম্প্রদায়! আমি আপনাদের প্রতিবেশি একজন মহিলা। যে সম্পদের বড়াই করে আপনারা আমাকে ঘৃণা করেছেন সেই সম্পদে আমি আপনাদের নেতৃস্থানীয়া। কিন্তু কুরাইশ সরদার আবদুল মুত্তালিবের পৌত্র হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে বিবাহ করার অপরাধে আপনারা আমাকে একঘরে করেছেন। আমার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। এখন আমি আপনাদের সমাজের কেউ নই। আপনাদের নিকট শুধু ধন-ঐশ্বর্যের মূল্য আছে, জ্ঞান, বুদ্ধি, সততা, সরলতার কোন মূল্যই নেই। কিন্তু সৎ চরিত্রের মানুষের মূল্যই অধিক, এর সঙ্গে ধন সম্পদের কোন তুলনাই নেই! হয়ও না। আর একটা কথা, আপনারা আমাকে ত্যাগ করেছেন কারণ আমি দরিদ্র একজন মানুষকে বিবাহ করেছি। কিন্তু আপনারা, আমাকে ত্যাগ করেছেন সত্য কিন্তু আমি ত্যাগ করিনি। তাছাড়া আপনারা আমার দরিদ্র স্বামীকে অবহেলা করবেন তা সহ্য করবো না, তাই সজ্ঞানে, সুস্থমস্তিষ্কে আমার সমস্ত সম্পত্তি আমার স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে দান করলাম।” উপস্থিত সকলে এ কার্য দেখে, এ কথা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল।

এরপর মক্কার ধনী লোকজন এবং খাদিজা (রা.)-এর ধনী আত্মীয়-স্বজন তাঁর সঙ্গে অসহযোগিতা শুরু করে। কিন্তু খাদিজা (রা.) এতটুকু ভীত বা উদ্বিগ্ন না হয়ে তাঁর আদর্শে অটল থাকেন এবং স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সেবায় মন-প্রাণ ঢেলে দেন। ওদিকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ধন সম্পত্তি সব গরীব দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে তাঁর ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য খরচ করতে থাকেন। এ ব্যাপারে খাদিজা (রা.) কখনও নিষেধ করেননি বরং স্বামীকে উৎসাহ দিয়েছেন।

তিনি বিবাহের আগে সম্রাজ্ঞীর মতো থাকলেও বিবাহের পর স্বামীর সংসারে নিজের সব কাজ কর্ম নিজের হাতেই করতেন। হযরত খাদিজা (রা.) শুধু স্বামীকে ধন-সম্পত্তি দিয়েই সাহায্য করেননি, ইসলাম প্রচারেও সহযোগিতা করেছেন। নবী যখন ইসলাম প্রচার করতে শুরু করলেন তখন মক্কার কুরাইশগণ চরম শত্ক্রুতা শুরু করে। পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে, ফলে একেক সময় নবীজি নিরুৎসাহ হয়ে পড়তেন। আর সেই মুহুর্তে একমাত্র খাদিজা (রা.)-ই তাঁকে উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একমাত্র সঙ্গিনী, সাহায্যকারিণী ও পরামর্শদায়নী। মহানবীর নবুয়তের পর এক সময় মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে প্রায় তিন বছর বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছিল। এই তিন বছর হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর সঙ্গে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। এই সংকটকালে খাদিজা (রা.) এবং তার সন্তানদের মাঝেমধ্যেই না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। কোন কোন সময় ‘তালাহ’ নামের এক প্রকার গাছের পাতা আহার করে কাটিয়েছেন। হযরত খাদিজা (রা.) জীবনে কোনদিন মহানবীর সঙ্গে রাগারাগি, মান অভিমান করেননি। স্বামীর যত্নে কোন সময় উদাসীনতা দেখাননি। তিনি যেমন স্ত্রীসুলভ ব্যবহার করেছেন, তেমনি একজন আদর্শ মায়ের মতো স্নেহ মমতা দিয়ে তাকে সান্ত্বনাও দিয়েছেন। এককথায় হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সুযোগ্য সঙ্গিনী, সুখ-দুঃখের সমভাগিনী, আনন্দদায়িনী, সাহায্যকারিণী, উৎসাহ-প্রেরণাদায়িনী। মহানবীর নবুয়ত লাভের কিছুদিন পর জিব্রাঈল (আ.) তাঁকে নামাজ শিক্ষা দিয়ে গেলেন এবং এই সময়ই সুরা ফাতিহা অবতীর্ণ হয়। তারপর তিনি ধর্ম প্রচার করার জন্য আদেশ প্রাপ্ত হন। জিব্রাঈল (আ.) মারফত আল্লাহতালার নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে তিনি খাদিজা (রা.) নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলেন “খাদিজা বলতো তুমি আমাকে কিরূপ বিশ্বাস কর?” খাদিজা (রা.) বললেন, “স্বামী আমি আপনাকে একজন সত্যবাদী, ন্যায়নিষ্ট, ওয়াদা পালনকারী, আমানতদার এবং সত্যানুসারী রূপে মনে করি ও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।” মহানবী বললেন, তাহলে এই মুহুর্তে পাঠ কর “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল।” হযরত খাদিজা (রা.) কোন দ্বিধা না করে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশ পালন করলেন। বললেন, “আমান্না আ সাল্লামনা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।” অর্থাৎ আমি বিশ্বাস করলাম ও ইসলামে দীক্ষিত হলাম। হযরত খাদিজা (রা.) পৃথিবীর বুকে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর যে কয়জন সন্তান ছিলেন তাঁরা সকলেই হযরত খাদিজা (রা.) এর গর্ভে জন্মেছিলেন। শুধু ইব্রাহিম নামে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেন পত্নী মারিয়া কিবতীয়ার গর্ভে। কিন্তু ইব্রাহিম শিশুকালেই মৃত্যুবরণ করেন। হযরত খাদিজা (রা.) এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দুইটি পুত্র এবং চারটি কন্যা। পুত্রের নাম ছিল কাশেম এবং আবদুল্লাহ। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পুত্রদ্বয় শৈশবেই মারা যান। তাদের কন্যাদের নাম ছিল জয়নব বিবি, রোকাইয়া, উম্মে কুলছুম এবং হযরত ফাতেমা (রা.)।

মহানবী (সা.)-এর নবুয়তের দশম বছরে তার একান্ত আপনজন চাচা আবু তালেব মারা যান এবং এর কিছু দিন পরই হযরত খাদিজা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। একেতে বার্ধক্য, তদুপরি রোগ যন্ত্রণায় তিনি একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েন। রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি প্রায়ই কাঁদতেন এবং বলতেন, “হায় আমার মতো ভাগ্যহীনা নারী আর নেই। জীবনের শেষ মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সেবা যত্ন করতে পারলাম না।” সেই সময় কিশোরী কন্যা ফাতেমা (রা.) সান্ত্বনা দিতেন। এমনি করে দিন যেতে লাগলো। একদিন সকলকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে হযরত খাদিজা (রা.) পরলোক গমন করলেন। ইসলামী বিধি অনুযায়ী গোসল ও কাফন পরিয়ে মৃতদেহ দাফন করা হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং খাদিজা (রা.) এর দেহ কবরে রেখেছিলেন। বর্ণিত আছে হুনুন নামক গোরস্থান খাদিজা (রা.) কে দাফন করা হয়েছিল।  

হযরত খাদিজা (রা.) এর বৈশিষ্ট্যাবলী :

তিনি ছিলেন শ্যেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর প্রথম ও প্রধান মহিষী, নারীকুল শ্রেষ্ঠ।

হযরত খাদিজা (রা.) প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

ইসলাম প্রচারের প্রথম অবস্থায় সহায়তা করেন তিনি।

হযরত খাদিজা (রা.) এর জীবিতকালে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিয়ে করেননি।

তাঁর মৃত্যুর বছরটিকে “শোকের বছর” অখ্যায়িত করা হয়।

হযরত খাদিজা (রা.) এর গর্ভজাত সন্তানদের মাধ্যমেই নবীজির বংশ বিস্তার হয়।

হযরত ফতিমা  (রা.) যিনি “খাতুনে জান্নাত” উপাধি পেয়েছিলেন তিনি হযরত খাদিজা (রা.) এর গর্ভে জন্মগহণ করেন।।

এই পৃথিবীতে তাঁর জীবিত অবস্থাতেই বেহেশতের সম্রাজ্ঞীরূপে অখ্যায়িত হয়েছিলেন।

 

তথ্যসূত্র : উম্মুল মোমেনীন হযরত খাদিজা (রাঃ) গ্রন্থ এবং পত্র-পত্রিকা।