কালিম  পাখির পালক – দিলারা মেসবাহ

কালিম  পাখির পালক দিলারা মেসবাহ

সাবের নিতান্তই কঠিন ধাঁচের মানুষ। বয়সে তরুণ বটে, কিন্তু চোয়াল চিবুকে লেস্টে  থাকে একধরনের সন্ন্যাস ভাব। তথাপি বলতে হয় বাহ্যিক রূপটাই সব নয়।

বিয়ে শাদী করে নাই। সময়, সুযোগ মর্জি, মুরোদ কোনটাই হয় নাই। ধরে নেওয়া যায় ভেতর মনটাকে এই  যুবক বালিশ চাপা দিয়ে যুৎ করে বসে আছে।

 

সাবের ভূতের গলির মেস ‘মালতী বোজিং’ এ আজ বছর কয় বাসিন্দা। মেসবাসীরা আদৌ জানে না কোন কাননে কী ফুল ফুটেছে। কোন দোকানের কোন মিষ্টি মুখে দিলে মাখনের মতো গলে যায়। রসনা তৃপ্ত হয়  অমৃত স্বাদে। এমনিতরো অনেক কিছুই তারা জানে না, দরকারও নেই। সাবেরের মেসবন্ধু চারজন। আহসানুল হক, জয়নাল মন্ডল, হারাধান দাস, পিয়ার মৃধা। বন্ধু বলা সঙ্গত কিনা, কে জানে। তবে আপাত মানতেই হয়। অবশ্য স্বভাবে, চিন্তায় বিস্তর ফারাক থাকলেও তারা প্রায়শ বন্ধুসুলভ। এ পোড়া মরা ঢাকা শহরে সমঝে চলার নামই বন্ধুত্ব। নয় কিনা?

 

দুইটি শোবার কামরা। প্রতি কামরায় দুটো করে তক্তপোষ।পাকঘর নামের ঘরটি হাবিয়া দোজখের নক্শা অনুকরণে তৈরি হয়তো। ঐ ঘরে তিতাস গ্যাসের ওয়ান বার্নার  চুলো দেখলে মনে হতে পারে কোনো খান্নাসের হা মুখ। তবু এই চুলোয় নীল রঙ আগুনের শিখা জ্বলে। তেল-চিটচিটে হাতল ভাঙা দুইটি কড়াই আর ভাতের তোবড়ানো হাঁড়ি, খুন্তি, লুসনি, মাছ ধোবার মাটির দুইটি গামলাই সয়-সম্পদ এই পাক ঘরের। সুরুজের মা তারাবানু রোজ বেলা এগারোটার দিকে এই গর্তে আবির্ভুত হয়। রাঁধুনির মেজাজ চড়া, হাসিটাও তেমন দেখন-শোভা। পান-চিবানোয় মুহূর্তের বিরাম নাই। হাকিমপুরী জর্দার খুশবুই এই মালতী বোর্ডিং এর অমূল্য সুগন্ধি। সাবের বাদে আর চারজনই জর্দাপানের পয়লা নাম্বার ভোক্তা। এটাই তাদের মোহ-মায়ার একান্ত আনন্দ।

 

‘আইজ মামারা মিজাজডাই খারাপ হয়্যা গেছে। দশ টাকায় হুজরালি চাচায় তিনডা পান দিছে। এইডা একডা কতা হইল। পাচখান পান তো পাওনাই। নাইলে চারখানতো দিবোই।’

তারাবানু তার বাজখাই খরখরে গলায় হুজরালির গীবতে পাকঘর নামের দোজখখানা তাঁতিয়ে তোলে। আজ ছুটির দিন। বুয়াবিবির মেজাজ সপ্তমে। ভোজনরসিক মন্ডলের ভেতর মনডা কঁকিয়ে উঠল। কেননা তারাবানুর সালুনাদি অনন্যোপায় হয়ে গিলতে হয়। তবে চ্যাপা শুটকি ভর্তাটা তার হাতে হয় ভারী স্বাদু। মানিব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে মন্ডল একখান জরাজীর্ণ দশ টাকার নোট উদ্ধার করে পতাকার মতো তারাবানুর  ব্যাজার মুখের উপর দোলাতে লাগলেন।

‘খালা আরো তিনখান পান কিনো। আইজ চ্যাপা শুটকি ভর্তা বানাইবা না। আশা কইর‌্যা রইছি তো।’  সুরুজের মার যাই যাই যৌবন মাখা মুখখানায় সহসা বিরল হাসির রেখা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মেসের বাসিন্দাগুলোর আটপৌরে জীবন এরকমই আলো, অন্ধকারে জ্বলে নেভে।

 

সাবের একদিন গলা চড়িয়ে মেসমালিক জগলুল মিয়াকে কয়েকটি কটু কথা কয়েছিল। ঘটনাটি ছিল একটা  রক্তকরবী গাছ নিধন করা নিয়ে। ফুলে ফুলে ছাওয়া গাছটি গুটিসুটি মেরে মেসের পূর্বদিকে বেড়ে উঠেছিল। জগলুল মিয়ার  গাছপালায় এলার্জি। এই লোকটা রক্তচোষা পাষন্ড। ফোটা ফুলসহ গাছ তার কী সমস্যা করেছিল! আধ হাত জায়গা তিনি ফালতু গাছগাছড়ার জন্য ছেড়ে দেবেন না। সজনা গাছ হলে তাও হতো। বাজারে সজনার উচ্চমূল্য। এইটা একটা  বেহুদা গাছ। কয়েক হায়দরি কোপে রক্তকরবী শুইয়ে দিলেন মাটিতে।

সাবেরের জানালা বরাবর নিচু ডালদুটো রাঙা ফুল  সমেত ঝুলে থাকতো। রক্তকরবী নাটক দেখেছিল সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়। সেই থেকে রবিঠাকুরের অন্ধ ভক্ত সে।

‘আপনে একটা অন্যায় কাজ করলেন। এরকম একটা তরতাজা ফুলে ভরা গাছ কাটার পিছনে কী যুক্তি থাকতে পারে?’

মুখে এটুকুই বলেছিল সাবের। মনে মনে গালাগাল করেছিল বটে। প্রায় খিস্তি খেউড় পর্যায়ের।

খেঁকিয়ে উঠেছিল মালিক, আমার গাছ আমি কাটছি, ‘আপনের কী হইসে? পারলে নিজেগর বাড়িত যায়া গাছগাছালি লাগায়া হাওয়া খান গিয়া। এইখানে রংবাজি কইরেন না’…………তড়িঘড়ি এরপর সাবের টিউশনির বাড়িমুখো হয়েছিল। এই  উন্মাদের সাথে আর কোন ব্যাকালাপ করে নাই।

ওর বাবা ইন্তেকাল করেছেন বছর দশ আগে।  সাবেরের মা মোমেনা খানম। জগতের যত রকমের যন্ত্রণা, যত রকমের বালা মসিবত থাকতে পারে সবটুকু তিলতিল করে সয়েছেন। গত  হয়েছেন আড়াই বছর হলো। আপদ অনাথ দুইবোন। তারাও তাদের সংসারের কারেন্ট জালে আটকে আছে। সে পৈত্রিক সূত্রে এক খন্ড জমি কেন একটুকরো সুতোও পায়নি। সাবের ছাত্র হিসেবে খুবই সরেস নিঃসন্দেহে। খালা, ফুপু, চাচাদের দয়াদক্ষিণ্যে এম. এ পাশ করেছে সসম্মানে। মুরুব্বিরা প্রায়শ তাঁদের দয়াদাক্ষিণ্যের বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়। তারা আদতে আর্থিক প্রতিদান আশা  করেন। সাবের জানে দুনিয়াটা এরকমই। নিজেকে পুষতেই তার প্রায় হিমশিম দশা। এ ঘিঞ্জি বেদরদী রাজধানী তাকে মুখোশ পরিয়েছে। কপট গাম্ভীর্যের রেখার আঁকিবুকি। টি.এস.সির মোড়ে বন্ধুদের সাথে-কিছু সময় কাটায়। বাদাম বুট ভাজা আর লালচায়ের টাকা নিজেকেই জোগাতেও হাত বাঁকা হবার দশা। নিজের মনে নিজেকেই ধিক্কার দেয় এই মেধা, এই তারুণ্য কী অপরাধে স্থবির হয়ে আছে!

তিনটি ছাত্রী পড়ানোর প্রাপ্ত টাকায় জীবন ধারন। জিগাতলায় এক অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী পড়াতে হয়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গবেট মারুফা। এখানেই সাবেরের মস্তিষ্কের সবটুকু সার পদার্থ শুকিয়ে যাবার দশা। মুহূর্মূহু ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে। মারুফাদের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে বেরুতেই জবা নামের মেয়েটির সঙ্গে। পাশের ফ্লাটেই ভাড়া থাকে। মেয়েদের  সৌন্দর্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হলেও তার সৌন্দর্য্য চেতনা মন্দ নয়। তার বোনেরা ছিল একদম টুলটুলে পাকা বেদানার রঙে রঙিন। কিন্তু চেহারার নাক, চোখ, মুখের নান্দনিক পারিপাট্য খুঁজে পায়নি ভাই সাবের। জবা মেয়েটির সবটুকুই নান্দনিক। তার গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যামল। চোখ দুটোতে প্রজ্ঞার ব্যাঞ্জনা। থুতনির ডানকোনে মারাত্মক একটা গাঢ় তিল। দশের থেকে আলাদা। মাঝারি উচ্চতার তন্বী কাঠামো। বছর ঘুরে আসছে এই টিউশনিতে। মাঝে মধ্যে ছেড়ে দিতে চায়, কিন্তু হয়ে উঠে না। জবা মেয়েটিও তার মতো লড়াই করছে কী? বেশি আলাপ আলোচনার সুযোগ নেই। তাছাড়া জবাও সাবের নামের দরিদ্র মাস্টার মশাইয়ের গুরু গম্ভীর মুখোশ প্রতিদিনই প্রায় দেখছেই।

 

মারুফাদের ‘ড্রিম ল্যান্ড’ বাড়িটার পশ্চিমে একটা আশোক গাছ। বাকল ভেদ করে থোকায় থোকায় রক্তলাল পুষ্পস্তবক দেখলেই সাবের কিছুক্ষনণর জন্য অন্য মানুষ হয়ে যায়। কোন জন্মে এ বৃক্ষের চারা রোপন করেছিলেন কোন বৃক্ষসখা। তাকে স্যালুট জানায় সাবের।

 

মেসের আর চারজনের নয়টা পাঁচটা অফিস। ওরা নাকে মুখে পলাশ হোটেলের চাপাতি আর আলুভাজি গিলে ঢকঢক করে পানি খায় এবং হাতে কাচা শার্ট-প্যান্ট পারে দৌড়ায় অফিস অভিযাত্রায়। মন্ডল আর মৃধা মতিঝিলের বাসে উঠে পড়ে। বাকি দুইজনের টেম্পু ভরসা। পুরানা পল্টন, শাহবাগ। কোনদিন অর্ধেক পথ হেঁটেই অফিস যায়। সাবের অবশ্য প্রায় প্রতিদিনই ফুটপাত ধরে হেঁটে টিউশনি করে। সে কারণে শরীর  ভালো রাখতে আলাদা করে হাঁটার প্রয়োজন পড়ে না। চাকরিওয়ালারা বেরিয়ে গেলে গোসলখানা খালি পাওয়া যায়। সাবের বেকার। অফিসের ছকে সে পড়ে না।

 

আড়মোড়া ভেঙ্গে আয়েশি চালে ভাঙা বেসিনের কল ছাড়ে। দাঁতব্রাশ করবে। কিন্তু পানির ধারা সরু থেকে সরুতর হয়ে আসছে। যে কারণে ঝটপট দন্তমাঞ্জন করতে হয়। এখনি পানির কল সাহারা মরুভূমি হয়ে যাবে হয়তো। এমনতো গা-সওয়া বিষয়। মাঝে মাঝে গ্যাস ও চলে যায় সারাদিনের জন্য। রাত দশটার পরে নীল অগ্নিশিখা একটু উজ্জ্বলতর হয়। তারাবানু প্রায় নির্দয়ের মতো চিৎকার করে, এইরকম আঁচে রান্ধুম কেমতে? আইজ পাউরুটি খাইয়া থাহেন মামারা।

কোনদিন জরাজীর্ণ শাওয়ারে ঝিরঝির করে পানি ঝরলে সাবের গালা ছেড়ে গান ধরে ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।’ স্যান্ডেলিনের খুশবুতে স্নানঘরে স্বর্গ নেমে আসে। একরকমের অবিশ্বাস্য ভালোলাগায় মুহূর্তের জন্য অন্যমানুষ হয়ে যায় দৃশ্যত গাম্ভীর মানুষটি।

 

আজও জবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। জবা আজ সবুজ বুটিদার শাড়ি পরেছে। সস্তা মাটির গহনা বুকের উপর  বিছানো রয়েছে। মানিয়েছে দারুণ। ভ্রু পল্লবের মাঝ বরাবর একবিন্দু লাল টিপ। একটু কৃপণ কি! আরো একটু বড় হতে পারতো। জবার চোখে মুখে নম্র সৌজন্যের অভিব্যক্তি! পরখ করলে দেখা যায় খানিক দিশেহারা ভাব লেগে আছে চোখের ভেতর।

কেমন আছেন? মারুফাকে পড়াতে যাচ্ছেন? ভাঙ্গা ভাঙ্গা দু একটু বাক্যালাপ না করলে বড়ই অভদ্রতা হয় বলেই কী কুশল জিজ্ঞাসা করছে মেয়েটি? যা হোক উত্তরও দিতে হয়, সেও এক ভব্যতা। সৌজন্য ‘আমি ভালোই আছি। আপনি ভালো আছেন? ঐতো টিউশনি আরকি।

সেই সৌজন্যের দোহাই। জবা মিষ্টি করে বলে, ‘জি¦ আছি ভালোই।’

আজ জবার চোখ  ছোটো মরা মাছের চোখের মতোই সাদা। কাজল পরে নি, হয়তো সময় বা মর্জি হয়নি।  মারুফাকে পড়ানো আর একটা গর্দভকে পাঠদান সমতুল্য। তবু ছাড়তে পারছে কই। মেয়েটির বাবার টাকা পয়সার তেমন অভাব নেই। তার আছে চামড়ার ব্যবসা। ইসলামপুরে আছে থান কাপড়ের রমরমা ব্যবসা। আবদুল কাহার মাস শেষে গৃহশিক্ষকের মোটামুটি মোটা অঙ্কের সম্মানী তুলে দেন। আরো দুইটা টিউশনি করে সাবের সেন্ট্রাল রোড আর তেজকুনি পাড়ায়। দুটোতেই ছাত্রী দুজন মেধাবী বলা চলে, তবে মাসেহারা প্রাপ্তি নগণ্য।

মারুফাদের বাড়ির লোকজনের গরুর মাংসের আসক্তি আছে। সপ্তাহে অন্তত দুই বা তিন দিন গরুর মাংস ভুনার ঘ্রাণ ঝাপটা দিয়ে যায় মাস্টারসাহেবের নাসারন্ধ্রে। কোন দিন খিচুড়ি পোলাও রান্নার অবাধ্য ঘন সুবাস। গত শনিবার সাবের তার পৃথুলা অমনোযোগী ছাত্রীকে বলেছিল, ‘রান্নাঘরের দরজাটা একটু চাপিয়ে দিয়ে এসো।’

মারুফা ভাবলেশহীন মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে শিক্ষকের  দিকে খানিকক্ষণ। ইতিহাসের পাতায় তখন তেজী ঘোড়ার পিঠে সওয়ার মোঘল সেনাদল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্ব। এই যতো যুদ্ধ বিগ্রহ রাজা বাদশার নাম ধাম মোটেই  মনে থাকে না মারুফার। মাথার মধ্যে চরকিবাজি হতে থাকে। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায় সে।

মোমেনা বেগমের ব্লাউজ ভিজে একসা। খুন্তি নাড়তে নাড়তে বলে,

‘ঐ মেয়া দরজা বন্ধ করছ ক্যা?’

নিচু গলায় মারুফা চলে,

‘সারে তো কইলেন। মশল্লার ধাঁ ছুটছে।’

ছাত্রীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে লম্বা একটা নিশ্বাস টেনে নেয় সাবের। বাতাসে মিষ্টি একটা ফুলের সুবাস। মনে হয় হান্সুহেনা। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু মাংস ভুনার সুবাসটা ভোলা যাচ্ছে না। মোমেনা বেগম রাতের খাবার খেয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু সাবের ‘আর একদিন হবে’ বলে এড়িয়ে গেছে।

মালতী মেসে মন্ডল আর হক ভাইয়ের বহুমুত্র ব্যাধি। রাতে তাই তারাবানু রুটি বানায়। আলু পটল কুমড়া ভাজি করে। সাবের মোড়ের হুজরালি চাচার দোকান থেকে একটা হাফ পাউরুটি একহালি শবরি কলা, দুইটা ডিম কিনে নেয়। ঠিকে বুয়ার চাপড়া রুটির চেয়ে পাউরুটি চিবানো অনেক উপাদেয়।

 

হারাধন দাদা মাঝে মধ্যে মাসকলাইয়ের ডাল দিয়ে খিুচড়ি, ডিমের কারি রাঁধেন। কারির উপর কুচি কুচি ধনে পাতা পা তুলে ভেসে বেড়ায়। সাবের, সর্বকনিষ্ঠ। সবার ইষৎ স্নেহের পাত্র। সে আনাড়ি হাতে শসার সালাদ বানায়। সেদিন মালতী মেসের ফিস্ট। দাদা আবার অতুল প্রসাদের গান ধরেন। ‘আমি অকৃতি অধম বলেওতো কম করে কিছু দাওনি।’ সুর টলোমলো হলেও বাণীতে মন জুড়ায়। চার মেসবন্ধুর পিছুটান আছে। দেশের বাড়িতে পরিবার স্ত্রী- সন্তান মুরুব্বিজন। ছুটি পেলেই ওরা পালাই পালই ভাব ধরে।

সাবেরের পিছুটানা বলতে পাবনার আটঘরিরায় দুই বোনের শ্বশুরবাড়ি। গত বছর চুমকিবু, রুশনিবুদের কথা খুব মনে পড়ছিল বিধায় গিয়েছিল। দুই বোনের ঘরগেরস্তি কাছাকাছি। দুই ভাই ভায়রা ভাই!

 

বোনদের যেন চেনাই যায় না। একদা এমন ছিল বোনদের রূপের প্রশংসা বাতাসে ভেসে বেড়াতো। এখন রুশনিবুর গালভর্তি মেচতা। রঙ পুড়ে অঙ্গার। কোমর ছাওয়া চুলের বাহার কবেই বেইমানি করেছে। ডাগর চোখ জোড়া গর্তে ঢুকেছে। চুমকিবুর সর্বাঙ্গে অনড় বাতের ছোবল।চড়া গলায় রুশনিবুর শাশুড়ি ডোলের ধানের নিকেশ করেন। চুমকিবুর শ্বশুর শ্লেষানজড়ানো গলায় কলার কাঁদির কলা কোন বান্দরে খেয়েছে তার শুলুক সন্ধান করেন। বাড়ি ভরা চিক্কুর। ভাগ্নে ভাগ্নিরা ক্রিমি ভরা পেট নাক ভর্তি সর্দি, মাথা ভর্তি উকুন নিয়ে বাড়িময় হৈ হল্লায় মত্ত। আর দুলা  মিয়াদের হাসি ঠাট্টা তীক্ষ্ন তুরপুন হয়ে বুকে বেঁধে।

‘কী শালাবাবু চাকরি বাকরি জুটলো না। এতো বড়  পাস দিলা খামোখা খামোখা। বিবাহের ফুলও ফুটতেছে না। কী অসম্ভব বিষয়। এমতে এমতেই বাঁইচা আছো। লাঙল বাইবা হেই জমি জিরাতও নাইক্কা। কী কপালখান।’  সাবেরের বুকের মধ্যে তোলপাড় পালাও পালাও। পরদিন পাখ-পাখালি জাগার আগে ঘন বাঁশঝাড় পার হয়ে সড়ক ধরে হাঁটতে থাকে সে। হাঁটতে হাঁটতে ঘাম ছুটে যায়। রুশনিবুর শাশুড়ির বাক্যবাণ আবার রক্ত ঝরায়।

‘বুনগর বাড়িত খালি হাতে কেমনে আসে জোয়ান মর্দ বাই। জেবনের প্রথম দেকলাম গো’।

 

আশ্বিন মাসের ঈষৎ শীতল সকাল। ঘুম থেকে একটু বেলা করেই উঠেছে সাবের। অফিস হাজিরার তাড়া নেই। বাকি চার মেসমেট বেরিয়ে গেছে।

টুথব্রাশটার মাজন পর্ব তখনও চলছিল। হঠাৎ টেবিলের বাঙিরঙের টেবিল ঢাকনার উপর চোখ গেল। ‘বাংলার কথা’ পত্রিকা অফিস থেকে এসেছে ব্রাউন রঙের জ্বলজ্বলে খামটি। এযে রাজার চিঠি। এতো শুধুমাত্র মামুলি চিঠি নয়, এতো দীপ্তিমান ধ্রুবতারা। যন্ত্রচালিতের মতো খামের গহ্বর থেকে চিঠি উদ্ধার করে সাবের। আসছে মাসের পয়লা তারিখেই জয়েন করতে বলেছে। পত্রিকা অফিস মতিঝিলে। মাস দুই আগে ইন্টারভিউ দিয়েছিল সাবের। আজ নিজেকে গৃহশিক্ষক নয়, পুরোদস্তর সাংবাদিক মনে হচ্ছে।  সাংবাদিকতায় ভালো রেজাল্ট করে বেরোলেও দিন দিন আত্মবিশ্বাস ঝরে যাচ্ছিল। ইন্টারভিউ এ যাবত কম দেওয়া হয় নাই। মারুফাদের বাড়িতে যেতে হবে। বাকি দুইটা টিউশনি সন্ধ্যায়। আজ প্রতিটি পদক্ষেপে যেন অচেনা আনন্দ। জবার সঙ্গে আজও দেখা হয়ে গেল। মেয়েটিকে আজ মূর্তিমতী কল্যাণময়ী মনে হলো। প্রাণবন্ত, নম্র। চোখে চোখ পড়ে গেল। টুংটাং সেতার বেজে উঠলো হৃদয়ের অতল অলিন্দে। ওর দুটো ঝকঝকে চোখের তারায় নিবেদনের ভাষা। আজ ভাবতে ভালো লাগছে তার রুক্ষ জীবনে ছায়াছন্ন সবুজ সিগন্যাল হয়ে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। জবা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে এগুচ্ছিল। বিনীত সৌজন্যের সঙ্গে আরো কিছু পরখ করলো সাবের। ব্যাখ্যাতীত।

 

আগ বাড়িয়ে সাবের প্রশ্ন করলো, ‘কেমন আছেন?  ভালো তো? ’

মেয়েটি দমের পুতুলের মতো মাথা অল্প দুলিয়ে বললো, ‘ভালো আছি। আপনি?

জবা জানে সে কেমন ভালো আছে। তবু নিজের মন্দ থাকার কাহিনি রাস্তাঘাটে বলা যায় না। আজ সিটি কলেজ থেকে ফেরার পথে মহল্লার গুন্ডা ফতে  রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে বলেছিল,

‘মহল্লার মাইয়ার  এতো দেমাক কিয়ের? পাড়ার ভাই বেরাদরের লগে বাতচিত আলাপ সালাপ করে না। এইসব বেয়াদপদের সাইজ বানাইতে বেশি টাইম লাগে না।’

 

গত বছর থেকে নানাভাবে হয়রান করছে ফতে আর তার চেলারা। ফাইনাল পরীক্ষা হলে বাঁচা যায়। জবার খোলা রাস্তায় চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

বাবার পেনশনের কটা টাকায় সংসারের চাকা নড়ে না। চাকরি তো সোনার হরিণ। চেষ্টা তো চলছেই।

ইতিমধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেছে সাবেরের একটা চাকরি হয়েছে। মঙ্গলবার দিন মারুফা ঘরে ঢুকতেই বলে উঠলো, ‘সার জবা আপু আপনাকে একটা বই আর চিঠি দিচ্ছেন। জরুরি, আপু বলসে।’

 

আবার ছেলেটার গহিন অতলে সেতারের টুংটাং। এরই মধ্যে ছাত্রীর বাবা ঘরে ঢুকলেন। তিনি দুঃখিত। এমন ভদ্র শান্ত মাস্টার আর কোথায় মিলবে। নিচু গলায় বললেন, ‘বাবা একবেলা আমাদের ঘরে ডালভাত খাবেন। আমার স্ত্রীর খুব ইচ্ছা আপনারে গরুর গোশত ভুনা কালিজিরা চাউলের পোলাউ খাওয়াবেন। খ্যাতের চাউল বাবা। বহুত ঘেরান। সাবের দাওয়াত অবলীলায় কবুল করে, ঠিক আছে আগামী পরশু দিন।’

 

মারুফা একটা নাম্বার ওয়ান গর্ধভ বটে। চিঠিটা দে। কোন সিন্দুকে রেখেছিস। মনে মনে  মহাবিরক্ত মাস্টার সাহেব। মনে হচ্ছে গবেট ছাত্রীটার তোম্বা তোম্বা গালে কষে একটা চড় মারে। কোথায় চিঠি, কোথায় বই। ‘আসতেছি সার’ বলে মারুফা ভেতরের ঘরে ঢুকে ছোটভাই ওর সাজগোজের বাক্স ধরেছে বলে চিলের মতো চেঁচাচ্ছে। খানিক বাদে ফুল-ফুল সবুজ পর্দা ঠেলে সে বসার  ঘরে ঢুকলো। হাতে একটা বই, একটা নীল খাম। বইটি সাবেরের প্রিয়-সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম।’স্ট্রাপলার মারা খাম হাতে নিয়ে দ্রুত মালতী বোর্ডিং এর পথে চললো সাবের।

 

তক্তপোষের তোষকটা আজ মখমলের মতো কোমল আর আরামদায়ক মনে হলো। খামটায় গোটা দুই স্ট্রাপলার আঁটা। তড়িঘড়ি করে খুলতে যেয়ে আঙুলে ফুটে গেল। কয়েক বিন্দু রক্ত ঝরলো। হু কেয়ারস? গুণগুণ করছিল সাবের। ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি।’…….

চিঠি উন্মোচিত হলো। তখনও চলছে সেতারের টুংটাং ধ্বনিপুঞ্জ! চোখদুটো ঠিকরে পড়ে সার বাঁধা চিরকুটের অক্ষরগুলোয়।

আদাব সালাম বাদে বক্তব্য- শ্রদ্ধাভানেষু সালাম ও শুভেচ্ছা নেবেন। অনুগ্রহ করে আপনার টিউশনিটা আমাকে দিয়ে গেলে বাধিত হবো। আপনাকে অভিনন্দন। চাকরি হয়েছে জানলাম। আমার এই অনুরোধ রাখলে চির কৃতজ্ঞ থাকবো। চির ঋণীও বটে। খুব ভালো থাকবেন।

 

নিত্য শুভার্থী,

জবা

বেশ তো! জোয়ারের জল এবার ভাটার টানে মিশে যেতে লাগলো। শবনম উপন্যাসটি কী ঘুষ!

ছোটবেলায় সাবের দেখেছে তার নিঃ সন্তান রাঙা চাচী কামিল পাখি পুষতেন। সে এক অদ্ভুত পাখি। লম্বা লম্বা পা। কালচে বর্ণ-ঠোঁটটা বুঝি লাল ছিল। একজোড়া পাখি লম্বা পা ফেলে চাচীর শোবার ঘরে পাকঘরে ঘুরে বেড়াতো । খাবার দিতেন চাচী মাটির সানকিতে যত্ন করে।  খুঁটে খুঁটে খেত। বড় বিস্ময় সদ্য কিশোর সাবেরের। ঐ পাখি রাতেও চাচীর সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতো। একবার সাবের পাখিদুটোকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল। রাঙা চাচাী হৈ হৈ করে উঠেছিলেন,

 

‘ও খোকন ওগরে ধরিস না বাপধন। ওরা ভয় পাইবে দুঃখ পাইবে। তখন আমারে ছাইড়া উড়্যা যাইবো। কত কষ্টে পোষ মানাইছি।’

আবেদনময় চিরকুট পড়ে রইলো তক্তপোষে। সাবেরের মনে আচানক শৈশবের কুয়াশা, সংশ্লেষ। চিরকুট অক্ষরসর্বস্ব শৈশবেরই কামিল পাখির পালক।