খা খা বক্ষিলারে কাঁচা ধইরা খা/ রক্তবীজ ডেস্ক

 

 

খা খা বক্ষিলারে কাঁচা ধইরা খা- খেলা দেইখ্যা যে পয়সা না দেয়, তারে ধইরা খা! বেদে বেদেনীর মুখে এ সংলাপ আমাদের ভীষণ পরিচিত। মাথায় ঝাঁপিতে সাপ নিয়ে বেদেরা হেঁটে চলেছে গ্রাম বাংলার কাঁচা রাস্তা ধরে। তাদের কণ্ঠ শুনে ঝাঁপ খুলে তাকিয়ে দেখছে অন্তঃপুরে থাকা গৃহবধু।  কিশোর-কিশোরী দৌড়ে এসে মায়ের আঁচল ধরে সাপের খেলা দেখার বায়না করছে। বেদেনীদের কাছে চুড়ি থাকে। কারো কারো কাছে থাকে শিঙ্গে, দাঁতের পোকা ফেলতে পারে তারা। এসব দৃম্য গ্রাম বাংলায় একসময় প্রতিদিন দেখা যেত।  সারাবছর বেদেরা গ্রাম থেকে গ্রাম, গঞ্জ থেকে গঞ্জে ঘুরে বেড়াত। আমাদেশ দেশ শুধু নয়, এই উপমহাদেশের লোকজ সংস্কৃতির  অনেকটা জুড়ে আছে বেদে সমাজ। আমাদের  লেখা গল্প উপন্যাস কবিতা নাটক চলচ্চিত্র সবই তো জীবনের প্রতিফলন। তাই নানা রূপে নানা ভাবে গল্প উপন্যাস থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রে বেদে- বেদিদনীরা এসেছে বিচিত্ররূপে।  প্ল্লীকবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন বেদের মেয়ে। চলচ্চিত্র হয়েছে বেদের মেয়ে নামে। এ ছাড়া অসংখ্য কবি সাহিত্যিক বেদেদের নিয়ে গল্প উপন্যাস লিখেছেন।  রূপকথাভিত্তিক এবং লোককাহিনি নিয়ে বানানো  চলচ্চিত্রে বেদের বীণ বাজানো এক সাধারণ ঘটনা।

বেদে সম্প্রদায়ের জীবন যাযাবরের মতো।  কখনই তারা কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করে  না। কখনও এ ঘাটে কখনও ও ঘাটে।  তাদের রয়েছে নিজস্ব সামাজিক আচার আচরণ ও সংস্কৃতি।  রয়েছে নিজস্বতা।

সময় বদলেছে। এখন সাপ খেলা দেখার মানুষ আর তেমন নেই। দাঁতের পোকা ফেলার জন্য কেউ বেদে বেদিনির কাছে যায় না। ফলে আগের তুলনায় বেদের সংখ্যা কমে গেছে। এখন আর নদীর ঘাটে বেদের বহর দেখা যায়  না। দেখা যায় না তাদের ঘুরে ঘুরে সাপের খেলা দেখাতে বা শিঙ্গে লাগাতে।  যাযাবর জীবন ছেড়ে বেদেরা অনেকেই স্থায়ী বসবাস  করছে।। জীবন ও জীবিকার তাগিদে বেছে নিয়েছে ভিন্ন পেশা। ফলে আমাদের লোকজ সংস্কৃতির এই সমৃদ্ধ ধারাটি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।  তবে বেদে সম্প্রদায়ের প্রতি মানুষের এখনও রয়েছে একই রকম কৌতুহল।

বেদেরা এদেশে এসেছিল  আরাকান অর্থাৎ মিয়ানমার থেকে।  সেটা ১৬৩৮ সাল।  আরাকানের তৎকালীন রাজা বল্লাল সেনের সাথে শরণার্থী হিসেবে তারা এদেশে এসেছিল।  ক্রমশ তারা সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে । আবার কারও কারও মতে প্রাচীনকালে  তারা এসেছিল সুদূর মিসর থেকে।  তারা বেদুইন জনগোষ্ঠীর । বেদুইন থেকে বেদে শব্দটির উৎপত্তি। জনশ্রুতি রয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গুগলি জেলার পান্ডুয়াতে  বেদেরা রাজত্ব গড়ে তুলেছিল।  আবার এটাও শোনা যায়,  বেদেরা  বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের উত্তরসূরি। এদেশে বেদেশের আগমণ ও অবস্থান বিষয়ে এসব ভিন্ন মতের কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা  তা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য।  বিষয়গুলি নিয়ে রয়েছে অনেক বিতর্ক।  তবে বেদেরা শত শত বছর ধরে এদেশে রয়ে গেছে, এদেশের জনস্রোতের সাথে মিশে গেছে।  মিশে গেছে সমাজ সংস্কৃতিতে। বেদেদের মধ্যে অনেক গোষ্ঠী বা গোত্র রয়েছে। বেদেরা গোত্রকে জাত বলে।  যেমন   বাংলাদেশে বেদেরা বেদে, বেদিয়া, বাইদ্যা, সাপুড়ে, মিশ্চিয়ারিসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। ভারতের পশ্চিম বাংলাতেও বেদেরা এসব নামে পরিচিত। তবে ভারতের উড়িষ্যায় ‘  খের’, উত্তর ভারতে ‘সপেরা’, অসমে ‘অঘোরিমান’, বোরো অঞ্চলে ‘হুগড়া’, মহারাষ্ট্রে ‘মাহব’ এবং ইংরেজীতে ‘ বেদিয়া’ নামে ডাকা হয়। ভারত এবং বাংলাদেশ মিলে বেদেদের জনসংখ্যা ২০ লাখের মতো। বেদেরা যে ধরণের কাজ করে অর্থাৎ  পেশা বেছে নেয় সেটার উপর ভিত্তি করেই তাদের নামকরণ হয়। যেমন যারা সাপ খেলে বা কেনাবেচান করে তারা সাপুড়িয়া। যারা  ঝাঁড়ফুক করে তারা মিশ্চয়ারি। শারীরিক কসরত দেখিয়ে জীবিকা অর্জনকারীরা চামরিয়া নামে পরিচিত। কাঁচের চুড়ি ও মালা যারা বিক্রি করে তারা সান্দার এবং যারা হাঁড়িপাতিলসহ সাংসারিক জিনিসপত্র বিক্রি করে তারা সওদাগর নামের গোত্রভুক্ত। তাবিজ কবজ বিক্রি করে ধবাইলা গোত্রের বেদেরা। যারা মাছ ধরে তারা মানতা। এ ধরনের আরও কয়েকটি গোত্র রয়েছে, যা ইরানিয়া, লারপুরিয়া, ব্যাবাইজ্জা, লাউয়া, ললুয়া, মালি, আমান, পাঁচ ভাইয়া, ষোলো গ্রাম, একুশ গ্রাম, কাগমারা, বহুরূপী, কালান্দর, নরসিংহা, বেচ, বাজানিয়া ভাতু, যোগি, ছাতা, কঙ্গর, মালবেদে, বড়িওলাসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত।   জায়গা ভেদে তাদের ভিন্ন ভিন্ন নামেও ডাকা হয়।

একটা সময়ে নৌকায় ছিল বেদেদের  ঘরবসতি। সময়ের পরিবর্তনে এখন তারা বিভিন্ন জায়গায় গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে বাস করছে। ঢাকার সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, তিনটুরী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়েতগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী এবং উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর ও নাটোরসহ বিভিন্ন জায়গায় এসব বেদেরা বসবাস করে। বেদেদের নিজেদের মদ্যে যোগাযোগ প্রবল। তারা  পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। সুনামগঞ্জের সোনাপুরে একসঙ্গে বাস কেরে অনেক বেদে।  তবে আবদুল্লাহপুর, মীরকাদিম, চিতলী, মাকহাটি এলাকায় বেদেদের আদি বাস ছিল। এসব এলাকা থেকেই সম্ভবত তারা ভাটপাড়া, বক্তারপুর, আমিনবাজার প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।বছরের কমপক্ষে তিন চার মাস তারা স্থায়ী ঠিকানায় মাটিতে বসবাস করে।  অন্য সময় তারা সারা দেশ ঘুরে যার যা পেশা অনুযায়ী কাজ করে। তারা কখনও একা বের হয় না, বহর নিয়ে চলাফেরা করে।  অধিকাংশ বেদের নৌকা আছে। এক একটা বহরে ৫০ ৬০ টা নৌকা নিয়ে তারা বের হয় ।

বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন কৌমসমাজের রীতিনীতি মেনে চলে এবং দলবদ্ধ হয়ে বাস করে।  তাদের গোত্রভুক্ত হয়ে থাকতে ভালবাসে। তাদের নিজেদের মধ্যে ভালবাসা প্রবল। একে অপরের সাহায্য সহযোগিতা করে তারা।  বেদে সমাজ পিতৃপ্রধান। তবে মেয়েদেরওর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে সংসারে।  বেদে পরিবারে ছেলেরা খুব অলস হয়। জীবন জীবিকা অর্জনের জন্য মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে। তারা দল বেধে  গ্রামে গ্রামে সাপের খেলা দেখাতে বা তাবিজ কবজ বিক্রি করতে যায় । তখন এটিকে তারা ‘গাওয়াল’ বলে। বেদেদের ঠার নামে নিজস্ব ভাষা আছে। নিজেদের মধ্যে তারা এই ভাষায় কথা বলে।  পরিবারের প্রধান ব্যক্তির পছন্দ অনুযায়ী বেদেরা বিয়ে করে থাকে। আধুনিক সমাজের মানুষের মতো বেদেদের মধ্যে বহুবিয়ে, বাল্যবিয়ে ও যৌথ পরিবার প্রথা নেই বললেই চলে। বেদে সম্প্রদায়ের পুরোধা হচ্ছে  সরদার। তার কথাই আইন। তার কথয় পুরো সম্প্রদায় চলে । বেদেদের বহর কোন এলাকায় যাবে, কতদিন থাকবে, কোথায় কিভাবে নোঙর করবে সেটাসহ বিয়ে শাদি সালিশ বিচার সবই সরদার করেন। আর বেদেরা বিনাবাক্য ব্যয়ে তা মেনে নেয়।  সরদার সমাজের সব কয়টা বহরের বাণিজ্য পথ নির্ধারণের দায়িত্বে থাকেন যাতে প্রয়োজন হলে সবাই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারে।  বহরের সমস্ত দায়িত্ব থাকে সরদারের উপর। তিনিই নিয়ম শৃঙ্খলিা রক্ষা করে থাকেন।

বেদেরাও এই ভূমির সন্তান। তারা নিজেদের মুসলমান  বলে পরিচয় দেয়। তবে  তারা মনসা ও বিষহরির পূজাও করে। অনেকে জলের দেবতা গঙ্গার পূজা করে। বেদেদের বিয়ের রীতি মুসলিমদের মতো হলেও কিছু বিচিত্র ব্যাপার রয়েছে। উপার্জনের মৌসুম শেষেই তারা বিয়ে করে। তারা বিয়েতে খুব আনন্দ করে।  বেদেদের বিয়েতে উপহার আদান প্রদানের নিয়ম নেই।  বিয়েতে আপ্যায়নও করা হয় না। বিয়েতে যারা উপস্থিত থাকে তাদের সবাইকে নাচ গান করতে হয় এমনকি বর কনেকেও। বিয়েতেই তারা সবচেয়ে  বেশি আনন্দ করে। বেদেদের বিয়েতে অবিবাহিত মেয়েরা খুব সাজগোজ করে  যাতে অবিবাহিত পুরুষদের চোখে পড়ে তারা। যাতে তারা ওদের পছন্দ করে।  বেদেদের কয়েকটি গোত্রে মজাদার কিছু প্রথা আছে। এই প্রথার একটি এমন। বর উঁচু গাছের ডালে বসে আর কনে নিচে দাঁড়িয়ে বরকে গাছ থেকে নেমে আসার জন্য ডাকতে তাকে। বর যেন শুনেও শোনে না। নির্বকার বসে থাকে। তখন বউ নানা প্রলোভন দেখায় বরকে। ‘আমি সংসারেরসব  কাজ করব। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করব। ছেলেমেয়েদের লালন পালন করব।’ বর তাও নামে না।  বসেই থাকে। কনে  বলে-‘আমি তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করব না।  যা বলবে তাই শুনব।’ বর তাও বসে থাকে। শেষে কনে বলে-‘তোমাকে আমার ভরণ-পোষণ করতে হবে না, আমিই তোমার ভরণপোষণ করব সারাজীবন রোজগার করে খাওয়াব।’ এরপর বর ডাল  থেকে  নেমে আসে। তাদের বিয়ে হয়। কয়েকটি গোত্রের বিয়ের সময় কনেকে অর্থ দিতে হয় সামর্থ্য অনুযায়ী । সে  অর্থ বেদেনীর কাছে গচ্ছিত থাকে।তাদের মদ্যে ছাড়াছাড়ি হলে  সম্পত্তি এমনকি ছেলে-মেয়েও ভাগাভাগি হয়। সরদার বিচার করে রায় দেন। সে রায় উভয়পক্ষকে মেনে নিতে হয়। স্বামী  অলস হলেও  বিয়ের রাতে তাকে সন্তান পালনের অঙ্গিকার করতে হয়। স্ত্রী উপার্জনের জন্য বাইরে গেলে, স্বামী ছেলে মেয়েদের দেখাশুনা করে।  বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর ঘরে যায়। স্ত্রীর ঘরই স্বামীর ঘর। বেদে নারীরা স্বামীদের বশ করার জন্য তাবিজ কবজসহ নানা কৌশল অবলম্বন করে। অন্য গোত্রের কেউ বেদে নারীর প্রেমে পড়লে তাকে তার গোত্র ত্যাগ করে নিজের গোত্রভুক্ত হতে হয়।  বেদেনিরা স্বামী বেদেকে দেবতাজ্ঞানে শ্রদ্ধা ভক্তি করে। সমস্ত বিপদ অপদ ঝামেলা তারা নিজেদের কাঁধে তুলে বেদেকে ভারমুক্ত রাখে।  নতুন নৌকা তৈরি শেষেও তারা উৎসব করে।

দেশের এখন আর বনজঙ্গল অরণ্য নেই।  উজাড় হয়ে গেছে। তাই সাপ আর আগের মতো দেখা পাওয়া যায় না। তাই বেদেদের মূল পেশা এখন অনেকটাই  নেই। বেদেদের একটি বড় অংশ অভাবে অনটনে আছে । কিন্তু এখন তাদের অনেকেরই নিয়মিত কাজ নেই। তাই তাদের জীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার। বেদে সম্প্রদাযের পুনর্বাসনের জন্য সরকার ও দেশের জনগণকে তাদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন।


সাপ নিয়ে নানান  কথা / রক্তবীজ ডেস্ক

সাপ আমাদের চেনা প্রাণী। সাপ শব্দটি  আমাদের মনে জন্ম দেয় ভয়ের, সঙ্কুচিত করে ফেলে আমাদের। খুব সাহসী লোকও সাপকে ভয় পায়।  যাদের জন্ম গ্রামে তারা শৈশব কৈশোরেই সাপের সাথে পরিচিত হয়। কিন্তু যারা শহরে জন্মেছেন, তারা সাপ দেখার আগেই শাপকে চেনেন দাদি -নানির কোলে শুয়ে গল্প শুনে শুনে। ঠিক যেভাবে মানুষ ভূত চেনেন।  সাপ সম্পর্ক আমাদের ধারণা,  এই প্রাণীর বিষদাঁত আছে। আর একবার যদি সেই বিষদাঁত মানুষ বা কোন জীবজন্তুর দেহে বসিয়ে দিতে পারে তবে  তাদের মৃত্যু অনিবার্য। আতঙ্ক, ভয় থেকেই কিন্তু জন্ম নেয় নানা কুসংস্কার, রূপকথা, উপকথা, লোককাহিনি। তাই আমরা জানি সাপের মাথার মণি অমূল্য। সাপ মানুষ হয়। মানুষ মানে সুন্দরী নারী। সেই নারী আবার সাপ হয়। সেই চিন্তা থেকে নাগীন কন্যাসহ কত কত কাহিনি আর চলচ্চিত্রের জন্ম হয়েছে। এদেশে অসংখ্য ছায়াছবি নির্মত হয়েছে যেগুলির কেন্দ্রে আছে সাপ।  ভারতবর্ষে ‘সর্পপূজা’র প্রচলনও হয়েছিল। আজও অজগ্রামে এ পূজা  প্রচলিত আছে।

সাপ আকার-আকৃতিতে তেমন বড় নয়।  অজগর গ্রুপের দু-চারটা প্রজাতি কিছুটা বড়। এ ছাড়া বাকি সাপগুলি  দৈর্ঘ্যে ৬-৭ ইঞ্চি থেকে নিয়ে ৮-১০ ফুটের বেশি নয়। পৃথিবীতে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে। বাংলাদেশে ৭৮টি প্রজাতির সাপের সন্ধান পাওয়া যায়। এই সাপগুলির  মধ্যে ৫২টি অবিষধর ও ২৬টি বিষধর সাপ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ৪টি প্রজাতি যেমন গোখরা, কালকেউটে, সানকিনী ও চন্দ্রবোড়া কামড়ালে তা   রীতিমতো ভয়ের কারণ। এছাড়া  ঢোঁড়া, পাইন্না, মেটে সাপ একেবারেই নিরীহ। কিন্তু অন্ধকার বা আলোতে সাপ কামড়ালে তা বিষধর কিনা তা বোঝা যায় না । কারণ আমরা সব সাপ চিনি না। আর সাপ কামড়েই দ্রুত সরে যায়। আশপাশে যারা থাকে তারাও ভয়ে সরে যায়। তাই সাপ কামড়ালেই আমরা ধরে নিই বিষধর সাপ কামড়েছে, বাঁচার সম্ভাবনা আর নেই।   কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মাত্র কয়েকটি সাপের কামড়ে আমরা মারা যেতে পারি।

সাপের বিষ  অন্য দেহে প্রবেশ করে দুভাবে বিষক্রিয়ার সূত্রপাত করে। একটি কার্ডিও টক্সিন, যা হৃদ্যন্ত্র-রক্তসংবহনতন্ত্র ও অন্যটি স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে। তবে মুম্বাইয়ের ইফকিন্স ইনস্টিটিউটে এক জরিপে দেখা গেছে, ভারতের যত লোক সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয় বা মারা যায়, তাদের শতকরা ৮০ শতাংশই ঘটে অবিষধর সাপের কামড়ে। এসব মৃত্যুর মূল কারণ বিষক্রিয়া নয়, বরং ভয়ভীতি, আশঙ্কা থেকে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

আমাদের সমাজ  বিজ্ঞানে যথেষ্ট অগ্রসর নয়।  এই জাতীয় অনগ্রসর সমাজে যে কোন ভীতিকর জিনিস নিয়েই  তৈরি হয় নানান  গল্প , সংস্কার, কুসংস্কার। আমাদের দেশেও  সাপ নিয়ে চালু  আছে অনেক সংস্কার-কুসংস্কার, অপবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। এসব কাহিনিকে জিইয়ে রাখে সাপুড়ে আর বেদেরা। এই কুসংস্কারকে অবলম্বন করে তারা ব্যবসা করে বেঁচে থাকে। তাই কুসংস্কার ক্রমশ বিস্তার লাভ করে।

সাপ নিয়ে চালু আছে কিছু কথা। যেমন: ক. সাপ প্রতিশোধপরায়ণ খ. সাপ গরুর দুধ খায় গ. সাপের মাথার মণি আছে ঘ. সাপ গুপ্তধন পাহারা  দেয় ঙ. সাপুড়ের বিচিত্র বাঁশি সাপ টেনে আনে ইত্যাদি।

সাপ প্রতিশোধপরায়ণ!

আমাদের সমাজে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, সাপ অকারণে কাউকে কামড়ায় না।  যদি কখনও রাতবিরেতে চলার পথে সাপের গায়ে পাড়া দেয় বা সাপকে আঘাত করে সাপ তাকে চিনে রাখে। পরে তাকে কামড়ে প্রতিশোধ নেয়। অর্থাৎ সাপ প্রতিশোধপরায়ণ।  কিন্তু কথাটা সত্য নয়।  বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে জানা গেছে  এমন কাজ কেবলমাত্র  উন্নততর মেরুদণ্ডী প্রাণী  করতে পারে। সাপের মগজের আকৃতিগত ও বিবর্তনভিত্তিক যে অবস্থান তাতে বাস্তবে এটা সম্ভব নয়। সুতরাং সাপ প্রতিহিংসা জিইয়ে রেখে প্রতিশোধ নেয় এই ধারণা ঠিক নয়।

সাপ গরুর দুধ খায়!

গ্রামীণ সমাজের একটি প্রচলিত ধারণা সাপ নিয়মিত সদ্য বাচ্চা প্রসব করা গরুর দুধ খেয়ে ফেলে। ফলে গরুর বাছুর বা গৃহস্থ দুধ পায় না। অনেক সময় গৃহস্থ দেখতে পায় গরুর পায়ে সাপ পেঁচিয়ে আছে। এতে তার বা তাদের বদ্ধমূল ধারণা হয় সাপ গরুর দুধ খায়।  কিন্তু বাস্তব বিষয় তা নয়। সাপ রাতের বেলায় ইঁদুর বা ব্যাঙ ধরতে আসে। তখন যাতে  গরুর পায়ে পিষ্ট না হয় এই  ভয়ে এমনটা করে। সাপের দুধ খাওয়ার কাহিনি মানুষের কল্পনাপ্রসূত। কারণ  গরুর দুধ খাওয়া বা  সংগ্রহের  নিয়ম সাপ আয়ত্তে আনতে পারবে না। সেটি বেশ জটিল।   কেননা, অধিকাংশ সাপের দাঁতের গঠন বেশ সুঁচালো এবং মুখের ভেতরের দিকে বড়শির মতো বাঁকানো। সুতরাং সাপ যদি গরুর দুধ খেতে যায়, সেই দাঁত গরুর ওলান চুষতে গেলে আটকে যাবে এবং বিষ নির্গত হবে। ফলে গরুর মৃত্যুর সম্ভাবনা  আছে।  সাপ গরুর দুধ খাচ্ছে বাস্তবে এই দৃশ্য কেউ কখনও দেখেছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এই কল্পনাকে ভিত্তি করে অনেক গল্প উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে সাপের গরুর দুধ খাওয়া  বা বাটিতে দুধ খাওয়ানোর কাহিনি দেখানো হয়েছে।

সাপের মাথার মণি!

সমাজে প্রচলিত একটা কথা আছে তা হচ্ছে সাপের মাথায় মণি আছে।  কেউ কেউ মেঘলা অন্ধকার রাতে সাপের মাথায় মণি দেখেছে।  এই মণি যে দেখতে পায় সে অতীব ভাগ্যবান। এসব গল্প  সাপুড়ে-বেদেরা বেশি করে থাকে।  সাপকেন্দ্রীক নানা ভয় ভীতি ও প্রলোভনের গল্প বলে তারা নিরীহ মানুষের পয়সা হাতিয়ে নেয়।  এ মণি নাকি  সাত রাজার ধনের সমান। এই   জাতীয় মণির কথাও সাপুড়ে – বেদেরা বলে থাকে। আমাদের জনগণের একটা অংশ একথা বিশ্বাসও করে।  তাই অনেক বোকা লোক এই মণি  সংগ্রহের স্বপ্ন দেখে।

আসলে, বিষধর সাপের মাথার ওপরে একটি ছিদ্র থাকে।  মুখবন্ধ অবস্থায় সাপ সেই ছিদ্র দিয়ে তার লকলকে  জিব বের করে এর চারপাশের পরিবেশ থেকে খাদ্যের কিংবা সাবধান হওয়ার সংকেত সংগ্রহ করে থাকে। সাপুড়েরা সাধারণত তাদের খাঁচা বা বাক্সে রাখা সাপগুলোর মাথার উপরের ছিদ্রে রংবেরঙের পাথর বসিয়ে রাখে। সে পাথর  দিনের আলো বা চাঁদের আলোয় ঝিলিক দিয়ে ওঠে । সেই আলোর বিচ্ছুরণকে তারা সাপের মাথার মণি বলে চালিয়ে দেয়।

সাপ সাপুড়ের বাঁশির সুর শোনে!

সাপুড়ের বাঁশির সুরের নাকি  সম্মোহনী শক্তি আছে।  সে শক্তি বা জাদুতে সাপ চলে আসে। এমন অনেক কাহিনি শোনা যায়। এগুলো আসলে গল্প। সাপুড়ে-বেদেরাই এসব গল্পের জন্ম দেয়  পয়সা সংগ্রহের কৌশল হিসেবে। তারা বলে, তাদের বাঁশির এমনই জাদু যে, সে বাঁশির সুরে সাপ গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসে সাপুড়ের হাতে ধরা দেয়।  এভাবেই সাপ তাদের বশে  আসে। বাস্তবে কথাটা ঠিক নয়।  সাপের কান নেই । তাই সুর বা শব্দ শোনার প্রশ্নই ওঠে না। সাপের চোয়ালের নিচে হাড়ে শ্রবণস্পন্দন গ্রহণের স্নায়ুতন্ত্রে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। সেই ব্যবস্থাতেই সাপ  শব্দ বা বিপত্সংকেত শোনে। সাপুড়ে যখন  বাঁশি বাজায় তখন তার দেহে নানা ভঙ্গি খেলা করে। সুরের ওঠা নামার সাথে সাথে সাপের শরীরও ওঠানামা করে। তাই সাপুড়ে বাঁশি বাজালে আমরা গোখরা সাপকে ফণা তুলতে দেখি।  এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন সাপুড়ের  বাঁশির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আকৃতি ও সাপুড়ের ছন্দময় অঙ্গভঙ্গি ও তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত নাড়া সাপকে খেপিয়ে তোলে। তাই সাপ ফণা তোলে। এই ফলা তোলার সাথে সাপুড়ের বাঁশির কোনো সম্পর্ক নেই।

সাপের গুপ্তধন পাহারা!

অনেক গল্প-উপন্যাসে আমরা পড়েছি  সাপ গুপ্তধন মানে  লুকানো রৌপ্য, মণিমুক্তা  পাহারা দেয়। বিষয়টা আসলে তা নয়। অতীতে ব্যাংক ছিল না। তাই অনেকে পারিবারিক দ্বন্দ্ব কলহের কারণে , শরিকীয় বিবাদে সম্পদ রক্ষার  জন্য সম্পদ স্বর্ণ-রৌপ্য ও মুদ্রাভর্তি হাঁড়ি বা কলসি মাটির নিচে গর্ত করে লুকিয়ে রাখত। এতে সাপের বেশ ‍সুবিধা হত। সাপ নিজে কষ্ট করে গর্ত খোঁড়ে না। সে  অপরের খোঁড়া গর্তে বসবাস করে। সাপ স্বর্ণ, রৌপ্যমুদ্রা বা ধনরত্ন চেনে না।  এ ধারণা একেবারেই ভুল । স্বাভাবিকভাবেই ধনদৌলত লুকিয়ে রাখার জায়গাটি খুব নিরাপদ ও  সুরক্ষিত হয়। সাপের প্রিয় খাবার ইঁদুর-ব্যাঙও ওই গর্তে যাতায়াত করে। সুতরাং খাদ্যের প্রলোভনে সাপ সেসব গর্ত বাস করার জন্য বেছে নেয়। গৃহস্থের লুকিয়ে রাখা ধনরত্ন পাহারা দেওয়ার জন্য নয়।

এমন ধারার অসংখ্য মুখরোচক গল্প, কল্পকাহিনি আমাদের সমাজে ছড়িয়ে আছে। সাপের বিষ নামানো, সাপের পা দেখা, সাপে-নেউলে সম্পর্ক, সাপের বিষ হজম করা ইত্যাদি। এগুলো সবই কুসংস্কার যা থেকে জন্ম নেয় অপবিজ্ঞান।