ছবির কারিগর / বেবী নাসরিন              

 

       ১৯২৩ সালের ১০ইআগষ্ট শিল্পী সুলতানের জন্ম যশোরের নড়াইলে মাছিমদিয়া গ্রামে। বাবা

মেছের আলী ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী, মা মেহেরুনেছা। স্কুলে পড়ার সময় দেখা যায় তিনি ছবি আঁকতে 

ভালোবাসেন । ১৯৩৮ সাল থেকে তিন বছরের জন্য তিনি কলিকাতা আর্ট কলেজে পড়াশোনা করেন। 

এ সময়ে উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও শিল্প সমালোচক অধ্যাপক হাসান শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর 

একান্ত সান্নিধ্য লাভ করে শিল্পকলা চর্চায় প্রচুর জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু প্রথাগত শিল্পশিক্ষায়

তার উৎসাহে ভাটা পড়ে। আর্ট কলেজের শিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই তিনি কলিকাতা থেকে 

বেরিয়ে যান ১৯৪৪ সালে । তারপর প্রায় দশ বছর ভারত ও পাকিস্তান এবং পরে আমেরিকা 

ও ইউরোপের অনেক দেশ তিনি ঘুরে বেড়ান। ছবি আঁকেন আর প্রদর্শনী করেন । পাবলো 

পিকাসো, সালভেদোর দালি ,পল ক্লী, ব্রাক- এর মত খ্যাতিমান শিল্পীদের সঙ্গে এক যৌথ প্রদর্শনীতে 

অংশ গ্রহণ করার গৌরব অর্জন করেন তিনি।

১৯৫৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং নড়াইলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এর

পরেও চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ভবঘুরে জীবন যাপন করেন  প্রায় বাইশ বছর। ১৯৭৬

সালে ছোট-বড় অনেক ছবি নিয়ে রীতিমত  নাটকীয়ভাবেই বাংলাদেশ শিল্পকলায় 

বিরাট প্রদর্শনী করে শিল্প রসিক ও শিল্পবোদ্ধাদের চমকে দেন। এরপর আর থেমে থাকেননি।

একের পর এক ছবি এঁকে গিয়েছেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছে ১০ই অক্টোবর ১৯৯৪ । তাঁর পুরো নাম শেখ

মুহাম্মদ সুলতান ।সবাই বলে এস,এম, সুলতান।

শিশুদের নিয়ে তিনি খুব ভাবতেন। শিশুরা যাতে প্রকৃতি থেকে কিছু শিখতে পারে, সুনাগরিক হিসেবে  

গড়ে উঠতে পারে সে জন্য শিশুদের শিক্ষা ও ছবি আঁকার প্রতিষ্ঠান ‘নন্দনকানন’ ও ‘শিশু স্বর্গ ‘

তৈরি করেছেন। 

বাংলাদেশ সরকার সুলতানকে ‘আটিষ্ট ইন রেসিডেন্টস ‘ এর সম্মানে ভূষিত করেছে এবং কেমব্রিজ 

বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে’ ম্যান অব এশিয়া ‘পদে ভূষিত করেছে। সুলতানের চিত্রের সংগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ দেশে বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তিগত সংগ্রহে।

দূরের মাঠ। ঘন নীল আকাশ। সবুজ সবুজ পাতায় ঘেরা বন। ছাতার মতো বটগাছ। ঝাঁকড় মাকড় বটের ঝুরি ঝাঁকড়া চুলের মত । পাশেই চিত্রা নদী কুল কুল বয়ে চলে । সেই নদীর ঘাটে বাঁধা একটা বড় নৌকা । যার নাম শিশু স্বর্গ। এই নৌকাতে ছোট ছোট বাচ্চারা ছবি আঁকে।

তারা কাগজের উপর লাল,নীল সবুজ রং দিয়ে নানা রকম ছবি আঁকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকে চলে । নৌকা ঘাটে ঘাটে ভেড়ে  দৃশ্যে বৈচিত্র্য আনতে। ছবিতে নানা রূপ ফুটিয়ে তুলতে। কত্ত আয়োজন।

বাচ্চাদের ছবি দেখতে প্রদর্শনীর আয়োজন হয় এস,এম, সুলতানের বাড়িতে। আবার কখন ও বটতলায়। মেলা হয় জমজমাট। এই মেলা বড় ছোটদের মিলনমেলা। বাঁশি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আনন্দ আয়োজন জমে ওঠে।

শ্যামল ছবি আঁকে।ও  মাঝে মাঝে ছবি আঁকা শিখতে যায় লাল মিয়ার কাছে।লাল মিয়া?   সেতো ছোটদের বন্ধু সুলতান। তাঁর ছবির চরিত্রে

তেজোদীপ্ত পুরুষ নারী। পেশীবহুল শক্তিশালী মানুষ।

তাঁর পোষা ইঁদুর ,গিগনিপিগ সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। হাতে থাকতো একটা বাঁশি। কখনো বাঁশিতে সুরের মুর্ছনায় ভরিয়ে তুলতেন । ঝাঁকড়া চুলের লম্বা শরীর । একটা কালো গাউন গায়ে থাকত । 

 একবার নড়াইল বয়েজ স্কুল মাঠে এক্সিভিশনের আয়োজন করা হয়েছে। শ্যামল এক্সিভিশনের ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশ 

নেবে । ভয়াখালীতে ওদের গাছপালাবেষ্টিত ছোট্ট বাড়ি। পরিপাটি সুন্দর। প্রাণ জুড়ানো পরিবেশ। আট ভাইবোনের সবার ছোট সে । চোখ ভরা স্বপ্ন। স্বপ্ন পুরণের ইচ্ছাগুলো অদম্য। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মত ডানা মেলে উড়ে চলে। আজ এক্সিভিশন শুরু হবে। সবাই দেখতে যাবে । ছবি   আঁকা কম্পিটিশনে অংশ নেবে। সঙ্গে যাবে মা বোন আর ভাইয়া। কখন যাবে তর সইছে না ওর। মা বললো, শ্যামল ,কোমল তোমরা খেয়ে 

বিশ্রাম কর । বিকাল পাঁচটায় আমরা বের হবো ।

ওরা গুছিয়ে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। অল্প রাস্তা পার করে এসে পড়ল। দূর থেকে দেখা গেল এক্সিভিশনের মাঝে একটা স্তম্ভ। স্তম্ভের চার পাশে এস,এম সুলতানের ছবি। মানুষের গুহা জীবন থেকে

ধীরে ধীরে উন্নত জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ক্রমান্বয়ে মানুষের চাঁদে পৌঁছান পর্যন্ত ছবিতে দেখানো হয়েছে।

ছবিগুলো অপূর্ব সুন্দর মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।।

এটা দেখতে দেখতে শ্যামল সকলের সাথে ভিতরে ঢুকল। বিকেলের পড়ন্ত মিষ্টি রোদে প্রদর্শনীর আঙ্গিনা উজ্জ্বল ঝলমল করছে। ঘুরতে ঘুরতে ওরা চলে এলো ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার স্থানে। শুরু হোল 

প্রতিযোগিতা ।সকলে মনের মাধুরি মিশিয়ে নানা রং ব্যবহার করে ছবি আঁকছে। একসময় ছবির সেই কারিগর এলেন ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন ।

 সবাইকে উৎসাহিত করলেন । দুদিন পর প্রতিযোগিতার রেজাল্ট 

হোল। শ্যামল প্রথম পুরস্কার পেল । বাড়িতে সকলে খুশি। পুরস্কার ছিল ডিমবাতি । তার জীবনের প্রথম আলোকবর্তিকা । আলোর মশাল হয়ে আছে।

শ্যামল  দেখতে পায় সোনালী দিনের সূর্য উঁকি দিচ্ছে।