ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া এক ক্ষণজন্মা পুরুষ
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া এক ক্ষণজন্মা পুরুষ
আমাদের দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা হাতে গোণা কয়েকজন। পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁদের অন্যতম। তিনি একজন মেধাবী নমস্য বিজ্ঞানী, প্রকৃত কৃতবিদ ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ডাকনাম সুধা মিয়া। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিল যে শিশুটি, যার ডাকনাম ছিলো সুধা মিয়া, তিনি যে একদিন অনেক বড় কিছু হবেন সেটার আভাস শৈশবেই পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল শৈশবেই। ১৯৫৬ সালে রংপুর জেলা স্কুল থেকে ডিসটিনকশনসহ প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর জীবনের প্রতিটি পরীক্ষাতেই তিনি অসামান্য মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। বিষয় ছিল পদার্থবিদ্যা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়ার সময় থেকেই তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৬১-৬২ শিক্ষা বছরের জন্য হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের চাকরিতে যোগদান করেন।
বিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্ব পরিসরে তাঁর যে ব্যাপ্তি তার অনেকটাই আমাদের অজানা। ১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাঁকে এসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি জার্মানিতে ‘আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ আণবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে তিনি পরপর দুবার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি পরপর তিনবার ওই বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থ বিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৭ সালে দুবছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে দুবছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।
অনেক ক্ষমতার মধ্যে ছিলেন তিনি, কিন্তু ক্ষমতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ক্ষমতার বলয়ে থেকে নিজেকে নিস্পৃহ এবং বিযুক্ত রাখার অসামান্য যোগ্যতা তাঁর ছিল। ক্ষমতাই যাকে স্পর্শ করতে পারেনি অপব্যবহারের কোন প্রশ্নই তাঁর ক্ষেত্রে আসেনা। তিনি চাইলেই অনেক কিছু পেতে পারতেন, করতে পারতেন, তিনি চাননি, করেননি।
তিনি ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। নম্র, ভদ্র, সদালাপী, নির্লোভ, নিরহংকার ও মানবিক গুণাবলীতে উজ্জীবিত পরিশুদ্ধ একজন খাঁটি মানুষ। আপন অবস্থানে থেকেই অনেক কাজ করে গেছেন তিনি। গবেষণাকাজে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তারঁ নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা ছিল অনুসরণীয় ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন তিনি। আর প্রিয়জনের মতোই কাজ করেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এর আগে ও পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসিত জীবন কাটান তিনি। এই সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে দেখাশুনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংরক্ষণ ও বিকাশেও তিনি (ড.ওয়াজেদ) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পদার্থ বিজ্ঞান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্রদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তাঁর লেখা ৪৬৪ পৃষ্ঠার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এবং ৩২০ পৃষ্ঠার ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ দুটিতে বঙ্গবন্ধুর শহিদ হবার পরবর্তী ঘটনাবলী মর্মদন্তু ঘটনাবলীসহ এদেশের রাজনীতির নানা চিত্র উঠে এসেছে।
তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়েই সবকিছু বিবেচনা করতেন। সেই বিজ্ঞানমনস্কতা তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি কর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। এটাই ছিল তার জীবনের অন্যতম বড় একটি দিক। কর্মজীবনে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে এই মানুষটি নীরবে, নিভৃতে, নিরলসভাবে গবেষণা করে দেশের উন্নয়নের জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তাঁর অপরিসীম জ্ঞান ও আন্তরিকতা আমাদের দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে বিশেষ অবদান রেখেছে। তিনি পরমাণুবিজ্ঞানকে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন আণবিক পাওয়ার প্লান্টের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। দেশের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রসারে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি শুধু একজন মেধাবী ছাত্র বা পরমাণুবিজ্ঞানীই ছিলেন না, নিভৃতচারী, নীতিবান, স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা, দেশপ্রেমিক, আদর্শবান, সৎ, সহজ-সরল, বিনয়ী, চরিত্রবান, যুক্তিবাদী, অজাতশত্রু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষ তিনি। তাঁর প্রতিভার অনেক দিকই আমাদের অজানা। তিনি ভিশনারি ছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল রূপপুরে একটি পরমাণু বিদ্যুকেন্দ্র চালু করা। দেশের বিজ্ঞানীদের পেশাগত কাজের উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য একটি বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ করা। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, তাঁর ইচ্ছার অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। বর্তমানে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।
২০০৯ সালের ৯ মে ৬৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ড. এম.এ ওয়াজেদ মিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি জনাব সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম কারিগর । তিনি বাংলাদেশকে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আর তাঁর নিরলস চেষ্টায় বাংলাদেশ আজ‘ ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেব আখ্যায়িত হয়েছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ব্যক্তিগত নিষ্ঠা ও তৎপরতার জন্যই পরমাণু বিজ্ঞানচর্চায় বাংলাদেশ অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। পরমাণু শক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বে সুনাম কুড়াতে পেরেছে।
কিন্তু এ কথা ভাবলে কষ্ট হয় যে, যতটা সম্মান তাঁর প্রাপ্য এই বিজ্ঞানীকে ততটা সম্মানিত আমরা করতে পারিনি। আমি মনে করি এই নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীকে ‘জাতীয় বিজ্ঞানী’র স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন বিজ্ঞানমনষ্ক গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বৃত্তি’ চালু করা ; তাঁর জীবন ও কর্মের নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘর নির্মাণ, একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন এবং তার কর্মময় জীবন ও ছবি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্তিকরণ ।
এই মৃত্যুঞ্জয়ী বিজ্ঞানীর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জানাই।
Facebook Comments Sync