দুপুরচণ্ডির প্রতীক্ষা পর্ব ৬

দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষায় আফরোজা অদিতি

ধারাবাহিক উপন্যাস

শিমুল ফিরে আসে একা। ওরা রাহাকে দেয়নি। বাড়ি নেই তমিজ। রাহার দাদী ইনিয়ে বিনয়ে বুক চাপড়ে চাপড়ে কেঁদেছে। দোষ দিয়েছে ইথিকার। বলেছে,‘কেমন মা, ছেলে রেখে চলে গেল একা। এখন আবার ঢং। ছেলে নিতে পাঠানো হয়েছে। না বাবা রাহাকে দেয়া যাবে না। রাহাকে ছাড়া এক দন্ডও থাকতে পারে না ওর ফুফু।’ শাশুড়ির কথা শুনে শিমুলের মনে সন্দেহ জাগে; কিছু বলতে না চেয়েও বলে ফেলে। ‘রাহাকে ছাড়া একদিন ওর ফুফু একা থাকলে কোন ক্ষতি হবে না খালাম্মা।’ এবারে শাশুড়ি মারমুখী হয়ে ওঠে।
‘না একদিনের জন্যও দেয়া যাবে না।’ এরপর শিমুল তর্কে যেতে পারতো, বলতে পারতো, রাহার ফুফু রাহাকে ছাড়া থাকতে পারবে না! সে কেমন কথা; তিনি তো রাহার ফুফু। আর রাহার মা ইথিকা, সে যে থাকতে পারবে না তা কিছু নয়! এসব কিছু বলে না শিমুল। তর্ক করতে ইচ্ছে করলো না। তাছাড়া মুরুব্বি মানুষ। তর্ক করতেও নেই আর তর্ক করে কোন লাভও হবে না তা বুঝতে পেরেছে শিমুল।
শিমুল চিন্তিত হয়। ইথিকা আর তমিজের মধ্যে কিছু হয়নি ত! শিমুল ভাবলেও এ বিষয়ে কোন কথা বলে না। ইথিকা নিজে থেকে না বললে কথা তুলতে পারে না ও। এই চার বছরে কেমন যেন একটা দেয়াল উঠেছে ওদের দুই জনের মাঝে; সে দেয়াল এতোটাই সুক্ষ্ম যে দেখা যায় না আবার ভাঙাও যায় না! এমনি বোধহয় ঘটে। ভাই- বোন যখন একসঙ্গে থাকে তখন সব ঠিকই থাকে, কিন্তু বিয়ের পর তাদের সম্পর্ক বদলে যায়! কেন সম্পর্ক বলে যায়? সব সম্পর্ক কী জলের মতো সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়!
ইথিকাকে কিছুই বলে না শিমুল। রাহাকে দেখতে চেয়েছিল কিন্তু রাহা বাসায় নেই। শিমুলকে মিথ্যে বলেছে ইথিকার শাশুড়ি। রাহা বাড়িতেই ছিল। ওর ছোট চাচার ঘরে। আসার মুহূর্তে টলোমলো পায়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল রাহা একঝলক; সঙ্গে সঙ্গে ওর চাচা ভেতরে নিয়ে গেছে। রাহার ছোট চাচা রফিক এবারে এম এ ফাইনাল দেবে। সে বাড়িতেই ছিল। কোথায় পড়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু বলেনি। ওদের সব বিষয়ে এতো রাখঢাক কেন বুঝতে পারে না শিমুল!
রাহাকে সঙ্গে আনেনি শিমুল। সেকথা জানাতে মেয়ের কাছে এসে দাঁড়ায় মা। ‘কি ব্যাপার বলতো ইথি, রাহাকে ওরা দিল না কেন?’ ‘রাহার ফুফু থাকতে পারে না ওকে ছাড়া।’ নির্বিকার জবাব মেয়ের মুখে। মা রেগে যায়। ‘আশ্চর্য মেয়ে তুই। রাহা তোর ছেলে, তুই রাহার মা, তোর কাছে থাকবে রাহা। রাহাকে ছাড়া ওর ফুফু থাকতে পারবে কি পারবে না তাতে কি যায় আসে!’
কথা বলে না ইথিকা। চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। মরিয়ম বেগম গজগজ করেন নিজের মনেই। আশ্চর্য ছেলের জন্য মায়া নেই। ছেলে রেখে একা একাই চলে এসেছে এ বাড়িতে। ঝগড়া করেছে নিশ্চয়। মা রাগ করেছে বুঝতে পেরেছে কিন্তু কিছুই বলে না।
মায়ের রাগের কারণ বুঝতে পারে ইথিকা। কিছুই করার নেই! এ বাড়ির কাউকে তো বলেনি সেই রাহা জন্মের পর থেকে তো এমনি চলে আসছে। মাকে বলেনি, শুধু মাকে নয় কাউকেই এ কথা বলেনি। একথা কী বলা যায়! ছেলে চেয়েছিল স্ট্যাম্পে সই করে, দেয়নি। দেবেই বা কেন? কেন দেবে। মনে মনে হাসে ইথিকা। না দিলেও কি বিশেষ কোন লাভ হয়েছে? হয়নি। দেয়া না দেয়ার কোন ফারাক হয়নি ওর জীবনে। জীবনে ফারাক না হলেও ফারাক হয়েছে ওর আর রাহার মাঝে। মা আর ছেলের দুরত্ব বেড়েছে। দিনদিন আরও বাড়বে তা জানে ইথিকা।
সকাল-সন্ধ্যা থাকে ফুফুর বাড়ি। ফুফু খাওয়ায় দাওয়ায় ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়ায়। ছেলেও হয়েছে তেমনি ফুফুর ন্যাওটা। ফুফুই ওর সব। ও কেউ না। কেউ না। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। মায়ের চোখ সেদিকে। মায়ের মনে খটকা লাগে। নিশ্চয় এমন কিছু ঘটেছে তা-না হলে মুখে কথা নেই ইথিকার; কেন? এই এক মেয়ে। মুখ ফুটে বলবে না কিছুই। ওর দিকে অপলক চেয়ে থাকে মা। কিছু বলে না। এই মুহূর্তে কিছু বলা ঠিক মনে করেন না মা। আগে তমিজের সঙ্গে কথা বলতে হবে তারপর ওর সঙ্গে।
‘কখন এসেছ মা।’ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে খুব খুশি হয় বাবা। ‘থাকবি তো?’
সেই যে বিয়ের পর চলে গেছে তারপর খুব একটা আসে না ইথিকা। বাবা খুব মিস করে মেয়েকে। অবশ্য বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতেই থাকে, ওটাই ওদের ঘর। এই সমাজ-সংসারে, এটাই নিয়ম! নিয়মটা অন্যরকম কেন হয় না! এতো কষ্টে আদরে সোহাগে বড় করে তুলে তারপর অন্যবাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়! কতো কষ্ট বুকে গহনে বাজে তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে। বাবা ভাবে, নার্সারী থেকে গাছ যেমন কিনে এনে অন্য বাগানে কিংবা টবে পুঁতে দেয় তেমনি মেয়েদের অবস্থা এই সমাজে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় এসে সময় কাটায়, বাড়ে, ফল দেয় ফুল ফোটায় তারপর একদিন ঝরে যায়। মেয়েরা বাবার সংসারে থাকে মাত্র কিছুদিন; তারপর ঠিকানা বদলে চলে যায় অন্য ঘরে, অন্য বাড়ি। মেয়ে যেন ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আসে বাবার বাড়িতে!
কেন এমন হয়! বাবা ভাবে। কেন ছেলেদের মতো মেয়েরা থাকতে পারে না চিরদিন বাবার ঘরে, বাবা-মায়ের কাছে। ছেলে আর মেয়েকে তো একই রকম আদর দেয়া হয়, একই রকম শিক্ষা-সহবত দেয়া হয়। ছেলে-মেয়ে দুজনের পেছনেই তো বাবা মাকে শ্রম দিতে হয়, তাহলে? বাবা ইথিকার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। । এখন ইথিকা তাদের কেউ না, ওই বাড়ি ইথিকার সব ঠিকানা। ইথিকা, তার ওই এক রত্তি মেয়ে, এখন তার বিরাট সংসার।
ইথিকার দুই জা। দেবরের এক মেয়ে। শ্বশুর-শাশুড়ি। বড় ননদের মেয়েও থাকে সারাদিন এ বাড়িতেই। ছোট আর এক দেবর লেখাপড়া করে। ইথিকার অনেক দায়, অনেক দায়িত্ব।
ওর কথা ভেবে বাবার বুকের ভেতরে টলটল জলের বুদবুদ ওঠে। আনমনা হয়। ছোটবেলার ইথিকাকে মনে পড়ে বাবার।
খুব অভিমানি মেয়ে। কখনও কোন কিছু চেয়ে বিরক্ত করেনি বাবা মাকে; যা দিয়েছে, খুশি থেকেছে তাতেই।
ওরা চা খেতে বসে একসঙ্গে। আবেগে আপ্লুত বাবা।
এবার কিন্তু যেতে পারবে না তাড়াতাড়ি।
ঠিক আছে বাবা।
হাসে ইথিকা। মিষ্টি হাসি।
মায়ের রাগ হয়। কেন রাগ হয় মা বুঝতে পারেন না। তবুও রাগ হয়। মনে মনে বলে আধিখ্যেতা!
চা এগিয়ে দেয় বাবাকে, মেয়েকে। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট। বাবার দিকে একটু ঝাঁঝ মেশানো কন্ঠে কথা ছুঁড়ে দেয়।
‘মেয়েকে থাকতে বলছ, ওর ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করেছ, আক্কেল বুদ্ধি যে কবে হবে তোমার।’
লজ্জিত হয় বাবা। ‘তাই তো মা, ছি ছি, কি কথা। আমি শুধু আমার মেয়েকে নিয়েই আছি। তোমার ছেলের কথা জিজ্ঞেস করিনি মা! তা মা, রাহা কোথায়, দেখতে পাচ্ছিনা তো! ওকে আননি?’ এদিক ওদিক তাকায় বাবা।
হেসে ফেলে ইথিকা। ‘থাক তোমাকে আর খুঁজতে হবে না রাহাকে। রাহা আসেনি। ওরা তো ওকে না দেখে….’
কথা শেষ করেনা ইথিকা।
‘ভালই হয়েছে। ওদের ছেলে থাক ওদের কাছে, আমার মেয়ে আমার কাছে।’ হা হা হেসে ওঠে বাবা। যেন ভীষণ এক রসিকতা করেছে মেয়ের সঙ্গে। বাবার এই কথা শুনে আরো রেগে যায় মা। ওরা চা খায়। কথা বলে। মা চুপচাপ। ওদের কথায় গল্পে যোগ দেয় না।
ইথিকার কথাটা খুব ভাবিয়ে তুলেছে মাকে। কেন এমন হ’ল। কী ঘটনা ঘটতে চলেছে বুঝতে চেষ্টা করে।
( চলবে)

আফরোজা অদিতি
আফরোজা অদিতি