দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা পর্ব  ৪

দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষায় আফরোজা অদিতি

রিকশা চলছে। কোথায় যাবে এখনও স্থির করতে পারেনি ইথিকা। যেখানে যাক ধরে নিয়ে আসবে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এতোদিনে ওদের চরিত্র বুঝে ফেলেছে ইথিকা। স্থির করলো মায়ের কাছেই যাবে। কিন্তু ও বাড়িতে এখন ভীষণ একা একা লাগবে তা জানে! বোনটা নেই; মারা গেছে ওর বিয়ের পরের বছর। মারা যাওয়ার দিন খুব অনুনয় করেছিল অর্পি। তমিজের কাছে বলেছিল,‘থাক না দুলাভাই, আপু আজকের রাতটা।’ অনুনয় রাখেনি তমিজ। ওকে নিয়ে এসেছিল, থাকতে দেয়নি। ও থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু যা নয় তাই বলেছিল তমিজ। শুধু বলাই নয় আর একটু হলে গায়েও হাত তুলতো। ওর সমঝে থাকার জন্য এতদিন গায়ে হাত ওঠায়নি, আজ উঠিয়েছে। আর এবার যখন গায়ে হাত উঠেছে তখন এই ধারা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এটা চলতে দেওয়া যায় না! অনেকদিক বিবেচনা করে, চিন্তা ভাবনা করে এতোদিন মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি! করতে পারলো ন ! এই সমাজ নিজে, পরিবারে মানিয়ে গুছিয়ে থাকা থেকে অন্য সব কিছুর দায় একজন নারীর কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে।  কিন্তু সব দায় তো একা নারীর নয়। নারী প্রগতি, নারী স্বাধীনতা অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে কিন্তু এই সমাজ দিনদিন পিছিয়ে যাচ্ছে! কেন? ওর মনে প্রশ্ন জাগলেও কারো কাছ থেকে এর সদুত্তর মেলেনি!  

     ওর রিকশা চলছে। সেই সঙ্গে ওর মন চলছে অতীতের ফেলে আসা পথে। আজ তো একেবারেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে; সেদিন যদি যেতো তাহলে বোনটার আবদার তো রাখতে পারতো! সেদিন কেন চলে আসেনি; কেন আসতে পারেনি? না হয় গায়ে হাত তুলতোই তাতে কি  হতো। ওর গায়ে হাত দেওয়া তো আর থামিয়ে রাখতে পারেনি, গায়ে হাত তো উঠলই শেষ পর্যন্ত! সেদিন যে বোনকে ছেড়ে চলে এসেছিল তমিজের ওপর রাগ করে, সেজন্য আজও ক্ষমা করতে পারে না নিজেকে। সেই রাতে চলে এল এ বাড়িতে। সকালেই এল বোনের মৃত্যুর খবর।  সে এক আশ্চর্য অনুভূতি! কান্না নেই চোখে। শুকনো চোখ; বুকের মধ্যে ঝড়, ঝড়ের সঙ্গে শুধু একটাই কথা, তুমি কথা রাখনি ইথিকা, মৃত্যু পথযাত্রী বোনের কথা রাখতে পারোনি। চোখ উপচে পড়ে জল, চোখ মোছে শাড়ির আঁচলে।

    ইথিকার রিকশা এসে থামে বাড়ির দরজায়। আসতে না চাইলেও আসতে হয় ওকে। সমাজ সংসারের কথা ভাবতে হয়। সমাজ সংসারের চেয়েও বড় কথা বাবা-মায়ের সম্মান। চিন্তা করতে হয় তাদের সম্মানের কথা। সব কথা চিন্তা করেই এ বাড়িতে ফিরে এসেছে ইথিকা। ভাড়া মিটিয়ে কলিংবেল চাপে ইথিকা। দরোজা খুলে দেয় আলী। মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ও। অবাক বিস্মিত মা! খুশিও হয়। খুশিতে উদ্বেল মা বলে,

 : ওমা একাই এসেছিস। রাহা কই, জামাই কোথায়?

মাথা নাড়ে ইথিকা। কথা বলে না। চোখ ভরে উঠতে চায় অশ্রুত, ঠেকিয়ে রাখে। মায়ের কাছে লুকোতে চায় সব। শুধু চায়ই না লুকিয়েই রাখবে, যতদিন পারে।

 রাহা ওর ছেলে।

দুই বছর বয়স. ও যখন বাড়ি থেকে চলে আসে তখন ঘুমিয়ে ছিল রাহা। ঘুমন্ত রাহাকে আনতে গিয়েছিল, দেয়নি ওকে। ছেলের ওপর কোন অধিকার নেই ওর। আশ্চর্য এই সমাজ সংসারের নিয়ম! যে ছেলেকে গর্ভে ধারণ করেছে,গর্ভ-যন্ত্রণা সহ্য করেছে নয় মাস তার ওপর কোন অধিকার নেই! অধিকার সব পিতার! অধিকার আদায় করতে গেলে আইনি-লড়াই লড়তে যেতে হবে! কিন্তু সেই আইনি লড়াই জিতে গেলেও তো সন্তানকে সব সময় কাছে রাখতে পারবে না মা! মায়ের কোন মূল্য নেই এই জীবনে। যদি কারো অবদান থাকে তা সর্বপ্রথমে থাকা উচিত মায়ের, তারপর বাবার! তারপরে অন্যান্যদের। ওর মন বিষণ্ন হয়ে যায়। মায়ের কথায় দুরন্ত ছেলেটাকে মনে পড়ে ওর। চোখ উপচে যায় জলে। জল লুকাতে উঠে যায় ওঘরে। 

     এখানে এলে সব সময় এই ঘরেই থাকে। দুবোনের ঘর। একটা খাট আছে, একটা আলনা আর ওয়ার্ডরোব। ওয়ার্ডরোবে এক ড্রয়ার ভর্তি বোনের জামা কাপড়, অন্য দুই ড্রয়ারে ওর আর রাহার কিছু কাপড়। ঘরের অন্য কোণায় ডাইনিং টেবিল। এ বাড়ির পেছন দিকে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। ধানক্ষেত। ওদের বাড়িটা বাসাবো ছাড়িয়ে মেরাদিয়ার দিকে যেতে মাদারটেক।

      ওরা যখন এ বাড়িতে এসেছিল তখন পেছনের ধানক্ষেত ছিল ঝিল, টলমল করতো পানি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলে মনে হতো এটা বাড়ি নয়, একটা জাহাজ। ওরা জাহাজের মধ্যে আছে। ওর খুব ভাল লাগতো। অবসর সময়ে ও জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতো ঝিলের দিকে। আজও জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ওই খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। ধানক্ষেতে সদ্য গজিয়ে উঠেছে ধানের চারা। খুব সতেজ সবুজ। ওর ভাল লাগছে। কষ্টের চোখে এই সবুজ ভাল লাগার আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে! তারপর চোখ থেকে বুকের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

      ‘ইথি

মায়ের ডাকে মুখ ফিরিয়ে তাকায় ইথিকা। ওকে এঘরে আসতে দেখে এসেছে মা-ও।

মায়ের মনে চিন্তার উঁকি ঝুঁকি। কিছু হয়নি তো মেয়ের। চার বছর হল গেছে এ বাড়ি থেকে, এমন করে তো কখনও আসেনি। ও যেমন চাপা স্বভাবের মেয়ে মনে মনে গুমড়ে মরবে, জ্বলবে, পুড়বে কিছুই বলবে না! ওর মুখে আজ পর্যন্ত কিছুই শোনেনি মা। যা শুনেছে ওর বান্ধবী শিল্পীর কাছে। শিল্পী বলেছে, ইথিকাকে খুব কষ্ট দেয় ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। বেতনের সব টাকা তুলে নেয় শ্বশুর তারপর হাত খরচ দেয় ন, এমনকি অফিসে যাওয়ার ভাড়াও নয়। হেঁটে হেঁটে নয় বাসে করে যায় অফিসে। মাস গেলেই চেক-এর জন্য চাপ দেয় শ্বশুর, সব-ই শুনেছে শিল্পীর কাছে। এতে নিশ্চয় নীরব সমর্থন আছে তমিজের! নাহলে এমন আচরণ কোন শ্বশুর করতে পারে না। অদ্ভুত মেয়ে বাবা,  কেন সব টাকা দিস! সারা মাস কষ্ট করে চাকরি করবি আর বেতনের অর্থ নিজের ইচ্ছামতো খরচ করতে পারবি না! কেন? 

   এ বিষয়ে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল মা।  জবাব পেয়েছিল,

: এসব বিষয়ে কথা বলো না তো মা। আমার ঐ সংসার নিয়ে কোন কথা বলতে ইচ্ছে করে না। শুধু এটুকু জেনে রাখ,  এ আমার ভাগ্য। মায়ের কথার জবাবে বলেছিল ইথিকা। ইথিকা ভাগ্য বিশ্বাস করে না, তবু মাকে বলেছিল একথা।

মা এখন চিন্তিত। ওকি বলবে কিছু। মায়ের নিজের মেয়েকে চিনতে বাকি নেই, সব মা-ই পারে তার সন্তানকে বুঝতে-চিনতে। আজ মা সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বলে,

: কিরে তুই রাহার কথা কিছু বললি না, উঠে এলি এখানে। জামাই বা এলো না কেন? বাড়ির সকলে কেমন আছে? কিছুই তো বললি না

 মায়ের কথার সাদামাটা উত্তর দেয় ইথিকা।

: কি বলবো মা। রাহা ঘুমিয়ে। ওরা ভাল।

( চলবে) 

আফরোজা অদিতি
আফরোজা অদিতি

 

%d bloggers like this: