দুপুরচন্ডির  প্রতীক্ষা (পর্ব ৮) – আফরোজা অদিতি

দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষায় আফরোজা অদিতি

রাকিবের ট্রেনিং শেষ হয়েছে তিনদিন আগে; জয়েন করেছে অফিসে।

ইথিকা কাজ করছে অফিসে। রাকিব দাঁড়ায় এসে ওর সামনে। ওর দিকে তাকিয়ে বলে ইথিকা

‘কি ব্যাপার, বলবে কিছু।’

‘হ্যাঁ, বাড়ি যাব। যেতে লিখেছে মা।’

‘কেন? কিছু হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ওর।

‘জানি না। লিখেছে তো মায়ের অসুখ।

ছুটির এ্যাপ্লিকেশন দিয়ে যায় রাকিব। দুই দিন ছুটি। শুক্র-শনিবার নিয়ে চার দিন।’

রাকিব চলে যায়। চারদিন পর অফিসে জয়েন করে কোন রকম ভনিতা ছাড়াই বলে ওকে।

‘মা বিয়ে ঠিক করেছিল, না করে দিয়ে এসেছি।’

‘কেন? মেয়ে পছন্দ হয়নি?’

‘পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নিয়ে তো মাথা ঘামাইনি।’

‘তবে!’ বিস্মিত কণ্ঠে বলে ও।

‘বিয়ে করব না।’

‘কেন করবে না? মা তো চাইবেই বিয়ে করাতে।  তা বিয়ে করবে না কেন?’

ওর কথার কোন উত্তর দেয় না রাকিব।

‘বিয়ে করবে না তা কী মেনে নিবে মা। তা ছাড়া মায়ের জন্য না হোক নিজের জন্য তো বিয়ে প্রয়োজন। একটা বিয়ে করলে দেখবে আর এই চাকরি ধরবে আর ছাড়বে সেটি চলে যাবে। এভাবে জীবন চলে না রাকিব। বিয়ে করো,  সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আমার আবার জীবন; তার আবার চলা না চলা।’ হতাশা ঝরে পড়ে রাকিবের কন্ঠে।

‘এটা আবার কেমন কথা হল। এমন কথা বলো না। জীবন সম্পর্কে এমন হতাশার কথা বলতে নে‘।’

জীবন একটাই । এই এক জীবনে মানুষ যা চায় তা সবসময় পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে খুশি থাকতে চেষ্টা করতে হয়।’ কথা বলতে বলতে মুখ তুলে তাকায় ইথিকা। রাকিবের চোখে মুখে আকুতি ঝরে পড়তে দেখে। আকুতির সঙ্গে ভালবাসা, ঘর বাঁধার স্বপ্ন, নিজেকে নিবেদন সব জড়াজড়ি করে আছে ওর চোখে। ইথিকা চোখ নামিয়ে নিয়ে কাজে মন দেয়।

 

অফিসে সবাই আসতে শুরু করেছে। ইথিকা সতর্ক হয়। কারণ গুঞ্জন কানে এসেছে। রাকিবের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তা বুঝতে পেরেছে ইথিকা। শুধু তাই নয়,  রাকিব কী চায় তা-ও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এসবে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না; মন চাইলেও মনটাকে চাপা দিয়ে রেখেছে। রাকিব দাঁড়িয়ে আছে। ইথিকা কঠিন হয়। বলে, ‘নিজের টেবিলে যাও রাকিব, কাজ কর।’

‘তাতো করবো। যদি একটা কথা বল।’ রাকিব যেন ছোট্ট এক জিদ্দি বালকের মতো কথা বলে।  ওর এই ছেলেমিপনা দেখে রেগে যায় ইথিকা। রাগ ঝরিয়েই বলে

,‘আমি কী বলবো বল? আর অফিস কি কথা বলার জায়গা রাকিব।’

‘তবুও  একবার যদি বল তুমি ভালোবাস আমাকে, একবার শুধু একবার।’ মিনতি ঝরে পড়ে ওর কণ্ঠে।

‘তোমার মাথা-টাথা খারাপ হয়েছে রাকিব, যাও তোমার টেবিলে।’ একটু জোরেই কথা বলে ফেলেছে ইথিকা। রাগ হলে নিজেকে সামলাতে পারে না ও।  এরপর মাথাা নিচু করে ফাইলে চোখ রেখে নিজেকে সামলে নেয়। তারপর আস্তে বলে, ‘সরি।’

রাকিব নিজের চেয়ারে চলে যায়। ফাইল নিয়ে কাজে মন দিতে চেষ্ট করে।  কিন্তু পারে না। ফাইল খুলে একটা চিঠি লিখে ইথিকাকে।

 

‘হৃদয় আমার,

তোমাকে অনেকদিন থেকেই একটা কথা বলব বলব,  কিন্তু পারছি না। সামনা সামনি দাঁড়িয়ে কখনই বলা হবে না আমার বুঝে গেছি। যেদিন বলতে গিয়েছিলাম সেদিনই যখন অবস্থার চাপে পড়ে বলা হয়নি আজও যে সামনে দাঁড়িয়ে মনের কথা বলা হবে তা আমি ভাবি না। আমি জানি আমার মনকথা কখনই তোমাকে বলতে পারবো না আমি! তোমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলতে পারি না, আমি ভালোবাসি ভালোবাসি তোমাকে। আর কখনও বলতে পারবো না তাও জানি আমি। তুমি মানবে কি মানবে না তা জানি না, জানতে চাই না। শুধু জানি আমি তোমাকে চাই। সকাল-সন্ধ্যা জীবনে মরণে তোমাকে চাই।

-রাকিব

বিঃ দ্রঃ দিয়ে আবার লেখে রাকিব। আমি তোমারই জন্য ওই চাকরিটা ছেড়ে ব্যাংকে জয়েন করেছি।

’ চিঠি লিখে ওর টেবিলে দিয়ে যায় রাকিব।

 

চিঠি পড়ে অবাক ইথিকা। কথা বলেনা। কাজ করে যায় আপন মনে। চিঠিটা দেওয়ার পর থেকেই ছটফট করে রাকিব। শেষে থাকতে না পেরে ছুটির সময়ে বলে, ‘জবাব দিলে না। আমি অবশ্য তোমার জবাবের অপেক্ষা না করেই মাকে বলে এসেছি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না।’

‘তুমি কি পাগল।’

ইথিকার মুখে এ কথাটা ছাড়া কোন কথা আসে না। রাকিবকে অবুঝ, অবোধ কিশোর বালক মনে হয় ওর। ম্যাচুউরিটি আসেনি এই মানুষটার। হাতে-পায়ে বড় হয়েছে কিন্তু বুদ্ধির পরিপক্কতা আসেনি। এতো বড় একটা দায়িত্বশীল পোস্ট হোল্ড করে অথচ এই রকম ছেলেমিপনা। অবাক হয় ইথিকা!  রাকিব ওর ভাবনার ধার ধারে না। বলে, ‘হ্যাঁ আমি পাগল। পাগল শুধু তোমার জন্য ইথি। আমি কিশোর বালক শুধু আমার রাই কিশোরীর জন্য। তুমি আমার কিশোরী রাই, জীবন মরণ যে আমি তোমারই গীত গাই, তোমারই প্রেম চাই।’

‘রাকিব এটা অফিস। এভাবে কী অফিস করে কেউ। বদনাম হয়ে যাবে। নানা জনে নানা কথা বলবে।’ শান্ত কণ্ঠে বলে ইথিকা।

‘তাহলে বল বিকেলে যাবে আমার সঙ্গে।’ অনুনয় ঝরে পড়ে রাকিবের কণ্ঠে।

‘ না। আমার ছেলে, স্বামী, আমার সংসার আমার জন্য অপেক্ষা করবে।’ রাগ করে ও।

‘করুক। এক আধটু অপেক্ষায় যায় আসে না কিছু।’

‘কি স্বার্থপর তুমি।’ ইথিকা ইচ্ছা করেই আঘাত করে ওকে। রাকিবের চোখ ছল ছল করে। নিজের জায়গায় গিয়ে বসে। পিয়ন এসে বলে, ‘ডিজিএম স্যার ডাকছে আপনেকে।’ ‘যাও আসছি।’ ডিজিএম সাহেবের  রুমে ঢোকে।

 

ডিজিএম ওকে বসিয়ে রেখে টেলিফোনে কথা বলে কিছুক্ষণ। কথা শেষ করে ওকে বলে, ‘দেখুন রাকিব সাহেব, আপনি একজন প্রিন্সিপাল অফিসার। আপনাকে বলার তো কিছুই নেই। আপনি কাজও ভালই করেন। কিন্তু ভাল কাজে তো সব কিছু মেনে নেওয়া যায় না।’

‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন স্যার; খোলাখুলি বলুন।’

‘আপনি ইথিকা ম্যামের টেবিলে দাঁড়িয়ে ওর কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন। ওর কাজের ক্ষতি করছেন। সব সময় একজনের টেবিলে বসে থাকাটাও দৃষ্টিকটু। এমন করলে বদলি করতে বাধ্য হবো।’

রাকিব কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। তাছাড়া এটা তো আর মিথ্যে নয় যে ও ইথিকার টেবিলে দিনের মধ্যে অনেকবার যায়,  কথা বলে। কথা না বলে চুপচাপ থাকে রাকিব। চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে হয় ওর কাছে।

‘ঠিক আছে যান।’

চেম্বার থেকে বের হয়ে আসে রাকিব। টেবিলে চুপচাপ বসে থাকে, সামনে খোলা ফাইল। কারও সঙ্গে একটা কথাও বলে না রাকিব। এমনকি ইথিকার সঙ্গেও না। ইথিকা অবাক। কী হলো হঠাৎ। চলে যায় দুই দিন। কথা বলে না রাকিব। উচাটন মন ইথিকার। যতদিন রাকিব কথা বলতো ততোদিন ও নানারকম ছলছুতায় ওকে কথা বলতে নিষেধ  করেছে। যাতা কথাও শুনিয়েছে এক-এক সময়। কখনও কখনও কথার জবাব না দিয়ে অপমানও করেছে কিন্তু আজ যখন কথা বলছে না রাকিব তখন ওর কথা শোনার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে বারবার। নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারে না ও। পায়ে পায়ে ওর টেবিলের সামনে দাঁড়ায় ইথিকা। ‘ব্যাপার কী একেবারে চুপ যে রাকিব।’

‘কিছু না, যাও তুমি।’

‘না যাবোনা। বল, কী হয়েছে?’

‘কি বলবো। আমি কথা বলি তোমার সঙ্গে ডিজিএমকে দিয়ে না বলিয়ে সরাসরি বললেই তো পারতে। কথা বলতাম না আমি।’

‘আমি বলেছি ডিজিএমকে। কে বললো একথা তোমাকে।’ আশ্চর্য হয় ইথিকা-ও।

‘কে আর বলবে, কেউ বলেনি, খোদ ডিজিএম স্যারই বলেছেন।’

‘না না এ মিথ্যা কথা। বিশ্বাস করো। তুমি কথা বললে তো ভাল লাগে আমার। আমি কেন….’ ইথিকা কথা বলতে বলতে ওর দিকে তাকিয়েই থেমে যায়। রাকিবের চোখে উপচে পড়া হাসি। ও লজ্জা পেয়ে কথা বন্ধ করে। রাকিবের ঠোঁটের কোণেও একচিলতে হাসি ফুটে ওঠে। ও বলে, ‘সত্যি।’

‘হ্যাঁ।’ আজ ইথিকা নিজের অজান্তেই ভুল করে বসে একটা। অবশ্য ইথিকার দোষ নেই। ওর মনের প্রত্যন্ত অতলে রাকিব নামের একটা সলতে জ্বলতে শুরু করেছে বেশ কিছুদিন ধরে। ভুলে ভুলে সেই সলতে আলো দিতে শুরু করলো। মনের দশদিক আলোতে ঝলমল করে উঠলো। রাকিবকে ভালবাসে কিনা বুঝতে পারেনি আজও তবে ওকে না দেখলে সব শূন্য ফাঁকা লাগে ওর। সেই শূন্যতা পূরণের জন্য নিজের সঙ্গে যুদ্ধ অহরহ, তমিজের সঙ্গে সমঝোতা, রাহার সঙ্গে সময় কাটাতে চাওয়া, সংসারে বেশী সময় দেওয়া।  কিন্তু সব দিক থেকে বাধা আসে ওর। বিশেষ করে তমিজের দিক থেকেই আসে বেশী বাধ।, সেখানে হার হয় ওর; ওর হেরে যাওয়া আর তমিজের লাগামহীন কথাবার্তাতে শূন্য হয় বুকের ভেতরে। আর সেই শূন্যাতায় জায়গা করে নেয় রাকিব। ও হেরে যায় ওর ভালবাসার কাছে; ওর চাওয়া-পাওয়ার কাছে। ওর সামাজিক বন্ধনের কাছে হেরে যায় ও।

সেদিন শুক্রবার। খাওয়া দাওয়া সেরে সেলাই নিয়ে বসেছিল ইথিকা। গান চলছে। রাধার মান ভঞ্জন। ‘সাজ সাজ রাই। তোমারে সাজাই শ্যাম সোহাগের ভূষণে।….’ গানে মগ্ন ছিল মন। ওর কীর্তন শুনতে সব সময়েই ভালো লাগে। কাজের অবসরে কীর্তন শোনে।

‘ভাবী।’

সেজ জা এসে দাঁড়ায়। ওর নাম লিমা। লিমা গাঁয়ের মেয়ে। লেখাপড়া তেমন জানে না। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল। তারপর ওর বাবা মা বিয়ে দিয়েছে। খুব ভাল মেয়ে। ইথিকা পছন্দ করে ওকে। লিমাও পছন্দ করে ইথিকাকে। লিমা এসে পাশে বসে। বলে, ‘ভাবী কি সেলাই করছো?’’

রাহার জন্য বুনতে থাকা সোয়েটারটা দেখায় ওকে। কি ডিজাইন, কেমন করে এই ডিজাইন সেলাই করতে হয় সব বুঝিয়ে দেয় ওকে।

লিমা সেলাই দেখে, কিছু একটা বলতে চেয়েও পারে না। বলে না। ইতস্তত: করে। ওর ইতস্তত: ভাব লক্ষ্য করে বলে, ‘কিছু বলবে? যা বলার বলে ফেল চটপট।’

‘মেজ ভাবীরা বাসা ঠিক করেছে।’ এই কথা  বলতে না চেয়েও বলেই ফেলে মেজ বউ।

 

ইথিকার সঙ্গে কথা বলাটা পছন্দ করে না এই বাড়ির কেউ। চুপি চুপি কথা বলে লিমা। লিমার কথা শুনে সেলাই করতে করতে থেমে যায় ওর হাত। বলে, ‘কি বললে, বাসা ঠিক করেছে, কোথায়?’

‘রায়ের বাজার। ওখানে কেন? কী হয়েছে? কার সঙ্গে বাসা নিলো, কেন নিলো?’ বিস্মিত কণ্ঠ ইথিকার।

‘কি জানি।’

 

কাকে জিজ্ঞাসা করবে ইথিকা। তমিজের সঙ্গেই তো কথা বলাই যায় না। কখনও ভাল মুখে ওর সঙ্গে কথা বলে না তমিজ। আর ওর শাশুড়ির সেই যে বিয়ের পর থেকেই মুখ চলছে তা থামেনি আজও। তার মুখেও ভালো কথা নেই। কোন কথা জিজ্ঞেস করলে কণ্ঠে তার মেদ থাকেই। মেদহীন কথা কখনও যেন বলতে পারে না ওর শাশুড়ি। বাড়িতে ননদ টুম্পা নেই, শরীফাও মায়ের মতোই। তবুও শরীফাকে জিজ্ঞাসা করা যায়। কিন্তু যেতে ভাল লাগছে না। লিমার কাছেই শুনতে চেয়ে জিজ্ঞেস করে। ‘ওরা আলাদা বাসা নিচ্ছে কেন? জানলে বলো।’

লিমা বলে, ‘কাউকে বলো না ভাবী। কালকে আম্মার সঙ্গে ঝগড়া লেগেছে মেজ ভাবীর। আর আব্বা মারতে উঠেছিল ভাবীকে।’

‘তাই নাকি। জানি নাতো।’

‘তুমিতো ছিলে অফিসে, জানবে কি ভাবে? তাও ঠিক।’ লিমা বলে।

‘এ কেমন কথা ঝগড়া-বিবাদ লাগতেই পারে, তাই বলে শ্বশুর বউ-এর গায়ে হাত দিবে। ছি ছি! বধু নির্যাতন আইনে মামলা করা উচিত।’

ইথিকার মেজাজ-মন দুই-ই খারাপ হয়। ভাবে,  এরা কেমন মানুষ, অসভ্য বর্বর! তাছাড়া ইথিকা জানে ওর শশুরের আক্কেলজ্ঞান একটু কম।  রগচটা মানুষ, রেগে যায় অল্পেই। আর কাকে কি বলতে হয় জানে না তাও।

 

মেজ জা, রিয়া শহুরে মেয়ে। এই একান্নবর্তী সংসারে থাকতে চায় না ও। ভালোলাগে না একসঙ্গে রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়া। শাশুড়ির সঙ্গে খিটির মিটির লাগে প্রায়ই কালও লেগেছে ওই রকমই। গতকালের ঘটনা আজই জানলো ইথিকা। কেউ যখন বলেনি, ও জানে না। লিমাকেও বললো না কিছু। বলতে ইচ্ছা করলো না।

মনে পড়লো রিয়াকে দিয়ে হেনস্থা করার কথা, অপমান করার কথা।  কতোভাবে ওই রিয়াকে দিয়ে হেয় করেছে সকলের সামনে শাশুড়ি তাও মনে আছে ওর। ওর মনে পড়ে এক সকালের কথা। এ বাড়িতে বিয়ের পর থেকেই সকালের নাস্তা ওই বানায়। ওর বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই দুই দেবরের বিয়ে হয়, ছোট ননদেরও। দেবরদের বিয়ের পরেও এই ব্যবস্থার নড়চড় হয় না।

শাশুড়িই বলেছে, ‘তুমি সারাদিন অফিসে থাক বউ মা, সংসারের কাজ তো করতে পারো না আর রিয়া বাড়িতে থাকে সব সময় সংসারের কাজই করে এ জন্য সকাল বেলাটা ছুটি দাও ওকে।’ আসল কথা সেটা নয়। রিয়া সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে পারবে না, সাফ কথা বলে দিয়েছে শাশুড়িকে। শাশুড়ির কথায় নাস্তার পাঠ হাতে তুলে নেয় ইথিকা। সেই সঙ্গে রাতের রান্না খাওয়ানোর ভারটাও ওর কাঁধে এসে পড়ে। ও মুখ বন্ধ করে কাজ করে, কিছু বলে না। ও বলতে পারতো চাকরির বেতনতো সব এই সংসারেই খরচ হয়। টাকাতো এমনি এমনি আসে না, মাথার ঘাম পায়ে ফেলেই কাজ করতে হয় অফিসে।  কিন্তু এসব কথা বলতে ইচ্ছা করে না ওর। বলবে কাকে নিয়ে। যাকে নিয়ে ওর শক্তি, যার পরিচয়ে পরিচয় এই সংসারে সে-ই তো থেকেও নেই। যে মানুষটার জন্য প্রাণপাত, সেই মানুষটা একটা ভাল কথা উচ্চারণ করেছে কিনা হাতড়ে ফিরলেও পায় না। পাবে না জানে তবুও হাতড়ে ফেরা! শাশুড়র কথায় কথায় অপমান, স্বামী কচকচানি, শ্বশুরের পুরো বেতন হাতিয়ে নেওয়া সবই সহ্য করেছ মুখ বুঁজে। কারণ একটাই; ও ঠিক করে রেখেছে এই সংসারে টিকে থাকবে, অন্তত:পক্ষে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করবে! পারবে কিনা জানে না তবুও চেষ্টা করে যাবে। আর সেই চেষ্টাই করে চলেছে আজ পর্যন্ত। শ্বশুর শাশুড়ির সব অপমান সহ্য করে ও। স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে থাকে ও। সকলে ভাবে যাওয়ার জায়গা নেই ওর, তাই থাকে। বাবা মা ওকে রাখতে চায় না। তাই থাকে। কেউ ভাবে না একাই থাকতে পারে ও; চাকরি করে নিজে, নিজের রোজগার। অন্যের মুখাপেক্ষি হতে হবে না কখনও। এরা সকলে ওর বিনয়কে, ভদ্রতাকে ওর নম্রতাকে দুর্বলতা ভাবে।

ও যে মনের দিক থেকে  কতোখানি সবল কেউ বোঝে না। ওকে বুঝতে চায় না কেউ। ও বড়দের সম্মান করতে, ছোটদের  স্নেহ করতে ভালবাসতে। সকলকে নিয়ে একত্রে থাকতে ভালবাসে ও! এসব কথা বুঝতে চায় না কেউ। সবাই মনে করে ওর যাবার জায়গা নেই তাই সব মুখ বুঁজে সহ্য করে। মনে মনে মুষড়ে পরে ইথিকা। গরম ভাপে যেমন ফুল মিইয়ে যায় তেমনি ওর মনটাও নিইয়ে যায়। রিয়া তো শাশুড়ির প্রাণের প্রাণ ছিল, ছিল প্রিয় বউ। কত সখ আহলাদ শাশুড়ির ওই বউকে ঘিরে। ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে কতোদিন বলেছে, এইটুকু মাত্র কচি বয়স, কারো মতো তো ধামড়ি মাগি না যে রোজ সকাল সকাল উঠে নাস্তা বানাবে সকলের জন্য। ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে কতোদিন ডেকেছে আহলাদ করে। রিয়া সোনা বউ, ওঠ, ওঠ।

ঝংকার দিয়েছে রিয়া। তবুও ডেকেছে শুধু ওকেই অপমান করতে, শুধুই ওকেই। আজ  এতো আদরের বউ এর সঙ্গে লাগে কেন?

কেন চলে যায়? রিয়া চলে যাচ্ছে খুশী হওয়ার কথা ইথিকার। কিন্তু ও খুশী হতে পারছে না কেন, কেন লিমাকে বলতে পারছে না, যাচ্ছে যাক। আমার কি? রিয়ার যাওয়ার কথা শুনে দুঃখ হচ্ছে ওর। ও কোন কথা না বলে, সেলাই করতে থাকে চুপচাপ।