দ্বিতীয়জীবন – কানিজ ফাতেমা

দ্বিতীয়জীবন - কানিজ ফাতেমা

এক.

গতমাসে আমি একটি কোর্স করেছি, কোর্সের বিষয়বস্তু ছিলো  ‘সাইকোসিস’।

কারো যদি মনে হয় এর মানে ‘সাইকোপ্যাথ’ বা তার কাছাকাছি কিছু, তাহলে ভুল। এর মানে হলো সিজোফ্রেনিক এর ছোট ভাই। লক্ষণ ব্যবহার প্রায় একই রকম। শুধু সিজোফ্রেনিয়া খুব গুরুতর অসুখ। আর সাইকোসিস সব মানসিক রোগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে সেই অসুখটাকে গুরুতর করে ফেলে।.

 

কোর্সটি করার আগে আমার এই বিষয়ে ভাসা ভাসা ধারণা ছিলো। ভাসা ভাসা ধারণা কোনো ধারণা না। বিশেষ করে ক্লিনিকাল সাইকোলজিতে না। পাকাপোক্ত ধারণা পাবো এই আনন্দে আমি তিনদিন আগে থেকে লাফাচ্ছিলাম। লাফালাফি করার আরো একটা কারণ হলো ১২ ঘন্টার এই কোর্সটি অত্যন্ত দামী ( প্রায় সাড়ে তিন হাজার ডলার ), এতো টাকা নিজের পকেট থেকে খরচ করে আমি কখনোই এই কোর্স করতামনা। আমার অফিস আমাকে স্পন্সরড করে।

 

কিন্তু লাফালাফি করে কোনো লাভ হলো না। এই কোর্স করতে যেয়ে দেখলাম সবাই পাকাপোক্ত ধারণা নিয়েই এসেছে। একলা আমি শিক্ষানবীশ।

 

আমার কপাল আরো খারাপ, কি জন্য যেনো আমি ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছিলাম। ট্রেইনার একজন অস্ট্রেলিয়ান লম্বা মহিলা। তিনি যেকোনো প্রশ্ন করেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন উত্তরের আশায়।  আর আমিও উদাসভাবে উনার দিকে তাকিয়ে থাকি উত্তরের আশায়। …

 

মহিলাটির নাম টমি। কোর্সের দুইদিনের  একদিনও আমি উনাকে হাসতে দেখিনি। অবশ্য মেন্টাল হেলথ এর বিষয়গুলো যারা পড়ায় তারা হাসি ঠাট্টা একটু কম করে। কিন্তু টমি টাইপ নাম আমার থাকলে , আমিও বোধহয় আজীবন মুখ গোমড়া করে থাকতাম।

 

টমি শুরুতেই একটা কুইজ দিলো  সবাইকে। কুইজটা হলো ‘তুমি জীবনে যা ভাবনি তা এই মুহূর্তে ভাবো এবং ভেবেই কাগজে লিখে ফেলো ‘ জীবনে কি ভাবিনি তা ভাবতে হলে পুরো জীবনটাকে আবার ভাবতে হবে , সেজন্য দীর্ঘ সময় দরকার।  কিন্তু আমাদের দেয়া হলো মাত্র দুই মিনিট।

 

গতকাল কি কি ভেবেছি সেটা ভাবতেই ৫/১০ মিনিট লাগার কথা। আর পুরো জীবনতো বিশাল ঘটনা।. অবাক ব্যাপার হলো,  ক্লাসের বাকি চৌদ্দজন ফটাফট লিখে ফেললো তাদের ‘অভাবনীয় জীবন’ আর আমি শূন্য খাতা নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলাম।

 

টমি আমার উপর বিরক্ত হয়ে লেকচার শুরু করলো। যেকোনো মানসিক অসুখের উপর ক্লাস বা ট্রেনিং এর আগে একটা কথা সবাইকে ক্লিয়ারলি বলে দেয়া হয়, তাহলো ক্লাসের কোনো পর্যায়ে তুমি যদি আর নিতে না পারো, তাহলে ক্লাস থেকে বের হয়ে তৎক্ষণাৎ একটা ব্রেক নেবে। সেটা যে কোনো কারণে হতে পারে।  কারণ মানসিক অসুখ খুব সেনসিটিভ ব্যাপার। এই বিষয় নেবার ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি একেকজনের একেকরকম। তোমার ক্যাপাসিটি নিয়ে লজ্জা বা অস্বস্তি হবার কিছু নেই। তোমার এই না নিতে পারার অর্থ হচ্ছে, জীবন তোমাকে এর চাইতেও বেশি কিছু দিয়েছে।

 

জীবন আমাকে কি দিয়েছে জানি না । তবে এই ক্লাস আমি ৪৫ মিনিটের বেশি করতে পারলাম না। শর্ট ব্রেকে বের হয়ে গেলাম প্রচন্ড মাথাব্যাথায়। চোখের পানি অনেক্ষণ আটকে রাখলে বুকের ভেতর যে শূন্যতা  তৈরী হয়, তা আমাদের ব্রেইনে যথেষ্ট অক্সিজেন সাপ্লাই এ বাধা দে। , আর তখন মাথাব্যথা হয়। এটা সেই টাইপ ব্যথা।

 

দুই.

কেসস্টাডি  আর ইন্টারভিউতে পরিপূর্ণ এই কোর্সের সবচেয়ে দুঃসহ অংশটি হলো,  এই রোগে আক্রান্ত মানুষগুলো কিভাবে বেঁচে আছে, কি যন্ত্রণা প্রতিদিন তারা ধারণ করছে এই বিষয়গুলো জানা।

 

সাইকোসিস কাঠখোট্টা বিষয়। এই বিষয়ে চাইলেই মজার কোনো গল্প লেখা যায় না। ইনফ্যাক্ট এই কোর্স শেষ করে যখন রাস্তায় বের হলাম তখন আমার মনে হয়েছে আমার আশে পাশে অনেকেই একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানেন না।

 

তথ্যটি হলো, আমরা সবাই দুইটা জীবন নিয়ে এই পৃথিবীতে আসি। মজার ব্যাপার হলো,  আমরা কেউই দ্বিতীয় জীবনে না যাওয়া পর্যন্ত প্রথম জীবনের অস্তিত্ব টের পাইনা। প্রথম জীবন আর দ্বিতীয় জীবনের মাঝের যে দেয়াল, সেটাকে বলা হয়,”পরীক্ষা ”

 

আমাদের সবার ,  সবারই জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে একটা কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। সেই পরীক্ষা এস এস সি বা এইচ এস সি পরীক্ষাগুলোর মতন পাস্ ফেল নির্ভর নয় বরং এসব পরীক্ষায় টিকে থাকাটাই জরুরি। এসব পরীক্ষার নানাবিধ নাম আছে।- এক্সিডেন্ট, ট্রমা, ডিভোর্স, মিসক্যারেজ, ক্রমাগত অর্থনৈতিক ব্যর্থতা, পরিবারের কাছের কাউকে হারানো এবং তারপরবর্তী জীবন । সেইসকল পরীক্ষার পর আমরা দ্বিতীয়জীবনে প্রবেশ করি। And we no longer the same person !

 

‘সাইকোসিসে’ যারা ভোগে তারা এই পরীক্ষাটা মেনে নিতে পারে না।  কিছুতেই তারা তাদের দ্বিতীয় জীবনে প্রবেশ করতে চায় না। তারা প্রতিনিয়ত দ্বিতীয় জীবন অস্বীকার করে।  প্রথম জীবনটা চায়। তারা ক্রমাগত অনুতাপ করে, ‘হয়তো এটা হইলে ঐটা হতো’ কিংবা ‘আহা জীবনটা আমার পাল্টে যেতো ঠিক ওই মুহূর্তে  ঐ ডিসিশনটা নিলে’।.

 

তারপর তারা হতাশা, বিষন্নতা, প্যানিক এটাক কিংবা বাইপোলারের মতন কঠিন সব রোগের জন্ম দেয়। তাদের দ্বিতীয় জীবন আস্তে ধীরে দুর্বিষহ হয়ে উঠে। তারা ডিলুশনাল বা ফ্যান্টাসিতে ভোগে তাদের প্রথম জীবন নিয়ে। …

তারপর..তারপর তারা না কোনোদিন প্রথম জীবন ফিরে পায়, নাদ্বিতীয় জীবনে কখনো প্রবেশ করতে পারে।. বাকি জীবনটা তারা পরীক্ষার হলে কাটিয়ে দেয়। মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, ‘প্রথম জীবন’ জীবনের ‘প্রথমেই’ আসে।

You can’t go back and change the beginning, but you can start where you are now and change the ending.

 

%d bloggers like this: