নর্তকী ও জনৈক ভদ্রলোক

নর্তকী ও জনৈক ভদ্রলোক অঙ্কনা জাহান

-এখন কেমন লাগছে মশাই?

মাথা মুছতে মুছতে জিজ্ঞাসা করল ঐন্দ্রিলা। সবেমাত্র গোছল সেরেছে সে। বিছানায় শুয়ে আছে আকাশ। ঐন্দ্রিলাকে দেখে উঠে বসল সে।

-ভালো। তবে আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কিছু খাবার হবে?

-আমি মানুষটা খারাপ হতে পারি। তবে এতটা খারাপ নই যে একজন ক্ষুধার্থকে না খাইয়ে রাখবো।

হেসে রান্নাঘরে চলে গেল ঐন্দ্রিলা। কিছুক্ষণ পরে এক থালা ভাত আর এক বাটি মাংস নিয়ে এল। বেডসাইড টেবিলে খাবারগুলো রেখে সে আবার বলল- নিন। এবার খেয়েদেয়ে কেটে পড়ুন। আমি মানুষ খারাপ। আমার কাছে খারাপ মানুষজনই আসে। আপনাকে আমার ঘরে দেখলে আপনার আর সমাজে মুখ দেখাবার জো থাকবে না।

ঐন্দ্রিলার কথার উত্তর না দিয়ে খাবারের দিকে তাকায় আকাশ। মাংস দেখেই চমকে ওঠে সে।

-একি মাংস? তাও আবার গরুর? আমি এসব খাই না।

-বাব্বাহ! আকাশ বাবু, আমি তো শুনেছি আপনি নাস্তিক। আপনিও এসব মানেন?

-মানা না মানার কি আছে? ঈশ্বর মানি না মানি, জাতে তো আমি ব্রাহ্মণ। জীবনে আজ পর্যন্ত আমি আমিষ ছুঁয়েও দেখিনি। সরান, সরান এসব আমার সামনে থেকে।

-হা হা হা। ঐন্দ্রিলার অট্টোহাসি ঘরময় প্রকম্পিত হতে লাগল।

-ধর্ম মানেন না অথচ জাত মানেন? হা হা হা, আপনি ভালোই মজা করতে পারেন দেখছি।

দৃঢ় গলায় আকাশ বলল- আমি মোটেও মজা করছি না মিস ঐন্দ্রিলা।

মুখ ভেংচে ঐন্দ্রিলা বলল- আমি ভেবেছিলাম নামের মত আপনার মনটাও বুঝি আকাশের মতই বিশাল। এখন তো দেখছি চিলেকোঠার ছাদ। হিপোক্রেট কাদের বলে জানেন?

-আমি মোটেও হিপোক্রেট নই।

আকাশ তীব্র প্রতিবাদ করে।

-তা তো দেখতেই পাচ্ছি। দু’কলম লিখেই আপনি নিজেকে অনেক বড় মানুষ ভেবেছিলেন। এই আপনি আমাকে একদিন রাস্তায় অনেক গালমন্দ করেছিলেন ‘নষ্ট মেয়েছেলে’ বলে। অথচ আপনার ভদ্র সমাজের কেউ আপনার বিপদে আজ এগিয়ে  এলো না। আপনি যখন রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন আপনার ভদ্র সমাজের লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এমন কথাও বলেছে অনেকে ‘আরে এই ব্যাটা তো নাস্তিক, ওকে সাহায্য করলে আমরাও নরকে যাবো।’ আপনার মুখে মানবতার বাণী শুনে বাহবা দেওয়া মানুষগুলোও শেয়ালের মত লেজ গুটিয়ে আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল।

-আপনি কি তবে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই আমাকে বাঁচিয়েছেন?

-কী যে বলেন মশাই! আমি অত হিসেব-নিকেশ করে কাজ করি না। করলে বোধ হয় আজ আপনার চোখে নষ্ট মেয়েছেলে হতাম না। ক্লাবে ক্লাবে ঘুরে আমাকে ডান্স করতে হত না। আপনি সেদিন বলেছিলেন আমি যুবসমাজকে নষ্ট করে দিচ্ছি। আমাকে কে নষ্ট পথে এনেছিল তা কি জানেন? জানেন না। আপনারা আমাদের বাহিরটাই শুধু দেখেন। মুখে মেকাপের প্রলেপ, ঠোঁটে জোর করে টানানো মেকি হাসি আর চোখ ধাঁধানো সাজ দেখেই মনে করেন আমরা এই রূপে, এই সাজে খুব সুখে আছি। ভেতরটা আপনারা দেখতে পান না। দেখতে পান না আমাদের মেকাপের আড়ালের মলিন মুখটা, ঠোঁটের মেকি হাসির আড়ালে অনেক কষ্টে চেপে রাখা কান্নাটা, সকল সাজ ভেদ করে ভগ্ন হৃদয়টা। কিছুই দেখতে পান না আপনারা। দেখতে চানও না হয়তো।

কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে ঐন্দ্রিলার। চোখের কোণে জমে শিশিরের ফোঁটার মত দু’এক বিন্দু অশ্রু। সন্তর্পণে তা মুছে নিয়ে বলে-এখন খেয়ে নিন তো। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। না খেলে ওষুধ খাবেন কি করে?

-আমি এসব খেতে পারব না। তাছাড়া আমি তো আপনাকে পছন্দ করি না বরং ঘৃণাই করি। আমার জন্য আপনি এত উতলা হচ্ছেন কেন?

-যদি বলি আপনাকে আমি ভালোবাসি, তাই?

-কি যা তা বকছেন? মাথা ঠিক আছে আপনার?  

অট্টোহাসিতে আবারো ঘর ভরিয়ে তুলল ঐন্দ্রিলা। সেই হাসিতে ঝরে ঝরে পড়তে লাগল ব্যঙ্গ। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতে লাগল সেই ব্যঙ্গাত্মক হাসি। আকাশের ভেতরটা ভয়ে কেঁপে উঠল। চোখে মুখে শংকার স্পষ্ট ছাপ। হাসি থামালো ঐন্দ্রিলা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল- খুব ভয় পেয়েছেন তাই না মশাই।

আকাশ কিছুই বলল না। বাঁকা হাসি ঠোঁটে টেনে ঐন্দ্রিলা আবারও বলল- আচ্ছা আকাশ বাবু, গো-মাংস খাওয়া হিন্দু ধর্মে পাপ, শুকোরের মাংস খাওয়া ইসলাম ধর্মে হারাম, আরো অনেক ধর্মে অনেক কিছু খাওয়া নিষেধ, মানুষের মাংস খাওয়া নিষেধ কোন ধর্মে বলুন তো?

-সব ধর্মেই। কোনো ধর্মই মানুষকে মানুষের মাংস খেতে বলেনি, বলবেও না কোনো দিন। এটা পাপ, মহাপাপ।

-তাহলে আপনারা পুরুষরা প্রতিনিয়ত যে মেয়ে মানুষগুলোকে চোখে, চিন্তায়, সশরীরে খেয়ে যাচ্ছেন আপনাদের পাপ হচ্ছে না? নাকি আপনারা পুরুষ বলে ধর্মেরও উর্ধ্বে?

-আমি মোটেও তেমন মানুষ নই।

-মিথ্যে কথা, আকাশ বাবু। আপনার প্রেমিকা, পাশের বাড়ির সুন্দরী বৌদি, পরিচিতা কোনো রূপসী ষোড়শীকে দেখে কি কখনোই আপনার মনে দোলা দেয়নি বলছেন? তাদের কাউকেই আপনার একান্তে পেতে ইচ্ছে করেনি?

মাথা নিচু করে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকল আকাশ। এই অবস্থায় আকাশকে দেখে ঠোঁটের কোণে সেই অদ্ভুত বাঁকা হাসিটা আরেকটু টেনে ঐন্দ্রিলা বলল- নিজেকে যতই ব্রক্ষ্মচারী বলুন, ভেতরে ভেতরে আপনিও একজন পুরুষ।

খাবারগুলো তুলে রাখছে ঐন্দ্রিলা। আকাশ হঠাৎ উঠে এসে তার সামনে দাঁড়াল। একটা হাত নিজের হাতে মধ্যে নিয়ে বলল-হ্যাঁ আমিও পুরুষ, আমারও অন্য অনেকের মত বিশেষ একজনকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে।

অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকাল ঐন্দ্রিলা। আকাশ তার চোখে চোখ রেখে বলল, কাকে জানো?

-কাকে? ঐন্দ্রিলার গলাটা কেন যেন কেঁপে উঠল।

-তোমাকে। আমাদের সুহৃদ সংগঠনে প্রায় তোমার নামে কুৎসা হত, খুব রাগ উঠত তোমার উপর। তখনো তোমাকে দেখিনি আমি। সবার কথা শুনে শুনে রাগ যেদিন তুঙ্গে উঠে গেল সেদিন গেলাম তোমার ক্লাবে। সেদিন তোমাকে দেখে ব্রক্ষ্মচারী আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল সাক্ষাত দেবীকে দেখছি আমি। বিসর্জনের দেবী। তোমার চটুল কথা, ব্যঙ্গাত্মক হাসি আর রসদ রসিকতার মাঝেও আমি বিষাদ দেখেছিলাম সেদিনই। তাই তোমাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করে গেছি, যাতে তুমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসো। আমি তোমার হাতে হাত রেখে মহাকালের পথে হাটতে চাই, সুদীপ্তা।

-আপনি আমার আসল নাম জানেন?

-যাকে এতোটা চাই, যার জন্য আমার বুকের ভেতর এতো এতো অনুভূতি, যার ভালোর জন্য নাস্তিক আমি ঈশ্বরের প্রার্থনায় বসে যাই তার সবটুকু জানবো না তা কি করে হয়।

ঐন্দ্রিলা কাঁদছে। তার চোখের জলে যেন বান ডেকেছে। আকাশ ঐন্দ্রিলার চোখের পানি মুছে দিয়ে দু’হাতে তার মুখটা ধরে আলতো উপরে তুলে বলল- ধরে নাও তোমার জীবনের এই অধ্যায়টা পেন্সিলে লেখা ভুল কোনো রচনা, ইরেজারে মুছে দাও একে। চল নতুন করে শুরু করি দুজনে মিলে।

নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো ঐন্দ্রিলা।

-তা আর হয় না।

-কেন হয় না?

-কেন হয় না তা আপনি জানেন না? হয় না কারণ বেশ্যাদের শুধু বাবু হয়, বর হয় না।

-কিন্তু তুমি তো তা নও।

-সমাজ তো তাই বলে। আর বললেন না পেন্সিলের লেখা ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলতে। ইরেজার দিয়ে না হয় সব লেখা মুছেই ফেললাম, লেখার আঁচড়টা মুছবো কি করে? আর আপনাকেই আমার জীবনে ধরে রাখবো কি করে? এই অভিশপ্ত অধ্যায়েই তো আপনার আগমন। তবে আপনাকেও যে মুছে ফেলতে হবে।

-আমায় ফিরিও না, সুদীপ্তা।

-আমারও যে ফেরবার পথ খোলা নেই। আপনি আসুন, আকাশ বাবু। আমার ক্লাবে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে।

-সুদীপ্তা! কাতর গলায় ডাকল আকাশ।

-চলে যান আকাশ বাবু। আপনি আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে আমি আর আপনাকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না। আর আপনাকে গ্রহণ করলে আমি চিরদিনের জন্য নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবো। আপনি কি তাই চান?

আকাশ আর কোনো কথা না বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দরজার বাইরে গিয়ে আবার ফিরে তাকাল। ঐন্দ্রিলা ঠাস্ করে তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে তাতে হেলান দিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল।

সুদীপ্তারা যখন ঐন্দ্রিলা হয়ে ওঠে তখন সমাজ জাগ্রত হয় কিন্তু সুদীপ্তাদের ঐন্দ্রিলা হয়ে ওঠার গল্পগুলো কেউ জানে না।

অঙ্কনা জাহান
অঙ্কনা জাহান

নর্তকী ও জনৈক ভদ্রলোক অঙ্কনা জাহান