নানা বাড়ির গল্প ০১

নানা বাড়ির গল্প ০১ ফিরোজ শ্রাবন

একদিন ছুটি হবে অনেক দুরে যাবো নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাবো। খুব ছোট বেলায় ”ছুটির ঘন্টা” সিনেমাটা দেখে অনেক কেঁদেছিলাম। গল্পের ছোট্ট ছেলেটাও নানাবাড়ি যাবে। তার জন্য ছুটির ঘন্টাটা ঠিকই বাজলো। কিন্তু বাথরুমে আটকা পড়ে যাবার কারণে তার আর বেড়াতে যাওয়া হল না । যখন স্কুল খুলল, ক্লাস আবার শুরু হল, দেখা গেল সেই ছেলেটি বাথরুমে মরে পড়ে আছে।এই স্কুলের বাইরের মাঠে কত ছেলেরা খেলাধূলা করলো, কত মাইকিং হলো। কেউ জানতেও পারলো না ছেলেটা স্কুলের বাথরুমে আটকা পড়ে আছে। আমি সবাইকে অনেক প্রশ্ন করেছি। কেউ বলতে পারলো না যে, কেন স্কুলে তাকে খোঁজা হল না। একটা গল্প মনে পড়ে গেল। এক লোকের বাম পায়ের অপারেশন। তো তার ফাইলে ভুলবশত ডাক্তার ডান পা লিখে রেখেছে। অপারেশন হলো । কিন্তু ব্যথা সারলো না। রোগীকে অপারেশন থিয়েটার থেকে নরমাল বেডে দেয়া হল। তখন রোগী তার বড় ভাইকে বললো, ভাই আমার তো বাম পায়ে ব্যথা, ডান পায়ে অপারেশন করলো কি জন্য? তখন বড় ভাই বললো, হারামজাদা চুপ কর, ডাক্তার শুনলে রাগ করবে। আর তুই কি ডাক্তারের চাইতে বেশি বুঝিস? আমার ক্ষেত্রেও তাই কেউ আমাকে বলতে পারলো না যে ছেলেটার স্কুলের বাথরুমে  কেন খোঁজা হল না। হয়তবা এমন না হলে সিনেমাটা তৈরি হত না। আমরা সমস্যা না বুঝেই সমাধান করি অথবা বুঝেও নিরুপায় হয়ে না বোঝার ভান করি। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা হয়ত সবার থাকে না। আমি সবার কথা বলছি না। আমি বলছি অসহায়দের কথা । তারা জানে ডাক্তারও কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। তবে তাদের ভুল ভাঙ্গে যখন তাদের আচরণের সাথে সাধারণ মানুষের সাথে মিল খুঁজে পায় না। কারণ তারা অসাধারণ। দামি গাড়িতে চড়ে লোকাল বাসের স্বাদ পাওয়া সত্যিই আসম্ভব। যাই হোক নানাবাড়ি বেড়াতে যাবো কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! সব ভাইবোন মিলে প্লান করছিলাম কোথায় কোথায় ঘুরবো, কোন কোন খালার বাসায় যাবো। আমার সব খালা বাড়ি প্রায় নানা বাড়ির কাছাকাছি। এই ধরেন ৫ থেকে ৭ কিলোমিটারের মধ্যে । শুধু আমার মায়ের বিয়ে হয়েছে সুদূর গোপালগঞ্জে। ভাল কথা, আমার নানাবাড়ি হচ্ছে রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলাতে। আমরা মায়ের কাছে শুনেছি মায়ের চাচা উপজেলার চেয়ারম্যান আর আমার নানা হোসেন পরামানিক মধ্যবিত্ত গৃহস্থলি করা এক সুখি পরিবার । মায়েরা ৫ বোন। সবার ছোট এক ভাই। সে হলো আমাদের সাইদুল মামা। মা বোনদের মধ্যে দ্বিতীয়। ছোটবেলায় যখন বুঝতে শিখেছি তখনই জেনেছি আমার নানাবাড়ি অনেক অনেক দূরে। মাকে বলতাম, সবার নানা বাড়ি কত কাছে আর আমাদের নানাবাড়ি এতদূরে কেন মা? মা বলতো, দূরের নানাবাড়ি অনেক মজার হয়। বার বার যেমন নানাবাড়িতে গেলে আদর থাকে না তেমনি দূরের নানাবাড়িতে গেলে অনেক আদর করে। মায়ের কথা শুনে আমরা যতটা খুশি হতাম, আড়ালে মায়ের চোখের জলের কারণ তাহলে কি তা বুঝতে পারতাম না। আমার মা ৩৮ বছরের সংসার জীবনে মনে হয় সর্বসাকুল্যে ৭ থেকে ৮ বার বাবার বাড়ি যাবার সুযোগ পেয়েছে। তাহলে গড়ে ৫ বছরে একবার বাবার বাড়ি যাবার সুযোগ পেয়েছে। এখনকার বউয়েরা কি আমার মায়ের কথা ভাববে নাকি মায়ের, বাবার বাড়ি না যাবার জন্য তার অপারগতাকেই দায়ী করবে? আমার মায়ের সংসার সামলে হয়ত বাবা মাকে মনে করার সময়ই থাকতো না। অথবা গভীর রাতে মায়ের চোখের জলে তার বাবা মাকে স্মরণ করার চেষ্টাটাও আমরা ব্যর্থ করে দিতাম। আমরা চাইলেই কি তার বাবা মায়ের অভাব পূরণ করতে পারতাম! হয়ত সেই চেষ্টাও আমরা কীভাবে করতে হয় জানতাম না। আমি কিন্তু আমার মাকে ভীষণ ভালবাসি এখনও, কারণ মা আমাকে সব ভাইবোনদের থেকে বেশি ভালবাসতেন । মা মনে করতেন বৃদ্ধ বয়সে আমিই হবো তার একমাত্র অবলম্বন। আমিও বলতাম, মা প্রয়েজনে আমি বিয়ে করবো না। মা আমার কথা শুনে খুশি হত কি না বুঝতাম না । তবে আমি  মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম আমার মা যতদিন জীবিত থাকে আমার যেন বিয়ে না হয়। আল্লাহ সত্যিই আমার চাওয়া পূর্ণ করেছেন।

 

চলবে…

ফিরোজ শ্রাবন
ফিরোজ শ্রাবন

 

%d bloggers like this: