নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এক অবিস্মরণীয় নাম

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এক অবিস্মরণীয় নাম রক্তবীজ ডেস্ক

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র  নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু | ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান আমাদের সবার জানা। তিনি আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী, বর্তমান ওড়িশার কটক শহরে |বাবার নাম শ্রী জানকীনাথ বসু।  যিনি কটক শহরের একজন বিখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। মা শ্রীমতী প্রভাবতী দেবী |

তিনি বাবা মায়ের চোদ্দ সন্তানের মধ্যে নবমতম । তাঁর মেজদা শরৎচন্দ্র বসু, যিনি তাঁকে খুব ভালোবাসতেন।  ছোট্ট নেতাজীরর খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি |

নেতাজীর মনে দেশপ্রেম জাগে তাঁর বাবার হাত কারণেই | যদিও তাঁর বাবা ব্রিটিশ শাসিত সরকারী অফিসে কর্মরত ছিলেন, তবুও তিনি তৎকালীন কংগ্রেসের সমস্ত অধিবেশনে যোগদান করতেন। তিনি সাধারণ মানুষের সেবা করতেন | তিনি স্বদেশী এবং জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষপাতী ছিলেন |

সুভাষচন্দ্র বসু পড়াশোনার বিষয়ে ভীষণ মনোযোগী ছিলেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কটকের এক প্রোটেস্ট্যান্ড ইউরোপীয় স্কুলে | ১৯০৯ সালে তিনি ভর্তি হন কটকের রাভেনশো কলেজিয়েট স্কুলে |

স্কুলে পড়ার সময় তিনি প্রিন্সিপাল বেনিমধাব দাসের ব্যক্তিত্বে বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরই সহযোগীতায় ছোট্ট সুভাষ, স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়তে আগ্রহী হয়ে পড়েন |

সুভাষচন্দ্র বসু পরবর্তীকালে তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও লেখা বই তাঁকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীতে পরিণত করেছিলো | স্বামীজির লেখা বই পড়েই তিনি তাঁর জীবনের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে পান |

নেতাজী ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতায় প্রথমস্থান অধিকার করেন । ১৯১১ সালে ভর্তি হন কোলকাতার প্রেসিডেন্সিতে। কিন্তু সেখানে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে ভারত বিরোধী মত পার্থক্যর জন্য ভীষণ সংঘাত শুরু হয় । সেই সংঘাতে সুভাষচন্দ্র ভারতীয় ছাত্রদের পক্ষে ছিলেন।  তাই তাঁকে এক বছরের জন্য কলেজ থেকে বহিস্কার করে দেওয়া হয়। পরীক্ষা দেওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়না | ১৯১৮ সালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিক সহ বি.এ পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি |

কোলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে সুভাষচন্দ্র বসু কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ফিজউইলিয়াম কলেজে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন । সেখানে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন।  তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান, কিন্তু বিপ্লব সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি হওয়ার জন্য সেই নিয়োগও প্রত্যাখ্যান করেন তিনি | চাকরি প্রত্যাখ্যান করার পর তিনি ইংল্যান্ড ছেড়ে ভারতে চলে আসেন । ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন তিনি | তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো  ভারতকে যেভাবেই হোক ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীন করে তোলা |

১৩ই এপ্রিল ১৯১৯, যখন অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড ও দমনমূলক রাওলাট আইন সমস্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে । এই পরিস্থিতিতে নেতাজী ‘স্বরাজ’  নামক একটি খবরের কাগজেলেখালেখি শুরু করেন। এসময় তিনি এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্বেও নিযুক্ত হন | চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৪ সালে কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নিযুক্ত  হন। এ সময় সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর অধীনে কাজ করতেন । চিত্তরঞ্জন দাশই ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু। তাঁর কাছ থেকেই সুভাষচন্দ্রের রাজনীতিতে হাতেখড়ি |

১৯২৫ সালে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দি করা হয়।  মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয় তাঁকে । সেখানে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। জানা যায়, তিনি তাঁর ২০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে, প্রায় ১১ বার গ্রেফতার হন ব্রিটিশদের হাতে তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তাঁর ভীতর জাতীয়তাবাদী মনোভাব, ব্রিটিশরা মোটেও পছন্দ করতো না। তাঁরা ভাষচন্দ্রের বাপারেসর্বদা সতর্ক থাকতেন |

১৯৩৮ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য ত্রিপুরা অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। সুভাষচন্দ্র বসু এই নির্বাচনে জয়লাভ করলেও গান্ধীজির বিরোধিতার ফলস্বরূপ তাকে পদত্যাগ পত্র পেশ করতে বলা হয়;  নাহলে কার্যনির্বাহী কমিটির সব সদস্য পদত্যাগ করবেন । এ নানা কারণে তিনি নিজেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন এবং “ফরওয়ার্ড ব্লক” নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এক অবিস্মরণীয় নাম রক্তবীজ ডেস্ক

এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।  যুদ্ধে ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশদের পক্ষে যোগ দেয় | ভারতবর্ষের এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণেসুভাষচন্দ্র বসু ভীষণভাবে ব্যথিত হন | তিনি সেই সময় গৃহবন্দি ছিলেন।  কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন দেশত্যাগ করার | তাঁর দলের একজন সদস্যকে নিয়ে তিনি, আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন | সেখানে গিয়ে তিনি প্রথমে বার্লিনে “ভারতীয় মুক্ত কেন্দ্র” গড়ে তোলেন।  তারপর ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান নেতা এডলফ হিটলারের সাহায্য চান | কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাহায্যের ব্যাপারে এডলফ হিটলারের কোনো ইচ্ছা ছিল না । এটা বুঝতে পেরে খুব দুঃখ পান | এরপর ১৯৪৩ সালে তিনি জার্মানি ত্যাগ করেন।  একটি সাবমেরিনে চেপে পোঁছে যান জাপানে, হিদেকি তোজোর সাহায্যের আশায় |

সেইসময় জাপানে রাসবিহারি বসু গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী | ১৯৪৩ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে তিনি সেই বাহিনীর দায়িত্ব তুলে দেন | নারী-পুরুষ মিলিয়ে এই বাহিনীতে মোট সৈন্য সংখ্যা ছিলো প্রায় ৮৫০০০ মতো | পরে অবশ্য এই বাহিনীর নাম বদলে “আজাদ হিন্দ” করা হয় |

 

সুভাষ চন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর তাঁর সৈন্যবাহিনীর হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী সে দলে যোগ দেবে । কিন্তু তা একদমই হয়নি | কারণ খুব সংখ্যক ভারতীয় সেনা সেই হামলার পর তাঁর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো |

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে যখন জাপান আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ করে , তখন তাঁর জাতীয় সেনাবাহিনীও আত্মসমর্পণ করে | ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫ সালে জাপানের তাইহুকু বিমানবন্দর থেকে প্লেনে করে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন নেতাজী।  মারা যান তিনি | যদিও তাঁর এই মৃত্যুর সত্যতা সম্পর্কে আজও মানুষ সন্দিহান| কেউ ঠি ভাবে জানে না যে, সেই দিনটির পর নেতাজীর কি হলো | অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই ঘটনা একদম ভুয়া | নেতাজীর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে উঁচুতলার কিছু ভারতীয় নেতারা এবং ইংরেজ সরকার মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করেন নৃশংস ভাবে |

যদিও এই তথ্যের কতটা সত্যতা আছে, তাও আমাদের কাছে এক রহস্য | কিন্তু নেতাজী ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যা করে গেছেন তা অবিস্মরণীয়| তিনি তাঁর কীর্তির জন্য অমর।  ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছেও অমর হয়েই থাকবেন |

 

%d bloggers like this: