পতাকার ফেরিওয়ালা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার

চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। উস্কো খুস্কো চুল আর শীতের শুষ্ক প্রভাবে ঠোঁট দুটো একদম ফেঁটে রক্ত গড়িয়ে পড়ার অবস্থা। পরণের জামাটি আর প্যান্টটিও ধুলোবালির আবরণ পড়ে নোংরা হয়ে গেছে।  বিষন্নতার চাদরে যেন মুখটি ঢেকে গেছে। তবুও যেন বেঁচে থাকার প্রবল তাগিদে পথচলা। বিজয় কি, বিজয়ের স্বাদ কেমন, বিজয়ের স্বাদ কতটা পেয়েছেন তিনি এসবের কিছুই জানেন না। সুদূর ফরিদপুর থেকে রামগঞ্জে এসেছিলেন কাজের সন্ধানে। কিন্তু কাঙিক্ষত কোন কাজ তার ভাগ্যে মেলেনি। পরে বাড়ির বিভিন্ন আসবাবপত্র ও গরু ছাগল বিক্রি করে ছোট খাটো কোন ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরপর বিভিন্ন জিনিসপত্র ফেরি করে চলতো তার সংসার। ডিসেম্বরে একটু বাড়তি লাভের আশায় পতাকা বিক্রির কাজ হাতে নেন। এসব ছোট খাটো বেচা-বিক্রিতে যে অর্থ মেলে তা দিয়েই চলে তাঁদের সংসার। এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম, তিনি পতাকা বিক্রেতা শাকিল। শাকিল এর পতাকা বিক্রির অভিজ্ঞতা খুবই অল্প। তবুও যেন পতাকা বিক্রিতে তার আনন্দের শেষ নেই। শাকিলের বিশ্বাস,  পতাকা বিক্রি শুধু লাভজনক ব্যবসা নয় সম্মানজনক অবস্থানও। এভাবে ভাবতেই তার ভালো লাগে।

 

ছিলেন ফেরিওয়ালা বিক্রি করতেন মেয়েদের ব্যবহারের চুড়ি,আলতা, স্নোসহ হরেক রকম প্রসাধনী। কিন্তু হঠাৎ তার এক বন্ধুর দেখাদেখি ১ মাসের জন্য নেমে পড়লেন ভিন্ন রকম এক ব্যবসায়। আর সে ব্যবসাটা জাতীয় পতাকার। বাংলাদেশের ইতিহাস তেমন ভালো জানেন না শাকিল। কারণ লেখাপড়া তেমন করা হয়ে উঠেনি তার। মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। বাড়ি ফরিদপুরে হলেও জীবিকার তাগিদে থাকেন লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ থানায়। এখানে থেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জিনিস ফেরি করেন।

শাকিলের পরিবারে স্ত্রী, ২ ছেলে বাবা-মা সহ ৫ সদস্য। পুরো পরিবারের সকল খরচ শাকিলকেই বহন করতে হয়। তার বাবা এক সময় অটোরিক্সা চালালেও এখন বয়সের ভারে আর পারেন না। ২ ছেলের একজন পঞ্চম শ্রেণি আর অপর জন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারের খাবার যোগাড়, অসুস্থতার সময় চিকিৎসার খরচ আর ছেলেদের পড়াশুনার খরচ যোগাতে শাকিলের খুবই হিমশিম খেতে হয়। এদিকে  তার বাবা অতিবৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ওষুধ তার নিত্যদিনের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ওষুধের জন্যও বাবার ভরসা শাকিলের উপর। সব মিলিয়ে শাকিলের চাহিদার চেয়ে আয় খুবই স্বল্প।

 

কিন্তু ডিসেম্বর এলেই মানুষ যে পতাকা কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে,  সেটা এক বন্ধুর কাছে জানতে পেরে এ বছর পতাকা বিক্রির ব্যবসাটি হাতে নেন। তবে লোকে কিনতে চায় না বলে তেমন ব্যবসা হয় না।  পতাকার ব্যবসা ধরার পর শাকিলের জমানো পুঁজির অর্ধেকই যেন শেষ হয়ে গেছে। কাল্পনিক মানুষগুলো এখন পতাকার চেয়ে মোবাইল ফোনে ছবি ব্যবহারেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পতাকা তেমন বিক্রি হয় না। মোবাইল ফোনের স্টিকার আর ছবি দিয়েই মানুষ এখন পতাকার প্রয়োজন  মিটিয়ে ফেলে।

তারপরও শাকিলের কাছে রয়েছে বিভিন্ন দামের পতাকা। ১০ টাকা থেকে শুরু করে শত টাকায় বিক্রি হয় পতাকাগুলো। কেউ কেনে আর কেউ দেখেই চলে যায়।

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বিজয়ের বহু বছর পেরিয়ে এখন আরো নতুন করে কিছু পাবার আশায় পা রাখছে বাংলাদেশ। সে খবর হয়তো শাকিল ভাল করে জানেও না। তবু সে পতাকা বিক্রি করতে আনন্দ পায়। দেশ ও দেশের পতাকাকে ভালোবাসে শাকিল তার নিজের মতোই।

শাকিল বলে, কাম কইরা যে টাহা পাই ঐডা দিয়া কোন রহমে সংসার চলে। কোন কামেই শান্তি পাই না। তাও তো বাইচা থাকনের জন্য কোন না কোন কাম করন লাগে। পতাকা বেইচা যে ভালো কামাই তেমনও না। লোকে অহন পতাকা কিনতে চায় না। বন্ধুরা কইলো ব্যবসা ভালো অইবো হের লাইগা রাস্তায় নাইম্মা পড়ছি। তয় কামডা কইরা টাহা না পাইলেও আনন্দ পাই। লাল-সবুজের পতাকা বিক্রি করতে খুবই আনন্দ লাগে। যুদ্ধ তো দেহি নাই, হুনছি এই পতাকার লইগা কত মাইনসেরে মরতে হইছে। আমাগো লাইগাই তো তারা জীবনের মায়াও ত্যাগ কইরা মাইরা গেছে। তাগো মনে রাখনের লাইগাই আমাগো এ পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা উচিত।

মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার