ফুটপাতের দোকান / আফরোজা পারভীন

 

ঢাকা শহরসহ সারা দেশের ফুটপাত জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য দোকান।  এসব দোকান যারা দেন তারা স্বল্প আয়ের মানুষ, তাদের পুঁজি  কম। ভাল জায়গায় দোকান ভাড়া নেয়ার সক্ষমতা তাদের নেই। শপিংমলে দোকান নেয়ার কথা তারা কল্পনাও করতে পারেন না। তাই তাদের আশ্রয় নিতে হয় ফুটপাতে। স্বল্প পুঁজি দিয়ে তারা শুরু করে কোন একটি পণ্যের দোকান। জামা কাপড়, ফল ফুল, সাজের জিনিস থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় চাল ডাল সবজি মাছ ভাত তরকারি রুটি ভাজাভুজি  সবই বিক্রি হয় ফুটপাতে। কেউ কেউ ফুটপাতেই পণ্য সাজিয়ে বসেন, কেউ ঠেলায় রেখে বিক্রি করেন। যাদের সামর্থ্য একটু বেশি তারা টিনের চালা মাথারউপর দিয়ে , একটি শোকেস আর দু চারখানা চেয়ার বেঞ্চ দিয়ে সাজিয়ে তোলেন দোকান। এসব দোকানের  ক্রেতা স্বল্প আয়ের মানুষেরা। মুটে মজুর থেকে শুরু করে বেসরকারি চাকুরে পিয়ন দারোয়ান এরাই ক্রেতা। এই দোকানগুলো না থাকলে স্বল্প আয়ের মানুষেরা খুবই বিপদে পড়ত। 

দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে পোশাক আশাক কোনোটাই নাগালের মধ্যে নেই। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের অবস্থা শোচনীয়। এক বেলা খেলে আরেক বেলা খেতে পায় না এমনই অবস্থা। স্বল্প বেতনের চাকুরেদের হাল অনেকটা এদের মতই। মাসের প্রথম সপ্তাহ যেতে না যেতেই বেতনের টাকা তলানিতে এসে ঠেকে। তারপর টেনে টুনে এক বেলা আধবেলা খেয়ে দিন কাটে তাদের । ধার দেনা হয়ে যায় । সে ধার শুধতে আরো দেনা হয়। তাই ফুটপাতের দোকান ছাড়া এদের উপায় নেই। বিশেষ করে দুই ঈদ আর পুজোয় এরা ভেঙে পড়ে ফেুটপাতের ছোট ছোট দোকানগুলোতে। আলো ঝলমল বড় বড় বিপনীবিতান থেকে যখন বড়লোকেরা গাড়ি বোঝাই করে জিনিস কেনে এরা তখন ফুটপাতের দোকান থেকে অনেক দামাদামি করে সবার জন্য একটা করে সস্তা কাপড় কিনে পরিতৃপ্তি বোধ করে। বাড়িতে স্ত্রী সন্তানও পথ চেয়ে থাকে তাদের ফেরার অপেক্ষায়। রোজার সময় সামান্য ইফতারির জন্য দরিদ্র জনগণ ছোটে এই দোকানগুলোর দিকে। এ বাটি  মুড়ি আর দুটো পিঁয়াজু দিয়ে এরা রোজা ভাঙে।  

এই দোকানগুলো দরিদ্র, হতদরিদ্র আর  নিম্নমধ্যবিত্তের ভরসার জায়গা। কিন্তু এরাও নিরাপদে দোকান করতে পারে না। মাঝে মাঝেই সিটি কর্পরেশন দোকানগুলো ভেঙে দেয়। নিয়মিত  চাঁদা  দিতে হয় পাড়ার মস্তান, পুলিশ আর রাজনীতিবিদের চামচাদের। এই চাঁদাগুলো যদি না দিতে হতো তাহলে আর একটু সস্তায় তারা জিনিসপত্র বিক্রি করতে পারত। 

শহরের রিক্সাচালক , গাড়িচালক, মুটে মজুরের দুপুরের খাবার জোটে ফুটপাতের এই দোকানগুলো থেকে। একটা বনরুটি আর দুটো কলা খেয়েই তারা দুপুরটা পার করে দেয়। পয়সা থাকলে তারা এক কাপ চা খায়, না থাকলে সেটাও খায় না। ফিল্টার পানি ওরা পায় বিনা পয়সায়। সেটাই ঢকঢক করে খেয়ে পেটের  খালি  অংশ  পূর্ণ করে প্যাডেল বা চাকা ঘোরায় বা মোট মাথায় নেয়। 

আমরা রাস্তা চলতে মাঝে মাঝেই বিরক্ত হই। অনেক সময় রাগ করে বলি,  ফুটপাত দখল করে রাখলে হাঁটব কী করে? মানুষের হাঁটা চলা করতে অসুবিধা হয় এটাও ঠিক। কিন্তু এরাই বা করবে কী? সামর্থ্যহীন এই মানুষগুলোর সংসার আছে, সংসারের মানুষগুলোর মুখ আছে, পেট আছে। তাদের ক্ষুধা পায়। সে ক্ষুধার জোগান দিতে হয় পরিবারের কর্তা  অথবা গিন্নীকে । কাজেই অন্যায় জেনেও ফুটপাতে তাদের বসতে হয়। 

যদি সমাজে  বৈষম্য না থাকত,  সবার অবস্থা সমান হতো তাহলে তাদের ফুটপাত দখল করে দোকান করতে হতো না। কিন্তু অসম সমাজ ব্যবস্থা তাদের ব্রাত্য করেছে। তাই তারা ফুটপাতে।