বিদেশীদের চোখে বাংলাদেশের গণহত্যা

বিদেশীদের চোখে বাংলাদেশের গণহত্যা আফরোজা পারভীন

(পূর্ব প্রকাশিতর পর)

 

রেভারেন্ড জন হেসটিংসে ও রেভারেন্ড জন ক্ল্যাপহাম এর বিবরণ:

 

কলকাতার সদর স্ট্রিটের মেথডিস্ট চার্চের রেভারেন্ড জন হেসটিংসে ও রেভারেন্ড জন ক্ল্যাপহাম এপ্রিল মাস থেকেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয়প্রার্থীদের শিবিরে ত্রাণ কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তাঁরা যা দেখেন, শোনেন, তার বর্ণনা দিয়ে লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ানে চিঠি পাঠান। দ্য গার্ডিয়ানে ওই চিঠি “ইস্টবেঙ্গল ট্রাজেডি” শিরোনামে ১৯৭১ সালের ২৭ মে ছাপা হয়। সেই মর্মন্তুদ বিববরণ:

আমরা খবরের কাগজের সংবাদদাতা নই। সেরা সংবাদের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানোর সময়ও আমাদের নেই। আমরা দুজনে পশ্চিম বাংলায় আছি ২০ বছর। ত্রাণ কাজ পরিচালনার সময় শত শত শরণার্থীর সাথে আমাদের আলাপ হয়। পূর্ব বাংলার ঘটনাবলি এখন আমাদের কাছে ছবির মতো স্বচ্ছ, পরিষ্কার। কোন অস্পষ্টতা নেই। গুলি করার জন্য লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছিল এমন অবস্থা থেকে বেঁচে বাসা বহু লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, এমন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও রয়েছে শত শত।

দিনে এবং রাতে যে কোন সময় ঘেরাও করা হয়। ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা পালিয়ে যায় অথবা তাদের যেখানে পাওয়া যায় হত্যা করা হয়। কিংবা মাঠের মধ্যে তাড়িয়ে নিয়ে খুন করা হয়। মহিলাদের ধর্ষণ করা হয় এবং কিশোরীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা ব্যারাকে। হাজার হাজার নিরস্ত্র জনগণকে কামান দেগে অথবা বেয়নেট বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে।

সাত সপ্তাহ পরও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। এমন কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে, শিশুদের শূন্যে ছুঁড়ে দেয়া হয় বেয়নেট গাঁথার জন্য। মহিলাদের উলঙ্গ বুক বরাবর বেয়নেট চার্জ করা হয়। শিশুদের টুকরো টুকরো করা হয়। এ সব কাহিনি বিশ্বাস করতে হয়েছে এই কারণে যে, যারা বলেছে তাদের কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। বলেছে একেবারেই সাদামাটা ভাষায়।

মা’র হাত এবং শিশুর পা কাটা অবস্থায় পেয়েছি। এগুলো ঘটেছে সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। বুলেটে সৃষ্ট ক্ষতস্থানে গ্যাংগ্রিন দেখা দিয়েছে। পালিয়ে আসা অনেকেই দেখেছে তাদের কন্যাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। শিশুকে আছড়ে মেরে ফেলা হয়েছে। অনেকে দেখেছে তাদের সন্তান এবং পৌত্রদের হাত এক দড়ি দিয়ে বেঁধেছে এবং পুরুষমানুষ নির্মূল করার জন্য তাদের গুলি করেছে।

কোন যন্ত্রণাহর ঔষধ মেয়েটিকে শান্ত করতে পারছে না। সে এখন বনগাঁ হাসপাতালে আছে। কাঁদছে, প্রলাপ বকছে, “ওরা আমাদের মেরে ফেলবে-আমাদের মেরে ফেলবে।” তার পাশের বেডে শুয়ে আছে একটি মেয়ে। এখনো সে ভয়ে কাঁপছে। সারাদিন ধরে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তারপর যৌনাঙ্গে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হয়েছে।

ভারতে আসার পথে চুয়াডাঙ্গায় ৪শ’ লোককে ঘেরাও করে হত্যা করা হয়। কী কারণে? সেখানে যা ঘটছে, তা তারা ভারতে এসে প্রকাশ করে দেবে? অথবা এ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বেছে নেয়ার খেসারত কী?

সম্ভবত সব চেয়ে জঘন্য হচ্ছে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নির্মূল করার জন্য নেয়া ব্যবস্থা। তাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি চালানো হয়। মাত্র কয়েকজন বেঁচে এসেছে। তারাই গুলি চালিয়েছে যারা আগের দিনও তাদের সঙ্গে একই মেসে থাকতো, ছিল বন্ধু। সমগ্র পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, এ তারই প্রতীক। (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস: প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪০৩-৪০৪)

 

সিদ্দিক সালিকের বর্ণনা

…‘দেশপ্রেমিক’ পাকিস্তানিদের খবরের উপর ভিত্তি করে তারা (পাকিস্তান সেনাবাহিনী) প্রায়শই ‘সন্ধান ও উচ্ছেদ অভিযান’ চালাতে লাগলো। একদিন একজন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক এক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক আইন সদর দফতরে আসেন। বারান্দায় হঠাৎ করে তার সাথে আমার দেখা। আস্থাভরে ফিসফিসিয়ে তিনি বললেন, “বিদ্রোহীদের সম্পর্কে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর আছে তার কাছে।’ আমি তাকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে তিনি বললেন, ‘বালকটি তার ভাইয়ের ছেলে। সে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পার কেরানীগঞ্জের বিদ্রোহীদের বন্দি শিবির থেকে পালিয়ে এসেছে।’ বালকটি আরো বললো, ‘বিদ্রোহীরা শুধু স্থানীয় লোকজনদের হয়রানি করছে না-রাতে শহর আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়েছে।’

তৎক্ষণাৎ ‘উচ্ছেদকরণ অপারেশন’ এর আদেশ দেয়া হলো। হামলা পরিচালনার জন্য বাছাইকৃত সৈনিকদের কমান্ডারকে ব্রিফ করা হলো। ভোরের আগে লক্ষ্যকে ‘নমনীয়’ করার উদ্দেশ্যে গোলাবর্ষণের জন্য ফিল্ড গান, মর্টার ও রিকয়েললেস রাইফেলস প্রস্তুত করা হলো। সূর্যোদয়ের আগেই স্থানটি দখল করার জন্যে সৈনিকরা সাঁড়াশি অভিযান চালাবে।

আমি অপারেশন রুমে বসে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের অগ্রগতি লক্ষ্য করছিলাম। সেখান থেকে গোলাবর্ষণের আওয়াজ পরিষ্কার শ্রুতিগোচর হচ্ছিল। যুদ্ধে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও যুক্ত হয়। অনেকে এই ভেবে ভীত হলো যে পরিবেশিত খবর অনুযায়ী আক্রমণকারী ব্যাটালিয়ন ৫ হাজার বিদ্রোহীকে পাকড়াও করতে সক্ষম হবে না। সূর্যোদয়ের পরপরই অপারেশনের সমাপ্তি ঘটে। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে, নিজেদের পক্ষে কোন হতাহত ছাড়াই আমাদের সৈনিকরা লক্ষ্যকে শত্রুমুক্ত করেছে।

যে অফিসারটি আক্রমণ পরিচালনা করে, সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা করলাম। সে যা বললো তাতে রক্ত আমার হিম হয়ে গেল। দৃঢ় বিশ্বাস ভরে সে বললো, ‘ওখানে কোন বিদ্রোহী ছিল না। ছিল না অস্ত্র। শুধু গ্রামের গরীব লোকেরা-অধিকাংশই নারী এবং বৃদ্ধ, গোলার আগুনের মাঝে পুড়ে দগ্ধ হয়েছে। (লেখক মাসুদুল হক অনুদিত সিদ্দিক সালিকের সালিকের নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-১০৫-১০৬)

(চলবে)