বিদেশীদের চোখে বাংলাদেশের গণহত্যা

বিদেশীদের চোখে বাংলাদেশের গণহত্যা আফরোজা পারভীন

অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের রিপোর্টের নেপথ্যের কথা

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ঢাকা থেকে বিদেশী সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হয়। বের করে দিয়ে পাকিস্তান সরকার কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল যে, সারা পূর্ববাংলা জুড়ে তারা যে ভয়াবহ নির্যাতন করছে বিশ্ব তা জানতে পারবে না। কিন্তু ভারতে আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীর ঢল নামা শুরু হলে দলে দলে বিদেশী সাংবাদিক সেখানে গিয়ে হাজির হন। তারা শরণার্থীদের কাছ থেকে ও অন্যান্য সূত্র থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে পাঠাতে থাকেন নিজেদের খবরের কাগজে। ফলে পাকিস্তান সরকার বিপদে পড়ে। তারা একের পর এক মিথ্যা খবর প্রচার করে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তখন তারা উপলব্ধি করে যে, তাদের পক্ষে মিথ্যে লেখার জন্য একজন সাংবাদিক দরকার। তারা তার মাধ্যমে বিশ্বকে জানাতে চাইছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগ রাজনৈতিক নয় সামরিক। সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈন্যদের বিদ্রোহের কারণে যত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং বিদ্রোহ দমনে যতখানি শক্তি প্রয়োগের দরকার ঠিক ততটাই করা হয়েছে তার বেশি নয়। যা লেখা হচ্ছে তা ডাহা মিথ্যা। এইসব লেখানোর জন্যে একজন সাংবাদিককে খুঁজে বের করা হলো। এ ব্যাপারে পাকিস্তানি সেনা অফিসার সিদ্দিক সালিকের ভাষ্য ছিল:

ব্যাপকহারে বাঙালি সৈনিকদের স্বপক্ষ ত্যাগের কারণেই যে বড় রকমের গোলমাল সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে তুলে ধরে আমাদের বক্তব্য প্রচারের জন্য একটি সংবাদপত্রের এক প্রতিনিধিকে খুঁজে বের করা হলো। (লেখক মাসুদুল হক অনুদিত সিদ্দিক সালিকের নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল: পৃষ্ঠা-১০২)

আর এই সাংবাদিক হচ্ছেন করাচি মনিং নিউজের সহকারী সম্পাদক অ্যান্থনী মাসকারেনহাস। পাকিস্তানে লন্ডন টাইমসেরও প্রতিনিধি তিনি। তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি ঢাকায় আসেন। মোট ১০ দিন থাকেন। এখানে অবস্থানকালেই ১৯৭১ সালের ১ মে তিনি লন্ডন সানডে টাইমসে একটি রিপোর্ট করেন। ওই রিপোর্টটি ছিল অনেকটাই অসম্পূর্ণ।

পূর্ব বাংলা সফর শেষে করাচি ফিরে গিয়ে মাসকারেনহাস পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করেন। এরপর তিনি যান লন্ডনে। সেখানেই বসেই তৈরি করেন তার মূল রিপোর্ট ‘গণহত্যা’। লন্ডন সানডে টাইমসে সেটা প্রকাশিত হয় ১৩ জুন, ১৯৭১ এ। এবং স্তম্ভিত হয়ে যায় সারা বিশ্ব। এই প্রথমবারের মতো একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের কাছ থেকে বিশ্ব জানতে পায় পাকিস্তানের সংহতি ও পবিত্র ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীরা পূর্ব বাংলায় ভয়ঙ্কর নৃশংসতায় গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এই পোর্ট প্রকাশের পর অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ওপর ভয়ানক চটে যায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। তার জন্যে পাকিস্তান হয়ে যায় নিষিদ্ধ দেশ এবং করাচিতে অবস্থানকারী তার স্ত্রী হন গৃহবন্দী। শেষপর্যন্ত বৃটিশ সরকারের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্ত হন। তাকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

গণহত্যা শিরোনামে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের রিপোর্ট

ভাগ্য আবদুল বারীকে প্রতারিত করলো। পূর্ব বাংলার আরো হাজার হাজার মানুষের মতোই ভুলটা করলো সে, মারাত্মক ভুল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের চোখের উপর দিয়েই দৌড়ে পালাচ্ছিল সে। হালকা পাতলা মানুষটি। বয়স ২৪। সৈন্যরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। সে কাঁপছিল। তারা তাকে গুলি করতে যাচ্ছিল।

যেহেতু সে দৌড়াচ্ছিল এসব ক্ষেত্রে আমরা সাধারণto গুলি করি। বললো নবম ডিভিশনের জি-২ অপস এর মেজর রাথোর, যেন খোশ গপ্পো করছেন, এইভাবে। কুমিল্লা থেকে ২০ মাইল দক্ষিণে মুজাফফরগঞ্জের কাছাকাছি একটি ছোট্ট গ্রামের উপকন্ঠে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। বললেন, শুধু আপনার কারণেই ওর উপর তল্লাশি চালাচ্ছি। আপনি এখানে নতুন এবং আমার মনে হচ্ছে আপনি কিচুটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের।

গভীর উদ্বেগাকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তাকে মেরে ফেলবেন?

কেননা সে একজন হিন্দু অথবা বিদ্রোহী। একজন ছাত্র অথবা আওয়ামী লীগের লোকও হতে পারে। ওরা জানে তাদেরকে আমরা বাছাই করছি। দৌড় মেরে ওরা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রতারিত করছে।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেন তাদের মারছেন? আর হিন্দুদেরই বা কেন খুঁজছেন? রাথোর রুষ্ট কন্ঠে বললো, আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য তারা কী ই না করেছে। এখন যুদ্ধের অজুহাতে ওদেরকে শেষ করে দেয়ার চমৎকার সুযোগ এসেছে।