বিদেশীদের চোখে বাংলাদেশের গণহত্যা

বিদেশীদের চোখে বাংলাদেশের গণহত্যা আফরোজা পারভীন

(পূর্ব প্রকাশিতর পর)

হিন্দুর বিলয়ন

অস্থি মজ্জায় কাঁপন ধরানো সামরিক কার্যক্রমের দুটি স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান। হত্যার মতো অপ্রিয় শব্দের বদলে একটি কোমল শব্দ ব্যবহার করতে কর্তৃপক্ষ অধিকতর পছন্দ করে। পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বশ্য উপনিবেশ বানানোর যে প্রক্রিয়া চলছিল,  সাধারণভাবে উচ্চারিত এবং সরকারীভাবে বার বার প্রজ্ঞাপিত “দুষ্কৃতকারী” “অনুপ্রবেশকারী” শব্দ দুটি হচ্ছে সেই ধাঁধার অংশই-যা দিয়ে বিশ্বকে বোঝানো হচ্ছে। প্রচারণাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে বাস্তবতাটা দাঁড়াবে ‘উপনিবেশকরণ’ এবং ‘হত্যাযজ্ঞ’।

হিন্দু বিলয়নের যৌক্তিকতা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তার এক রেডিও ভাষণে শব্দের মারপ্যাচে তুলে ধরেছিলেন। ১৮ এপ্রিলে দেয়া ওই রেডিও ভাষণ আমি শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তান সৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারা একে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু এক উগ্র ও আক্রমণাত্মক সংখ্যালঘিষ্ঠ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবন ও সম্পদের প্রতি হুমকি সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মতামত দাবিয়ে রেখেছে। আর এরাই আওয়ামী লীগকে ধ্বংসাত্মক পথে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।”

অন্যরা, যারা ঘরোয়াভাবে বলেন, তারা হিন্দু বিলয়নের যৌক্তিকতা অত্যন্ত স্থুলভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।

কুমিল্লার অফিসার মেসে নবম ডিভিশনের সদর দফতরের কর্নেল নঈম বললেন, “হিন্দুরা তাদের অর্থ-কড়ি দিয়ে মুসলিম জনগণের ক্ষতিসাধন করে চলেছে। তারা প্রদেশকে রক্তশূন্য করে ফেলেছে। অর্থ,  খাদ্যদ্রব্য এবং পণ্য সীমান্তের ওপারে পাচার হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও কলেজ এবং স্কুলের শিক্ষকদের অর্ধেকেরও বেশি তারাই। অথচ তাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার জন্য পাঠায় কলকাতায়। বাঙালি সংস্কৃতি এমন একটা পর্যায়ে উপনীত হয়ে গেছে যে, সেটা মূলত হিন্দু সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আর পূর্ব পাকিস্তান কলকাতার মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই ভূমির প্রতি যারা বিশ্বস্ত, তাদের হাতে এটা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমরা ওদের প্রত্যেককে বাছাই করবো।”

অথবা মেজর বশিরের কথাই ধরা যাক। সাধারণ সেনা স্তর থেকে সে এসেছে। কুমিল্লার নবম ডিভিশনের এস এস ও। গর্ব করেই বললো, ২৮ জনকে সে হত্যা করেছে। যা ঘটেছে সে ব্যাপারে তার নিজের যুক্তি রয়েছে। সবুজ চায়ে চুমুক দিয়ে আমাকে বললো, “এ হচ্ছে পাক এবং নাপাকদের মধ্যে যুদ্ধ। এখানকার লোকদের নাম মুসলামন বটে এবং নিজেদের এরা মুসলমান বলেও কিন্তু মনে প্রাণে এরা হিন্দু। এখানকার ক্যান্টনমেন্ট মসজিদের মৌলভি শুক্রবার জুমার নামাজে ফতোয়া জারি করে এই বলে যে, যারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হত্যা করবে তারা জান্নাত পাবে। জানি কথাটি আপনার কাছে অবিশ্বাস্যই মনে হচ্ছে। আমরা এই জারজটিকে বাছাই করেছি। আর অন্যদেরও বাছাই করছি। এখানে একমাত্র খাঁটি মুসলমানই বেঁচে থাকবে। আমরা তাদেরকে উর্দুও শেখাবো।”

সবখানেই দেখেছি অফিসার ও সৈনিকরা নিজস্ব ধারণার অনুকূলে কাল্পনিক যৌক্তিকতা খাড়া করেছে। আদতে যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা- বাঙালিরা নির্বাচনে বিজয়ী হয় এবং দেশ শাসন করতে চায়- এই সমস্যার ভীতিকর “সমাধানের” পক্ষে এবং তাকে আইনসিদ্ধ করার জন্য বলির ছাগলও জোগাড় করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঞ্জাবিরা সরকারি নীতিতে তাদের প্রভাব ও স্বার্থ যেভাবে অক্ষুণ্ন রেখে এসেছে, তাকে ধরে রাখার জন্য এতটুকু ভাঙন তারা মেনে নেবে না। সেনাবাহিনীর সর্মথন রয়েছে তাদের পেছনে।

ঘরোয়া আলাপচারিতায় সরকারি কর্মকর্তারা তাদের নেয়া পদক্ষেপের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন সেনাবাহিনী পৌঁছানোর আগে অবাঙালি হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ হিসেবে। কিন্তু ঘটনাই বলে দেয় এই হত্যাকান্ড কোন স্বতঃস্ফূর্ত অথবা বিশৃঙ্খলার প্রতিক্রিয়া নয়-এ সুপরিকল্পিত।

 

জেনারেল টিক্কা ক্ষমতায় আসীন হলেন

স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, “বাছাই প্রক্রিয়ার” পরিকল্পনা তখন থেকে শুরু হয় যখন পূর্ববাংলায় গভর্নর পদটি সুজন, আত্মপ্রচার বিমুখ অ্যাডমিরাল আহসান ও সেখানকার সামরিক অধিনায়কত্ব পন্ডিতসুলভ লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা খানের কাছ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান গ্রহণ করেন। এটা মার্চ মাসের প্রথম দিককার কথা। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় তখন শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠে। ওই জাতীয় পরিষদের সৈন্যদের অব্যাহত অবমাননা সামরিক প্রশাসনের উঁচু স্তরে ক্ষোভের সঞ্চার করে। বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি প্রণয়নে ঢাকায় পাঞ্জাবি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড তার প্রাধান্য বজায় রাখে। (সম্ভবত এটা উল্লেখের আবশ্যকতা রয়েছে যে, খানরা একে অপরের সঙ্গে আত্মীয়তা সূত্রে আবদ্ধ নয়। খান পাকিস্তানে একটি সাধারণ বংশপদবী)।

২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বিদ্রোহ দমনে প্রাথমিক আঘাত হানার জন্য যখন ঢাকায় সেনাবাহিনীর ইউনিট ছড়িয়ে পড়ে সে সময় তাদের সঙ্গে একটি নির্মূল তালিকা ছিল। ওই তালিকায় হিন্দুরা ছিল। তেমনি ছিল বিরাট সংখ্যক মুসলমানও। ছিল ছাত্র, আওয়ামী লীগের লোকজন, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং শেখ মুজিবের আন্দোলনে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন, তাঁরাও। তখন প্রকাশ্যে অভিযোগ আনা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হল থেকে সেনাবাহিনীর ওপর মর্টার ছোঁড়া হয়। এ অভিযোগ দু’টি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা-রমনা রেসকোর্সের ভেতরের মন্দিরের চারপাশের বসতি এবং পুরোনো শহরের কেন্দ্রস্থলে শাঁখারিপট্টি ধ্বংসসাধনের পক্ষে ন্যায্য যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো যায় না। এমন কী এর ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি-কেন ২৬ ও ২৭ মার্চ দিবারাত্র সান্ধ্যআইন বলবৎ থাকাকালে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী শিল্প শহর নারায়ণগঞ্জের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু নিখোঁজ হয়ে যায়। একইভাবে সান্ধ্য আইন চলাকালে যে সব মুসলমাদের আটক করা হয় তাদেরও কোন খোঁজ নেই। এই মানুষগুলোকে পরিকল্পিত অপারেশনের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে।

১৫ এপ্রিল ঢাকা সফরে এসে দেখতে পেলাম ইকবাল হল হোস্টেলের ছাদের ওপর চার ছাত্রের কর্তিত মাথা পচছে। হলের তত্ত্বাবধায়ক বললেন, ২৫ মার্চ রাতে এদের হত্যা করা হয়েছ্। এক এবং দোতলা সিঁড়ির ওপর রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। চারটে রুমেও ছিল রক্তের দাগ। ইকবাল হলের পেছনে একটি বিরাট আবাসিক ভবন। দেখে মনে হলো সেনাবাহিনী একে বিশেষ মনোযোগ সহকারে বাছাই করেছে। বুলেটবিদ্ধ হওয়ায় ভবনের দেয়ালে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সিঁড়ি থেকে তখনও দুর্গন্ধ ভেসে আসছে যদিও প্রচুর পরিমাণে ডিডিটি পাউডার ছড়ানো হয়েছে। প্রতিবেশিরা জানালেন ২৩ জন নারী এবং শিশুর লাশ ঘন্টা খানেক আগে ঠেলা গাড়িতে করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ২৫ মার্চ সেগুলি ছাদের ওপর পচছিল। নানা প্রশ্নের ভেতর দিয়ে অবশেষে জানা গেল মৃতদেহগুলি ছিল কাছাকাছি এলাকার হিন্দু বস্তির। সেনবাহিনীর হামলা শুরু হতেই তারা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল।

এক একটি গণহত্যা ঘটানো হয়েছে বিস্ময়কর আকস্মিকতায়। ১৯ এপ্রিল সকালে কুমিল্লার সামরিক আইন প্রশাসক মেজর আগার অফিসে বসে তাৎক্ষণিক বিচার পদ্ধতি এবং শাস্তি প্রদানের দৃশ্য দেখলাম। এক বিহারি পুলিশ সাবইন্সপেক্টর হাজতে আটক বন্দিদের তালিকা নিয়ে এলো। আগা সেটার ওপর চোখ বোলালেন। তারপর হাতের পেনসিল দিয়ে তালিকার চারটে নামের পাশে টিক চিহ্ন দিলেন।

“সন্ধ্যায় এই চারটাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে, নিকেশ করা হবে,” তিনি বললেন। তালিকায় আরেকবার চোখ বোলালেন। হাতের পেন্সিল দিয়ে আবার খোঁচা মেরে বললেন…“আর এই চোট্টাকেও নিয়ে আসবে ওদের সঙ্গে।”

( চলবে)