বিশিষ্ট জনের বিচিত্র কাহিনী

বিশিষ্ট জনের বিচিত্র কাহিনী

জনাব মৃন্ময়মিত্র দাস একটি কর্পোরেট অফিসের নিম্নপদস্থ কর্মচারী। ছোটবেলা থেকেই সমাজ তথা পরিবার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত বয়োজ্যৈষ্ঠদের (Senior Citizen) খেদমতে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবরূপ দিতে তিনি দিনের পর দিন আহারে-অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে অর্থ সঞ্চয় করেছেন। একদিন তার স্বপ্ন মহিরূহ আকারে প্রকাশিত হলো।  তিনি স্বপ্নের বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলতে সক্ষম হলেন। স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি প্রচন্ড মনোবলে ক্ষুদ্র পরিসরে একটি বৃদ্ধনিকেতন গড়ে তোলেন। সেথায় সমবয়সি ৪/৫ জন পক্বকেশ নারী থাকেন। যারা একে অপরের সুখ-দঃ:খের সঙ্গি। পরমোল্লাসে মৃন্ময় তাদের সেবাযত্ন করেন। আছিয়া নামের এক ভদ্রমহিলা ঐ নিবাসে থাকেন। তিনি অনেক বড় পরিবার থেকে বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা তার স্বামী নঃ:গৃহীত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুতে তিনি অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েন। সন্তানদের মানুষ করার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। অনেক দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন। ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখায় খুব আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিধবা মা সন্তানদের কোন চাওয়া অপূর্ণ রাখেননি। অবশেষে তার সন্তানেরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। কনিষ্ঠ তনয়া পরিণয়সূত্রে লন্ডনে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করছেন। জ্যৈষ্ঠ সন্তান অলিক রহমান একটি কর্পোরেট অফিসের প্রধান (চেয়ারপার্সন) এবং তার স্ত্রী আলভি রহমান একই অফিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আছিয়া বেগম বিশাল অট্টালিকার ক্ষুদ্র একটা কামরায় বসবাস করেন। বস্তুত একসময় তিনিই ঐ বাড়ির মূল কর্ণধার ছিলেন। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তাকে অন্যের দয়ায় এ বাড়িতে থাকতে হ!। তথাকথিত শিক্ষিত পুত্রবধুর অনুগহে এঁটো খাবার খেয়ে কোন রকম জীবন চলত। তিনি ছিলেন সর্বদা নির্যাতিত নিষ্পেষিত। দিনে দিনে শিক্ষিত পুত্রবধুর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছিল। আছিয়া বেগম উপায়ান্তর না পেয়ে বিকল্প অনুসন্ধান করছিলেন। অবশেষে  তিনি পাশের বাড়ির খোকার সাহায্যে বৃদ্ধাশ্রমের সন্ধান পেলেন এবং সেটাকেই স্থায়ী নিবাস হিসেবে কবুল করলেন। মৃন্ময় তাকে মাতৃসমতুল্য সেবা যত্ন করতেন। মৃন্ময় যে অফিসের একজন নিম্নপদস্থ কর্মচারী সেই অফিসেরই এমডি জনাব আলভি রহমান এবং মৃন্ময় সরাসরি তার সঙ্গে কাজ করতেন। আলভি রহমান একাডেমিক সর্ব্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। মৃন্ময় জানত না যে আছিয়া বেগম তার অফিস বসের শাশুড়ি। যে অফিসের বস তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে সেই অফিসের পিয়ন সে। সে কীন তার মাকে আশ্রয় দিচ্ছে। কি বিচিত্র আমাদের এই জীবন ব্যবস্থা! মৃন্ময় মাঝে মাঝে সমাজ তথা জনগণের কল্যাণে তার বসের মুখে অনেক বুলি শুনে থাকে। আলভি রহমান বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের উদ্বোধনী ফিতা কাটার কান্ডারী ছিলেন। বসের সমাজকল্যাণ দর্শনে মুগ্ধ হয়ে কোন এক মা দিবসে মৃন্ময় তার বসকে দাওয়াত করে। বস এমন একটা মহতি কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করার কথা ভেবে বেশ আপ্লুত। যথারীতি মৃন্ময়ের সঙ্গে তিনি বৃদ্ধনিকেতনে হাজির হলেন এবং একে একে সকল বৃদ্ধাকে তথাকথিত আদর করলেন । এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য রচিত হয়। ৫ম জনকে অর্থাৎ আছিয়া বেগমকে আদর করতে গিয়ে ব্যত্যয় ঘটল। আছিয়া বেগম তাকে দেখে মুহূর্তের মধ্যে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, তোমার ভালবাসা আমি চাই না। আলভি রহমান অবস্থা বেগতিক দেখে নিজের মান বাঁচাতে তড়িঘড়ি করে তিনি বৃদ্ধনিকেতন থেকে প্রস্থান করলেন।

শেখ আবু মোহাম্মদ কিসলূ
শেখ আবু মোহাম্মদ কিসলূ