সায়েন্স ফিকশন গল্প

ভালো বাসা 

 

কৈ গেলা রে বন্ধু!

 

ডাক্তার আমার সাথে, কেবল মাত্র আমার সাথেই কথা বলতে চাইলেন। আমি জানি তিনি কি বলবেন। আমার জানার সাথে হুবহু মিলে গেল ডাক্তারের কথা।

‘মিসেস খন্দকার! মন শক্ত করুন।’

আমি জানি এখন আমাকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাতে হবে। আমি তাকালাম। বললাম, ‘মন শক্ত করতে হবে কেন? কি হয়েছে? কি হয়েছে সোলায়মানের? ডাক্তার! কিছু বলছেন না কেন? বলুন, কি হয়েছে আমার সোলায়মানের?’

এক্কেবারে বাংলা সিনেমার হিরোইনের মতো গলা চড়িয়ে দিয়েছি। অসুস্থ স্বামী হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। স্বামীঅন্তপ্রাণ স্ত্রী ডাক্তারের সাদা এ্যাপ্রনের সামনেটা মুঠো করে ধরে চড়া মেলোড্রামা ঘটিয়ে এভাবেই তো বলবে, ‘ডাক্তার! কিছু বলছেন না কেন?’

শোকগ্রস্ত স্ত্রীর সামনে ডাক্তাররাও তো কেবল মাত্র মানুষ হয়ে যান। তাদেও চোখে-মুখেও আবেগ ফুটে ওঠে। তারাও সত্য কথা বলার কষ্টে ভুগতে থাকেন। আমার সামনে বসা ডাক্তারটারও তা-ই হ’ল। প্রৌঢ় ডাক্তারের চওড়া কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠতে দেখছি, অথচ ঘরে চমৎকার নিয়ন্ত্রিত শীতলতা! ডাক্তার চোখ নামিয়ে নিয়ে বিভ্রান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘সোলায়মান খন্দকারের কী যে হয়েছে, তা-ই তো বোঝা যাচ্ছে না। আমরা দফায় দফায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করেছি। বিশ্বের বড় বড় হাসপাতালে, বড় বড় ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। কনফারেন্স-সেমিনার দফায় দফায় চলেছে। কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না। দেশের বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়ে লাভ হবে কি না, সে খোঁজও নেওয়া হয়েছে। আসলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি আমরা, এর বেশি আর কিছু করার নেই।’

ডাক্তার খাবি খাওয়া মাছের মতো খাবি খেতে খেতে বললেন,‘সোলায়মান খন্দকারকে ক্লিনিক্যালি ডেড বলেও ঘোষণা করা যাচ্ছে না। সেটা হলেও তো আমরা একটা কিছু করতে পারছি বলে ভাবতে পারতাম।’

ঝুপ্ ঝুপ্ করে চোখের পানি ফেলে আমি কাতর কণ্ঠে বলে উঠি, ‘ক্লিনিক্যালি ডেড! সোলায়মান! কী বলছেন আপনি?’

‘উনার শরীর দিব্যি সুস্থ। প্রতিটি অরগ্যান চমৎকার ফাংশন করছে।’

‘আমার সোলায়মান তবে কেন ক্লিনিক্যালি ডেড হবে? কী বলছেন এসব আবোল তাবোল?’

ডাক্তারের মাথাটা আরো নিচু হ’ল। বিভ্রান্তির পারদ আরো উঠে গেছে। বলছেন, ‘উনি ক্লিনিক্যালি ডেড নন, কেননা শরীর জীবিত মানুষের সব লক্ষণ ধারণ করে আছে। সমস্যা হচ্ছে ওর মনে।’

‘মনে?’

‘সোলায়মান খন্দকারের তাজা শরীর থেকে মনটা উধাও হয়ে গেছে। আপনাকে বুঝিয়ে বলি। মানুষের মস্তিষ্ক কোন এক দারুণ উপায়ে শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে দিয়ে সব কাজ করায়, কাঁদায়-হাসায়-ভালোবাসায়। আমরা বিষয়টাকে ভাবি যে, মন-ই সব করছে। সোলায়মান খন্দকারের শরীরকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য মনটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তরতাজা শরীরটা থেকে মনটাই গায়েব হয়ে গেছে।’

আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম। ডাক্তার করুন কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘আপনার স্বামী যে মন দিয়ে আপনাকে ভালোবাসত, সেই মনটা তার হাতকে নির্দেশ দিত গভীর মমতায় আপনার হাতটাকে জড়িয়ে ধরতে, সেই মনটা কোথায় যেন চলে গেছে। এটা কিভাবে ঘটল আমরা বুঝতে পারছি না। মনটাকে কিভাবে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে, তা-ও আমরা বুঝতে পারছি না। আসলে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

মনের ভেতরে আনন্দ উথলে উঠছে। ডাক্তারদের কখনো বেচারা ভাবিনি, আজ এই ডাক্তারকে দেখে বেচারা বেচারা বলে মনের ভেতর ঢেউ তুলে গেল আমারই মন। সচেতন হলাম, এই ঢেউয়ের ছিটেফোঁটা আমার চোহারায় যেন আছড়ে না পড়ে। শুকনো বালির তটভূমির মতো বিশাল সমুদ্রের দুঃখ শুকিয়ে কিচকিচ করে উঠি বিলাপের স্বরে। 

‘এ কী হয়ে গেল! এ কী শুনছি আমি! সোলায়মান আছে কিন্তু নেই। আমার স্বামী সোলায়মান রক্তমাংসের মানুষ হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। আবার আমারই স্বামী সোলায়মান চলে গেছে কোন এক অজানায়। এও কি হয়? এও কি সম্ভব?’

ডাক্তার বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছেন আর মাথা নাড়াচ্ছেন। শরীর আছে তবে মন নেই, এ রকম তাজ্জব পরিস্থিতিতে তাকে তো আর আগে পড়তে হয়নি। আমার কথা আলাদা। মানিক বন্দোপাধ্যায় যখন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ লিখেছিলেন, তখন যামিনী কবিরাজের স্ত্রী কুসুমকে কি তিনি আমার আদলে গড়তে চেয়েছিলেন কি না বুঝি না। আমার কান্না আমার নিজের কানেই শোনায় কুসুমের আওলা মনের বিলাপের মতো। 

ডাক্তার আমার চোখ থেকে বেয়ে পড়া পানির ধারায় তার টেবিল ভিজে যেতে দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন, বুঝতে পারছি। স্বামীর জন্য এমন পোড়ে যে নারীর মন, তাকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে? তিনি আমার মরে যাওয়া বাবার জায়গা নিতে চাইলেন। আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার বয়স কম। বুঝতে পারছি।’

আমার কান্না আর থামে না। অসহায় ডাক্তার দুজন নার্সের সাহায্য নিয়ে আমাকে নিয়ে এল সোলায়মানের কেবিনে। বিছানায় শুয়ে থাকা সোলায়মানের শূন্য দুই চোখ সামনে তাকানো, নিরিখ ঠিক করে ঠিক সেই দৃষ্টির সামনে আমাকে দাঁড় করানো হ’ল, অথচ দিব্যি সবাই বুঝতে পারল সোলায়মান আমাকে দেখছে না।

শশী ডাক্তারটা যে কী গাধা ছিল! কুসুমের প্রেম মনে না শরীরে, আসলে প্রেম মনে না শরীরে নাকি মন আর শরীর দুই জায়গাতেই থাকে বুঝতে না পেরে ছাগলের মতো বলেছিল, ‘শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?’

এই যে সামনে শুয়ে থাকা সোলায়মান। এখানে কেবলি শরীর। মন নেই। আচ্ছা, সোলায়মান খন্দকারের শরীরে কি কখনো মন বলে কিছু ছিল? এই যে তাকিয়ে থাকা, আমি দিব্যি সামনে দাঁড়িয়ে আছি তবুও সে আমাকে দেখছে না, এ কি নতুন কোন ঘটনা? বহুবার, বহুবার আমি তাকে এই প্রশ্নটা করেছিলাম, ‘তোমার কি মন বলে কিছু নেই? তুমি কি মানুষ?’

সোলায়মান খন্দকার হা হা করে হাসত। আজ হাসতে পারবে কি? একটু পরীক্ষা করে দেখি। বিছানার খুব কাছে গিয়ে সোলায়মানের হাতটা ধরলাম। ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, ‘তোমার কি কেবলি শরীর? মন নাই? তাহলে তুমি কি বেঁচে আছ? না মরে গেছ? মন না থাকলে কি বেঁচে থাকা যায়? আহা সোলায়মান, তুমি কবে মরে গেলে?’

এই শরীর সর্বস্ব সোলায়মান খন্দকার আজ আর আমার হাতে শক্তি প্রয়োগ করতে পারল না। পুতুলের মতো শুয়েই থাকল। তবে শরীরের উত্তাপ জানান দিচ্ছে, শরীরটা বেঁচে আছে। মনটা নেই। যে মন দিয়ে শরীরসর্বস্ব সোলায়মান খন্দকার আমার হাত মুচড়ে দেওয়ার মতো কাজ করতে পারত, সেই মন আজ উধাও। 

নার্স দু’জন বেরিয়ে গেছে। স্বামীর শোকে পাথর স্ত্রীকে কান্নার স্বাধীনতা দিয়ে গেছে। কিসের কান্না? আমি ফিসফিস করে সোলায়মান খন্দকারকে শোনালাম, ঠিক সেই কুসুমের মতো করেই, ‘লাল টকটক করে তাঁতানো লোহা ফেলে রাখলে তা-ও আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যায়। যায় না? যে কষ্ট তুমি আমাকে দিয়েছ, তা আমি ভুলে গেছি, ঠান্ডা হয়ে গেছে আমার সব ক্ষোভ। কেননা, শোধবোধ আজ হয়ে গেছে। এখন আমি আবার তেঁতে উঠব। লাল টকটকে হয়ে উঠবে জীবনের সবটুকু। তুমি আর আমার কিস্যু করতে পারবে না। কিভাবে পারবে? তুমি তো মরে গেছ। যে যা-ই বলুক, তুমি বহু বছর আগেই মরে গিয়েও আমাকে জ্বালানোর জন্য বেঁচে ছিলে। আর আজ আমাকে শান্তি দেওয়ার জন্যই তুমি মরে গিয়ে বেঁচে আছ। কী মজা না! মন নেই তোমার। মন ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায়, বল সোলায়মান? আরো স্পষ্ট করে বলি, ভালোবাসা ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায়? তোমার মন ভালোবাসতে পারেনি। আমি তো পেরেছি। উহু, তোমাকে না, তোমাকে আমি কখনোই ভালোবাসিনি। স্যরি, সোলায়মান। আই এ্যাম এক্সট্রেমলি স্যরি।’

সোলায়মান কিছুই বলতে পারেনি। যে মন খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে, তা কি আমার সব কথা শুনতে পেয়েছে? না পেলেও আমার কিছুই যায় আসে না। কেবিন থেকে বেরুতে বেরুতে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে খুনখুন করে কাঁদি। আমার কানে সে কান্না দিব্যি সুর হয়ে উঠেছে, কি এক লোকসুর, কৈ গেলা রে বন্ধু! কৈ গেলা রে!!

 

খালি কণ্ঠ খালি রইল না পরিলাম মালা

 

হাসান আরিফ খবরটা পেয়ে প্রথমেই যেটা ভেবেছে, সেটা হ’ল, ব্যাটা কেন মরল না? মরলে তো তার টাকা-পয়সার ভাগ-বাটোয়ারার ঝামেলা মিটে যেত। যে পেত, তার কাছ থেকেই বিলটা মেটানো যেত। সোলায়মান খন্দকারের স্ত্রী মিসেস খন্দকার-ই তো পেত সব। একবারই দেখেছে মহিলাকে, ঝামেলা করত বলে মনে হয়নি। ঝামেলা শব্দটা মাথায় এলে সোলায়মান খন্দকার যে কী পরিমাণ ঝামেলা করত, তা মনে করে হাসান আরিফের মুখটা তেঁতো হয়ে যায়। ব্যাটা কিছুতেই আর্কিটেক্ট হাসান আরিফকে ঠিক ভাবে সম্বোধন করত না। ফোনে হোক আর সামনা সামনিই হোক, ব্যাটা কথা শুরু করত ঠিক এই ভাবে, ‘কি আর্কিটেকচার হাসান সাব—’

হাসার আরিফ তো কম কষ্ট করে আর্কিটেক্ট হয়নি। তাই প্রতি বারই বাধা দিয়ে বলে উঠত, ‘না না। আমি আর্কিটেক্ট হাসান, বাংলায় যাকে বলে স্থপতি। স্থপতি হাসান আরিফ।’

মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে ব্যাটা কি বলত? বলত, ‘ঐ হইল, আর্কিটেকচার আর ফার্কিটেকচার একই কথা।’

এরপর হাসানকে বলতে হ’ত, ‘স্যরি, একই কথা না। আমার কাজের ক্ষেত্রটা আর্কিটেকচার, বাংলায় যার অর্থ স্থাপত্য। যিনি স্থাপত্য চর্চা করেন, তিনি স্থপতি—আর্কিটেক্ট! তবে, ফার্কিটেকচারটা কি, বুঝলাম না।’

এক পর্যায়ে ঠেকে গিয়ে ব্যাটা মেজাজ দেখাত। বলত, ‘এই সব বেহুদা ক্যাচর ম্যাচর বাদ দ্যান। আমার বাসা-বাড়ির কদ্দূর কি করলেন?’

শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য সোলায়মান খন্দকার নাকি প্রায়ই দেশের বাইরে যায়, ব্যবসাটা উপলক্ষ্য মাত্র। কয়েকবার গা দুলিয়ে দুলিয়ে নোংরা ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়েছেও, শরীর-স্বাস্থ্য বিদেশে গেলে কিভাবে ঠিক থাকে। সেই লোক কি না তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য বাড়ি বানাতে চেয়েছিল, এস্টিমেটেড কস্ট যা এসেছিল তা দেখে হাসানের চোখ ছানাবড়া না হয়ে পারেনি। ডিজাইনটা দাঁড় করাতে ঝক্কি কম যায়নি, কেননা ব্যাটা সেই বাড়ির নাম দিয়েছিল ‘ভালো বাসা’, তা শুনে আর তার স্ত্রীর ঝকঝকে চেহারার আড়ালে ভালবাসাহীন সংসার জীবনের যন্ত্রণা টের পেয়ে হাসান কিছুই আর মেলাতে পারছিল না। কি মনে করে যেন বাড়িটাতে মিউজিক রুমের জায়গা রেখেছিল, সোলায়মানকে বলেছিল, ‘ছাদটা পুরো কাঁচের, চাইলে খুলে ফেলতে পারবেন। মেঝেতে বয়ে যাবে পানির স্রোত।’ 

এই পর্যন্ত সোলায়মানের চোখ চকচক করলেও এর পর হাসান যখন বলেছিল, ‘ভাবীর সুমধুর গান শুনে থেমে যাবে মেঘ, চুপ হয়ে যাবে পানির কুলকুল ধারা।’ তখন সোলায়মানের চোখটা হায়েনার মতো জ্বলে ওঠে। সাপের মতো হিসহিস করে জানতে চায়, ‘আমার স্ত্রী গান গায়, আপনি জানলেন কিভাবে?’

সে যাত্রা কোন মতে রক্ষা পেয়েছিল হাসান। তবে এ যাত্রা কি হবে বুঝতে পারছে না। ব্যাটা সস্ত্রীক হাসান আরিফের অফিসে এসেছিল বাড়ির নকশা- থ্রিডি মডেল আর ভার্চুয়াল মডেল দেখতে আর এখানে এসেই অদ্ভুত এক মৃত্যু ঘটে গেল তার! ডাক্তার বলছে, মরে নি আবার মরেছেও। ব্যাটার শরীর পড়ে আছে, আর ব্যাটার মনটা হলুদিয়া পাখি হয়ে উড়ে গেছে। এর কোন মানে হয়? 

সোলায়মান খন্দকারকে এই অফিসে এসে ডিজাইন দেখার প্রস্তাব দিয়েছিল বলে নিজেই নিজের হাত কামড়াতে থাকে। প্রস্তাবটা না দিয়েই বা কি করার ছিল? ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে বাড়ির নকশা বানানোর কৃতিত্ব কেবল হাসান আরিফের ফার্মেরই আছে। বাসা বাস্তবে তৈরি হওয়ার আগেই সেখানে পা রাখা, ঘুরে দেখা—লেটেস্ট আর ভেরি মাচ সুপার্ব টেকনোলজি। খরচটা একটু বেশি হলেও বড় বড় ক্লায়েন্টরা আজকাল ওর কাছেই ভিড় জমাচ্ছে। এসব কিছুর জন্য হাসান উৎসের কাছে বড়ই কৃতজ্ঞ। কেননা, ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ‘ভালো বাসা’ দেখানোর কায়দা-কানুন সব ওরই বানানো। 

কম্পিউটার বিজ্ঞানী উৎস আর হাসান একই ব্যাচের। কলেজ জীবন থেকে বন্ধুত্ব, বুয়েটে একজন চান্স পেল আর্কিটেকচারে আর আরেকজন কম্পিউটার বিজ্ঞানে। উৎস বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল, প্রতিটি সেশনে ওর রেজাল্ট ছিল দেখার মতো, সবাই জানত উৎস টিচার হবে, বাইরে পড়তে যাবে, পড়া শেষ করে মাইক্রোসফট কিংবা এ্যাপলের মতো খ্যাতিমান কোম্পানির কেউকেটা একজন হবে, সারা বিশ্ব চিনবে বাংলাদেশের গর্ব কম্পিউটার বিজ্ঞানী উৎস প্রিয়ংবদকে। 

হাসানের ঠিক পাশের রুমে উৎস বসে। হাসান দুই কাপ কফির মগ হাতে উৎসের কাছে গিয়ে সোলায়মান খন্দকারের কি হ’ল আর সোলায়মান খন্দকারের পকেট থেকে না বেরুনো টাকাটার কি হবে, তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করবে বলে উঠে পড়ল। উৎসের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ল্যাবরেটরিতে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ, একমাত্র উৎস আর হাসান আরিফের হাতের ছাপ না পড়লে ঐ ঘরের ভারি দরজাটা কিছুতেই খুলবে না। নিয়ম মতো দরজার পাশের সিকিউরিটি প্লেট-এ হাতের ছাপ বসায় হাসান, ধাতব কণ্ঠে আওয়াজ হয়, প্রবেশ অনুমোদিত। খুলে যায় দরজা।

চুপচাপ কাজ করছিল উৎস। হাসানকে দেখে মৃদু হাসে। বহুকালের শুকনো মুখের বিষণ্ন উৎস আজ কি ঝকঝকে চোখে তাকাল, নাকি ওটা দেখার ভুল, বুঝতে পারল না হাসান। 

বুয়েট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রায় ছয় বছর পর দুই বন্ধুর দেখা হয়েছিল আবার। মতিঝিলের শাপলা চত্বরের কাছে গাড়ি দিয়ে যাচ্ছিল হাসান, কোন এক ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিল। গনগনে দুপুরে হনহন করে রাস্তার ভিড় ঠেলে এগুচ্ছিল উৎস, হাসানের গাড়ির সামনে এসে খানিকটা থমকে যেতে হয়েছিল, কেননা হাত দিয়ে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল আরো অনেকের সাথে। এ দেশের মানুষ রাস্তার ব্যবহার জানে না, আর তাই এরকম দেখলে হাসানের মুখ দিয়ে খিস্তি-খেউড় বের হয়। সেদিনও বের হয়েছিল, তবে তা শেষ হয়েছিল গোঙানি দিয়ে। পার হয়ে যাওয়া মানুষটাকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি, কেননা হলে একই ঘরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ঐ মানুষটার সাথে কাটিয়েছে হাসান। পাশ করে বেরুনোর পর আর যোগাযোগ হয়নি, কেননা হাসান ধরেই নিয়েছিল আন্দাজ মোতাবেক উৎস পৌঁছে গেছে স্টিভ জবস বা বিল গেটস-দের আশে পাশে। সেই উৎস কেন মতিঝিলের শাপলা চত্বরে পুরনো রঙচটা চটি পরে, ময়লা টিশার্ট গায়ে রাস্তা পার হচ্ছে আর ওকে একদম ফকিরের মতো লাগছে, তা হাসানের কাছে ধাঁধা লেগেছিল। সেই ধাঁধার উত্তর জানতে উৎসকে পাকড়াও করে ওর ভবঘুরে জীবনটাকে টেনে এনে নিজের অফিসে বসিয়ে দিয়ে আসলে হাসান নিজেই শান্তি পেয়েছিল। উৎস শুধু বলেছিল, ‘তোর সাথে থাকব, যদি তুই আমার শর্তগুলো মানিস্। আমার কথা কেউ জানবে না। কোন বন্ধু না, কোন শত্রু না, কেউ না।’

‘কেন?’

‘আই এ্যাম নো বডি, তাই। যদি এই শর্ত মানতে পারিস্ তো আমি আছি। নইলে নাই।’

হাসান উৎসকে হারাতে চায়নি। তাই শর্ত মেনে চলেছে। উৎসের কথা কেউ জানে না। এমনকি উৎসের আসলে কি হয়েছিল, সে তথ্য ওর নিজের কাছেও নেই। এই ল্যাবরেটরি রুমটাতে উৎস ওর জগত তৈরি করে নিয়েছে। উৎসের চাহিদা মতো হাসান কেবল জোগান দিয়েছে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির গবেষণায় উৎস যে কি বিপ্লব ঘটিয়েছে, তা পুরোটা বুঝতে না পারলেও এক দিন উৎস ওকে সত্যি সত্যিই মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে কী অভিজ্ঞতা! কিভাবে কি ঘটেছিল, তার ব্যাখ্যা হাসানের জানা নেই। তবে হাসান ওর সমস্ত শরীর আর মন দিয়ে অনুভব করেছিল মঙ্গলের লালচে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে ও। একা। ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা ওকে চেপে ধরল চারপাশে। মগজে তৈরি করা বাস্তবের ভয়াবহ বাস্তবতায় বিহবল হাসান চোখ ভরা পানি নিয়ে দেখেছিল আকাশে ঝুলছে প্রিয় পৃথিবী আর চাঁদ। নিজের পরিচিত জগতটাকে ফিরে পাওয়ার জন্য ও হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেছিল। উৎস যখন ওকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনল, তখন হাসান নাকি ‘মা মা ’ বলে কাঁদছিল! 

সেই ‘মাঙ্গলিক’ ধাক্কা সামলে নিতে হাসানের লেগেছিল পাক্কা দুই মাস। এরপর অল্প অল্প করে ওর মাথায় এল আর্কিটেকচার ডিজাইন অনুযায়ী কাগজের ত্রিমাত্রিক মডেল বানানোর অতি পুরনো আইডিয়াকে নতুন করে উপস্থাপনের বুদ্ধি। উৎস যদি মঙ্গলে পাঠাতে পারে, তবে ডিজাইনের বাড়ির ভেতরে কি পাঠাতে পারবে না? উৎসকে বলতেই উৎস বাঁকা হাসি হেসেছিল। এরকম সহজ কাজে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে নেই। তবে বন্ধুকে আর্থিকভাবে লাভবান করতে উৎস রাজি হয়েছিল। সত্যি বলতে কি, এরপর থেকে হাসানের ভাগ্য উপচে পড়তে শুরু করেছে। সোলায়মান খন্দকারের মতো বোয়াল মাছগুলো ধরা পড়ছে টপটপ করে। বাড়ি বানানোর আগেই বাড়ির ভেতর ঘুরে বেড়ানোর পর এরা প্রত্যেকেই আনন্দে গদগদ হয়ে ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছে। কেবল ঐ সোলায়মান খন্দকারের বেলায় বেঁধে গেল ভজঘট। ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়ার জন্য তাকে তো খাড়া হতে হবে। ব্যাটা চওড়া শরীর নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে কুমড়ো পটাশের মতো, খাড়া হওয়ার নির্দেশনা পাচ্ছে না মগজ থেকে। কেননা, ওর খুলির ভেতরকার মগজ ফ্রিজ হয়ে গেছে, ওটাকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ‘মন’ উড়ে গেছে! সোলায়মান খন্দকারের বাড়ির ডিজাইনের পেছনে হাসান আরিফের  খরচ হয়ে যাওয়া পয়সাপাত্তি উসুল হবে কিভাবে, সে চিন্তায় হাসান আরিফের মনে হচ্ছে সোলায়মানের মনের খোঁজে ও নিজেই ছুটবে। দরকার হলে ঐ নিঃসঙ্গ মঙ্গলের বালি খুঁড়বে, ওর নিচে চাপা পড়ে আছে কি না কে জানে!

দেড় সপ্তা আগে ঠিক এই ভাবেই উৎসের কাছে এসেছিল হাসান, যখন নিশ্চিত হয়েছিল যে সোলায়মান খন্দকার নামের বিশাল বোয়াল মাছটাকে বড়শিতে বেঁধে ফেলেছে আর সেই বোয়ালটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ডিজাইন করা তার ভবিষ্যৎ বাড়ি ‘ভালো বাসা’ পরিদর্শনে আসছে, সেই দিন বিকেলেই। এর আগেই ‘ভালো বাসা’র ডিজাইনটার সফট কপি মেইল করে দিয়েছে উৎসকে। বিবাগী হব হব বলে হাসানের কানের পোকা বের করে দিতে থাকা উৎস ছোট মানুষের মতো গোঁ ধরে বলেছিল, ‘এই শেষ প্রজেক্ট। এরপর তুই আর আমাকে বাধা দিবি না। প্রমিজ?’

‘সত্যিই তুই বিবাগী হবি?’

হাসান উৎসকে জড়িয়ে ধরে বড় একটা শ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘কিন্তু, আমি যে তোকে মিস্ করব…তোকে ছাড়া থাকব কিভাবে?’

উৎস মৃদু হেসে হাসান আরিফকে বসিয়ে দিয়েছিল মনিটরের সামনে। ওর মাথায় পরিয়ে দিয়েছিল হেলমেট। কানে, হাতে, পায়ে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় তারসহ সেন্সর লাগিয়ে দেয়। নিজেও একই ভাবে কথা বলতে বলতে হেলমেট আর সেন্সর গায়ে লাগিয়ে বসেছিল পার্টিশনের ও পাশে। কিবোর্ডে ঝড় তুলে বলেছিল, ‘ ভিএএলওবিএএসএ। পাসওয়ার্ডটা মনে রাখিস্!’

‘ভিএএলওবিএএসএ। ভালবাসা! মনে থাকবে।’

‘এবার এন্টার কি টিপলেই—’

উৎস সুইচ টিপে দিলে ওর কথার মাঝখানের অংশ ইকো হয়ে যায়, চারপাশে শুধু অন্ধকার। ছাদ-দেয়াল কিছুই নেই, শুধু স্পেস। ধবধবে সাদা স্পেস-এ শুধু লাল রঙের একটা বন্ধ দরজা। হাসান আরিফ আর উৎস মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বন্ধ দরজায় টোকা দিতেই খুলে গেল দরজা। দরজার ওপাশেও শূন্য স্পেস। বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা ‘উৎস’, অবাস্তব জগতের অবাস্তব উৎস। হাসান আরিফ দেখেই বুঝতে পারল, এই উৎস হাসানের সেই রুমমেট জীবনের উৎস। হা হা করে হাসতে পারে, স্টকে প্রচুর জোকস আছে সেই উৎসের মতো। আর সত্যি সত্যিই হাসানকে সত্যিকারের তাজ্জব করে দিয়ে হাসানের পিঠ চাপড়ে আগের দিনের মতোই বলে উঠল এই উৎস, ‘দোস্ত, তুই যেভাবে দেখছিস্, আমার তো কাতুকুত লাগছে!’ 

বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে পারছিল না হাসান। ফিরে আসার পর হাসফাঁস করতে থাকে হাসান। ওর আসলে নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছিল। ওভাবেই বলল, ‘দোস্ত্, তুই সত্যিই একটা জিনিয়াস। আমার তো ওয়াও লাগছিল। ফিরিয়ে আনলি কেন? আচ্ছা, অবাস্তব জগত থেকে ফিরে আসার পাসওয়ার্ডটা কি?’

‘সব এক সাথে বললে তুই মনে রাখতে পারবি? আগে ঢোকার পাসওয়ার্ড মুখস্ত কর। বেরুনোর বুদ্ধি আমি বিবাগী হওয়ার আগে দিয়ে যাব।’

‘দরকার নেই তোর বিবাগী হওয়ার।’

গোঁয়ার উৎস তখন বলেছিল, ‘বোয়াল মাছকে মানা করে দে। ওর ‘ভালোবাসা’ প্রজেক্ট এখানেই খতম।’ এরকম ব্ল্যাকমেলিং-এর পর আর কোন কথা থাকে না। উৎসকে আর না খুঁচিয়ে হাসান কেবল বলেছিল, ‘তুই মানুষ পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছিস্ দোস্ত!!’

‘আসল না নকল।’

‘বাস্তবেই কি আসল মানুষ পাওয়া যায়? তবে দোস্ত, তুই কিন্তু আসল। তোর অভাব পূরণ করতে কেউ পারবে না। নকল উৎস-ও না।’

দেড় সপ্তা আগে এরকম কথাবার্তা হ’ল, তার পর এই তো চার দিন আগে সোলায়মান খন্দকার অদ্ভুতভাবে মরে গেল। কফির মগটা উৎসের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসান আরিফ উদাস কণ্ঠে বলে, ‘লস প্রজেক্ট। খালি পকেট খালিই রইল রে দোস্ত!’

এই কথা শুনে উৎসের ঠোঁটের কোণায় সন্তুষ্টির হাসি দেখল বলে কেন মনে হ’ল হাসানের? ওর ব্যবসায়িক লস দেখে কি উৎস আজকাল আনন্দ পেতে শুরু করেছে? এ যে হতে পারে, হাসান তা কিভাবে বিশ্বাস করে?

 

না আইল মোর প্রাণের পতি ডুইবা গেল বেলা রে!

 

সোলায়মান খন্দকার তার স্ত্রীকে নিয়ে যখন হাসান আরিফের অফিসে এসেছিলেন, তখন খন্দকার উদ্ধত দৃষ্টিতে দেখছিল ডিজাইন শিট, মডেল, সব কিছু আর তার স্ত্রীর মুখে ছিল বিষণ্নতা। চোখে চশমা, শাড়ি গয়নাতেও ঊজ্জ্বল লাগেনি মোটেও। হাসানের সেকেন্ড কয়েকের দৃষ্টি আগুন জ্বালিয়েছিল খন্দকারের চোখে। নিজেকে সামলে নিয়ে হাসান কেবল বলতে পেরেছিল, ‘ অবাস্তব ‘ভালো বাসা’য় ঢুকবেন, ঘুরে ঘুরে দেখবেন, একদম বাস্তব অনুভূতি।’

মিসেস সোলায়মান বিড়বিড় করে ‘অবাস্তব ভালো বাসা’ শব্দ দু’টি উচ্চারণ করেছিলেন, নজর এড়ায়নি হাসানের। ল্যাবরেটরিতে খন্দকার আর তার স্ত্রী পাশাপাশি সিটে বসলেন। দুজনের মাথায় হেলমেট, চোখে কাল চশমা, শরীরে নানা রকমের সেন্সর। আজব আজব কথাবার্তা বলছিল খন্দকার, যদিও তার স্ত্রী একদম চুপ। হাসানই সাহায্য করেছে এসব করতে, উৎসের সাথে থেকে থেকে শিখেছে কি কম? সব হয়ে গেলে হাসান চলে এল পার্টিশনের ওপাশে। উৎস এখন ‘ভালো বাসা’ পরিদর্শনের কাজ শুরু করতে পারে। নিজের মাথায় হেলমেট আর শরীরে সব সেন্সর লাগিয়ে উৎস পাসওয়ার্ড টিপে এন্টার টিপবে, তখন হাসান ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘গুড লাক, দোস্ত!’

উৎস নিশ্চল হয়ে গেছে এন্টার কি টেপার পর পরই। হাসান উঁকি দিয়ে পার্টিশনের ওপাশে বসা মিস্টার এন্ড মিসেস খন্দকারকে দেখে মুর্তির মতো বসে থাকতে। হাসানের হাত নিশপিশ করছিল বোয়াল মাছটার পিঠে বিশাল একটা থাবড়া দিতে, যান্ত্রিক গন্ডগোল বেঁধে যায় কি না এই ভয়ে চুপচাপ সরে এল। পরিদর্শন চলুক, ততক্ষণ অন্য কাজ এগিয়ে নিতে হাসান ওর নিজের ঘরেই ঢুকেছিল। 

আর ওদিকে, অবাস্তব ‘ভালো বাসা’য় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল খন্দকারের উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর। মিসেস খন্দকার অবাস্তব জগতে বাস্তব ঘর-দরজা-জানালাসহ মানুষের বসবাসের সব উপকরণ দেখে তাজ্জব হলেও নির্লিপ্ততার দীর্ঘকালীন অভ্যাস থেকে বের হতে পারেননি। পারলেন তখনি, যখন দেখলেন ‘ভালো বাসা’ ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য যে গাইডটাকে পাঠানো হয়েছে, তাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখে সোলায়মান খন্দকার চিৎকার করে ডেকে বললেন, ‘কি এক মিউজিক রুম নাকি বানাইছে আর্কিটেকচারে। ঐডা দেখতে চাই।’

মিউজিক রুম তো দেখাই যাবে। তার আগে, ঠিক তখনি মিসেস খন্দকার যখন সেই গাইডটার সামনে দাঁড়ানো, তখন যে বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করল! চশমার কাঁচে সোলায়মান খন্দকারের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি গোল হতে শুরু করেছে টের পেয়েও হাতুড়ির শব্দ কিছুতেই যে ঢেকে রাখা যাচ্ছিল না। আর সেই গাইডটা যখন ‘চুমকি’ বলে অস্ফুট উচ্চারণে বিড়বিড় করল, তখন সোলায়মান যেন কিছুই হয়নি ভাব করে ‘দারুণ বাড়ি, তোমার পছন্দ হইছে না কি কইয়া দাও, কৈ কৈ পাল্টাইবা না কি পাল্টাইবা’ ইত্যাকার ত্যানা প্যাচাতে প্যাচাতে উৎসের কাছে গিয়ে সোজা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি আমার স্ত্রীকে চেনেন নাকি?’ 

উৎসের মুখটা কী রকম তেঁতো হ’ল, তা দেখে মিসেস খন্দকার চশমার আড়ালেই চোখটা ভিজিয়ে ফেললেন। উৎস বলেছিল, ‘আপনার স্ত্রীকে আমি চিনি না। কোন দিন চিনতামও না।’

খুশির ভাব দেখিয়ে সোলায়মান নানান জিনিস দেখতে দেখতে আর নোংরা শিস বাজাতে বাজাতে সরে যান অন্য ঘরে। মিসেস খন্দকার লোকটাকে চেনেন, জানেন এই সরে যাওয়া আসলে ভাল করে খতিয়ে দেখা সন্দেহের বিষাক্ত দলাকে, তবুও যেন তার কিছু এলো গেলো না। যে উৎসকে দেখার জন্য এতকাল বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ, সেই উৎস যে আজ তারই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দুজন দুজনকে দেখে, দৃষ্টিতে অসংখ্য প্রশ্ন আর অভিমান। উৎস কথা বলতে গেলেই বহু কাল আগে হারিয়ে যাওয়া চুমকি মিসেস সোলায়মান খন্দকার হয়ে ফিসফিস করে কাতর হয়ে ওঠেন। বলেন, ‘লোকটা টের পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

বিস্মিত উৎস জানতে চায়, ‘তুমি সুখি হওনি?’

বিষণ্ন হাসি যখন চুমকির ঠোঁটে ফোটে, তখন উৎস নিজেই জবাব প্রস্তুত করে। ‘টাকা তাহলে মানুষকে সুখ দিতে পারে না।’

চুমকি ছটফট করে বলে, ‘তুমি যাও উৎস। লোকটা বুঝে ফেললে—’

‘ কি করবে?’

‘ কী করবে! ভালবাসবে। খুব ভালবাসবে। আমি সহ্য করতে পারি না—-ছটফট করি। প্লিজ, তুমি যাও—প্লিজ—’

শিস দিতে দিতে এগিয়ে আসা খন্দকারকে শুনিয়ে চুমকি বলতে শুরু করে, ‘একদম সত্যিকারের বাড়ির মত। মনেই হচ্ছে না, কোন অবাস্তব বাসায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা।’

খন্দকার নাটকীয় ভঙ্গিতে পাক খেয়ে মিসেস খন্দকারের কোমর খামচে ধরে এক হাতে, কাঁধের উপর মুখ রেখে উৎসের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি খুশি তো?’

উৎসের ভেতরটা ফেটে পড়ছিল গনগনে আগ্নেয়গিরির মতো। চুমকির সাথে এই নোংরা অসভ্যতা ওকে সহ্য করতে হবে, এ কি কখনো ভেবেছিল? খন্দকার সরে যেতেই ও ছুটে আসে চুমকির কাছে। মুখের ঘাম মুছে শুকনো গলায় চুমকি জানতে চায়, ‘তুমি যে সাকসেসফুল হবে, এ আমি জানতাম। তোমার বউ নিশ্চয়—’

‘বিয়ে করিনি।’

শিসসহ খন্দকারকে এদিকে আসতে দেখে চুমকি দ্রুত ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করে। ‘রান্নাঘরটা দেখেছি। ওয়াল কেবিনেট আরো বাড়িয়ে দিতে হবে। সংসারের জিনিসপত্র কি কম? আমার স্বামী আবার খুব আচার খেতে পছন্দ করেন। আচারের বোয়েমগুলো রাখার জন্য জানালার পাশে তাক-টাক কিছু রাখা যায় কি না দেখবেন।’

খন্দকার খুশি হয়ে ওঠার ভান করলেও তার চোখের ভাষা দেখে ভয়ে কেঁপে ওঠে চুমকি। উৎস থমথমে মুখ নিয়ে দেখছে চুমকির ভয়। উৎসের ভেতরে কি হয়, তার ব্যাখ্যা ওর কাছে স্পষ্ট না হলেও ও বুঝতে পারে অবাস্তব উৎস-কে ওর প্রয়োজন এখন। দ্রুত পায়ে চলে আসে রান্নাঘরের ঠিক উল্টো দিকে। লাল দরজায় টোকা দিতেই খুলে যায় দরজাটা। বুকে হাত বেঁধে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে ‘উৎস’। উৎস ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ওদের ভেতর কি কথা হচ্ছিল, তা ওরাই জানে। তবে ওদিকে খন্দকারের হাতের মুঠি চেপে ধরেছিল চুমকির হাত। বহু বারের মতোই খন্দকার চুমকিকে মনে করিয়ে দিল, তার প্রথম স্ত্রী কিভাবে মরে গিয়েছিল। বিয়ে করা বউ অন্যের হাত ধরে পালাতে চাইবে, আর খন্দকার তাকে বাঁচিয়ে রাখবে, এ তো হতে পারে না। চুমকি অসচেতন ভাবেই চিৎকার দিয়েছিল, ‘উৎস!’ চুমকি ছুটতে শুরু করেছিল উৎসকে ডাকতে ডাকতে, কেননা খন্দকার ছুরি হাতে তাড়া করেছিল ওকে। 

উৎস কোথায়? চুমকি চরম হতাশায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে ভাবে, ছয় বছর আগে উৎসের হাত ধরে পালানোর কথা ছিল ওর। পারেনি। আর তাই কি উৎস ওকে একা ফেলে চলে গেল? ছয় বছর কি আসলেই খুব লম্বা সময় সব কিছু ভুলে যাওয়ার? তাই কি খন্দকারও হা হা করে হাসছে? বলছে, ‘পলায়ছে! ব্যাটা পিরিতের নাগর ভয় পাইছে! জানের মায়া বড় মায়া!’ 

হাসতে গিয়েই সোলায়মান খন্দকার খানিকটা ছাড় দিয়ে ফেলেছিল বলে চুমকি সামনে একটা চেয়ার সরিয়ে দিয়ে কোনমতে বেরিয়ে যায়। সামনেই ছুটে আসা উৎসকে দেখে জড়িয়ে ধরে ওকে। পেছনে ভেসে আসছে খন্দকারের চিৎকার, ‘খুন করে ফেলব শালা! আমার বউ-এর সাথে ফষ্টিনষ্টি!’

চুমকি ওদিকে তাকাতেই দেখে খন্দকার ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে উৎস’র উপরে, উৎস’র শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া ছুরি কোন ঘটনা ঘটাতে পারছে না বলে আর বুকের উপর দুই হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা উৎস হা হা করে হাসছে বলে খন্দকারের মেজাজ উঠে যাচ্ছে চরমে। 

মানে কি এসবের? চুমকিকে জড়িয়ে ধরা উৎস চোখের ভাষায় কি বলে তা না বুঝলেও আর কোন ভয় যে নেই, তা বুঝতে কষ্ট হয় না চুমকির। উৎস চুমকিকে নিয়ে পা বাড়ায়, অবাস্তব জগত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য শূন্যে পাসওয়ার্ড অনুযায়ী আঙ্গুলের টোকা দিয়ে অনেকগুলো আলোকবিন্দু সৃষ্টি করে। উৎস’র গায়ে ছুরির আঘাত থামিয়ে ছুটে আসে খন্দকার, কেননা তৈরি হওয়া আলোক বিচ্ছুরণ আর তাতে পর পুরুষের হাত ধরে নিজের বিয়ে করা বউকে নাই হয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। মাথাটা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়, কেননা যে হারামজাদা চুমকিকে নিয়ে নাই হ’ল, সে এখানে কেন এখনো? নাকি চুমকিকে নাই করে দিয়ে হারামজাদা এখন ওকেও নাই করবে? কত বড় বিপদে পড়তে হ’ল, সে কথা ভেবে ছুরি নিয়ে আবারো ঝাঁপিয়ে পড়ে খন্দকার। নির্বিকার উৎস তখন বলছে, ‘একটা জোক্স বলি? পরের বউ-এর সাথে ফষ্টিনস্টি বিষয়ক।’

‘চুমকিরে কই গায়েব করলি, ক’ হারামজাদা, ক’!’

উৎস উত্তরে যা বলেছিল, তা শুনে খন্দকারের মাথা আরো খারাপ হ’ল। বলে কি না, চুমকি নাকি উৎসের সাথে চলে গেছে!

উৎস’র শরীরে বাতাস কেটে যাচ্ছে ছুরি, বুঝে পাচ্ছে না খন্দকার। চোখে-মুখে ক্রমশঃ আতঙ্ক ভর করে। চিৎকার করে জানতে চায়, ‘উৎস-র সাথে! মানে কি? তুই ব্যাটা কে তাইলে? তুই উৎস না?’

‘না।’

‘তাইলে তুই কে?’

‘আমি তোকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না।’

সোলায়মান খন্দকার রাগে অন্ধ হয়ে গেলেন। এই ব্যাটা তার মতো টাকার পাহাড়কে তুই বলে ডাকছে! বলছে, ‘উৎস আসুক, তখন জেনে নিস্ আমি কে।’

উৎস আসুক মানে? উৎস কোথায় গেছে? সেটাও নাকি উৎস ফিরলেই জেনে নিতে হবে। আর ততক্ষণ উৎস আর সোলায়মান—-সোলায়মানকে এখানেই নাকি থাকতে হবে। কারণ, উৎস ছাড়া এই জগৎ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দরজা আর কেউ খুলতে পারবে না। উৎস তৈরি করেছে এই জগত। ও-ই একমাত্র পারে একে নিয়ন্ত্রণ করতে।

খন্দকার কিছুই বিশ্বাস করতে পারছেন না। পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছেন এ ঘর থেকে সে ঘর। প্রতিটি দরজা খুলে দেখতে চাইছেন। একটাও খুলছে না। খন্দকার বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন, আকাশে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে এসে পড়েছিলেন ঘরের ভেতর, উৎস’র পায়ের কাছে। উৎস হাসি মুখে এসে বসল থম্ মেরে বসে থাকা সোলায়মান খন্দকারের পাশে। বলল, ‘একটা জোক্স বলি? দরজা খোলা নিয়ে। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে তোর।’

সোলায়মান খন্দকার খুনখুন করছিলেন।

‘এক বোকা গেছে শ্বশুরবাড়ি। রাতে বেডরুমের দরজা—ইয়ে জোক্সটা কিন্তু বড়দের উপযোগী। মাইন্ড করবি না তো?’

সোলায়মান খন্দকার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। ‘উৎস’ হাসিমুখে জোক্স বলেই যাচ্ছে।

 

বন্ধু রঙিলা রঙিলা রঙিলা রে!

 

আমি স্থপতি হাসান আরিফকে যা বলেছিলাম, তা হচ্ছে, ‘‘ভালো বাসা’ দেখে সোলায়মান এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে ওখানেও পাগলের মতো আচরণ করছিল। ফিরে আসার পর আমি দেখলাম, আমার স্বামী হেলমেট মাথায় দিয়ে, চোখে কাল চশমা পরে, শরীরের সব সেন্সর নিয়ে পাথর হয়ে বসে আছেন চেয়ারে।’

হাসান আরিফ ব্যস্ত হাতে হেলমেট খুলে, চোখের চশমা খুলে, সেন্সর সরিয়ে নেওয়ার পরও যে পাথর সে পাথরই থাকল। বিব্রত হাসান কাঁদ কাঁদ স্বরে বলছিলেন, ‘এর আগেও তো কত ক্লায়েন্টকে এভাবে ঘুরিয়ে এনেছি। কখনো কোন ঝামেলা হয়নি।’

হাসপাতালে নেওয়ার কথা আমিই বলেছিলাম। মাথা খুব ঠান্ডা ছিল আমার, তাই হাউ মাউ করে কাঁদতে সমস্যা হয়নি একটুও। পুলিশ এসেছিল যখন, হাসান আরিফের বক্তব্য নেওয়ার সময় আমিই বলেছিলাম, ‘উনি ডিজাইন দেখতে দেখতে হঠাৎ বললেন, বুকে ব্যথা করছে। ছটফট করতে লাগলেন। হার্টের সমস্যা ছিল, কিছু দিন আগে সিঙ্গাপুর থেকে চেকআপও করে এসেছিলেন।’

পুলিশ অফিসারটা তল খুঁজে না পেয়ে বললেন, ‘ডাক্তার তো বলছেন, উনার শরীর সম্পুর্ণ সুস্থ। বাট মেন্টালি, হি ইজ অলমোস্ট ডেড।’

হাসান আরিফ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, টের পাচ্ছিলাম। অবাস্তব ‘ভালো বাসা’ ভ্রমণের কথাটা এড়িয়ে গেলাম বলে কি উনি খুশি হলেন? তা-ই তো মনে হ’ল। কী সুন্দর হাই তুলতে তুলতে ক্লান্ত ভাব দেখিয়ে বললেন, ‘সেটা তো ভাই আমার বোঝার কথা নয়। আমি তো আর ডাক্তার নই। আমি হচ্ছি আর্কিটেক্ট। ভুলেও আমাকে আর্কিটেকচার বলবেন না, ওটা হচ্ছে সাবজেক্টটার নাম, বুঝেছেন?’

পুলিশটা কিছুই বোঝেননি। আমার হাসি পেয়েছিল খুব, কিন্তু কী সুন্দর হাসিটাকে দীর্ঘশ্বাসের ঢঙে ভাসিয়ে দিলাম বাতাসে! দু’ দিন পর বিষণ্ন মিসেস সোলায়মান সেজে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে গাড়ি দিয়ে নামলাম, হাসান আরিফের অফিসে পা রাখতেই হাসান সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন। ওর বিলটা মার যাবে না, আনন্দটা এই কারণে দিব্যি বুঝতে পারছি। 

তবে বুঝে ওঠার তো আরো কিছু ছিল। যখন আমি উৎসের সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হাসলাম আর হাসানকে বললাম, ‘আমি চুমকি’, তখন হাসানের নাকি মনে পড়েছিল হলে থাকার সময় এক ভরা পূর্ণিমার রাতে উৎস কেন শচীন কর্তার ‘বন্ধু রঙিলা রঙিলা’ গান গেয়ে হা হা করে হেসেছিল আর কেনইবা সেই উৎস সব সম্ভাবনাকে পায়ে ঠেলে বিবাগী হতে চেয়েছিল।

আমার চোখে এখন আর চশমা নেই। তাই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে নিতে উৎসের সমস্যা হ’ল না। সত্যিকারের যে কান্নার জন্য আমি এতকাল অপেক্ষা করেছিলাম, সে কান্নাটা কাঁদতে পারলাম উৎসের বুকে মাথা রেখে। হাসান আরিফ আমাকে কান্নার শান্তি দেওয়ার জন্য সরে গেলেন বলে ভাল লাগল। 

প্রথম স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা আর দ্বিতীয় স্ত্রীকে ক্রমাগত মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য কোটপতি ব্যবসায়ী সোলায়মান খন্দকারের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। বাস্তব জগতে সে শাস্তি তার হ’ত না, টাকার জোরে ঠিকই পার পেয়ে যেত। উৎসকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘অবাস্তব জগতে নিশ্চয় মানুষের বিবেক বিক্রি হয় না। হয়? উৎস!’

উৎস মুখে কোন জবাব দেয়নি। এর কোন প্রয়োজনও ছিল না।  

 

নাসরীন মুস্তাফা