লাইব্রেরি

লাইব্রেরি মীম মিজান

স্বল্পশিক্ষিত মানুষ মোহাম্মদ আলী। উঁচু মসজিদে ফ্যানের শোঁশোঁ শব্দের ভিতর রমজানের তারাবি পড়ছিলেন। তিনি আট রাকাত তারাবি পড়েন। আট রাকাত তারাবি পড়া শেষে মসজিদের খোলা জায়গায় বসলেন। উঠতি বয়সি ছেলেপুলে জোরসে আড্ডা মারছিল। তারা কেউ আট রাকাত পড়েছে। কেউ চার। আর কেউবা ছয়। এদের অনেকেই ঝুঁকে পড়েছে মোবাইলের স্ক্রিনে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ডলা মারছে দামী দামী এন্ড্রয়েডের বিশাল পর্দায়। আর মুখপুস্তিকার নোটিফিকেশন আসার টুংটাং শব্দ বেজে যাচ্ছে ক্রমাগত। উত্তরীয় মৃদু সমীরণ মোহাম্মদ আলীকে শীতল করে তুলল। শহুরে ভ্যাপসা গরম উবে গেল। ঢুলুঢুলু চোখ। দু’টো ছেলের খুনসুটির আওয়াজে ঘুম টুটে যায়। সামনে দেখতে পেলেন নানা রঙের পুষ্প, লতা, বৃক্ষের সমাহারে সুসজ্জিত এক বিশালায়তন।

 

কী এক অবচেতন মন তাকে টেনে নিলো সেই বিশালায়তনের ভিতরে পায়চারি করতে। তিনি হাঁটছেন। কিছু পাহাড়াদার আছে এইখানে। কী এক উদাসীন ভাব তাদের! মূল সড়ক ধরে আনমনা হয়ে এগুচ্ছেন তিনি। তিনি যে জায়গাটির ভিতর হাঁটছেন সেটিকে তার বিশাল বড় লাইব্রেরি মনে হচ্ছে। ডানে বাপে ছোট্টছোট্ট অনেক রাস্তা বা গলি। আর গলির দু’পাশে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন প্রকার জীবনীগ্রন্থ। বিখ্যাত এক ভাষা সৈনিকের জীবনীগ্রন্থ তার চোখে পড়ল। নাম আবুল কালাম শামসুদ্দীন। কবে জন্ম। কবে মৃত্যু। সবই লিখা আছে। কী কী অবদান তাও লিখা। এইগলিরই পাশে দেখতে পান সদ্যপ্রয়াত পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপির জীবনীগ্রন্থ। কত কত জায়গায় ভ্রমণ করেছেন তিনি। কত্ত অপারেশন করেছেন তিনি। কিন্তু তারই জীবনীগ্রন্থ আজ স্থান পেল নামকরা অনেক গুণ্ডা, বদমায়েশের জীবনীগ্রন্থের পাশে। বদমায়েশগুলোর পরিচয় লিপিবদ্ধ তাদের জীবনীগ্রন্থের প্রচ্ছদে। যেমনটি একজনের পরিচয় বিখ্যাত নেতা, ধনকুবের, জনদরদী মোকছেদ ভাই। মোহাম্মদ আলী তার জ্ঞানমতে জানেন যে, এই বিখ্যাত নেতা একসময় টোকাই ছিল। পড়ে মানুষের বাড়িঘর, দোকানপাট, সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি দখল করে হয়েছিলেন ধনকুবের। সেজেছিলেন নামকরা জনদরদী। পেয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সম্মানজনক পদবী ও সংসদে একটি আসন।

 

আরেকটু এগুতেই দেখতে পেলেন এক পীরের জীবনীগ্রন্থ। বাপরে কী সাজসজ্জা! প্রচ্ছদ যেন ঝলকে উঠছে! অন্যান্য গ্রন্থগুলোর থেকে এটি বেশ ঝকঝকা। ফকফকা। অনেকজনই সম্ভবত পড়েন এটি। অথবা খোঁজখবর রাখেন। মোহাম্মদ আলীর এক বন্ধুর বোনকে নিয়ে ভেগে গেছিল এই পীর। কত মানুষের পকেটের টাকা বের করেছে! কতজনকে ভুলভাল বুঝিয়ে বাড়িঘর সর্বস্ব বিক্রি করে তার দরবারের খাদেম আর খলিফা বানিয়েছে! পীরের লকব, পদবীও ঝাক্কাস!

 

এত্ত এত্ত বই কখন পড়ে শেষ করবে মোহাম্মদ আলী। তবুও সামনে এগিয়ে যান। দেখেন দেশের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর খেতাবে ভূষিত নারীর জীবনী। পাশেই সাজিয়ে রাখা আছে এক মুটে-মজুরের দিনলিপি। পিতৃপরিচয়হীন এক বালকের জীবনী একই সারিতে। গরীবদের একদমই সহ্য করতে পারতো না আলমাস মিয়া। তার জীবনী দেখে এই দুঃস্থ ছেলেটির জীবনীর গা ঘেঁষা।

 

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই লাইব্রেরির শেষতক পৌঁছুতে পারেন না মোহাম্মদ আলী। ক্লান্তি ভর করে তার শরীরে। তিনি ফিরে আসেন মসজিদ প্রাঙ্গণে। এসে দেখেন সবাই চলে গেছে বাড়িতে। তিনিও ভাবুকচিত্তে পা বাড়ালেন বাড়ির দিকে।

 

বাড়িতে পৌঁছুতেই তার ছেলে আনোয়ারুল ফেরদৌস শাহীন জিগ্যেস করে ওঠে, বাবা এতক্ষণ কই ছিলা? আমি তোমায় আশেপাশে কোথাও খুঁজে পেলাম না।

 

বাপরে, মসজিদের ঐ উত্তর পাশের লাইব্রেরিতে পায়চারি করতে গেছিলাম, বলে উত্তর করে মোহাম্মদ আলী।

 

বাবা, তুমি এসব কী বলো! ওটা লাইব্রেরি হতে যাবে কেন? ওটাতো আজিমপুর কবরস্থান।

 

মীম মিজান
মীম মিজান