শেকড় ভুলে শিখরের অণ্বেষণে

শেকড় ভুলে শিখরের অণ্বেষণে মীম মিজান

বাসের কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট জানালার কাঁচ দিয়ে পূর্বদিগন্তে তাকাতেই দেখলাম এক ঘোলাটে ডিমের কুসুম। এ কুসুম বিশাল দিগন্তে সকালের শীতমোড়া সূর্য। আমরা তখন হবিগঞ্জ থেকে সিলেটের অভিমুখে। সারারাত বাসের ঝাঁকুনি খেয়ে সবাই ব্যথাভরা শরীরে শীত নিবারণের মোটা বস্ত্র দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে জানালায় চোখ রাখছিলাম। আজ ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার, এক নতুন অভিজ্ঞতার সকাল। আমরা মোট পনেরজন। সিরাজগঞ্জ কড্ডার মোড় থেকে গতকাল রাত সোয়া দশটার সময় ইউনাইটেড বাসে করে রওয়ানা দিয়েছিলাম। লাল-সাদা-সবুজের ছোট্ট-বড় ডোরাকাটা বাসটির গতকালের ইঞ্জিন চালু হয়েছিল নওগাঁ থেকে। যা এসে থেমেছিল সিলেটের কদমতলী নামক কদম্বহীন এক বাসস্ট্যান্ডে।

দেশের বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন নাম। আর এসব নাম শুনে অনেকেই অজান্তে হেসে ফেলি। বলে উঠি, ‘কী আজব নাম ভাইরে!’ এ রকমই কিছু নাম দেখছিলাম লালাবাজার, গোলাপগঞ্জ ইত্যাদি। আমাদের সাথেকার আব্দুর রাজ্জাক ভাই বলে উঠলেন, ‘আরে জানেন না, এই পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ে উঠতে উঠতে মানুষের লালা পড়ত। এইজন্য নাম রেখেছে লালাবাজার।’ সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। আমি কিছুটা যুক্তিবাদী মানুষ। একটু গলা ঝেড়ে বললাম, সিলেট জেলার আরেক নাম জালালাবাদ। আর এই নামের প্রথম ‘জা’ ও শেষ ‘বাদ’কে বাদ দিয়ে লালাবাজার করা হয়েছে হয়ত।

ড়ির কাটা আটটা ছুঁই ছুঁই। আমরা বাংলার জমিন ও রাস্তা-ঘাটের অমূল্য খয়েরি পাউডার মাখা অবয়ব নিয়ে নেমে পড়লাম সিলেটের কদম্ববৃক্ষ ও ফুলবিহীন কদমতলী স্টান্ডে। বাসের ড্রাইভারকে জিগ্যেস করা হলো যে, আমরা প্রথমে হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজারে যেতে চাই, কীভাবে যাব। তিনি পরামর্শ দিলেন এই স্টান্ড পার হয়ে ব্রিজটুকু পেরিয়ে মিনিট দশেক হাঁটলেই আপনারা পেয়ে যাবেন মাজার। কিন্তু সারারাতের ক্লান্তি ও লাগেজ নিয়ে উপরন্তু দু’জন মহিলা এবং একটি শিশুসহ হেঁটে যাওয়া সমীচীন নয়। তাই তিনটে সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিলাম। অটোরিকশা এগিয়ে চললো মাজারের দিকে। প্রথমেই ব্রিজটি পেরুচ্ছিলাম আমরা। অনেক উঁচু ব্রিজ। এলাকায় ছোট্টবেলায় শুনেছিলাম যে, এই ব্রিজে রিকশা উঠতে পিছনে অতিরিক্ত একজন ধাক্কা দেয়ার মানুষ প্রয়োজন হতো। সেসময় তাদের দু’টাকা করে নাকি পারিশ্রমিকও দেয়া হতো। হ্যাঁ, এই ব্রিজটির নাম হচ্ছে সুরমা ব্রিজ। নদীটি খুব বেশি পানি তার বক্ষে বয়ে নিচ্ছে না। অনেক উঁচু করে পাড় বাঁধানো। স্বল্প বয়ে চলা স্রোতের এক পারে ক’য়েকজন রমণী তাদের বাসন কোসন মাজছেন। পাশেই লুঙ্গি পরিহিত ঊর্ধ্বাঙ্গ উদোম ব্যক্তিরা গাছের ডালের মাজনদ্বারা রাতের জমে থাকা দাঁতের ময়লা পরিষ্কারে হাত চালাচ্ছেন। দু’য়েকজন সুরমার খরাকালীন পানিতে ডুব দিচ্ছেন। সপ্তাহের মধ্যদিন। তাই কর্মজীবী মানুষের নিজস্ব কর্মস্থলে যাওয়ার ঢলের প্রারম্ভ দেখছি রাস্তায়। হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। চোখগুলো তাদের ঘুমের রেশ এখনো জানান দিচ্ছে।

 

ব্রিজের অপরপ্রান্তের কাছ ঘেঁষেই সিলেট সার্কিট হাউজ। কী ঝকঝকে তকতকে হাউসের প্রাঙ্গণ! অটোরিকশা চালক বললেন, ‘আজ এখানে মন্ত্রী আসবেন। তাই এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।’ কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম সিলেটের ডাক লেখা একটি সাইনবোর্ড। আমার লেখা একটি রিভিউ এই পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল। আরো সামনে দেখে আমার মনে হলো সিলেটের প্রাণকেন্দ্র বলা চলে এই জায়গাটিকে। ডিসি অফিস, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলো এখানে। খানিক পরেই চোখ আটকে গেলো একটি ভবনের পরিচয়দানকারী লেখা সম্বলিত একটি গেট ও সাইনবোর্ডে। ‘কেমুসাস’ বা কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ নামের সেই ভবন আমাকে উদ্বেলিত করল। এই সংগঠনের নাম কত শুনেছি! কত পড়েছি ছাপানো কালির হরফে! 

অটোরিকশা দাঁড়ালো মাজারের রাস্তার মোড়ে। এর বেশি তারা যেতে পারবে না। আমরা সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শলা-পরামর্শ করলাম যে, আগে হোটেলে উঠে তারপর ফ্রেশ হয়ে মাজারে যাব। হোটেল হলিগেট নামক হোটেলের রিসিপশনে তাদের ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আমরা বুঝলাম যে, আমাদের সাধ-সাধ্য মিলছে না। তাই পরামর্শ চাইলাম সাধ-সাধ্যের মধ্যে কোথায় হোটেল পাওয়া যাবে। রিসিপশনিস্ট ছাত্র-ভদ্র স্বভাবের। তিনি পরামর্শ দিলেন একটু সামনের মোড় পেরুলেই জিন্দাবাজার যান, সেখানে আপনাদের চাহিদার মধ্যে হোটেল পেতে পারেন। 

আমরা জিন্দাবাজারের শাহজাহান হোটেলে গিয়ে কথা বলা শুরু করেছি। হোটেলের একজন কর্মচারী আমাদের বলছেন, ‘আউগ্যা’। ‘বউগ্যা’। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। এ লোক বলে কী! কিসের আউগ্যা? কিসের বউগ্যা? চার রুম বুকিং দেয়ার কথা হচ্ছিল। ম্যানেজার বলতেছেন, ‘এখানে অনেখ ভালো সুবিদা পাওয়া যাবে। আমাদের রেস্টুরেন্ট এ আপনারা খম দামে বালু খাবার পাবেন। আপনি চাইলে শুধু দশটাখার সবজি দিয়ে ভাত খাইতে পারেন। এই হোটেলের চারতলায় এখখানা ছাদ আছে। আপনারা বসতে পারবেন।’ আমি একটু রস যোগ করে বললেম, আমরা ছাদ বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো সাথে করে তো? একগাল হেসে দিলেন ম্যানেজার। আবার বলে উঠলেন, ‘আমাদের এখানে ওয়াইফাই আছে। আছে স্মার্ট টিভি।’ আমাদের কক্ষগুলি হলো ৪০১, ৪০৩, ৪০৬ ও ৪০৮। এর মধ্যে ৪০৬ নম্বর রুমে আমি ও আমার পরিবার উঠলাম। রুমে একটি বড় খাট। পুরু তোষক। মিনি আলানা। একটি বৈদ্যুতিক পাখা। ছোট্ট একখানা টেবিল। টেবিলে মোটকা গোছের একটি টিভি। টিভিটি অনেকভাবে চালানোর চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থদের তালিকাভুক্ত। বালিশ দিয়েছে দু’টো। একখানা বড় সাইজের শাদা কাভারের লেপ। বিছানার চাদরটি সেই পরিমাণে আপত্তিকর। চাদরের জমিনে ছোপ ছোপ দাগ। 

দীর্ঘ বাস যাত্রার শ্রান্তি আর অমূল্য খয়েরি পাউডার থেকে পরিত্রাণে গোসল সারলাম টেপের শীতল জলে। সহযাত্রী একজন প্রভাষক জাকিয়া বেগম গরম জলের জন্য হাকডাক করলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সাড়া দিলো না। অগত্যা তিনিও ট্যাপের শীতল জমানো জলে কাকস্নান সেরেছেন বোধহয়। ছেলে আমার পাঁচবছর ছুঁই ছুঁই। এরকম শীতল জলে নিজেকে সপে দিতে বড্ড বেয়াড়া আচরণ করল। তবুও আমি সুবোধ বাবা সাজিনি। করালাম একখানা সিলোটি গোসল।

প্রায় দশটার দিকে সাথে করে নিয়ে আসা নুডুলস খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমার সহধর্মিণীর সেই প্রভাষক সহকর্মী জাকিয়া বেগমের স্বামী ফিরুজুল ইসলামের এক ছাত্র থাকেন সিলেটে। সেই ছাত্র গুরুজনের আগমণে স্বাগত জানাতে এসেছিলেন হোটেলে। তিনি গুরুজনের সম্মানে নামকরা রেস্তোরা ‘পানসী’তে সকালের খাবারের আয়োজন করলেন। কী খাওয়া হবে এ নিয়ে বাতচিত করার মধ্যে হোটেলবয় বলল, ‘পরাটা হবে, তন্দুরি রুটি হবে, সাদা রুটি হবে, ভুনাখিচুড়ি হবে, সাদা ভাত হবে, নান হবে, স্পেশাল নান হবে।’ আমার সবিস্ময় জিগ্যেস, আচ্ছা ভাই নান কী? আর রুটি কী? বয়ের জওয়াব, ‘রুটি একধরন আর নান আরেক ধরন।’ আমার ফারসি জানা জ্ঞান আর ইরান সফরের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, ফারসি নান অর্থই রুটি। আমি সেটাই খোলাসা করলাম। আমার সাথে ভক্ষণের অপেক্ষায় পর্যটকগণ ও বয় ইতস্তত বদনে একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলেন। অবশেষে অর্ডার করা হলো স্পেশাল নান। 

চলছিল বিপিএল। ষষ্ঠতম এ আসরের কয়েকটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে সিলেটে। আর খেলোয়াড়েরা উঠেছেন শাহজালাল (রহ.) মাজারের গেটের কাছাকাছি নামকরা হোটেলে। আমরা মাজারে ঢুকতে যাচ্ছি দেখি ভলভো বাস হোটেলের সামনের দাঁড়ানো। বিপিএল খেলিয়ে বাংলাদেশ কাঁপানো প্লেয়াররা একে একে বাসে উঠছেন। তাদের দেখার জন্য মানুষজন খুব ভীড় জমিয়েছে তিনদিকে। দানবীয় চেহারার ক্রিস গেইলকে দেখে উঠতি বয়সি কিছু ক্রিকফ্যান হৈ-হুল্লোড় করে উঠল। তাকে টিভিতে যেরকম বয়স্ক লাগে সরাসরি তার থেকেও কমবয়সী মনে হলো। কী জানি এটা কি সিলোটি পানির জাদুকরী স্পর্শ কিনা? রংপুর রাইডার্স ক্যাপ্টেন মাশরাফিকে দেখলাম সহাস্য বদনে বাসে উঠতে।

হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজারে লোকজন গতায়াত করছেন তবে সংখ্যায় একটু কম। মাজার রাস্তার দু’পাশে নানান কিসিমের জিনিসের দোকান। মোমবাতি, গোলাপজল, শাহজালাল (রহ.) এর কবরের উপর বিছিয়ে দেয়ার জন্য একধরনের জৌলুশপূর্ণ আরবি লেখা সমৃদ্ধ বড় কাপড়ের চাদর, জালালী কবুতরের জন্য ধান, গজার মাছের জন্য খাবার, শিরনীর ঢিবি ইত্যাদি। দোকানদাররা এই জিনিশপত্র হাতে নিয়ে মাজারগামী লোকজনকে বলছেন, ‘বাবার মাজারে যাবেন, খিছু লিয়া যান। বাবার খবরে আতর, গোলাপজল, মোমবাতি দিবেন না? লিয়ে যান!’

মাজার গেটটি দু’ভাগে যাতায়াতের জন্য নির্দিষ্ট। শাহজালাল (রহ.) এর সমাধিটি সিঁড়ি বেয়ে যেতে হয়। সিঁড়ির ডানদিকে জুতো রাখার জন্য ব্যবস্থা আছে। প্রতিজোড়া জুতো পাঁচটাকা করে। তার ডানেই মহিলাদের ইবাদতের জায়গা। পর্দার ভিতর। তাদের(মহিলাদের) উপরে অর্থাৎ সমাধির কাছে যাওয়া বারণ। আমার বোধগম্য হলো না যে, রাসুলে আকরাম (সা.) এর রওজাতে তো এরকম বৈষম্য নেই। তবে এখানে কেন? আমার ছোট্ট খোকাসহ সিঁড়িপথে উপরে উঠতে যাচ্ছি। একজন মহিলা একটি গোলাপজলের শিশি নিয়ে বড্ড পেরেশান। তার এই গোলাপজলের শিশিটি কেউ একজন বয়ে নিয়ে পীরের মাজারে ছিটিয়ে দিয়ে মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন। সেই মহতী উদ্যোগ দেখলাম না। আমিই গুরুদায়িত্ব নিলাম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ডানপাশে সমাধি। বামপাশে মসজিদ। আমি খোকাকে কোলে নিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম ঠিক কবরের কাছে। কবরকে ঘিরে বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত মানুষজনের দোয়ার আলাদা আলাদা জামায়াত। কবরকে চুমু খেতে খেতে এমন অবস্থা যে সেখানে কোন খাদেমের পরিচ্ছন্ন কাজের প্রয়োজন নেই। ধুলো-বালি সব ভক্তেরা খেয়ে ফেলবে। কবরের পাশেই পেটমোটা মাথায় টুপিঅলা খাদেম। তারকাছে ভক্তগোষ্ঠী বিভিন্ন সংখ্যার নোটের টাকা দিচ্ছেন। তিনি নিচ্ছেন আর পকেটে পুরছেন। একজন একটি বড় চাদরের মতো জৌলুসপূর্ণ আরবি লেখা সমৃদ্ধ কাপড় দিলেন সেই খাদেমের হাতে। খাদেম মহোদয় কবরের চারপাশের মোজাইক পাথরের দেয়ালের এককোণের গ্রিলখুলে কবর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাপড়খানি ছড়িয়ে দিলেন। ছড়িয়ে দেয়ার সময় তার ভিতরে দেখলাম না কোন আন্তরিকতার ছিটেফোঁটা। খানিকপরেই গুটিয়ে নিলেন চাদরখানি। গোলাপজলে কবরখানা চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে কেউ কেউ কবরের অনতিদূরে কোটরগুলোতে রাখছেন। অনেকেই কোরান তেলায়াত করতেছেন কবর থেকে হাত দ’শেক দূরের শানে বসে। এই একটি কাজই আমার কাছে ভালো লেগেছে। অন্ততপক্ষে এখানে এসে কোরানের কিছু অংশ তেলায়াত বা অধ্যয়ন করে যদি লোকজন জানার বা বুঝার চেষ্টা করে যে, কেন কোরান নাজিল হয়েছে? অথবা শাহজালাল (রহ.) যে কোরান পড়ে ও ঈমানের দাবীতে সুদূর সেই ইয়েমেন থেকে এখানে এসেছেন সেই দাবীটি যদি বোঝে। 

আমরা আসলে কী মুমিন-মুসলমান? হযরত শাহজালাল (রহ.) ঈমানের দাবীর তাকিদে নিজ দেশ ত্যাগ করে হাজার হাজার ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে আসলেন কেন এদেশে? তা কি দেখেছি ভেবে? আর এখানে এসেই বা তিনি কী করেছিলেন? তার যদি আমাদের মতোই কাজ হতো, তাহলে তিনি এই বিধর্মীদের দেশে এসে রাজা গৌড় গোবিন্দের সাথে লড়তেন না। তিনি মক্কা-মদিনায় রয়ে যেতেন। আর তসবিহ তাহলিল করে মুহাম্মদ (সা.) এর অসিলা করে নিজের ফায়দা হাসিল করতেন। অথবা নিজ দেশে থেকে আমাদের মতো আমোদ প্রমোদ করে মাঝে মাঝে নবীর রওজায় গিয়ে হাত তুলে কাঁদতেন। কিন্তু তিনি তা না করে ইসলামের আলোকে আলোকিত করে অন্ধকারে নিমজ্জিত এই দেশের পূর্বপুরুষদের করেছেন পবিত্র। আর আমরা তার করা কাজের কোন হদিসই করছি না। বরং শেকড় ভুলে শিখরের অণ্বেষণে হাপিত্যেশ করছি। তার দেখানো পথধরে ইসলামের আলোকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার কাজে মগ্ন না হয়ে তার কবরের কাছে ছুটে যাচ্ছি বারংবার। অবশ্যই তার সমাধির কাছে যাওয়া উচিৎ এজন্য যে, তিনি কী ত্যাগ করেছেন তা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য। তিনি যে আমল করেছেন সেটা তার জন্য। তার অসিলায় আমরা পার পাব না। আমরা পার পাব নিজের আমলে। আর সেটাই যদি হতো, তিনি মক্কা-মদিনায় যেতেন। এই কণ্টকাকীর্ণ পথধরে এখানে আসতেন না।

আচ্ছা আমরা মসজিদে কার ইবাদত করি? নিশ্চয়ই উত্তর, একমাত্র আল্লাহর। আচ্ছা আমরা কি মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় আমাদের পিছন অংশকে কি পশ্চিম দিকে ফিরাই না? নিশ্চয়ই এখানে উত্তর দিবেন, হ্যাঁ ফিরাই তো। তবে এই মাজার থেকে ফেরার সময় কেন মাজারকে সামনে রেখে পিছনে পা ফেলে আসি? তাহলে কি মাজার মসজিদের থেকেও অনেক উত্তম ও শ্রেয় স্থান? মক্কা শরীফে নামাজ আদায় শেষেও কি মুসল্লিগণ মুখ সামনে রেখে পেছন পেছন পা ফেলিয়ে বেড়িয়ে আসেন? নাকি মসজিদে যার ইবাদত করি তিনি মাজারে শায়িত ব্যক্তির থেকে কম সম্মানীয়(নাউজুবিল্লাহ!)? এ পর্যায়ে এসে আপনার বিবেকের কাছে আমার আরো কয়েকটি প্রশ্ন, এইযে আমরা টাকা পয়সাগুলো মাজারে অকাতরে দিচ্ছি তাতে মরহুম সেই ইসলাম প্রচারকারীর কী উপকার? কবরের উপর জৌলুশপূর্ণ আরবি ভাষার চাদর ছড়িয়ে দেয়াতে তাকে কি খুবই সম্মান জানানো হলো? তার কাজ যেটা ইসলাম প্রচার করা ছিল সেটা না করাতে তাকে কি খুবই মর্যাদার জায়গায় স্থাপন করলাম আমরা? ইসলামের আলোতে অন্ধকার দূরীভূত করা যার কাজ ছিল, তার কবরে কি আলোর এতোই অভাব যে মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকে আলো পাঠাব? আমলে আমলে যে ব্যক্তির জীবন পরিপূর্ণ, তার কবরে আতর, গোলাপজল, ধুনা ইত্যাদির সুবাস দিয়ে কী করব?

এসব করা কি তার সাথে চরম অসম্মান করা নয় কি? তাহলে নিজের করণীয় কি তা এতক্ষণে বুঝে গেছেন নিশ্চয়?

আমি সালাম জানালাম। তার আত্নার মাগফিরাত কামনা করলাম। বিস্ময়ে বিস্মিত হলাম ইসলামের সুশীতল ছায়া এই বঙ্গদেশ পর্যন্ত পৌঁছাতে তার অতুলনীয় ও অমূল্য ত্যাগ স্মরণ করে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে পুকুরে গজাল মাছ দেখতে গেলাম। বড় বড় অনেকগুলো গজাল মাছ। অনেকেই কিনে আনা খাদ্য খেতে দিচ্ছে মাছগুলোকে। আমার খোকার উচ্ছ্বাস, ‘আব্বু, দেখো কত্ত বড় মাছ!’ এক মহিলাকে দেখলাম কালো বেঢপ এক বোরকা পরে। সিগারেটের ভিতরকার তামাকের গুড়ো ফেলে সেখানে গাজা ঢুকিয়ে আগুন ধরিয়ে টানছে। পুকুরের দক্ষিণপাড়ে একটি বিল্ডিং। তার গায়ে কবুতরের খোপ। কবুতরের অনেক গল্প শুনেছি। কবুতর দেখে নয়নকে তৃপ্ত করলাম। বের হওয়ার সময় গেটের বামপাশে জালালী কবুতরকে ধান খাওয়ানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা দেখলাম। সেখানে লোকজন হুমড়ি খেয়ে কবুতরের ধান খাওয়ার দৃশ্য নিজেরা উপভোগ করছে। একজন ইতালির পর্যটকের সাথে সাথে দেখা হলো। তাকে আমাদের এই অনন্য শ্যামল দেশে ওয়েলকাম জানালাম।

গেটদিয়ে বেড়িয়ে বড় একটা লেগুনা ভাড়া করলাম আমরা। গন্তব্য শাহপরান (র.) এর মাজার। এঁকেবেঁকে শহরের বুকচিঁরে আমরা পৌঁছলাম শাহপরান (রহ.) এর মাজারে। মুয়াজ্জিন মাইকে আল্লাহর বড়ত্ব উচ্চকিত করে যোহরের নামাজের আহ্বান জানাচ্ছিল তখন। একটি খাটিয়ায় করে একজন মৃতব্যক্তির লাশ উপস্থিত করা হলো। নামাজ শেষে তার জানাজা পড়ানো হবে। একটি বট গাছ আছে এই মাজারের পূর্বভাগজুড়ে। মাজারের রাস্তা সংলগ্ন পূর্বপাশ ঘেঁষে একখানা পুকুর। পুকুরের পানি ময়লা-আবর্জনায় জীর্ণ, সবুজ বরণ। তদুপরি অনেকে শানবাঁধানো ঘাটে নেমে গোসল সারছেন। এই পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্বে অজুখানা ও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার স্থান। ট্যাপের পানিতে সেই পরিমাণে আয়রন আছে। অজুখানা ও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার স্থান কঠিন লালচে আকার ধারণ করেছে। আমি কিছুটা হাল্কা হয়ে অজুকরে মাজারে উঠতেই দেখি নামাজের বিরতির জন্য শাহপরান (রহ.) এর মাজার দর্শন আমার হবে না। বড্ড জোরাজুরি করে সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছি র দোহাই এ একদণ্ড দেখলাম। জৌলুশে পূর্ণ। নামাজ শুরু হতে খানিকটা সময় লাগবে তাই আমি মুসাফির দু’রাকাত কসর আদায় করে পনেরজনের সেই টিমে যোগ দিলাম। দেখি সবাই অপেক্ষায়। লেগুনায় বসে আছে। লেগুনায় উঠতেই জানলাম আমরা এখন মালনিছড়া অভিমুখী। পনেরজন সংকুলান হয় না এই সিলোটি লেগুনায়। বেশ ঠাসাঠাসি হয়েছিল। তবুও একটা মজার ও হাস্য-রসাত্নক পরিবেশে আমরা পৌঁছলাম মালনিছড়ায়। মালনিছড়া পৌঁছানোর কিছুটা আগে পেলাম বিপিএল অনুষ্ঠিত হওয়ার মাঠের প্রবেশ পথ। ক্রিকফ্যানদের উচ্ছ্বাস আর ভীড় লক্ষণীয়। কাঠফাটা রোদ। তাতেও তাদের বিরক্তিটুকুন নেই। 

আমরা মালনিছিড়া তথা বাংলাদেশের সর্বপ্রথম চা বাগানের গেটে। রাস্তায় এত্ত এত্ত হোন্ডা যে গণনা করা যাচ্ছে না। সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ও শপথগ্রহণকারী মন্ত্রী মহোদয়গণ যাবেন খেলা দেখতে। আর তাদের মহড়াদানকারী বাহিনী এই স্বাগত জানানোর ঢেউয়ে উদ্বেলিত করছে রাস্তাঘাট। চাবাগান দেখে আমরা রাবার বাগান দেখলাম। রাবারও খেজুর রসের মতো ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ে। এই রাবার বাগান এতটা উঁচু-নিচু যে আমাদের জন্য ওঠানামা বেশ সতর্কতার বিষয়। নইলে পা পিছলে অনেকখানি নিচে পড়ে গুরুতর আহত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আমরা মালনিছড়ায় চরে বেড়াচ্ছি আর বিপিএলের মাঠের হৈ-হুল্লোড় শুনতে পাচ্ছি। এক কেজি চা কিনেছিলাম। সেখান থেকে হোটেলে ফিরলাম। বিকেল হয়ে গেছে। আমরা ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলাম।

জিন্দাবাজার এলাকায় মাগরিবের আজান ধ্বনিত হচ্ছে মসজিদের মাইক থেকে। সারারাতের ক্লান্তি আর গোটা দিনের নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের শ্রান্তি ভেঙে মাগরিব সেড়ে তিনজনের এক বাজার পর্যটক দল নেমে পড়লুম জীবন্তবাজার তথা জিন্দাবাজারে। লোকজন গিজগিজ করছে। তার মানে এইজন্য বুঝি এই বাজারের নাম জিন্দাবাজার। না সে ধারনা ভুল প্রমাণ করে সঠিক তথ্যটি রাতে ভোজনবাড়ি হোটেলে জানিয়েছিল কিউটবয় মুয়াজ বিন এনাম। উদীয়মান ছড়াকার তিনি। 

রাস্তার দু’ধার দিয়ে সারি সারি দোকান। মাঝে মাঝে লম্বা কাপড়ের মার্কেট। ভূট্টা আগুনে পুড়ে বিক্রি হচ্ছে। নানা স্বাদের গ্যাস্ট্রিকের আঁধার ভাজা-পোড়া। গিন্নি আমার কিছু একটা কিনে সিরাজগঞ্জ থেকে বয়ে নেয়া টাকার সৎকার করবেন। পর্দার দোকানে ঢুকলাম। সেখানে মশারি রাখার একটা নান্দনিক কভার কিনে ক্রয়ের শুভ সূচনা করলেন। কৃত্রিম ফুল ও ঘর সাজানোর নানা আইটেমের দোকান। সোপিচ কিনতে তিনি আগ্রহী হলেন। কিন্তু আমার না। বাসের ঝক্কিঝামেলায় এই সোপিচ বাসাঅব্দি পৌঁছবে বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে।

আমার গৃহকর্ত্রীকে বাজার ঘুরানোর ফাঁকে ফাঁকে ঢুঁ মারছিলাম ম্যাসেঞ্জারে। সিলোটি কয়েকজন লিখিয়ে বন্ধু আছেন। তাদের মধ্যে প্রকাশক সিদ্দিক আহমদ ভাই, কবি ও শিক্ষক মামুন সুলতান ভাই, ছড়াকার তোরাব আল হাবিব, ছড়াকার ও নাট্যকার মিনহাজ ফয়সল, কিউটবয় মুয়াজ। নামোল্লিখিত শিল্পমানসগণের সাথে টুংটাং করে জানান দিচ্ছিলাম আমার জিন্দাবাজারে জীবিত বিচরণের কথা। সিদ্দিক ভাই ফোন করে বললেন, ‘শাহ জাহান হোটেলের সামনে দাঁড়ান। আমি আসতেছি।’ তিনি উপস্থিত হলেন। আমাদের তিনজনকে নিয়ে তিনি হাঁটা শুরু করলেন ভোজন বাড়ির দিকে। ভোজন বাড়ির দ্বিতল মেঝের এককোণে বসে বেশ গল্পগুজব। নান ও চিকেন চাপ দিয়ে আতিথেয়তা করালেন। ক’দিন পরেই বইমেলা। তাই প্রকাশক হিশেবে তার শ্বাস ফেলানোর জোটুকুও নেই। আন্তরিকতার দরুণ বেশ সময় কাটালেন। হোটেল থেকে বেড়িয়ে আমরা রাস্তার বাঁপাশ ধরে হাঁটছি আর নানা জিনিশ কেনার চেষ্টা করছি। ঢাকার থেকে এখানে জিনিশপত্রের দাম বেশি। হোটেলে ফিরে সালমা মিজান আর তাশভিক মিজান ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি মার্ক জুকারবাগের মুখপুস্তিকা পড়ছিলাম। মুয়াজের ফোন। ‘ভাইয়া, আমি শাহ জাহান হোটেলের গেটে।’ তার সাথে মোলাকাত করে হাঁটতে হাঁটতে আবারো সেই ভোজন বাড়ি। এবার অবশ্য নিচতলার জানালা ঘেঁষা চেয়ার টেবিলে বসে চা খাচ্ছি আর নানা গল্পে মশগুল। মামুন সুলতান ভায়ের ফোন। ‘আমি শাহ জাহান হোটেলের গেটে। আপনি কই?’ আমি জানালাম যে আমি আর মুয়াজ চা খাচ্ছি ভোজন বাড়িতে। তিনি বাইক টেনে কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত। ভারচুয়াল জগৎ থেকে আজ একচুয়াল জগতে পেলাম শারীরিক স্পর্শ। সহাস্যমুখ নিয়ে কোলাকোলি। আবারও নান দিয়ে চা খাওয়া। তিনি তার ‘মেঘরাখালের বাঁশি’ নামক কাব্যগ্রন্থ উপহার দিলেন। তিন শিল্পপ্রেমিকের একখণ্ড আড্ডা। রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি তিনি। তার কাব্য পাঠে মনে হয় সচেতন ও সামগ্রিক বিষয় ধারণকারী। ভোজন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। বারোটা ছুঁই ছুঁই ঘড়ির কাটা। তৎক্ষণে জিন্দাবাজার প্রায় মানুষশূন্য হয়ে নিস্তব্ধ। মুয়াজ একটি মাজার দেখিয়ে বললো, ‘এই, এটি জিন্দা পীরের মাজার। এনার নাম থেকেই এলাকার নাম জিন্দাবাজার।’ আমি বললাম, জিন্দা মানুষকে আবার কবরে সমাহিত করা যায় নাকি? মামুন সুলতান ভাই তার বাইকে শাই করে শাহ জাহান হোটেলের গেটে ছেড়ে দিলেন আমায়। আমি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আগামীকাল বিহানবেলা পর্যন্ত ঘুম নামক মৃত্যুকে স্বাগত জানালাম।

মীম মিজান
মীম মিজান