সন্ধ্যারাগের আচমকা আলোয়
আমার এই মুহূর্তে খুব বিরক্ত লাগছে। খুব বলতে খুউউব।
কফি আমার ভীষণ পছন্দের কিন্তু বিরক্তির কারণে এখনো একটা চুমুকও পড়েনি তাতে। আমার সামনে অসম্ভব বিরক্তিকর একজন লোক বসে আছেন। তিনি দিব্বি কফি খাচ্ছেন আর আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছেন। এমনিতে আমার দিকে কেউ বেশিক্ষণ তাকালে বিব্রত হয়ে পড়ি। এই লোক তো হাসছে। রাগে আমার নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। নাহ্ নিজের চুল ছিঁড়বো কেন? ছেঁড়ার জন্য কি চুলের এতো যত্ন করি? ইচ্ছে করছে সামনে রাখা মগটার সবটুকু কফি লোকটার গায়ে ঢেলে দিই। কিন্তু মা বারবার করে নিষেধ করে দিয়েছে উল্টাপাল্টা কিছু যেন না করি। আমি খুবই বিরক্তি নিয়ে জানতে চাইলাম, -আচ্ছা আমাকে দেখে কি আপনার সং মনে হচ্ছে?
লোকটির নির্লিপ্ত উত্তর – হুম, একটু তো মনে হচ্ছেই।।
-মানে?
-এতো সুন্দর করে না সেজে এলেও পারতেন। শুনেছি আপনার নাকি মত নেই?
-ঠিকই শুনেছেন।
-বাব্বাহ্! মত না থাকতেই যে সেজেছেন, মত থাকলে না জানি আর কি করতে!।
আমি এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম। টেবিলের দিকে একটু ঝুঁকে আঙুল উঁচিয়ে বললাম,
– এই যে মিস্টার, শুনুন, আমি মোটেও সাজিনি। পরিপাটি থাকতে আমি পছন্দ করি।
উনি আবার সেই গা জ্বালানো হাসিটা হাসলেন। আমি কন্ঠে আরও একটু ঝাল মিশিয়ে বললাম
– এখানে আসার আগে বাবা-মাকে টেন পারসেন্ট আশা দিয়ে এসেছিলাম। আপনাকে দেখে তা এখন জিরোতে নেমে গেছে। আপনি একজন অসম্ভব বিরক্তিকর মানুষ।
-আমি জানি।
মানুষটার মিচকে শয়তানের মত হাসি আমাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করলাম।
– আচ্ছা আপনার একটা গুণ বলুন তো যেকারণে আপনাকে আমি পছন্দ কর?।
– দোষগুলো আগে শুনি।
আমি কেবল তার দোষগুলো বলতে যাব এর আগেই চারদিকে পটপট করে কি যেন শব্দ হল। সেই সাথে লাইটগুলোও নিভে গেল। সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্টটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। চারপাশে লোকজন ছুটাছুটি করছে। আমি মানুষটার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললাম,
– কি হয়েছে?
-মনে হয় ইলেক্ট্রিসিটিতে কোন সমস্যা হয়েছে।
তার কথা শুনে আমি কেঁদেই ফেললাম। আমি যে ভীতুর ডিম, এতো বড় একটা ব্যাপার হজম করব কীভাবে?
-এখন কি হবে? আমার কিছু হলে আব্বু আম্মু বাঁঁচবে না।
-কাঁদবেন না, প্লিজ। আমি তো আছি।
এই মুহূর্তে বাইরে থেকে “আগুন”, “আগুন” বলে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে বের হব তারও কোন উপায় নেই। দরজায় মানুষ গিজগিজ করছে। মানুষটা উঠে দাঁড়ালেন। নিজের পরণের কোটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পরতে বললেন। লক্ষ্য করলাম, আমি ভয়ে কাঁপছি। তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে কোটটা পরে নিলাম। আমার হাত ধরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। অনেক চেষ্টার পরও আমরা বেরোতে পারছি না। এদিকে আমি সমানতালে কেঁদেই চলেছি। হঠাৎ মানুষটা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিলেন। চেয়ার দিয়ে সামনের থাইগ্লাসটায় সজোরে আঘাত করতেই ঝনঝন শব্দে সেটা ভেঙে গেল। রেস্টুরেন্টের কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠলেন “এই ভাই, এটা কি করলেন?” সেদিকে কান না দিয়ে আমার হাত ধরে ‘আসুন’ বলে তিনি ছুটতে শুরু করলেন। এক ছুটেই সিড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম। এখানেও প্রচণ্ড জটলা। সবার আগে নামার প্রচেষ্টা। আমরা সুযোগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। কেউ একজন আমার পা মাড়িয়ে চলে গেল। ওমা গো- বলে পা চেপে ধরে আমি বসে পড়লাম। দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল আপনা আপনি গড়িয়ে পড়ল। অজ্ঞাত লোকটাকে ইংলিশে কয়েকটা গালি দিয়ে মানুষটা আমার পাশে বসলেন। খুব নরম গলায় বললেন,
– চলতে পারবেন?
-না। আমি বোধ হয় আজ এখানেই শেষ হয়ে যাব।
– এত ভয় পাবেন না। আমি আছি তো আছি।
আমার হাত ধরে উঠানোর চেষ্টা করলেন। আমি উঠতে পারছিনা। হঠাৎ আমি শূন্যে ভাসলাম। তিনি আমায় কোলে তুলেছেন! আমাকে লজ্জা পাওয়ার অবকাশও দিলেন না। একটু ফাঁক পেয়েই সিড়ি পথে পা চালালেন। আমিও সুবোধ বালিকার মত নিজে থেকেই ওনার গলা জড়িয়ে ধরলাম। মানলাম আমি গম কিংবা আটার বস্তা নই তবুও একজন মানুষকে কোলে করে চারতলা থেকে নামানো কি চাট্টিখানি কথা? আমি কয়েকবার নামিয়ে দিতে বললাম, তিনি শুনলেন না। কত ধাক্কা, কতজনের কত কথা উপেক্ষা করে তিনি আমাকে নিয়ে নিচে নামলেন। নিচে এসে দেখি রাস্তায় অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এবার আমার ভীষণ লজ্জা পেল। তিনি একটা রিক্সা ডেকে আমাকে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে বসলেন। বিল্ডিংয়ের আগুন এতোক্ষণে নিভে গেছে। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার মনের ভেতর হঠাৎ একটা আলো জ্বলে উঠল। এই আলোয় আমার মনের অন্ধকার গলিগুলো আমি দেখতে পেলাম। নিজের প্রতি ঘৃণা হল, রাগ হল প্রচণ্ড। এতোদিন ভালো মানুষ সাজার মেকি অভিনয় করে গেছি তাহলে? সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। পরিস্থিতি আমাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে থাকে। এইযে আমার পাশে বসা মানুষটা, যাকে কিছুক্ষণ আগে অসম্ভব বিরক্তিকর মনে হচ্ছিল; তার গায়ের রং কালো, মাথায় সামান্য টাক, একটু বেটে বলে আমার বর হিসেবে তাকে গণ্যই করছিলাম না। অথচ এখন এই মানুষটাকেই আমার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ বলে মনে হচ্ছে। নিজে সুন্দর বলে অসুন্দরদের এড়িয়ে চলতাম। আজ বুঝলাম সৌন্দর্য কখনো সুদর্শন চেহারায় থাকে না, সৌন্দর্য থাকে মনে।
আমি কতকিছু ভাবছি, বারবার তাকাচ্ছি মানুষটার দিকে। কিন্তু তিনি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছেন। একবারও তাকাচ্ছেন না আমার দিকে। আমি বুঝে গেছি, এই মানুষটা আমার পাশে থাকলে আমাকে তিনি নরকেও একা ছাড়বেন না। আমি তো সারাজীবন এমনই একজন জীবনসঙ্গী চেয়েছি যার সবটা জুড়ে শুধু আমি থাকব। তাহলে তার বাহ্যিক রূপে কি এসে যায়?
রিক্সা আমাদের বাসার দিকেই যাচ্ছে। রিক্সাওয়ালাকে বললাম
– মামা, রিক্সা ঘোরান। আমরা ওদিকে যাব না।
অবাক হয়ে মানুষটা জানতে চাইলেন
-বাসায় যাবেন না?
-না। আজ সারা শহর ঘুরবো।
– কিন্তু আপনার তো পায়ে ব্যথা।
– আপনি আছেন তো। প্রয়োজনে আবার কোলে নেবেন।
মানুষটা হাসলো। আবছা আলোয় দেখলাম তার হাসিটা বেশ সুন্দর, প্রাঞ্জল। আকাশে কি সুন্দর থালার মতো একটা চাঁদ উঠেছে। ভেবেছিলাম এই মানুষটাকে রিজেক্ট করে আজ হ্যাট্রিক করব। মুক্তির আনন্দে ডানা ঝাপটে একটু সুখ বিলাস করব। কিছু কিছু বাঁধনেও যে সুখ আছে, অন্যরকম একটা মুক্তি আছে আগে কখনো বুঝিনি। সন্ধ্যারাগে আচমকা যে আলোকচ্ছটা মনের কোণে ছলকে উঠল তা আমার জীবনের এতোটা অন্ধকার ঘুচিয়ে দেবে, কে জানতো।
Facebook Comments Sync