সাম্যবাদী নজরুল: অসাম্যের শিকার/ আফরোজা পারভীন

সাম্যবাদী নজরুল: অসাম্যের শিকার/ আফরোজা পারভীন

পরাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। দেশ তখন ব্রিটিশের করায়ত্ত। ব্রিটিশরা সব লুটে  নিয়ে তাদের দেশে পাচার করছিল। সম্পদের পাহাড় গড়ছিল নিজেদের দেশে। অথচ ভারত জুড়ে তখন দারিদ্রের  নির্মম কষাঘাত, ধনী-গরীবের ব্যবধান আকাশসম। যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, মারামারি নিত্যকার ঘটনা। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বিরোধ প্রতিদিনের চিত্র ।

১৯১৯ সালের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন নজরুল। পৃথিবীর প্রায় ১২ আনা রাষ্ট্র  তখন ছিল উপনিবেশ। এইসব দেশের মানুষ ছিল পরাধীন।  মানবতা ছিল পর্যুদস্ত । অন্যদিকে স্বাধীন রাষ্ট্রেও ধনী দরিদ্রের তারতম্য ছিল আকাশচুম্বী। সম্পদ, ক্ষমতা, কেন্দ্রীভূত ছিল  মুষ্টিমেয় কতিপয় লোকের হাতে।

নজরুলের  জন্মই যেন হয়েছিল ধনী দরিদ্রের প্রভেদ আর সবরকম সামাজিক  বৈষম্য দূর করার জন্য। নজরুল সাম্যবাদের বাণী প্রচার করে গেছেন সোচ্চারে। তার মতো এমন জোরালোভাবে আর কোনো কবি-সাহিত্যিক সাম্যবাদের কথা বলেছেন কীনা আমার জানা নেই।

নজরুল ছিলেন প্রচÐ আবেগী। যা বিশ^াস করতেন সেটাই বলতেন, সেটাই করতেন। মনেপ্রাণে সাম্যবাদী ছিলেন তিনি। আবেগের আতিশয্যে অনেক সময় হয়ত অতি উচ্ছ¡াসী হয়ে পড়তেন। কবিতায় ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেননি তিনি কোথাও কোথাও, এমন সমালোচনা আছে। কিন্তু সেকালে যখন কেউই কথা বলছে না , মুখ খুলছে না, মুখ বুজে সব মেনে নিচ্ছে তখন এমন আবেগী ধাক্কার প্রয়োজন ছিল।

নজরুলের সাম্যবাদে ঈশ্বরের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই, নেই কোনো অস্বীকৃৃতি বা অবিশ^াস ।  তার  অভিযোগ সেই সব মানুষ নামধারীর প্রতি যারা মানুষের সমাজে কৃত্রিম ভেদাভেদ রচনা করে নিজেদের স্বার্থসাধনে রত।  তিনি বিশ^াস করতেন, জগতের সবাই খারাপ নয়, সবাই  অসাধু নয়, ভন্ড নয়, সবাই স্বার্থান্বেষী নয়।  কারণ মানুষের মাঝেই বিরাজ করে  ভগবান।

মানুষের মাঝে যেমন আছে ভগবান তেমনই আছে শয়তান। মানুষের মধ্যে কামনা, বাসনা, লোভ প্রলোভন ক্ষুধা থাকবেই। এসব আছে বলেই মানুষ । নইলে সবাই অতিমানব হতো। কিন্তু  লোভ লালসা অসততা জয় করার সাধনস্পৃহাও থাকতে হবে। এ স্পৃহা সবার মনেই আছে। দরকার সেটাকে জাগিয়ে তোলা, সেটার উদ্বোধন। নজরুলের কবিতার ছত্রে ছত্রে আমরা পাই সেই উদ্বোধনের আহŸান। সাম্যবাদের প্রকাশ দেখি অবারিত। ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটিতে তিনি পতিতা নারীর মাতৃত্বকেই মা বলে সম্বোধন করেছেন। কামনার মাধ্যমেই সন্তানের জন্ম হয়। হয়ত পতিতার কামনা অবৈধ। কিন্তু কেন তার এই অবৈধ কামনা সেটা সবার আগে বিবেচ্য।  পতিতাকে ভাল হবার সুযোগ সমাজ দেয় না। সে ভাল হতে চাইলেও সমাজ তার সামনে দ্বারগুলি একে একে বন্ধ করে দেয়।  নজরুল এটা সমর্থন  করেননি।  তার ভাষ্যমতে ‘পাপ করিয়াছি বলিয়া নাই কি পুণ্যের অধিকার?  অবশ্যই আছে। প্রতিটি মানুষেরই পুণ্য করার অধিকার আছে। সেই অধিকার কেউ হরণ করতে পারে না, অস্বীকারও করতে পারে না। ‘ অসৎ চরিত্রের জন্যে যদি নারী পতিতা হয়,  তাহলে একইভাবে অসৎ চরিত্রের জন্য  নরকেও পতিত করা উচিত।’ তাছাড়া পতিতা কেন হয়, কে তাকে পতিতা বানায় সে বিচার না করেই তার জন্য দÐ নির্ধারণ করা অন্যায়, অরাজকতা।

নজরুল মনে প্রাণে চাইতেন নর-নারীর সমান সামাজিক মর্যাদা। আর এই চিন্তা থেকেই তিনি লিখেছিলেন ‘বারাঙ্গনা‘, ‘নারী’ প্রভৃতি কবিতা। মানুষকে নিয়েই পৃথিবী। আর সেই মানুষের মাঝে আছে পুরুষ, নারী, আছে তৃতীয় লিঙ্গ। সবাই প্রকৃতির সন্তান। প্রতিটি মানুষই মানুষ, কেউ বাদ নয় মানুষের হিসেব থেকে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের  যদি সমান মর্যাদা, সমান  মানবিক অধিকার মেলে, তাহলে পৃথিবী হবে সুখের নিবাস, সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন। এমন পৃথিবী সব মানুষের কাম্য। শুধু অত্যাচারী লোভী আর স্বার্থপর মানুষ চায় বিভেদের পৃথিবী। তারা চায় শুধু নিজেদের সুখ, নিজেদের আনন্দ।

ঘুণেধরা  সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নজরুলের তুমুল প্রতিবাদী কবিতা  ‘বিদ্রোহী’ যেন মানবমুক্তির আকুল-আকুতি। নজরুল কবিতার শেষাংশে বলেছেন-

‘মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন- রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি  সেই দিন হব শান্ত! ’

(বিদ্রোহী: কাজী নজরুল ইসলাম)

এ কবিতায় কবি উৎপীড়িতের কথা বলেছেন। উৎপীড়িতের ক্রন্দন তাকে ব্যথিত করে । তাই তিনি অশান্ত। তিনি সেদিনই শান্ত হবেন যেদিন উৎপীড়ন হবে না। উৎপীড়িতের ক্রন্দনের শব্দ আকাশে বাতাসে কেঁদে ফিরবে না।

নজরুল কেবল সাম্যের বাণী প্রচার করেই থামেননি, অসাম্যের কদর্য কলুষিত রূপও তুলে ধরেছেন। তিনি নিজে অসাম্যের বীভিষিকাময় রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন, এর ভয়াবহতা  দেখেছেন তাই চেয়েছিলেন তাঁর সকল কর্ম ও সাধনা দিয়ে সব ধরনের অসাম্য দূর করতে। নজরুলের সাম্যবাদ তাই চাপিয়ে দেয়া কোন বিষয় নয়। এই সাম্যবাদী চিন্তা তাঁর হৃদয়জাত। আর এই সাম্যবাদ  প্রকৃতির আইনেরই অংশ । এ পৃথিবীর মালিকানা সবার। কোন ব্যক্তি, জাতি, গোষ্ঠী বা দেশ বিশেষের নয়।  মহান আল্লাহর সৃৃষ্ট দুনিয়ায় সৃষ্ট জীব হিসেবে সকল মানুষের সমঅধিকার রয়েছে সবকিছুর উপর। আর এটিই সাম্যের মূলমন্ত্র। নজরুলের ভাষায়,

রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে

‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে।

এই ধরণীর যাহা সম্বল

বাসে-ভরা ফুল, রসে ভরা ফল,

সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখির কণ্ঠে গান,

সকলের এতে সমঅধিকার, এই তাঁর ফরমান!’

(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জীবনের শেষ অভিভাষণে বলেছেন, আমার কাব্য আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছে। বিনা কারণে তিনি কিছুই সৃষ্টি করেন নাই। ‘এ নহে বিলাস বন্ধু…‘ গানে যেন তিনি এ কথাই বলেছেন।

নজরুলের সাম্যবাদ সর্বব্যাপী, সর্বপ্লাবী। তিনি সরাসরি সাম্যের কথা বলেছেন।  নেই তাঁর বলায় কোনো অস্পষ্টতা, নেই কোনো ভণিতা-ভন্ডামি। তিনি যা বিশ্বাস করেছেন তাই বলেছেন এবং যা বলেছেন তাই করেছেন। কোনো কিছু পাশ কাটিয়ে বলা কওয়ার মতো মানুষ বা কবি তিনি ছিলেন না। বরং সবকিছুকে হৃদয়ে ধারণ করে, সবটুকু  চাওয়া দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবার চিন্তা  থেকে তিনি লিখেছেন, বলেছেন। সাদা আর কালোর মধ্যে কোন  বৈষম্য দেখেননি। কোনো   বৈষম্য  আনার  নৈতিক বা আইনগত অধিকার কারোর নেই এটাই তিনি বিশ^াস করতেন। কেননা,

শ্বেত পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ।

আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ!

তুমি বল নাই, শুধু শ্বেতদ্বীপে

জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে,

সাদা র’বে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান।’

(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)

কিন্তু সব ন্যায়কে পায়ে দলে অসাম্যের রাজত্ব কায়েমের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীকে অস্থির করে রেখেছিল ব্রিটিশরা। রেখেছিল মানুষ নামধারী লোভী আর ঈর্ষাতুর কতিপয় পাপাত্মা। এরা কখনো রাজা, কখনো জমিদার, কখনো বা মহাজন সেজে অন্যের অধিকার অন্যায়ভাবে লুণ্ঠন করে। নজরুলের কলমে এদের কথা  ফুটে উঠেছে এভাবে,

‘তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী,

রসনা তাহার শ্যামল ধরায় করিছে সাহারা গোবী!

মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া

রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া!

সে পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস্থান!

ভাই-এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান!’

(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)

মানুষে মানুষে যারা  বৈষম্যের জগদ্দল পাহাড় সৃষ্টি করছে তাদের মূলোৎপাটন তো দূরের কথা, উল্টো তাদেরকে বীরের আখ্যা দেয়া হয় এ অদ্ভুত সমাজে!

কিন্তু অত্যাচারিতদের বাহ্যত দুর্বল মনে হলেও এরাই শক্তিশালী। কারণ এরা সংখ্যা আর শক্তিতে বেশি। এদের রয়েছে সততার অপরাজেয় শক্তি। অধিকারহারা মানবগোষ্ঠীকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন, তাদের শিখিয়েছেন দৃপ্ত উচ্চারণ-

তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে করিব ভোগ,

এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন-দিনের যোগ।

তাজা ফুলে ফলে অঞ্জলি পুরে

বেড়ায় ধরণী প্রতি ঘরে ঘুরে,

কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান?

আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ

এতদিনে ভগবান!

(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)

এ পৃথিবী সবার। এমন কোনো দস্যু বা ডাকু নেই যে কারো গোলায় ধান কেড়ে নেবে, কারো ক্ষুধার অন্ন কেড়ে নেবে। যদি কেউ তা করতে চায় তার প্রতিবিধান অবশ্যই হবে। কারণ ‘সাম্য’ সত্য। আর অসাম্য মিথ্যা। মিথ্যা মানেই কপটতা, দানো, দৈত্য।   দৈত্যের হাত থেকে সত্যকে মুক্ত করে সুন্দর পৃথিবী প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নজরুলকে আমরা পাই আপোসহীন হিসেবে।  সাম্যের একজন নিরন্তর সাধক হিসেবে। মানবসৃষ্ট অসাম্যের সকল প্রাচীর ভেঙে নজরুল সাম্যের গান শুনিয়েছেন।

নজরুল প্রতিটি মানুষের মাঝেই স্রষ্টাকে প্রত্যক্ষ করেন। তিনি বিশ^াস করতেন মানুষের মন শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান, উপসনালয়। ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই’ কিংবা ‘কারো মনে তুমি দিও না আঘাত/ সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে/ মানুষেরে তুমি যত কর ঘৃণা/ খোদা যান তত দূরে সরে।’ সাম্যের এসব অমোঘ বাণী বিঘোষিত হয়েছে নজরলের রচনায় দর্পের সাথে, সোচ্চারে।

নজরুল পাপকে ঘৃণা করেছেন, পাপীকে নয়। তাই তিনি বারাঙ্গনাকে মা বলতে পেরেছেন। চোর-ডাকাত, মিথ্যাবাদী তথা সকল পাপীর প্রতি তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন পরম মমতার হাত।

সাম্যের গান গাই

যত পাপী-তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।

(পাপ : কাজী নজরুল ইসলাম)

তিনি পাপীকে ভালবেসেছেন, সংশোধন হবার সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে পাপকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। নজরুল এমন  এক সমাজ ও রার্ষ্টের  স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে কারো কোনো অন্যায় করার প্রয়োজন হবে না, পাপের পথে যাবার প্রয়োজন হবে না। সবাই থাকবে সমান। সকলে মিলে ন্যায় ও সাম্যের প্রতিষ্ঠা করবে। যেখানে মানুষের মাঝে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। এমনকি পাপী-তাপী, চোর-ডাকাতও মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সে প্রয়াস চালানো হবে তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে।

‘চোর-ডাকাত’ কবিতায় কবি চুরি ডাকাতির বিষয়টি সামগ্রিক অর্থে দেখেছেন।  আমরা যাদের চোর-ডাকাত হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেই এবং সমাজচ্যুত করি, এদের চেয়েও ভয়ংকর হ’ল তারা যারা অন্যের সম্পদ লুট করে ‘ পেতেছে বিশ্বে বণিক- বৈশ্য অর্থ- বেশ্যালয়’। আর এদের কারণেই

অন্ন, স্বাস্থ্য, প্রাণ, আশা, ভাষা হারায়ে সকল-কিছু,

দেউলিয়া হয়ে চলেছে মানব ধ্বংসের পিছু পিছু,

পালাবার পথ নাই,

দিকে দিকে আজ অর্থ-পিশাচ খুড়িয়াছে গড়খাই।

( চোর-ডাকাত : কাজী নজরুল ইসলাম)

ড. সুশীলকুমার গুপ্ত লিখেছেনÑ ‘নজরুল কাব্যের এই বিদ্রোহাত্মক ভাবই পরবর্তী বাঙলা সাহিত্যে সাম্যবাদী ধারণা প্রচারে নজরুলের অবদান অবশ্য স্বীকার্য। …বহু শিরোনামায় বিভক্ত ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় নজরুল সাম্যবাদের প্রতি যে বিশ্বাস ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, তার তুলনা বাঙলা সাহিত্যে প্রায় নেই বললেই চলে।’

সাম্য ভ্রাতৃত্ব এবং উদারতা নজরুলের পারিবারিক ও ধর্মীয় উত্তরাধিকার। এর একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ড. সুশীলকুমার গুপ্ত ‘নজরুলের পূর্বপুরুষেরা পাটনার অন্তর্গত হাজীপুরের অধিবাসী ছিলেন। সম্রাট শাহ আলমের সময় তাঁরা বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত চুরুলিয়ায় এসে বসবাস আরম্ভ করেন। মোগল রাজত্বকালে এখানে যে একটি বিচারালয় কাজী নজরুলের পূর্বপুরুষ এই বিচারালয়ের কাজী ছিলেন। তাঁর বাড়ির পূর্বদিকে ছিল রাজা নরোত্তম সিংহের গড় আর দক্ষিণে পীরপুকুর। এই পুকুরের পূর্বপারে পীরপুকুরের প্রতিষ্ঠাতা সাধক হাজী পাহলোয়নের মাজার শরীফ এবং পশ্চিমপারে একটি ছোট সুন্দর মসজিদ। নজরুলের পিতা ও পিতামহ সমস্ত জীবন ধরে এই মাজার শরীফ ও মসজিদের সেবা করে পরিবারের ভরণপোষণ করে যান। মুসলমানধর্মের প্রতি অসাধারণ নিষ্ঠা থাকা সত্তে¡ও নজরুলের পিতা অন্য কোন ধর্মমতের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন না। ধর্মের ক্ষেত্রে পিতার এই উদারতা নজরুল উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছিলেন। তাছাড়া ফারসী ও বাংলা কাব্যের প্রতি গভীর অনুরাগও তিনি লাভ করেছিলেন তাঁর পিতার কাছ থেকে।’

শৈশবে দেখা ইসলামের সুমহান সাম্য এবং সৌন্দর্য্যর রূপ পরবর্তীকালে তাঁর  জীবনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। পতিত মুসলমানদের বিষয়ে তাঁর আক্ষেপের সীমা ছিল না। বিশ্বসভ্যতাকে সুরক্ষার জন্যে তিনি বারবার ফিরে গেছেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে, স্বর্ণালী সময়টিতে। সাহায্য প্রার্থনা করেছেন আল্লাহ পাকের দরবারে, মিনতি সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়া সালামের প্রতি,

‘পাঠাও বেহেশত হতে হজরত পুনঃ সাম্যের বাণী,

(আর) দেখিতে পারি না মানুষে মানুষে এই হীন হানাহানি।’

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর  জীবন ছিল নজরুলের আদর্শ। তাঁর জীবনাচার তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, তাঁর কীর্তি বিহŸল করেছিল,

মানুষে মানুষের অধিকার দিল যে-জন

‘এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই কহিল যে-জন,

মানুষের লাগি চির দীন বেশ ধরিল যে-জন

বাদশাহ-ফকিরে এক শামিল করিল যে-জন

(আজি) মাতিল বিশ্ব-নিখিল মুক্তি কলরোলে।

পতিত মুসলিমরা যেমন তাকে আহত করেছে, রক্তাক্ত করেছে তেমনি হন্দুধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিরাজমান জাতিভেদ প্রথা তাঁকে  মর্মাহত করেছে।  তার প্রমাণ ‘জাতের নামে বজ্জাতি’সহ আরও অনেক লেখায়।

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ ছিলেন নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নজরুলের জীবনে তাঁর গভীর প্রভাব রয়েছে। নজরুল তাঁর কাছ থেকে কেবল অসা¤প্রদায়িকতার শিক্ষা লাভ করেননি, ধনী-দরিদ্রভেদে মানুষ যে সমান, এই ধারণাও অর্জন করেছিলেন। মুজফ্ফর আহমেদের এই প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, নজরুল একসময় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত পার্টিতে যোগ দেননি পার্টির নিয়মকানুন তিনি মেনে চলতে পারবেন না ভেবে। নিয়ম কানুন মেনে চলার মতো মানুষ ছিলেন না। তিনি চলতেন আপন খেয়ালে। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি দলে যাই যত নিয়ম কানুনশৃঙ্খল।’  এটা কবিত্ব নয়, তাঁর জীবনের সারসত্য। তাঁর স্বভাবের মধ্যেই প্রোথিত ছিল নিয়ম না মানার প্রবণতা।

নজরুলের সাম্যবাদী কবিতা প্রকাশিক হয়েছিল লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় । কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু ছিল ‘ঈশ্বর’ থেকে আরম্ভ করে ‘ চোর-ডাকাত’, ‘কুলি-মজুর’, ‘বারাঙ্গনা’ ইত্যাদি নিম্নশ্রেণির মানুষ।  এই কবিতাগুচ্ছ ছাড়াও সর্বহারা কাব্যের কৃষক, শ্রমিক ও ধীবরদের নিয়ে রচিত কবিতায় সাম্যবাদ সম্পর্কে কবির ধারণার জোরালো  প্রকাশ দেখি।

‘কুলি-মজুর’ কবিতায় তিনি বলেছেন, শ্রমজীবীদের শ্রমের বিনিময়ে সভ্যতা গড়ে উঠেছে। সুতরাং সভ্যতার পরিচালিকা শক্তি তাদেরই হাতে ন্যস্ত থাকার কথা:

‘সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে/এই ধরণির তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!’

‘সর্বহারা’ ও ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছে সামাজিক সাম্য ও দরিদ্রের অধিকারের কথা লিখেছেন। কুলি-মজুর-চাষি-ধীবরসহ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি তাঁর  সহানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে এসব কবিতায়।

তিনি শ্রেণি-সংগ্রামের কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। ধনীদের উদ্দেশ্য বলেছেন , দরিদ্ররা তাদের দ্বারে এসেছে অধিকার নিয়ে। তাদের প্রাপ্য অংশ  দিয়ে দাও, নইলে ছিনিয়ে নেবে।

১৯৪২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার সাড়ে চার মাস আগে প্রকাশিত একটি কবিতায় কবি বলেছেন,

‘জয় হোক জয় হোক আল্লার জয় হোক/শান্তির জয় হোক সাম্যের জয় হোক/সত্যের জয় হোক জয় হোক জয় হোক।…নহিলে আল্লার আদেশ না মানিবে/পরকালে দোজখের অগ্নিতে জ্বলিবে/…রবে না দারিদ্র্য রবে না অসাম্য/সমান অন্ন পাবে নাগরিক গ্রাম্য/রবে না বাদশা রাজা জমিদার মহাজন/কারও বাড়ি উৎসব কারও বাড়ি অনশন।’

শ্রেণিসংগ্রামের কথা যে কবি তিনি বলেন তিনি কেন হঠাৎ আল্লাহর বিচারের কথা বললেন এটা আমাদেও ভাবায়। অবশ্য আল্লাহর বিচারের কথা ‘শ্রমিক মজুর’ কবিতায়ও বলেছেন তিনি। তবে  শেষটা অন্যরকম। সর্বহারাদের ‘শক্তি’র কথা বলেছেন শেষে। এ কবিতায় আমরা ধর্ম ও শ্রেণিসংগ্রামের কথা একত্রে শুনতে পাই: ‘নহে আল্লার বিচার এ ভাই, মানুষের অবিচারে/আমাদের এই লাঞ্ছনা, আছি বঞ্চিত অধিকারে/… দেখেছি নিজের শক্তিকে, আর লাঞ্ছনা সহিব না!/ যে হাত হাতুড়ি দিয়া গড়িয়াছি প্রাসাদ হর্ম্যরাজি,/ সেই হাত দিয়া বিলাস-কুঞ্জ ধ্বংস করিব আজি।…গড়ার হাতুড়ি ধরেছি, এবার ভাঙার হাতুড়ি ধর।’

কবি তাঁর জীবনের প্রথম ছয়-সাত বছর শোষিত মানুষের জন্য অনেক কথা বলেছেন, সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু জানি না কেন, পরবর্তী প্রায় পনেরো বছর তিনি আর তেমনভাবে তাদের কথা বলেননি।  তবে চিরতরে মূক হয়ে যাবার আগের  শেষের আট-নয় মাস তিনি আবার নিঃস্বদের জন্য তাঁর সমমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। হতে পারে মধ্যবর্তী সময়ে অন্যবিধ লেখায় তিনি ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু শ্রেণিবিভেদ এবং অসাম্যের ব্যাপারটি তাঁর মনে সবসময়ই ক্ষত হিসেবে ছিল।

ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষ তখন ছিল  কৃষক। আধা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিক ব্যবস্থার বলি হচ্ছিল  গোটা ভারতবর্ষ ।  এই জাতীয় অর্থনীতি ছিল ভূমি ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কৃষক খাজনা দিয়ে জমি ব্যবহার করতো। ব্রিটিশদের জন্য  খাজনা আদায় করত উঠতি মধ্যবিত্ত হিন্দু জমিদাররা। লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় কৃষক ছিল ভূস্বামীদের শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নায়েব গোমস্তা খাজনা আদায় করতে গিয়ে সীমাহীন অত্যাচার নিপীড়ন চালাতো।  চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে খাজনা আদায়ের বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। সাথে সাথে একদল দ্বিতীয় সারির জমিদার  তৈরি হয়। এর নব্বই শতাংশই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষিত জনগণ। পূর্ব বাংলা মুসলমান ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। যার বেশিরভাগ ছিল ভূমিদাস কৃষক, বর্গাচাষী। তারা ছিল হিন্দুদের থেকে পিছিয়ে।

ব্রিটিশ শাসন শোষণের মাত্রা কৃষকের উপরই বেশি হত। ফলে গোটা ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে কৃষক বিদ্রোহ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।  কৃষকদের জীবনের অনিশ্চয়তা ছিল। ইংরেজ শাসনে পূর্ব বাঙলা ছিল সবচয়ে পিছিয়ে। এক কথায় শ্মশান। মরা লাশ নদীতে ভেসে চলা ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। মহামারি কলেরা গুটিবসন্তে মানুষ মারা যেতো আকছার।

নজরুল বললেন, জাগো নিপীড়িত, জাগো কৃষক, জাগো শ্রমিক, জাগো নারী। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র।

নিপীড়িত-লাঞ্ছিতদের জন্য তিনি আরও লিখেছেন, ‘জাগো/ জাগো অনশন-বন্দী, ওঠরে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত!/ যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি/ হাঁকে নিপীড়িত-জন-মন-মথিত বাণী,/ নব জনম লভি অভিনব ধরণী…। ’

নিপীড়িত জাতির বুকের ব্যথা আর মুখের ভাষা সাহিত্যে বলিষ্ঠতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুললেন নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তখন দানা বাধছে । বাঘা যতিন, ক্ষুদিরাম, চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাস বোস, প্রীতিলতা, মাস্টারদা সূর্যসেন, ভগৎসিং, প্রফুল্ল চাকীদের আবির্ভাব হয়েছে। নজরুল হয়ে উঠলেন এই অগ্নি  সন্তানদের আপনজন। কবিতার মাধ্যমে তাদের রক্তে আগুন জ¦াললেন নজরুল। বেগবান হলো ব্রিটিশ বিরোধী লাগাতার আন্দোলন।

নজরুল সাম্যবাদী ছিলেন। নিজেও জীবন কাটিয়েছেন সর্বহারার মতো।  কোথাও এক টুকরো বা এক কণা সম্পত্তি রেখে যাননি। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিলেন। যখন যা পেয়েছেন তা করেই জীবন অতিবাহিত করেছেন। ব্যক্তি জীবনে একের পর এক আঘাত পেয়েছেন। সন্তানদের মৃত্যু, স্ত্রীর মৃত্যু তাঁকে ভেঙেচুরে দিয়েছে। তারপরও ভালোবেসেছেন মানুষকে। মনোযোগ রেখেছেন মানুষের প্রতি, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি। সামাজিক অসাম্যের শিকার মানুষের প্রতি।

১৯৪১ সালে ২৫শে মে কবির ৪৩তম জন্মজয়ন্তীর পরের বছরের ২০ আগস্ট নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগে আক্রান্ত হওয়ার এগারো বছর পর নজরুলের চিকিৎসার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়। লন্ডন ও ভিয়েনার চিকিৎসাদল পরীক্ষা করে দেখেন নজরুল আর আরোগ্য লাভ করবেন না। এইভাবে স্তব্ধ হয়ে যান বাকপটু স্পষ্টবাদী সাম্যবাদী নজরুল ।

নজরুল আজ  আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এতবড় কবি হওয়া সত্তে¡ও কেন তিনি অসুস্থ হবার এগারো বছর পর তার চিকিৎসার জন্য তহবিল গঠন করা হলো , কেন সময়ে তাঁর যথোচিত চিকিৎসা হলো না সে প্রশ্ন সংগত কারণেই মনে বাজে। আর এই ঘটনাও প্রমাণ করে দেয় সামাাজিক অসাম্যের কথা ।

তথ্যসূত্র:

নজরুল-চরিত মানস, ড. সুশীলকুমার গুপ্ত, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা (এপ্রিল ২০১২)।

উইকিপিডিয়া।