সোনালি কাবিনের কবি আল মাহমুদ

সোনালি কাবিনের কবি আল মাহমুদ আফরোজা পারভীন

আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদ লোকান্তরিত হয়েছেন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি। বিষয়টা এখনও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারি না। অনেক আয়ু নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। শেষ ক’টা বছর বার বারই মনে হয়েছে তিনি চলে যাবেন, কিন্তু ফিরে এসেছেন তাঁর কবিতার মতোই অমিত শক্তিতে। অফুরান প্রাণশক্তি ছিলো তাঁর। সেই শক্তিই বার বার ফিরিয়ে আনতো তাঁকে । কিন্তু শেষবার সে শক্তি আর ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। প্রকৃতি আমরা যাকে বলি অথবা বাস্তবতা কিংবা নিয়তি তাঁর নামের সাথে যোগ করল ‘মৃত’ শব্দটি। আসলেই কী তিনি মৃত!

আম্মা বলেন পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।

কবির এ কবিতা দিয়েই আমার শুরু। আমার মনে হয়, আমাদের সময়ের এমন কোন শিশু কিশোর নেই যে এ কবিতা পড়েনি । এখনকার কথা অবশ্য জানি না। তারপর একে একে হাতে এলো ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’ ‘মায়াবি পর্দা দুলে ওঠে।’ গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ পড়ে নির্ঘুম রাত কাটালাম। ‘সোনালি কাবিনে’র সনেটগুলো আমার অবচেতনে স্থায়ী হয়ে গেল। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি।
আবেগ না থাকলে কবিতা হয় না। কিন্তু সে আবেগ হবে সংহত। অতি আবেগ কবিতাকে জোলো করে ফেলে। অতি আবেগে হারিয়ে যায় কবিতার বলবার কথা। তাঁর কবিতায় আমরা পাই লোকজ শব্দ, গ্রামীণ পটভূমি, রূপাত্মক শব্দ প্রয়োগ, উপমা, ইতিহাস, এতিহ্য, ইতিহাসের বহমানতা। নাগরিকতার সাথে লোকজ উপাদানের মিশেল দিয়ে তিনি কবিতাকে নিয়ে গেছেন শীর্ষমাত্রায়। তাঁর কবিতা আমাদের অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে, গন্ধের সুবাসে আমোদিত হই আমরা। কাঁঠালপাতার গন্ধ কিন্তু সত্যিই পাই আমরা। সত্যিই পাঠে মন বসে না। তাঁর কবিতা একাধারে আমাদের রসনা ও স্বাদ মেটায়।
আল মাহমুদ দুর্বোধ্য কবি নন। অনায়াস, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা তাঁর কবিতা। পাঠকের বুঝতে সমস্যা হয় না। সহজে স্বাচ্ছন্দ্যে কবিতার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, করতে পারে কবিতার রসাস্বাদন। যে কবিতায় পাঠক নিজেকে মিলিয়ে দিতে পারে না, সে কবির মৃত্যু ঘটে। কারণ কবিতাই পাঠকমনে কবির বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তাই বলে, তিনি কিন্তু কোন গতানুগতিক কবি নন। তাঁর যে সহজিয়া ভাব বা শব্দ সেটি বোধ্য কিন্তু ব্যতিক্রমী। তাঁর কবিতার আমরা পাই প্রকৃতি। পাই ফুল, পাখি, নদী, চাঁদ, ঝর্ণা আর প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্য। পাই লাবণ্যবতী রমণীর পুরো শরীর। বক্ষ, কেশ, আঁখি, মুখ। অনেক রমণী তার কবি মনকে নাড়া দিয়েছে। সে রমণীরা তাঁকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে । শরীরী প্রেমের ব্যাপারেও তিনি অকপট, কোন রাখঘাট নেই। কামনার জোয়ারকে তিনি বাধা দেননি, উস্কে দিয়েছেন প্রবাহমানতাকে। বুঝিয়েছেন এর স্বাভাবিকতা। প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে শব্দকে সাজিয়েছেন। আদিমতাকে চিত্রায়ণ করেছেন অপূর্ব নান্দনিকতায় :

‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দু’টি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।’
এভাবেই ‘ সোনালি কাবিন’-এর সনেটগুলোতে উপমা আর রূপকে নারীর প্রতি পুরুষের অদম্য আকাক্ষা ও কামনার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি অক্লেশে, অপার সুষমায়।
আল মাহমুদ কবিতা ছাড়াও গল্প উপন্যাস ও আত্মজীবনী লিখেছেন। লিখেছেন শিশুতোষ গল্প কবিতা ছড়া। কবিতার মতোই গদ্যেও তিনি অনায়াস, সাবলীল। তাঁর গদ্য ঝরঝরে কিন্তু বেগবান। সে বেগ কখনই হোঁচট খাওয়ায় না। তাঁর গদ্য পাঠককে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। আগেই বলেছি, তাঁর লেখায় উঠে এসেছে ইতিহাস। সোনালি কাবিনসহ অন্যান্য গ্রন্থে তিনি ইতিহাস তুলে এনেছেন। তার নজর এড়ায়নি সমকালও । তাঁর কবিতা আমাদের অতীত আর ভবিষ্যত সম্পর্কে ভাবনা জাগায়।
জীবনের এক পর্যায়ে সোনালি কাবিনের কবি ইসলামী ভাবধারার কিছু রচনা লিখে সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু তাতে কী ঢাকা পড়েছে তাঁর সোনালি কাবিন?
কবি আল মাহমুদ আধুনিকতায় লোকজ উপাদান উদার হাতে মিলিয়ে দিয়ে বহুল আলোচিত হয়েছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তরের ‘অরণ্যে ক্লান্তির দিন’, ‘এমন তৃপ্তির’, ‘ নৌকোয়’ ইত্যাদি কবিতায় গ্রামীণ ঐতিহ্যলগ্নতার যে উদ্ভাস ছিল তা দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কালের কলস এবং বিশেষ করে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিনে এসে বিচ্ছুরিত হয়।
‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিনের’ অনেক কবিতার গ্রামীণ জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হঠাৎ ‘নাগরিক’ বনে-যাওয়া মানুষের জন্য কবির আক্ষেপের প্রকাশ দেখি। কালের কলসে ‘জল দেখে ভয় লাগে’, ‘ ফেরার পিপাসা’, ‘ হে আচ্ছন্ন নগরী’, ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে এ আক্ষেপ :

দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি, নারী
উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি;
গতর উদোম ক’রে হাতে-লেপা মাটির চত্বরে
লাঞ্ছিত নিশেন হয়ে পড়ে আছে যেন অনাদরে
(‘প্রত্যাবর্তন’, কালের কলস)

সোনালি কাবিনের ‘দায়ভাগ’, ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা, ‘তোমার হাতে’, ‘নতুন অব্দে’, ‘পালক ভাঙার প্রতিবাদে’, ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতায় এই আক্ষেপের উত্তরণ ঘটেছে উচ্চমাত্রায়। গ্রামীণ ঐতিহ্যের সাথে লগ্ন থাকার আকুতি ব্যক্ত হয়েছে প্রতিটি কবিতায় :
‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতায় আমরা দেখি গ্রামের একদল মানুষ (কবির ভাষায় ‘শস্যের শিল্পীরা’) ক্ষেতের আলে বসে তামাক সাজাচ্ছে। শহর থেকে আগত এক বালকের উদ্দেশে ‘একগাদা বিচালি বিছিয়ে দিতে দিতে’ তাদের সাথে বসার আহবান জানাচ্ছে তারা। কিন্তু ‘নগরের নিভাঁজ পোশাক খামছে ধরেছে সে বালকের হাঁটু’ , তাই সে কিছুতেই দেশের মাটির বুকে আনায়াসে বসতে পারছে না; অথচ এই বালকের ‘বাপের মারফতি টান শুনে বাতাস বেহুঁশ হয়ে যেতো’। আল মাহমুদ এ-কবিতার একস্থানে বালককে উদ্দেশ্য করে বলেন : ‘ তোমাকে বসতে হবে এখানেই/ আদরে এগিয়ে দেয়া হুঁকোটাতে সুখটান মেরে/ তাদের জানাতে হবে কুহলি পাখির পিছুপিছু/ কতদূর গিয়েছিলে পার হয়ে পানের বরুজ।’

‘সোনালি কাবিন’ অভিন্ন শিরোনামের ১৪টি সনেট। এর বিষয়বস্তু বহুমাত্রিক । একজন নারীকে লক্ষ্য করে উচ্চারিত এই সনেটগুচ্ছে কবির প্রেমানুভূতি প্রাধান্য রয়েছে। তবে প্রেমই একমাত্র বিষয় নয় সনেটগুচ্ছে। বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা রয়েছে। বাঙালি সমাজের নানা অনুষঙ্গ, মিথ ও সাহিত্য-ঐতিহ্য, প্রাচীন বঙ্গভূমির সমাজব্যবস্থা, বাঙালি-সমাজের অসংহতিসমূহ থেকে শুরু করে ফসলের সুষম বণ্টন অর্থাৎ সাম্যবাদের মতো রাজনৈতিক ভাবনাও স্থান পেয়েছে সনেটগুলোতে। রয়েছে নরনারীর যৌন বাস্তব ছবি । শরীরী প্রেমের এমন খোলামেলা প্রকাশ বাংলা কবিতায় তেমন চোখে পড়ে না :

বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে হবো চিরচেনা
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়
বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানে না যা বাৎসায়ন আর যত আর্যের যুবতী

সম্পদের সুষম বন্টনের কথা উচ্চারণ করেছেন কবি। উল্লেখ্য, কাজী নজরুল ইসলাম ও সুকান্ত ভট্টাচার্য ছাড়া অন্য যেসব কবি সাম্যবাদী কবিতা লিখেছেন তার অধিকাংশই কবিতা না হয়ে স্লোগান হয়ে উঠেছে। কিন্তু আল মাহমুদের কলমে সাম্যবাদের মতো রাজনৈতিক ভাবনাও শিল্পিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বারবার

বর্গিরা লুটেছে ধান, নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড়ো, হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েন সাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা

আল মাহমুদের সমগ্র রচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ শুধু নয়, তাঁর সমগ্র রচনাতেই শ্রেষ্ঠতম ফসল তুলে এনেছেন তিনি।

তিনি চলে গেছেন, রেখে গেছেন কালজয়ী কীর্তি। তিনি একবার লিখেছিলেন, ‘আমি লেখক হওয়ার, কবি হওয়ার মোহে দৃঢ় বাসনা পোষণ করতাম, আর লোকে তো এখন আমাকে কবিই বলে।… আমি কবিতা লিখেছি, গল্প-উপন্যাসও লিখেছি। সব মিলিয়ে সমালোচকেরা একদিন আমার বিচার করবে। আশা করি আমি সুবিচার পাব।’
তিনি কবে সুবিচার পাবেন বা আদৌও সুবিচার পাবেন কীনা জানি না। তবে বলতে পারি লোকান্তরিত হবার পরবর্তী প্রক্রিয়ায় তিনি সুবিচার পান নি। কিন্তু তাতে কী যায় আসে! আল মাহমুদের কবিতার ভক্ত অসংখ্য পাঠক তাঁর জন্য চোখের জল ফেলেছে, ফেলছে, ফেলবে। ফেলছে ভীনদেশীরা। মনে পড়ে ২০০১ সালে দারির্জলিং মেলে কলকাতা থেকে দাজিলিং যাচ্ছিলাম। অনেকটা পথ, চলতে হবে অনেক সময়। পাশের সিটে বসা একজন যুবক। প্রথমে কথা শুরু হল ইংরেজিতে। তারপর একসময় বুঝলাম দুজনই বাঙালি। নাম অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় । কবিতা লেখেন। আমার পরিচয় জেনে উচ্ছ্বসিত। দুজনই একই পথের মানুষ। বললেন, মাহমুদকে চেনেন? বললাম, কোন মাহমুদ ? উনি কিছুটা বিরক্ত হলেন, খানিকটা যেন আশাভঙ্গও। বললেন, লেখালিখির জগতের মানুষ মাহমুদকে চেনেন না? মনে হলো আমি সত্যিই লিখি কীনা এটা নিয়ে উনি দ্বিধান্বিত। বললাম, শুধু মাহমুদ বললে হবে কী করে, আগে পরে তো কিছু আছে? উনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, সব মানুষের নামের আগে পরে লাগে না। দুই বাংলার সেরা কবি, সোনালি কাবিনের কবি মাহমুদের নামের আগে পরে লাগে না। সেদিন প্রচন্ড সম্মানিত বোধ করেছিলাম। অমর তার লেখা বই ‘উপনিবেশ থেকে’ আমাকে দিয়েছিল কবি আল মাহমুদকে পোঁছে দিতে। বলেছিল, কবিকে আমার প্রণাম জানাবেন। তাঁকে দেখার আমার বড় সাধ। পৌঁছে দিয়েছিলাম। আর একদিন একটা অনুষ্ঠানে কবির সামনে কথাগুলো বলেছিলাম। সেদিন কবি খুব খুশি হয়ে গালভরে হেসেছিলেন। মনে হয়েছিল চারধার ভেসে গেলো কাঁঠালচাঁপার গন্ধে। কবির সেই গন্ধধোয়া হাসি মুখটাই আমার বার বার মনে পড়ে। মনে পড়বে আমৃত্যু।জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা সোনালি কাবিনের কবি।