১০ জানুয়ারি ও কিছু প্রত্যাশা / লেঃ কর্ণেল  সৈয়দ হাসান ইকবাল

১০ জানুয়ারি ও কিছু প্রত্যাশা / লেঃ কর্ণেল  সৈয়দ হাসান ইকবাল

১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত হয়ে ব্রিটেন হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সেদিনটি ছিল সত্যিই বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত।  ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাক হানাদারদের পরাস্ত করে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জন করেছিল বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্ত তারপরেও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ে বিজয়ের আনন্দ কিছুটা হলেও অস্তগামী ছিল। বিজয়ের ২৪ দিন পর অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করায় বাংলার  স্বাধীনতা অর্জন পূর্ণতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের প্রথম ধাপ অর্জিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাঙালির জাতির দুটি বড় অর্জন সম্ভব হয়েছিল ।

ক। মিত্র বাহিনীর (ভারতীয় সৈন্য) ০৩ (তিন) মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করা।

খ। মুক্তিবাহিনীর বিরাট অংশের অস্ত্র সমর্পন করা।

উল্লিখিত ঘটনা দুটি সম্ভবপর হয়েছিল রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কারণে। নতুবা উক্ত বিষয়গুলি বহুদিন ধরে অমিমাংসিত থাকতে পারতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি সমগ্র বাঙালি জাতিকে আরো বেশি একত্রিত  করেছিল। তিনি তার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অত্যন্ত সাংগঠনিকভাবে গঠন করে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার তারই অত্যন্ত বিশ্বস্ত জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর নেতৃত্বে সুসংগঠিত হয় ।  মাত্র ৯ মাসের মধ্যে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। উক্ত বিজয় ৩০ লক্ষ বাঙালির প্রাণ বিসর্জন এবং ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জন সম্ভব হয়েছিল। একটি সমীক্ষা/গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৭৮ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এদেশের কৃষক শ্রমিকের সন্তান। তাদের মধ্যে ছাত্র, শ্রমিক, পুলিশ, সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যই ছিল বেশি।

১৯৭১ সালের ০৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের ভাষণই ছিল প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের সকল দিক নির্দেশনা। ২৫ শে মার্চ ১৯৭১  পাকিস্তানি  বাহিনী বাঙালি জাতির উপর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে  পাকিস্তানি  বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ করে রাখে। সামরিক বিচার করে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে বিশ্বনেতৃবৃন্দের চাপে বিশেষ করে ভারত, রাশিয়া, ব্রিটেন এবং অন্যান্য বহু দেশের দূরদর্শিতার কারণে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে পাকজান্তা বিরত থাকে। ১৬ ডিসেম্বর ৭১ এর পরে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো (Bhutto) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ০৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রথমে ব্রিটেনে এবং ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনী বিশেষ ফ্লাইটে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ই তারিখে দিল্লী হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সেই সময়কার একটা ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করে প্র্ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে  একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রথমেই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করেছিলেন “কখন বাংলাদেশ হতে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।” উত্তরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন “বঙ্গবন্ধু আপনি যখনই চাইবেন তখনই করা হবে।” এই হলো আমাদের বঙ্গবন্ধু। ৯ মাস কারারুদ্ধাবস্থা শেষ করে প্রথম সুযোগেই বঙ্গবন্ধু বিশ্ব নেতার পরিচয় প্রদান করেন। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কোলকাতায় রাষ্ট্রীয় সফর করেন। সে সময় ভারত- বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। যে কোন কারণেই হোক উক্ত বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে বাংলাদেশ হতে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি অনুপস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয় পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে উত্তর দিয়েছিলেন যে, “বঙ্গবন্ধু আমি জানি আপনার জন্মদিন ১৭ই মার্চ । আমার সৈন্যবাহিনী তার পূর্বেই প্রত্যাহার করা হবে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালে ১৭ই মার্চ বাংলাদেশ সফর করে ছিলেন। তার কয়েকদিন পূর্বে সমস্ত ভারতীয় সৈন্য  বাংলাদেশ হতে প্রত্যাহার (Withdraw) করা হয়েছিল। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর  রাজনৈতিক নেতৃত্বেয উজ্জ্বল  দৃষ্টান্ত।

 ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে (যেটা বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-সস্ত্র বঙ্গবন্ধুর কাছে সমর্পণ করেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার।  বঙ্গন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না হলে এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরকারের কাছে জমা পড়তো কিনা সেটা অনেকেরই  সন্দেহ ছিল। সম্প্রতি রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরৎ না আসলে অনেকেই অস্ত্র জমা দিতেন না।

 বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রসংগেঃ পাকিস্তানে ২৩ বছর শাসন আমলে বঙ্গবন্ধু ১৩ বছরই জেল খেটেছেন  বাঙালি জাতির স্বাধীকার আদায়ের লক্ষে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুতথান, আইয়ুব খানের পদত্যাগ,  আগরতলা ষড়যন্ত্র প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, ১৯৭০ সালের নির্বাচন -এ অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করেন বঙ্গবন্ধু। তদানীন্তন পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ দল বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এর কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরে কুটচাল করতে থাকে পাক হানাদার বাহিনী । ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ০৭ই মার্চ তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন সার্ভভৌম রাষ্ট্র প্রদান করে গিয়েছেন। ০৭ই মার্চ এর ভাষণে সমগ্র বাঙালি জাতিকে একত্রীভূত করেছিলেন “জয় বাংলা” শ্লোগান এর মাধ্যমে। মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ শত্রুমুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তেঁজগাও বিমান বন্দরে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ ফ্লাইটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৯ মাস ২৪ দিন পর পাকিস্তান কারাগার হতে মুক্ত  বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তেঁজগাও বিমান বন্দর লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়ে উপচেপড়ছিল।  দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বিকাল বেলায় লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেন । সে এক অবর্ণনীয় ঘটনা। স্বচোখে না দেখলে সেই অনুভূতি বোঝা বড়ই মুশকিল। আমার আবারও সৌভাগ্য হয়েছিল উক্ত দিন সোহরাওয়ার্দী ময়দানে উপস্থিত থাকার। লক্ষ লক্ষ জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “আজ আমার স্বপ্নের সোনার বাংলা স্বাধীন হয়েছে”। লক্ষ মানুষের করতালির মধ্যে বাঙালি জাতি আনন্দে উদ্বেলিত  হয়ে ওঠে সেদিন প্রকৃতপক্ষে বিজয় অর্জন পুর্ণতা পায় ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে। আসলে বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু।

কিছু প্রত্যাশাঃ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নিকট জাতির অনেক প্রত্যাশা রয়েছে ।বর্তমান সরকারের চ্যালেঞ্জও রয়েছে অনেক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক সপরিবারে শাহাদৎ বরণ করেন কিছু স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের মাধ্যমে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় আল্লাহর রহমতে বেচে যান। ১৯৮১ সালের ১৯ মে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দীর্ঘ ৩৭ বছর দলের সভাপতি এবং ৪ বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে পরপর ৩ বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পরিশ্রমি সফল প্রধানমন্ত্রী যিনি দেশের অর্থনীতিকে স্বচ্ছল করেছেন। দেশের উন্নয়নসমূহ যথা পদ্মা সেতুসহ বড় মেগা প্রোজেক্ট এর কাজ চলছে। তার কাছে দেশের মানুষের আশা আকাঙক্ষা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এক কথায় বর্তমান সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের লক্ষে দেশে একটি সুশাসন ও দূর্নিতীমুক্ত প্রশাসন গঠন করে মানুষের আশা আকাঙক্ষা পূরণ করা। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উক্ত বিষয়ে মন্ত্রীসভায় দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।