গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে – লে. কর্নেল সৈয়দ হাসান ইকবাল (অব.)
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও সুশাসনই পারে একটি গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করতে। বঙ্গবন্ধ কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। হ্যাঁ, এটা সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে সবার আগে গ্রামকেই প্রাধান্য দিতে হবে। তবে গ্রামীণ জনপদের সকল কিছু ঠিক রেখে গ্রামের মানুষের জন্য শহরের সুযোগ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষলে বঙ্গবন্ধ বলেছিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। এ মুক্তি অর্থনৈতিক মুক্তি, মানুষের স্বাধীকার আদায়ের মুক্ত।, এ মুক্তি জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের মুক্তি।
বাংলাদেশের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। গ্রামীণ অবকাঠামো ঠিক রেখে গ্রামকে শহরে রুপান্তর করা অতি সহজ বলে আমি মনে করি। যেটা বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যেই সম্ভব। নিম্নে কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করা হলোঃ
শতভাগ বিদ্যুৎতায়নের ব্যবস্থা করা:
প্রতিটি গ্রামে যদি বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা করা যায় তাহলে এলাকার অনেক সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। বিদ্যুৎ থাকায় স্থানীয় স্কুল/কলেজে কম্পিউটার শিক্ষা প্রসার সম্ভব হবে। ছোট ছোট কুটি শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব।
গ্রামীণ সড়ক পাকাকরণ:
ইউনিয়ন পর্যায়ে গ্রাম গুলির রাস্তাঘাট, অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারলে মানুষের যাতায়ত ব্যবস্থা সহজ হবে। গ্রামীণ জনপদে উৎপাদিত কৃষি সামগ্রীর সটিক মূল্য পাওয়া সহজ হবে। কৃষক ভাইয়েরা অতি সহজে ও দ্রুত গতিতে উৎপাদিত পণ্য শহর এলাকায় নিয়ে যথাযথ মূল্য পেতে সক্ষম হবেন।
স্কুল/কলেজ সমূহে আধুনিক সুযোগ সুবিধা প্রদান:
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে ছাত্র/ছাত্রীদের লেখাপড়ার সুবন্দোবস্ত করা প্রয়োজন। স্কুলের পরিচালনা পরিষদ এর প্রধানকে শিক্ষিত হতে হবে। সমাজের সম্মানিত ও নিবেদিত ব্যক্তিদের মধ্য হতে নিয়োগদান করতে হবে। তাহলে গ্রামে বসেই ছাত্র/ছাত্রীরা ভাল লেখাপড়ার সুযোগ পাবেন।
সর্বস্তরে সুশাসন প্রয়োগ:
গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষগুলি প্রায়ই সুশাসন হতে বঞ্চিত হন। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রভাব খাটিয়ে বিবিধ অনিয়ম করে তাদের কষ্ট দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এসব নিরীহ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ইউনিয়ন পর্যায়ে মডেল স্বাস্থ্যক্লিনিক প্রতিষ্ঠা:
যদিও ব্যবস্থাটি বর্তমানে রয়েছে তবে সেটা স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে গ্রামীণ মা ও শিশুদের সুস্বাস্থ্যের জন্য আরো উন্নত ব্যবস্থা প্রয়োজন।
ইউনিয়ন পর্যায়ে মডেল শহর গড়ে তোলা:
মডেল শহর বলতে আমি মনে করি, এখানে কমিউনিটি হল ও, তথ্য- প্রযুক্তি সেবা প্রদানের ব্যবস্থা থাকা। কমিউনিটি হলে সকল শ্রেণির মানুসের জন্য বিয়ে-শাদি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন ইনডোর গেমস এর ব্যবস্থা করা।
মসজিদ মাদ্রাসা ও আলেম-ওলামাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা:
গ্রামীণ মসজিদ মাদ্রাসাগুলিকতে যুগোপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা এবং আলেম-ওলামাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বর্তমানে মসজিদ মাদ্রাসায় যে সকল আলেম-ওলামা রয়েছেন তাদের উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধকে সমুন্নত করা সম্ভব।
কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন:
১৬ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করে থাকেন আমাদের প্রিয় কৃষক ভাই ও বোনেরা। তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সঠিকভাবে পান না। মধ্যসত্ত্বভোগীরা কৃষকদের মুনাফা কেড়ে নেয়। কৃষক ভাইদের চিকিৎসার ভাল ব্যবস্থা নেই। তারা শরীরের ঘাম ঝরিয়ে ফসল উৎপাদন করেন কিন্তু অসুস্থ হলে তদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা:
-গ্রামীণ জনপদ এখন অনেকটা মাদক ও সন্ত্রাস কবলিত হয়ে পড়েছে। এটা একটা মরণব্যাধি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই সন্ত্রাস ও মাদক হতে নতুন প্রজন্মকে স-রক্ষা প্রদান করা। সেজন্য এলাকায় শান্তি শৃংখলা বাহিনীর তৎপয়তা আরো বৃদ্ধির প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন:
মুক্তিযোদ্ধারাই জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। এক গবেষলায় দেখা যায়, এদেশের ৭৮% মুক্তিযোদ্ধাই কৃষক/শ্রমিকের সন্তান। যারা যুদ্ধে গমন করেছিলেন দেশমাতৃকাকে ভালবেসে। অনেকেই দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। এখন অনেকে জীবিত আছেন। যাদের বয়স ৬০ এর উর্ধে। সমাজের উচিৎ এই সূর্য সন্তানদের সম্মান করা। সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাদেরকে যতদূর সম্ভব সহায়তা প্রদান করার।
সবশেষে বলতে চাই, গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে। গ্রামের উন্নতি হলে দেশের উন্নতি হবে। তবে সেটার অর্থ এই নয় যে, সমস্ত গ্রামকে নগরায়ন করতে হবে। গ্রামকে ঠিক রেখে অর্থাৎ কৃষি জমি, পুকুর রাস্তাঘাট ঠিক রেখে গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। গ্রামীণ অ কাঠামো ঠিখ রেখে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগের মা্যেমে সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য সেবা মানুষের হাতের কাছে পৌছাতে হবে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান করতে হবে এবং কৃষকদের সুস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে হবে।শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যথাযথ অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
গ্রামীণ জনপদের রাস্তাঘাট উন্নয়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, শতভাগ বিদ্যুৎতায়ন ও স্বাস্থসেবা নিশ্চিত করতে পারলে গ্রামের মানুষ শহরের মতই বসবাস করতে পারবেন বলে আমারবিশ্বাস য় । সরকারের বর্তমান ঘোসষত বাজেট ব্যবস্থাতেই উর্লিখিত উন্নয়ন সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা একান্ত অপরিহার্য।
Facebook Comments Sync