দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা (পর্ব ১১) – আফরোজা অদিতি

দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা (পর্ব ৯) - আফরোজা অদিতি

কয়েকদিন অফিসে যায়নি ইথিকা। আজ কাপড় পরতে দেখে তমিজ বলে, ‘যাচ্ছ কোথায়?’ তমিজের কথার জবাব দেয় না ইথিকা। কণ্ঠে রাগ ঝরিয়ে বলে তমিজ, ‘কথার জবাব দিচ্ছ না যে।’ ‘ইচ্ছে করছে না।’ ওর কথায় আরো রেগে যায় স্বামী। বলে, ‘জানি, এখন তো দেখা হয় না পিরীতের নাগরের সঙ্গে, তাইতো কথা কইতে ইচ্ছা করে না। বুঝি না আমি, সব বুঝি, বেশ্যা মেয়ে-মানুষ।’

‘দেখ তমিজ কথা বাড়িয়ো না, আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, আমার শরীর ভালো না।’

‘শরীর, না মন? মনের মানুষের সঙ্গে কাটাতে চাও সময়, এখন পারছ না তাই….’ কণ্ঠে ব্যঙ্গ ঝরিয়ে মুখ ভেংচিয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তমিজ। কিন্তু তার আগেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে ইথিকা।

‘কাটাতে যদি চাই, তাতে হয়েছে কী! আমি যদি ওর সঙ্গে যেতে চাই তবে ঠেকাতে পারবে কি তুমি?’ একটু থামে ইথিকা। দৃঢ় কন্ঠে বলে,

‘তোমাকে বলে দিচ্ছি, এ ধরনের বাজে কথা বলবে না তুমি। আমি যাচ্ছি না বলে আমাকে পাচ্ছ, সুযোগ পাচ্ছ এতো কথা বলার। আমি চাইলেই যেতে পারি যখন তখন; গেলে ঠেকাতে পারবে না।’

‘আরে ছো: যাতো দেখি কেমন যেতে পারিস। এসব কয়েক দিনের ব্যাপার মাত্র। আমার মতো বোকা নাকি কেউ। ওরা দুদিন ফুর্তি করবে তারপর ফেলে দেবে।’

‘এসব প্যাচাল আমার কাছে না, ওসব অন্য জায়গায় গাও। এ সব শুনতে আমার ইচ্ছে করে না। চুপ করো।’

‘চুপ করবো, করবো। আগে কথাগুলো বলতে চাইনি। তোর শুনতে ভাল না লাগলে কি হবে এখন তো আমি বলবই। আর ভাল তো লাগবেই না। নটীদের আবার সংসারের কথা ভাল লাগে নাকি।’

‘দেখ নিষেধ করছি গালাগাল দিবে না।’ জোরালো কণ্ঠে বলে ইথিকা।

‘কি করবি হারামজাদী।’

‘আমিও গাল দিব।’ রাগে শরীর কাঁপতে থাকে ইথিকার। শরীরে যেন আগুন ধরে গেছে এমন লাগছে। ও উল্টা দিক থেকে শুনতে থাকে। ১০০, ৯৯, ৯৮, ৯৭….. চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে ও। বের হয়ে যায় তমিজ। ঘরে ঢোকে বিরাজউদ্দিন। বিরাজউদ্দিনের বাড়ি চট্টগ্রামে। কী দুষ্কর্মের জন্য সাসপেন্ড হয়েছে; যেতে হয় না অফিসে। বেশীর ভাগ দিন বাসায়ই থাকে। মাঝে মধ্যে আসে এ বাড়িতে। চা খায়, গল্প করে।

বিরাজউদ্দিন পছন্দ করে ইথিকাকে। ইথিকা বোঝে। ওকে আসতে দেখে উঠে বসে ইথিকা। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে বিরাজউদ্দিন, ‘কী ব্যাপার শ্যালক গিন্নি শুয়ে যে।’

‘এমনি।’

‘ওরা চলে গেছে বুঝি।’

‘হ্যাঁ। দুলাভাই। কেন চলে গেল ওরা বলুন তো। আমিতো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’

‘ অতো বুঝার কি আছে ; তুমিতো আর তাড়াওনি ওদের।’

‘আমি তাড়াইনি এটা ঠিক কিন্তু সব দোষ তো আমারই হচ্ছে। জানেন দুলাভাই সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি কোন দোষ না করেও দোষের দায় ভার বহন করতে হয়েছে আমাকেই। আমার এমন কি ঘাটতি আছে বলেন তো যে এভাবে দোষী হতে হয়।’ইথিকার কন্ঠ কান্নায় রুদ্ধ হয়। ছলছল চোখে বিরাজের দিকে তাকায় ইথিকা। বিরাজ হাত রাখে ওর মাথায়।

‘কিছু মনে নিয়ো না ইথিকা, মানুষ এমনি। যখন নিজের কিছু করার থাকে না, নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে ব্যস্ত হয়, চাপিয়ে সুখ পায়। আর তোমার দোষ তুমি কারোর কোন কথার প্রতিবাদ করো না। আচ্ছা চলি।’

‘চা খেয়ে যান।’

‘না না চলি।’ বিরাজ বের হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢোকে তমিজ। কটমট চোখে চেয়ে থাকে।

‘দুলাভাই এসেছিল কেন? মাথায় হাত দিয়ে কি করল?’

‘কি করলো আবার কি!’

‘ন্যাকা সেজ না বলছি। কি করল, কি বলল, বল শুনবো আমি।’ আগে থেকেই সন্দেহ প্রবণ লোক এই তমিজ। এখন দিন যতো গড়াচ্ছে ততো সন্দেহ করা বাড়ছে, বাতিকগ্রস্ত হয়ে পরছে।

‘এমনি এসেছিল, কিছু বলেনি।’

‘কিছু বলেনি নাকি কী বলেছে তা বলবে না।’

‘দেখ জালাতন করো না, ভাল লাগে না।’

‘তাতো লাগবেই না। এখন যে নতুন আশনাই, ভাল লাগবে কেন আমাকে। ওই যে গ্রাম্য কথায় আছেনা ’ভাত খাবি ভাতারের, গীত গাবি নাঙের।’ স্বামীর কথায় রেগে যায় ইথিকা। ‘এতো খারাপ কথা বলো কেন তমিজ। একটুও ভালো কথা কি বলতে পারো না।’

ইথিকা কখনও খারাপ কথা বলে না, শুনতেও পছন্দ করে না। আর ওকেই সবসময় এই খারাপ কথাগুলো শুনতে হয়। এমন অদৃষ্ট কেন ওর। ভাবে ইথিকা। হায় ঈশ্বর। ও একবার ভাবে কোন কথাই বলবে না এ বিষয়ে। কিন্তু কথা না বলে থাকতেও পারে না। তমিজকে খুব শান্তভাবেই বলে, ‘তুমি এমন নোংরা কথা বলো কেন সব সময়।’ তমিজ এই কথাটাকে অন্যদিকে নিয়ে যায়।

‘কি আমি নোংরা, নোংরা কথা বলি। বের হ আমার বাড়ি থেকে। যা।’ খাট থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয়। তারপর ধাক্কাতে ধাক্কাতে দরোজার কাছে নিয়ে যেতে থাকে। এবারে ধৈয্যের বাঁধ ভেঙে যায় ইথিকার; ধাক্কা দিয়ে খাটের ওপর ফেলে দেয় স্বামীকে।

‘সব সময় আমার সঙ্গে ঘ্যানঘ্যান করা; এইসব ঘ্যাঘ্যানানি, প্যানপ্যানানি আমাকে গাল দেওয়া কেন? কোন সাহসে? কোন সময় ভাল ব্যবহার করো না। আমি কি তোমার রোজগারে খাই না পরি। আমার রোজগারে আমি চলি। তোমার ভাল না লাগে সেপারেশন নাও। অন্য একটা বিয়ে  করো। আর যদি তা না করো আমার সঙ্গে একটাও মন্দ কথা বলবে না, খারাপ ব্যবহার করবে না।’ একটানে কথাগুলো বলে হাঁফাতে থাকে ইথিকা।

‘হারামজাদী।’ চুলের মুঠি ধরে আছড়ে ফেলে বিছানায়। তারপর বুকের উপর উঠে দাঁড়ায় তমিজ। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে থাকে ওর। ওকে ধাক্কা দিয়েও সরাতে পারে না ইথিকা।

‘কি কর কি কর তমিজ।’ বিরাজউদ্দিন একটা গল্পের বই নেওয়ার জন্য ফিরে এসেছিল এ ঘরে। এই অবস্থা দেখে হাত ধরে টেনে নামায় তমিজকে। ইথিকা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না এ বাড়িতে। ওর মনে হয় আর কিছুদিন এ বাড়িতে থাকলে ওর এই জীনটাই চলে যাবে। আজকাল হরহামেশাই কাগজের পাতার বের হওয়া খবরের মতো ও খবর হতে চায় না । একটাই জীবন; শত চেষ্টা করলেও জীবনটাকে দুইবার পাওয়া যাবে না। তাই ওর জীবনটা অতো সস্তা নয়! যে কেউ ইচ্ছা করবে আর নিয়ে নিবে। কখনই তা হতে দিতে পারবে না। কিন্তু ও যাবে কোথায়? মায়ের কাছে! ওখানে গেলে ওকে না জানিয়েই মা ডেকে পাঠাবে তমিজকে, এ বাড়িতে ফিরে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে মা। যেটা আগেও কয়েকবার করেছে। তবুও মায়ের বাড়ি ছাড়া যাওয়ার জায়গা তো নেই। অন্য এক জায়গায় যাওয়া যায়, রাকিবের বাসায়। কিন্তু মান-সম্মানের প্রশ্ন। এ ভাবে কি ওঠা যায় ভালোবাসার কাছে। অত্যাচারিত হয়ে, বিতাড়িত হয়ে নিজের একটা ঠিকানা নিতে কি যাওয়া যায় ভালোবাসার কাছে কখনও; যায় না। এতো কিছু ভাবনা চিন্তার পরেও  রিকশা নেয় রাকিবের বাসার উদ্দেশ্যে। রাহা খেলছিল গেটের বাইরে তুলে নেয় ওকেও। রাকিবের বাসার কড়া নাড়ে।

দরোজা খুলে দেয় রাকিবের মা।

রাকিবের মা কবে এসেছে জানে না তা। রাকিব তো বলেনি কিছু।

‘রাকিব কোথায় খালাম্মা?’ সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে রাকিবের কথা।

‘ও ঘরে।’

‘কবে এসেছেন বাড়ি থেকে।’

‘আজই, এই মাত্র। তুমি কে মা?’

‘আমি ইথিকা, আর আমার ছেলে রাহা।’ মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রাকিবের ঘরে ঢোকে ইথিকা। রাকিব বসে আছে। ওকে দেখে বলে,

‘কি ব্যাপার তুমি!’

‘চলে এলাম।’

‘কি হয়েছে?’

সব খুলে বলে ইথিকা। কথা বলতে বলতে শোনে রাকিবের মায়ের কণ্ঠ। এই ছেলেসহ মেয়েমানুষ বিয়ে করতে চায় রাকিব। এ্ঁটো মেয়েমানুষ! ওর মায়ের কথা শুনতে পেয়ে ইথিকা বলে,‘আমি আসতে চাইনি এখানে। হঠাৎ কি মনে হলো চলে এলাম।’ এরপর আর থাকে না রাকিবের ওখানে বেরিয়ে আসে। রিকশা নেয় মায়ের বাসার উদ্দেশ্যে।

রাত নয়টা নাগাদ এ বাড়িতে আসে তমিজ সঙ্গে শরীফা। ওকে না, নিতে এসেছে রাহাকে। রাহা খেলছিল বাইরের ঘরে। ফুফুকে দেখে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাহা কোলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় ওরা। কাউকে কিছু বলেও না, দেখাও করে না কারো সঙ্গে। রিকশায় দেখা শিমুলের সঙ্গে। দোকান থেকে ফিরছিল। ও আশ্চর্য হয়। ‘কি ব্যাপার দুলাভাই।  এলেন কখন যে চলে যাচ্ছেন। আপা আপনিও চলে যাচ্ছেন।’ তমিজ বা শরীফা কেউই কথা বলে না। শিমুল রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘কেন যাচ্ছেন? আরে আপা, আপনারা চলে যাচ্ছেন তাও আবার রাহাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন! কেন?’ ওর কথার জবাব না দিয়ে রিকশাওয়ালাকে বলে, ‘এই রিকশা চলো।’ রিকশা চলতে শুরু করে। শিমুল সরে দাঁড়িয়ে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে রিকশার দিকে।

‘কি ব্যাপার মা রাহাকে নিয়ে গেল ওরা। রাহা কি কাঁদছিল।’

‘রাহাকে নিয়ে গেল! কারা!’ বিস্মিত মা প্রশ্ন করে।

‘দুলাভাই আর তার বোন।’ শিমুলের কথা শুনে মা অবাক। ‘এসেছিল ওরা। কখন? দেখা হয়েছে কি ইথিকার সঙ্গে।’ এরপর একা একাই কথা বলে মা। না মেয়েটাকে নিয়ে আর পারলাম না। কিছু হলেই হুটহাট চলে আসে। যাকগে, যার যার কপাল। আমার কি।

শিমুল রাগ করে। ‘তোমার এই এক দোষ মা। কথায় কথায় আপার সঙ্গে রাগারাগি। আগে তো এমন ছিলে না। একটু রাগ কমাতে পারো না মা। এমন রাগ করো দেখেই তো আপা বলে না কিছুই ও। কোন কারণ ছাড়া নিশ্চয় আসেনি আপা।’ মা কথা না বলে গজগজ করতে থাকে।

 

ছেলে নেই কাছে। অফিস থেকে ফিরে ভাই-বোনদের সঙ্গে গল্প করে, ক্যারাম খেলে কখনও, কখনও রাতে রান্নায় সাহায্য করে মাকে। এই কাজের ফাঁকে রাহাকে মনে পড়লেও বিষণ্নতার মাঝেও ভালোই কাটে দিন। কিন্তু রাত যখন নিঝুম, নিস্তব্ধ তখন রাহার জন্য বুকের ভেতর হু হু কান্নার ঝড় ওঠে। রাহাকে আদর করতে ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে দেখতে। রাহা ছাড়া একাকী নিঃসঙ্গ জীবন হয়ে ওঠে ওর।

এই নিঃসঙ্গতার মধ্যে রাকিব এতদিন যা পারেনি সেই আসন করে নেয় ওর মনে। ইথিকা এখন রাকিবের সঙ্গে কাটাতে শুরু করে সময়।

ইথিকার সঙ্গী এখন রাকিব। অফিসের পরে প্রায়ই আসে রাকিব। গল্প করে, চা খায়, ক্যারাম খেলে কবিতা পাঠ করে। রাকিবের মায়ের অপমান ভুলে যায় রাকিবের ব্যবহারে। ওর ভালবাসায় ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে ইথিকার নিঃসঙ্গতা। বিষণ্নতা কাটিয়ে ওঠে ও। হাসে। খাওয়া দাওয়া করে ঠিকমতো। ওর এখন আবার বেঁচে ওঠার ইচ্ছা জাগে।

 

ওর জীবন তো অন্ধকারেই নিমজ্জিত হতে চলেছিল। যে রাকিবের সাহচর্য্ চায়নি তমিজের জন্য। সেই রাকিবের সাহচর্য্ ওকে দেখায় আলোকোজ্জ্বল নগরের পথ। যে জীবনে অন্ধকারের পর্দা পড়েছিল সেই জীবনে ওই পর্দা ছিড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভোরের বাতাস, প্রবেশ করে আনন্দ সূর্যের আলো। সেই আলোর নাচন ওঠে ওর হৃদয়। ও ভুলে যেতে চায় সংসারের কথা, স্বামীর কথা। সব ভুলে যেতে চাইলেও ভুলতে পারে না ছেলের কথা। তবুও স্বামী-সংসারের অবহেলা কাটিয়ে উঠতে চায়!  যে সংসার, স্বামীর জন্য অবহেলা করেছিল একদিন রাকিবকে তা আজ পুষিয়ে দিতে চায়। রাকিবের জন্য কুড়াতে থাকে ঝরা বকুল, শিউলি ফোটায় গোলাপ, বেলী। প্রতীক্ষা করে দুপুরচন্ডির। প্রখর রৌদ্রতাপে স্নিগ্ধতার আমেজ হয়ে আসে এই দুপুরচন্ডি ওর কাছে।

 

ওরা মাঝে মধ্যেই বেড়াতে যায়, যায় নাটক পাড়ায় নাটক দেখতে। করে আবৃত্তি সন্ধ্যা। ইথিকা সুবর্ণলতার সদস্য এখন। আবৃত্তি করে। এই সংগঠনে যোগ দিয়ে ও নতুনের সন্ধান পেয়েছে। জীবন কুয়ো বা কুয়োতলা নয়, জীবন এক বৃহৎ সমুদ্র, গভীর অরণ্য। এটি সুদৃশ্য গন্ধময় পুষ্পকানন। যার সীমানা আছে দেখা যায় না, যার ঘনত্ব শুধু অনুভব করা যায়, ছোঁয়া যায় না। ক্লেদাক্ত হয় না মন।

ইথিকা ভাল আছে। এই ভাল থাকা পছন্দ নয় ওর মায়ের। ওর মা বিরক্ত মেয়ের ওপর। রাকিবের ওপর। এখন প্রায়ই খিটখিট করছে মা। তার ইচ্ছা মেয়ে চলে যাক তমিজের ওখানে। যাওয়ার জন্য তাগিদও দেয় বারবার। নিজেতো বলেই, বাবাকে দিয়েও বলাতে চায়।

বাবা বলেনি কিছুই। মায়ের কথাতেও না করেনি। ওর মা চাকরি করে। বাবা, মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। মেয়েদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। ইথিকার স্বাধীন ইচ্ছায় বাধা দেয় না বাবা।

ইথিকা মায়ের কথায় ওপর কথা বলে না। খারাপ লাগে কিন্তু সহ্য করে। ওতো সকলের সুখেই সুখি হতে চেয়েছিল কিন্তু পারলো কোথায়? এই একটা জীবনে পেয়েছে শুধু অবজ্ঞা অপমান আর নির্যাতন। এখন ও কারো কথা ভাববে না, শুধু ভাববে নিজের কথা। নিজের ইচ্ছামতো চলবে এখন ও।

 

ছয় মাস কেটে গেছে।

ও বাড়ি থেকে একদিনের জন্যও আসেনি তমিজ। একদিন এসেছিল শাশুড়ি আর বিরাজউদ্দিন। বলেছিল ওকে নিয়ে যাবার কথা। মা কথা দিয়েছে। এবারে ও যাবেই। আর কয়েক দিন পর শিমূল আমেরিকা চলে যাচ্ছে, ও চলে গেলেই যাবে। ইথিকা কিছুই জানে না এসবের। মা-ও জানাতে চায়নি। ও একমনে অফিস করে, সংগঠন করে। আবৃত্তি কোর্স করিয়ে বের হওয়ার সময় রাকিব ডাকে। কথা আছে। চল

ওরা হাঁটতে হাঁটতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে ঢোকে। ওপাশ দিয়ে বের হয়ে রিকশা নেবে। হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘ইথিকা যশোর যাবে।’

‘কেন?’

‘এমনি।’

‘এমনি আবার কেউ যায় নাকি।’

‘একদম এমনি এমনি না। ওখানে একটা আবৃত্তি কর্মশালার আয়োজন করেছে ওরা। কয়েক মাস আগে বলেছিলাম। ওরা খবর দিয়েছে এখন। সব অ্যারেঞ্জ করেছে। মাত্র দুই দিন।’

‘বেশতো যাবো। থাকবো দুইদিন। আবার তিনদিনও হতে পারে। উদীচীর প্রোগ্রাম আছে সেটা দেখে আসা যাবে।

’ মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও যশোর চলে যায় ইথিকা। উদিচীর অনুষ্ঠানে গিয়ে বোমায় আহত হয় রাকিব। রাকিবের ভাগ্য ভাল তাই আহত হয়েছে। দশজনের মধ্যে তো ওর বন্ধু আছে।

ওরা বেশ দুরেই ছিল। অনেকদিন পর ওই বন্ধুটির সঙ্গে দেখা। কথা বলতে বলতে ওরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই ফেটে যায় বোমা।

রাকিব হাসপাতালে। জীবন মৃত্যুর সঙ্গে চলছে লড়াই। মাথার কাছে ইথিকা। ইথিকা ঢাকায় নিয়ে এসেছে ওকে। হাসপাতালে ভর্তি করেছে। দিনরাত মাথার কাছে বসে আছে। রাকিবের মা চলে গেছে, এখন কেউ নেই এখানে। ফোনও নেই বাড়িতে। রাকিবের চাচার দোকান আছে বাজারের মধ্যে । ওখানে খবর দিয়েছে। চিঠিও লিখেছে একটা। কেউ এসে পৌঁছায়নি এখনও।

ইথিকা ছুটি বাড়িয়েছে। সামনে শুক্র,শনিবার। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মাথার কাছে বই পড়ছিল ইথিকা। হঠাৎ নাম শুনে ঝুঁকে পড়ে মুখের ওপর। চোখের পাতা নড়ছে।

‘নার্স’ ডাকে ইথিকা।

নার্স এসেছে, এসেছে ডাক্তার। রাকিব এখন সম্পুর্ণ বিপদমুক্ত । মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ফিরে এসেছে।  কিন্তু অনেকে তো ফিরতেই পারেনি।

দেশটার যে কি হল। খুন জখম বোমাবাজি হাইজ্যাক লেগেই আছে। শান্তি নেই। অশান্ত দেশে আর কতোদিন।

ইথিকার তো এখন খবরের কাগজও পড়তে ইচ্ছা করে না, ইচ্ছা করে না খবর দেখতে।

রাকিবের বাবা-মা এসেছে। ওরা এলে পা ছুঁয়ে সালাম দিয়ে কেমন আছে, পথে কোন কষ্ট হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করে। জবাব দেয় না ওরা।

ইথিকা কষ্ট পায় মনে। ছোট বেলায় এই খালাম্মার কোলে চড়েছে, হাতে ভাত খেয়েছে। দুপুরে ওদের বাড়িতেই ঘুমিয়েছে। ছোটবেলাতেই বা কেন, যখন রাহাত মারা যায় তখন এই খালাম্মার কাছেই তো সাত্ত্বনা খুঁজে পেয়েছে ও। সকলে ওকে অপয়া, অলক্ষী বলতো কিন্তু খালাম্মা বলতো না কখনই। আদর করে চোখ মুছিয়ে বলতো, ওদের কথা শুনো না মা। তুমি লেখাপড়া করে চাকরি করো দেখবে ওরা সবাই আবার লক্ষী পয়া বলবে তোমাকে। সেই খালাম্মা কী ব্যবহার হয়েছে আজ! কথা  বলে না। কটু কথা বলতেও ছাড়ে না।

রাকিবকে নিয়ে সেই যশোর থেকে এসেছে এখানে, ভর্তি করেছে, অফিস কামাই করে সেবা করেছে তার কোনই মূল্য নেই এদের কাছে।

অবশ্য মূল্য চায় না তবুও সাধারণ সৌজন্যটুকু আশা করে মানুষ। এই সৌজন্যটুকু আশা করেছিল ও। এটা মানুষের ধর্ম। রাকিবের বাবা-মা রাকিবের কাছে বসতেই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসে ইথিকা। কোন কিছু এখানে বুঝিয়ে দেওয়ার নেই। নার্স ডাক্তার আয়া সবই আছে। সবাই দেখবে ওকে। প্রয়োজনে বুঝিয়ে দিবে।

 

রিকশায় ওঠে ইথিকা। কি জানি কেন দুই চোখ ভরে উপচে যায়  জলে। চোখ যতোই মুছে ততোই জলে ভরে উঠে।

এলোমেলো লাগে মন। হালকা এক ঝড়ো হাওয়া যেমন উলট পালট করে দিয়ে যায় রোদ্দুরে দেওয়া ধোয়া কাপড় তেমনি লাগছে ওর ভেতরটা। ঘরের ভেতর পা দিতেই দেখে বিরাজউদ্দিন আর তমিজ কথা বলছে মায়ের সঙ্গে। বাবা বসে আছে একটু দুরে। গম্ভীর। শিমূলের সঙ্গেই খেলছে রাহা। ওকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে।

ডাকে, ‘মা…. মা।’ রাহাকে কোলে নিতেই এতক্ষণের জমাট কান্না সমুদ্রের জোয়ারের মতো প্লাবিত করে ওকে। চোখের জল লুকাতে চলে যায় ঘরে। ‘কিরে যাস কেন।’ মা ডাকে। মায়ের ডাক শুনলেও কথা বলে না। ছেলেকে বুকে নিয়ে চলে যায়।

‘কিরে শুনতে পাস না।’

‘আসছি।’

‘আসছি না দাঁড়া। তমিজ নিতে এসেছে তোকে।’ মায়ের কন্ঠে আদেশের সুর। মায়ের কন্ঠে আদেশ শুনে ঘুরে দাঁড়ায় ইথিকা, তাকিয়ে থাকে কথা বলে না। চলে যায় ঘরে। মা এবারে উঠে আসে ঘরে।

‘চলে এলি কেন?’

‘এমনি।’

‘ দেখ নিজের সংসার ওখানে, সব কিছু তোর নিজের। নিজের সংসার ফেলে পরের সংসারে পড়ে থাকবি কেন? এটা কেমন কথা। কতোদিন আর থাকবি এখানে। আর রাহার কথাও তো ভাবতে হবে।’

‘আমি যাবো না মা।’

ইথিকা জানে না, ও যখন যশোর তখন ওদের খবর দিয়ে নিয়ে এসেছিল মা। কথাবার্তা বলে আজকের দিনটা ঠিক করেছে। মায়ের কথামতোই এসেছে ওরা।

রাকিবের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করছে না মা। ইথিকা যদি এতসব খবর জানতো তবে না করতো না। ও না করে দেয়। মা রেগে যায়।

‘কেন যাবি না।’

‘এমনিই। তোমার মতো বাবারও কি এই মত।’

‘হ্যাঁ। আমার কথার ওপরে কোনদিন কি তোর বাবা কখনও কথা বলেছে। আর একটা কথা, তোমার বাবার মত আছে কি নেই সেটা কোন কথা নয়, আমি বলছি যাবে তুমি, তুমি যাবে। এই আমার শেষ কথা।’

‘থাক না আম্মা, ও যখন যেতে চাচ্ছে না আজ, কাল আসবো আবার।’ ভালোমানুষি দেখায় তমিজ। কখন উঠে এসেছে এ ঘরে ওরা কেউই দেখেনি। বিরাজউদ্দিন উঠে চলে যায় বাবার কাছে। ‘চাচাজান, আপনি বললেই ও যাবে। আমি ক্ষমা চাচ্ছি তমিজের হয়ে।’ ইথিকার বাবা সরাফত আলি এতক্ষণ গুম হয়ে বসেছিলেন, একটি কথা বলেননি। এবারে একটু রুষ্ট কন্ঠেই বললেন, ‘তুমি ক্ষমা চাইলে বা কি,  না চাইলেই বা কি। এই নিয়ে ক বার হলো।’

‘আর হবে না আব্বা।’ দুলাভাইয়ের এক চিমটিতে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে যায় তমিজ। তমিজের ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কেন চাইবে। কি অপরাধ ওর। ঘরের বউ তো মার খাবেই। তাই বলে চলে আসবে। ওর বাবাও তো মারতো মাকে, কই মা-তো কখনও যায়নি বাড়ি ছেড়ে কোথাও। ‘দেখ এইবার শেষ বার। আর শুনে রাখ ও যদি যায় যাক। কিন্তু আমার ইচ্ছা নেই। আরও একটা কথা আর একবার যদি এরকম হয় তবে ইথিকা ও বাড়িতে আর কখনও যাবে না, ওর আবার বিয়ে দেব আমি।’ বাবার কথাতে মা,বাবার ওপর রাগে ফুলছে। কি কথার ছিরি আবার বিয়ে দেব। মায়ের মত পেয়ে ইথিকার কাছে ছুটে যায় তমিজ। অনেক কথা কাটাকাটি, কান্নাকাটি পর ইথিকা সন্ধায় তমিজের সঙ্গে চলে যায় ও বাড়ি। সমস্ত রাস্তা একটিও কথা বলে না ইথিকা। ওর মনে হয় এ কোথায় চলেছে ও। এক অজানা গন্তব্যের পথে ওর যাত্রা। এ যাত্রা পথ মসৃণ নয় বন্ধুর পথ, অমসৃণ। ওর যেতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে ফিরে যেতে কিন্তু পারে না। মায়ের মুখ মনে পড়ে ওর। মায়ের ক্রোধ, আর কান্না ভেজা মুখ ওকে পৌঁছে দেয় এ বাড়িতে। ওর ভাল লাগে না। এ সংসার টেনে রাখতে পারে না আর ওকে। এ সংসারের কোন কিছুই আপন মনে হয় না ওর। এই সংসার মরুভূমির মধ্যে শুধুমাত্র একটুখানি আনন্দের উৎস ওই রাহা। মায়ার বন্ধন। অথচ এই আনন্দ উৎসটুকুও সব সময় থাকে না কাছে। রাহাকে ওর কাছ থেকে সব সময় দূরে রাখে ওরা। ওরা গুছিয়েই করে সব কাজ।

 

রাহা ছেলে মানুষ। ওদের কাছেই ওর প্রয়োজন মিটে যায় বলে, ওর কাছে আসে না, ইথিকার প্রয়োজন হয় না রাহার কাছে। রাহার খাওয়া গোসল ঘুম পাড়ানোর জন্য অনেকেই আছে এ বাড়িতে। শুধু কেউ নেই ওর। এ বাড়িতে আসার পর থেকেই রান্না ঘরের কাজ, সংসারের কাজ ওকে প্রায় করতেই দেয়না শাশুড়ি। শুধু রাতের খাবারটা দেয় ও। ভালমানুষি ভাব ধরে আছে এরা। খুব তোয়াজ করে কথা বলছে ওরা। কিছু বুঝতে পারছে না ইথিকা। মনে পড়ে রাকিবের কথা। কয়েক দিন যেতে পারেনি। অফিস থেকে হাসপাতালে যায়। সঙ্গে তমিজ।

রাকিব অনেকটা ভাল। পুুুরো সারতে সময় লাগবে মাসখানেক। ওদের দেখে উঠে বসে রাকিব। ওকে উঠতে দেখে হা হা করে ওঠে তমিজ। যেন কতদিনের আপন; ওর প্রতি কোন বিদ্বেষ ছিল না কখনও। ওকে ধরে শুইয়ে দেয়।

‘শুয়ে থাক ভাই, শুয়ে থাক। তোমার এখন রেষ্টের দারকার। আমার বউ এর কাছে সব শুনলাম। খুব দঃখের ব্যাপার। কেন গিয়েছিলে বলতো।’  না জানার ভান করে ভালো মানুষি করলেও রাকিব সব বুঝতে পারে। অবাক হয় না। কারণ ও জানে ইথিকা এসব কথা বলতেই পারে না ওকে। হাসে মনে মনে। তোমার সব কথা আমি বুঝতে পারি তমিজ। ভাল মানুুষির আড়ালে তোমার শয়তানি চেহারা, তোমার  মনোভাব ঢাকতে পারবে না কখনও। তোমার মুখে এক মনে আর এক। তুমি মুখে এক কথা বল, চোখে বলো অন্যকথা। রাকিব কথা বলে ইথিকার সঙ্গে।

‘কেমন আছ ইথিকা। কয়েক দিন আসনি।’ ওর কথা শুনে চোখ ছলছল করে ইথিকার। ওর দিকে তাকিয়ে থাকে রাকিব। কষ্টের ছায়া দোলে ওর চোখে। তুমি চলে গেলে ইথিকা। এভাবে বুঝি ভাল লাগছিল না। ভাল না লাগলে তুমি বলতে আমাকে আমি তোমাকে নিতাম আমার ঘরে। আমি তোমাকে ভালোবাসার সব দেব বলে কবে থেকে প্রস্তুত হয়ে আছি ইথিকা। এসব কথা মুখে না বললেও চোখে ভেসে ওঠে সব; রাকিবের চোখে ওর হৃদয় দুলছে তা দেখতে পায় ইথিকা। অপ্রস্তুত হয়। অপ্রস্তুতভাবে কাটিয়ে ওঠার জন্য অন্য কথা পাড়ে ইথিকা।

‘খালাম্মা, খালু চলে গেছে।’

‘না যায়নি। আগামী কাল যাবে তাই একটু মার্কেট গেছে। এখনি এসে পরবে।’

‘ঠিক আছে চলি তাহলে। কাল আবার আসবো।’

‘আর একটু থাকো না, বেশ লাগছে। হাসপাতালে তো কথা বলার লোক নেই। আছে গম্ভীর মুখ সব ডাক্তার আর নার্স। ওরা ব্যস্ত নাড়ী টেপা আর ওষুধ খাওয়ানো নিয়ে। একটু বস, প্লীজ।’ রাকিবের কথায় আর একটু বসে। কথা বলে।