আমি মায়ের কাছে যাবো – আফরোজা পারভীন

আমি মায়ের কাছে যাবো - আফরোজা পারভীন

আজ  ১৮ অক্টোবর। রাসেলের জন্মদিন। পায়েস রান্না হয়েছে। তবে কারো মনে আনন্দ  নেই। মনে কষ্ট নিয়ে সবাই হাসছে। রাসেল ছোটমানুষ, মাত্র চার বছরের। ও মন খারাপের কি বোঝে! আব্বা জেলে । বাড়িতে অনেক মানুষ আসছে যাচ্ছে । মার সাথে কথা বলছে। মা হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলছেন। মার এই হাসিমুখটা রাসেলের খুবই পছন্দ। মার শুধু হাসিমুখ কেন, সবকিছুই ওর পছন্দ। আব্বাকেও ওর খুব পছন্দ। কাকে  যে বেশি পছন্দ বুঝে উঠতে পারে না রাসেল। দ্বিধায় পড়ে। মা ডাকছেন,

: হাসু  রেহানা জামাল কামাল

রাসেলরা পাঁচ ভাইবোন। বড়বোন হাসিনা, তারপর কামালভাই আর জামালভাই। তারপর রেহানাবু সবার ছোট রাসেল। মায়ের নাম ফজিলাতুন নেসা । আব্বা ডাকেন রেনু। আব্বা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি  বড় নেতা। তারও একটা ডাকনাম আছে। খোকা। দাদা দাদি ডাকেন।

জামালভাই  কামালভাই বাড়িতে ছিল না । ‘একটু আসছি’ বলে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল।  রাসেলকে কোলে নিয়ে হাসিনা খাবার ঘরে গেল। খাবার টেবিলে অন্যদিনের চেয়ে আজ ভাল খাবার। মাঝখানে বিশাল একটা বাটিতে পায়েস। উপরে কিসমিশ ভাসছে। কী তার সুঘ্রাণ!

: মা আমি পায়েস খাবো

: খাবে তো সোনা। তোমার জন্যই তো পায়েস রান্না করলাম। আজ তোমার জন্মদিন।

সিঁড়িতে জামাল কামালভাইয়ের পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। ওদের পায়ের শব্দ রাসেলের চেনা। কামালের হাতে একটা কেক। আর চারটে মোমবাতি। ওরা ঘরে ঢুকে বলে,

: কেক নিয়ে এসে পড়েছি, এসে পড়েছি।

হাততালি দিয়ে ওঠে রাসেল।

কামাল কেকটা টেবিলে বসিয়ে মোমবাতি দিয়ে সাজায়। তারপর সবাই মিলে রাসেলকে  মাঝে আর পাশে মাকে রেখে ওর হাত ধরে কেক কাটে। ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। হাপি বার্থ  ডে টু ডিয়ার রাসেল, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। ’ মা কেকের একটা টুকরো রাসেলের মুখে তুলে দেয়। সবাই একে একে ওর মুখে কেক আর পায়েস তুলে দেয়। তারপর ওরা বলে,

: আমাকে খাইয়াও, আমাকে খাওয়াও।

রাসেল সবাইকে একে একে খাইয়ে দেয়। আচমকা বলে,

: আব্বা কই? আব্বাকে খাওয়াবো।

ওরা কথা বলে না। পরস্পরের দিকে তাকায়।

: বলছ না কেন, আব্বা কই, আব্বাকে খাওয়াবো।

এবার মা  বলেন,

: অমন করে না সোনা। তুমিতো জানো,  তোমার আব্বা দেশের কাজ করতে গিয়ে জেলে গেছেন। উনি ফিরে আসবেন বাবা। আবার সবাই মিলে তোমার জন্মদিন করব।

: কবে আসবে, কবে! আমি আব্বার কাছে যাবো । আব্বার কাছে যাবো। ভ্যা করে কেঁদে ফেলে রাসেল।

সেদিন মার পাশে শুয়ে রাসেলের আর ঘুম আসে না। আব্বার কথা মনে পড়ে। আব্বা তাকে কত আদর করতেন। কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন। ঘুমানোর আগে গল্প শুনাতেন। রাসেল আব্বার চশমা আর পাইপ মাঝে মাঝে লুকিয়ে রাখত। কোথায় চলে গেলেন আব্বা। কোন জেলে আছেন ? সে জেলে কি যেতে পারে না রাসেল!

ওদিকে ফজিলাতুন নেসারও ঘুম আসছে না। তারও মনে পড়ছে স্বামীর কথা।  জেলে যাওয়া স্বামীর জন্য নতুন না। সারাক্ষণ জেলে যাবার জন্য সুটকেস একটা গোছানোই থাকে। জেলে যান, ফেরেন আবার যান এমনই চলে। এবার বেশ দীর্ঘ সময় ধরে তিনি জেলে। ৬৬ তে লাহোরে ৬ দফা দিলেন । তারপর  চিটাগাং-এ লালদীঘির পাড়ে জনসভা থেকে এরেস্ট হলেন। সে খবর ৩২ নাম্বারে এসে পৌঁছালো সাথে সাথে।

: শুনেছেন তো লিডার  এরেস্ট হয়েছেন।

এরেস্ট হবার পর জামিন পেলেন। কিন্তু জামিন হবার পর পরই আবার এরেস্ট। সেই এরেস্টে থাকা অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে আসামী করা হল। সেই থেকে কারাবন্দী।

রাসেল নড়ছে । বড় বড় শ্বাস ফেলছে

: কিরে তোর ঘুম আসছে না?

: না মা, গল্প শুনাও না। আব্বা আমাকে ঘুমানোর আগে কত গল্প শুনাতো।

: গল্প শুনবি। আয়, কাছে আয়।

রাসেলকে কাছে টেনে নিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন মা। বড় আদরের সন্তান তার।  ফজিলাতুননেসা রাসেলকে তার আব্বার গল্প শুনান। টুংগিপাড়া গ্রাম, সেখানকার সহজ সরল মানুষ, প্রকৃতি,  গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলা, গ্রামের গরীব ছেলে মেয়েদের নিজের কাপড় দিয়ে দেয়া, নিজের বইপত্র দেয়ার গল্প করেন। তারপর বলেন মানুষের মঙ্গলের জন্য তার রাজনীতির কথা।  রাসেল হা করে শোনে। তার আব্বা এত ভাল! এত মহৎ ! বড় হয়ে সে আব্বার মতই হবে। এরপর ফজিলাতুন নেসা বলেন,

: বুঝলি বাবা তোর আব্বা আমাকে মাঝে মাঝেই বার্ট্রান্ড রাসেলের গল্প বলতেন। রাসেলের  লেখা তোর আব্বার খুব প্রিয় ছিল। শুনতে শুনতে আমিও রাসেলের ভক্ত হয়ে গেলাম। তাই তোর জন্মের পর নাম রাখলাম রাসেল।

: বার্ট্রান্ড রাসেল কে  মা?

: একজন অনেক বড় লেখক, দার্শনিক, অনেক বড় মানুষ।

: আমি বড় হয়ে তাঁর মতো হবো।

: নিশ্চয়ই হবি। অবশ্যই হবি।

আস্তে আস্তে রাসেলের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। ও আর কথা বলে না। একসময় বোঝা যায় ঘুমিয়ে পড়েছে রাসেল।

দিন গড়িয়ে যায়। শেখ মুজিব ছাড়া পেয়েছেন। দেশের অবস্থা উত্তাল, উত্তপ্ত। স্বাধীনতা পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে মানুষ। পাকিস্তানিদের শাসন আর বাঙালিরা মানবে না। তাদের অত্যাচার নির্যাতন মেনে নেবে না। আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছে। ৭০-এর নির্বাচন হয়ে গেছে। বাঙালিরা জিতেছে। কিন্তু তাদের  হাতে ক্ষমতা দেয়া হয়নি। সারা বাড়ি গম গম করে মানুষে। আর সারাক্ষণ শুধু একই আলোচনা।

রাসেল আর একটু বড় হয়েছে। সব কথাই ও শোনে। বেশিরভাগ কথাই বোঝে না। তবে ওর মোটেও ভালো লাগে না। আব্বাকে ও কাছেই পায় না। আব্বা সারাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাড়িতে যখন আসেন তখন মানুষে ছেয়ে থাকে সারা বাড়ি।   নিচে কথা বলে মিটিং করে গভীর রাতে ঘরে ফেরেন। রাসেল জেগে বসে থাকে। আব্বা ঘরে ফেরামাত্র ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। আব্বা ওকে কাঁধে তুলে নেন। মাথায় হাত বুলান। ওর সাথে গল্প করেন। ফরিদপুর বরিশাল ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা আর উর্দু মিলিয়ে অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলে রাসেল। আব্বা  হাসেন, মজা পান। ফজিলাতুন নেসাকে বলেন,

: আচ্ছা  এই অদ্ভুত ভাষা ও শিখল কিভাবে বলত রেনু?

: মাঝে মাঝে টুগিংপাড়া যাই আমরা। তাছাড়া বাসায় কত এলাকার কত  লোকজন আসে। এক এক জন এক একরকম ভাষায় কথা বলে । সবাই ওকে ভালবাসে। ওদের সাথে মিশে শিখেছে।

মায়ের কাছে একটা সাইকেলের বায়না ধরেছে রাসেল। মা তাকে একটা তিন চাকার সাইকেল কিনে দিয়েছেন। সেই সাইকেল নিয়ে সারাক্ষণ বাড়ির মধ্যে চক্কর খায় রাসেল। একবার এর গায়ে পড়ে তো একবার ওর গায়ে। সবাই হাসে আর বলে,

: ভাগ্যিস দু’ চাকার সাইকেল পাওনি। তাহলে আমাদের আর রক্ষে ছিল না।

রেগে যায় রাসেল। ছুটে যায় মায়ের কাছে।

: মা মা, ওদের বকে দাও। আমাকে বাজে কথা বলছে।

কদিন ধরে কেমন যেন থমথমে চারধার। দেশে নাকি যুদ্ধ বাধবে। আব্বা নাকি যুদ্ধের ডাক দেবেন। গৃহকর্মী রমার হাত ধরে ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে হাঁটে রাসেল । রমা বলে,

: বুঝলে ভাইয়া স্যার ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ভাষণ দেবেন। কি বলবেন সে ভাষণে কে জানে। সবাই  সে ভাষণ শোনার অপেক্ষায় আছে।

: আমাকে নিয়ে যাবে  ভাষণ শুনতে?

: আরে না না । কত কত মানুষ যাবে সেখানে। সারাদেশের মানুষ। অত মানুষের ভিড়ে তোমার মতো ছোট বাচ্চার যেতে  নেই।

: আমি বড় হলে যেতে পারব তো?

: তাতো পারবেই। তখন তুমিও স্যারের মতো ভাষণ দেবে

৭ মার্চের ভাষণ হল। রমা বলল, আব্বা নাকি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। তারপর দিনগুলো যেন কেমন হয়ে গেল। একদিন রাতে সবার মুখ শুকনো দেখে রাসেল বলল,

: কি হয়েছে । কেউ আমাকে কিছু বলছ না কেন?

হাসুবুবু বলল,

: রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলা হয়েছে। অনেক মানুষ মেরে ফেলেছে পাকিস্তানিরা ।

কামাল ভাই জামাল ভাই রেহানাবুবু চুপ করে বসে রইলেন। সেদিন রাতে বাড়ির কেউ ঘুমালো না। আব্বার মুখ থমথমে। তিনি বললেন,

: অপারেশন সার্চলাইট করে আমার নিরীহ ভাইদের পাকিস্তানীরা এভাবে মেরে ফেলল!

আব্বার গলা কেমন যেন কাঁদো কাঁদো।

অনেকক্ষণ মার পাশে বসে রইল রাসেল। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝরাতে   হৈ চৈ-এর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ওর । আব্বাকে এরেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছে যেন কারা। আব্বার  পেছন পেছন ছুটে গেল রাসেল। মা রাসেলকে টেনে ধরল। মায়ের চোখে কোন কান্না নেই। কঠিন দেখাতে লাগল তার চোখ মুখ। আব্বাকে নিয়ে গেল। ওরা সবাই দাঁড়িয়ে থাকল। রাসেল কাঁদতে লাগল,

: আমি আব্বার কাছে যাবো, আব্বার কাছে যাবো।

পরদিন হাসু বুবু রেহানা বুবু বলল,

: আব্বা কাল রাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন । আব্বাকে কোথায় রেখেছে জানা যাচ্ছে না।

এরপর জানা  গেল আব্বাকে দুদিন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে রেখে পাকিস্তানে নিয়ে গেছে পাকিস্তানিরা।

হাসতে ভুলে গেল রাসেল।  ও এখন আর সাইকেল চালায় না। হাসুবুবু রেহানাবুবুর মুখও কেমন  যেন পাথরের মতো। কামালভাই জামাল ভাই চলে গেলেন যুদ্ধে।

হাসু বুবু একদিন বললেন,

: কামাল কর্নেল ওসমানীর এডিসি হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে।

মা হাসলেন অনেকদিন পর। কেমন যেন একটা গর্বের ভাব তার চেহারায়।

কয়েকদিন পর কয়েকজন   লোক এসে রাসেলদের নিয়ে  গেল অন্য একটা বাড়িতে। যাবার সময় রাসেল সাইকেলটা নিতে চাইলে ওরা নিতে দিলো না। হাসু বুবু বললেন,

: ওরা কিছু নিতে দেবে না , বায়না কোরো না। ওরা আমাদের গৃহবন্দি করে রাখবে।

তাই-ই হলো। গৃহবন্দি হয়ে আছে রাসেলরা। অনেকগুলো পাকিস্তানি সৈন্য সারাক্ষণ বন্দুক তাক করে বসে থাকে। বাসার চারদিকে বেরিকেড। কাউকে বাসায় ঢুকতে দেয় না। বের হতেও দেয় না। মা নামাজ কালাম পড়েন, দেশের জন্য দোয়া করেন। হাসুবুবু রেহানাবুবু সারাক্ষণ দেশ স্বাধীনের স্বপ্ন দেখেন । ফিসফিস করে গল্প করেন,

: দেখিস দেশ স্বাধীন হবে, হবেই

: ঠিক বলেছ বুবু আমারও তাই মনে হয়।

মা এসে মাঝে মাঝে ওদের পাশে বসেন। হাসুবুবুর জন্য খুবই চিন্তিত তিনি। বুবুর নাকি বাচ্চা হবে। রাসেল মামা হবে! আব্বার কোন খবর পাওয়া যায় না। রাসেলের বাড়ি থেকে বের হতে ইচ্ছে করে। সামনের রাস্তায় সাইকেল চালাতে ইচ্ছে করে, খেলতে ইচ্ছে করে। কিচ্ছু পারে না ও। ওর রাগ হয়। পাকিস্তানিরা এমন নিষ্ঠুর কেন, শিশুদের মন বোঝে না কেন ওরা? ওদের কি ছেলে মেয়ে নেই।

একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে হাসুবুবুর। ওর নাম রাখা হয়েছে জয়। ওকে নিয়ে দিনের অনেকটা সময় কেটে যায় রাসেলের।  সেদিন ওই বাড়িতে কেমন যেন এক অদ্ভুত উত্তেজনা। সবার চোখ মুখে চাপা আনন্দ। রাসেল একবার হাসুবুবুর কাছে একবার রেহানাবুবুর কাছে ঘোরে।

: কি হয়েছে বুবু ? বলো না কি হয়েছে?

: দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমরা এখন স্বাধীন।  হা হা হাহা আমরা এখন স্বাধীন।

হাসুবুবু রাসেলকে মাথার উপরে তুলে দু এক পাক ঘুরিয়ে নেয়।

রাসেল বলে,

:দেশ তো স্বাধীন হল। আব্বা কবে আসবে, আসবে তো?

রাসেলের এ কথায় সবার মুখ ভার হয়ে যায়। সবাই উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে।

পরদিন জানালার আড়াল  থেকে একজন ইন্ডিয়ান অফিসারকে বাসার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ওরা। সবগুলো বন্দুকের নল ঘুরে যায় তার দিকে। অফিসারের হাতে মাইক । তিনি মাইকে বলেন, ‘পাকিস্তানের পতন হয়েছে। আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। আপনাদের নিরাপদে দেশে যেতে দেয়া হবে।’ তারপরও ওরা  বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু একসময় আত্মসমর্পণ করে ওরা। জানালার আড়াল থেকে দমবন্ধ করে দেখে রাসেল আর সবাই। একসময় দরজায় টুকটুক আওয়াজ হয়। দরজা খুললে ইন্ডিয়ান অফিসার ঘরে ঢোকেন।

: আমি মেজর আশোক তারা । আমি নির্দেশ পেয়ে আপনাদের হাউস এরেস্ট থেকে মুক্ত করতে এসেছি।

পাকিস্তানি পতাকা পায়ে মাড়িয়ে বেরিয়ে আসেন ফজিলাতুননেসা। সাথে হাসিনা  রেহানা রাসেল। রাসেলের কোলে ছোট্ট জয়।

কেটে গেছে আরো বেশ কিছু দিন। রাসেলরা ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে নিজেদের বাসায় । আব্বার প্রতীক্ষায় দিন কাটে ওদের। আব্বা কি বেঁচে আছেন?  জামালভাই কামালভাই ফিরে এসেছেন। আব্বা ফিরবেন তো?

বাড়িতে সারাক্ষণই গমগম করে মানুষ। নেতা কর্মি সমর্থন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীরা সবাই আসেন।

৮  জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। রাসেল বারান্দায় বসে ছিল।

সিকিউরিটি মুহিতুল ভাই কাছে এসে বললেন,

: স্যারকে আজ পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তিনি লন্ডন যাবেন। সেখান থেকে ভারতে। সেখানে তাঁকে রাজকীয় সম্বর্ধনা  দেয়া হবে। ১০ তারিখে দেশে ফিরবেন স্যার।

: কেন কেন, অত জায়গায় যাবার দরকার কি আব্বার। উনি তো সরাসরি দেশে ফিরতে পারেন। কতদিন আব্বাকে দেখি না।

মুহিতুল হাসেন।

: উনি তোমার আব্বা । কিন্তু উনি যে অনেক বড় নেতা।  দেশের কথা ভেবেই এসব কাজ করতে হয় ওনাকে।

এ দুদিন যেন আর কাটতেই চায় না। আজ ১০ তারিখ। বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছেন। দাদা লুৎফর  রহমান বিমানবন্দরে যাচ্ছেন আব্বাকে আনতে। বললেন,

: যাই  খোকাকে নিয়ে আসি।

কাঁদতে শুরু করল রাসেল,

: আমি যাবো, আমি যাবো। আমাকে নিয়ে চলো না।

দাদা ওকে অনেক আদর করলেন । তারপর বললেন,

: সারা  দেশের লোক এসে জড়ো হয়েছে ঢাকায় নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে। তোমার যাওয়ার দরকার নেই। একটু পরে তো আব্বা বাসায় ফিরবেনই।

রাসেল চোখ মুছল। দাদা বেরিয়ে গেল। রাসেল আব্বার জন্য অপেক্ষা করছে তো করছেই। আজ মারও যেন তার দিকে খেয়াল নেই।

একজন কর্মি ভেতরে এসে বলল,

: লিডার রেসকোর্সে  গেছেন। আর কি বলব। সারাদেশই যেন আজ হাজির হয়েছে এয়ারপোর্টে। আমি লিডারকে  রেসকোর্সে রেখে আপনাদের খবর দিতে এলাম। মানুষ আর মানুষ। রাস্তার দুপাশের ছাদ আর গাছের ডালে ডালে মানুষ। কেউ কেঁদে গড়িয়ে পড়ছে । কেউ পাগলের মতো হাসছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য!

: আব্বা বাসায় আসবেন কখন? আমাকে না দেখে আব্বা প্রথমে রেসকোর্সে গেলেন কেন?

: ওভাবে বলে না বাবা। উনি তোমার আব্বা ঠিক আছে। কিন্তু উনি জনগণের নেতা। জনগণই তো তাঁকে নেতা বানিয়েছে। ওদের কাছেই তো আগে যেতে হবে।

সবাই খালি এক কথা বলে। জনগণের নেতা। কেউ বলে বঙ্গবন্ধু, কেউ বলে জাতির পিতা। আরো কত কি। এত ভারি ভারি কথা বেঝে না রাসেল। ও শুধু আব্বাকে কাছে পেতে চায়।

একসময় আব্বা এলেন। দৌড়ে গিয়ে রাসেল ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর বুকে। আব্বাও যেন ছেলেকে বুকের গভীরে ঢুকিয়ে নিতে চাইলেন। অনেকক্ষণ এভাবে রেখে একসময় বললেন,

: একটু ছাড় বাবা। আব্বা মাকে সালাম করে নি

বাবা মা আর মুরব্বিদের সালাম করলেন আব্বা । অন্য সন্তানরা কাছে এল। সবাইকে বুকের সাথে আঁকড়ে রাখলেন। মা আব্বার বুকে মাথা রেখে অজ্ঞান হলেন। পানির ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হল তাঁর। এরপর তিনি আব্বার হাতটি এমনভাবে ধরে বসে রইলেন যেন কখনই ছাড়বেন না, কেউ ছাড়াতে পারবে না। রাসেল গিয়ে আব্বার কোলে শুয়ে পড়ল।

অদ্ভুত আনন্দে কাটছে দিন! আব্বা দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। কিন্তু উনি থাকেন ৩২ নাম্বারের সেই পুরানো বাড়িতেই। কামালভাই জামালভাই-এর বিয়ে হয়েছে। ভাই-ভাবিদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে রাসেল। ভাবিরা ওকে খুব ভালবাসে। প্রতি বিকেলে রাসেল বেড়াতে যায় গণভবনে। গণভবনের সবুজ লনে  ঘোরে। ডিগবাজি খায়। দৌড়ায়, উল্টে উল্টে পড়ে । হাসে হা হা হি হি ।

আজও রমার হাত ধরে রাসেল এসেছে গণভবনে।  বেশ কিছুক্ষণ দৌড়দৌড়ি করে ও এসে দাঁড়ালো সামনের লেকের ধারে। রমা সাথে এল। হাতে  দুটো বড়শি। একটা ছোট একটা বড়। ঘাসের ওপর বসল রাসেল ।

: করছ কি করছ, কি মোড়া পেতে দি

: না অন্যদের মতো বসব।

বসে পড়ল ওরা। রাসেল ছোট বড়শিটা ফেলল। রমা ফেলল বড় বড়শি। বড়শি ফেলে বসে আছে তো আছেই। মাছের দেখা নেই। রমা কি যেন বলতে গেল। রাসেল ঠোঁটে হাত রেখে বলল,

: চুউপ মাছ পালিয়ে যাবে।

অনেক অনেকক্ষণ বসে থাকার পর বড়শিতে টান পড়ল। একটু একটু করে টান বাড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে রাসেলের চোখ বড়বড় হয়ে গেল। রমা  বলল,

:  তোমারটা খেয়েছে

: চুউপ

বড়শিতে টান মারলো রাসেল। বড়শি উল্টে পেছনে পড়ল । বড়শিতে  গেঁথে আছে বেশ বড় সাইজের একটা পোনা মাছ। যত্নে বড়শি থেকে মাছটা খুলল রাসেল। বলল,

: দেখেছ  দেখেছ বড়শিটা  কেমন গেঁথে গেছে। ব্যথা পেয়েছ ও। ইস।

এরপর ও যত্নে মাছটাকে খুলে পানিতে ছেড়ে দিলো।

পর পর অনেকগুলো মাছ ধরে ছেড়ে দিলো রাসেল। একটাও বাড়ি নিলো না।

ফিরল আবার গণভবন লনে। আরো কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে বাড়ি ফিরল।

চিৎকার করে ডাকল,

: মা মা

সিঁড়ি দিয়ে  নেমে এলেন মা।

: কি হয়েছে ? ফিরেছিস কাদায় মাখামাখি করে। হাত মুখ ধো।

: মা ক্ষুধা লেগেছে

: হাতমুখ দো । খাবার দিচ্ছি।

অনেক রকম নাস্তা সাজিয়ে দেন মা। নাস্তা খাবার পর রাসেল পড়তে বসে।  সে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়ে । পড়ায় খুবই মনোযোগী। আর ভীষণ আদুরে। সবার ছোট বলে সবাই ওকে  যেন বুকে করে রাখে। বিশেষ করে আব্বা মা আর হাসুবুবু । পড়াশুনা শেষ করে ও পোষা কুকুর টমকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করে। টম রাসেলের খুব প্রিয়। আর প্রিয় বাকস বোঝাই কবুতরগুলো। ও নিজহাতে ওদের খাবার আর পানি দিলো। কবুতরের ঘরের ময়লা পরিষ্কার করল। বাড়িতে কাজের অনেক লোকজন আছে । কিন্তু এসব কাজ রাসেল নিজেই করে। রাসেলের পরিচর্যা আর আদর পেয়ে কবুতরগুলোর চেহারা দারুণ সুন্দর হয়েছে। খুব স্বাস্থ্যবান আর নাদুস নুদুস। একদিন গৃহকর্মী  নেওয়াজ বলেছিল,

: কবুতরগুলো তো খুব মোটাতাজা হয়েছে। জবাই করে রান্না করে দি।

: না না কিছুতেই না। যাদের আমি নিজ হাতে পালি তাদের মাংস আমি খাবো না ।

এসব করতে করতে বেশ রাত হয়ে যায়। রাসেলও ব্যস্ত, মাও ব্যস্ত। মা ডাকছেন,

: সবাই খাবার টেবিলে আসো

খাবার  টেবিলে বসে সবাই । মা রাসেলের মুখে তুলে খাওয়ান। হাসি আর গল্প করতে করতে সবাই খাওয়া শেষ করে।

শেষরাত।  ঘুমিয়ে ছিল রাসেল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কেমন যেন একটা শব্দ হচ্ছে গুড়–ম গু–ড়–ম। ও বিছানায় উঠে বসল। পাশে মা নেই। পাশের ঘরে গিয়ে দেখল সবাই উঠে পড়েছে। সবার চোখ মুখে আতঙ্ক। আব্বা টেলিফোন করার চেষ্টা করছেন বাইরে। কামাল ভাই জামালভাই যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। সব লাইন কাটা। কিভাবে যেন  মেজর শফিউল্লাকে ফোনে পেলেন আব্বা। কিন্তু ওনার কথা শুনতে শুনতে আব্বার মুখ আঁধার হয়ে গেল। উনি এলেন না। এরপর পেলেন কর্নেল জামিলকে। সামান্যক্ষণ কথা বললেন। তারপর সবার দিকে চেয়ে বললেন,

: জামিল আসছে। আশ্চর্য আমার লোকেরা আমার বাড়িতে হামলা করল!

ভয়ার্ত চোখে একবার এদিক একবার ওদিক তাকাছে রাসেল। হাসুবুবু  রেহানাবুবু জার্মানিতে বেড়াতে গেছে। ওকে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মা আব্বাকে ফেলে যায়নি রাসেল। এখন ওরাও নেই। কামাল ভাই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন । পর পর অনেকগুলো গুলির শব্দ  ভেসে এল। আব্বা সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। অনেকগুলো ভারি পদশব্দ উপরে উঠে এল। আব্বাকে ওদের সাথে যেতে বলল। আব্বা ঘরের দিকে ফিরছেন। আবার গুলি। এরপর ওরা ওপরে উঠে এল। ঘরে ঘরে ঢুকল আর শুধু গুলি চলল, কত গুলি কে জানে। মুহিতুল ভাইকে দেখে তার পেছনে লুকালো রাসেল। বলল,

:  ওরা সবাইকে মেরে ফেরছে। আমাকেও কি ওরা মেরে ফেলবে?

: তোমাকে মারবে না, তুমি শিশু  তোমাকে মারবে কেন!

ওদের একজন  মুহিতুলের পেছন থেকে রাসেলকে টেনে বের করল। রাসেল কাঁদতে কাঁদতে বলল, :আমি মায়ের কাছে যাবো।

: চলো তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।

অনেক আপনজনের মৃতদেহের মাঝখান দিয়ে ওরা রাসেলকে নিয়ে এল মায়ের কাছে । মা রক্তের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছেন। চিৎকার করে কেঁদে ভয়ার্ত রাসেল বলল,

: আমাকে হাসুবুবুর কাছে পাঠিয়ে দিন।

সেকথার  রেশ শেষ হবার আগেই এক ছররা গুলি বেরিয়ে এল। এফোঁড় ওফোঁড় হল একটা দশ বছরের শিশু। যার নাম রাসেল।  যে বড় হয়ে আব্বা শেখ মুজিবুরের মতো হতে চেয়েছিল, বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো হতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বয়স আর বাড়ল না। তবে নিশ্চিত বয়স বাড়লে সে মুজিব কিংবা বার্ট্রান্ড রাসেলই  হতো।