দুপুরচন্ডির  প্রতীক্ষা পর্ব ১২ – আফরোজা অদিতি

দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষায় আফরোজা অদিতি

রাত এগারোটা।

ইথিকা খাওয়ার টেবিল গুছিয়ে ঘরে এসেছে। সকলে  টেলিভিশন দেখছে। ওর ভালো লাগছে না। ওরা যা দেখে তা দেখতে ভালো লাগে না ওর। আর ও যা দেখতে চায়, ওরা কেউ তা দেখে না। ওরা বাংলা সিনেমা দেখে কিন্তু বাংলা সিনেমার কাহিনী ভালো না হলে দেখতে ভালো লাগে না ওর। টেলিভিশনের রূমে না গিয়ে ঘরেই ছিল। ফোন বেজে উঠতেই ধরে। রিয়া। কন্ঠ ভারি কান্না মেশানো।

‘কি ব্যাপার রিয়া।’

‘ভাবী, এখনও ফেরেনি হাকিম।’

‘হাকিম ফেরেনি! এতোক্ষণ অফিসে কী করছে?’

‘না অফিস থেকে ফিরেছিল। রাত দশটার দিকে একটা ফোন এলো আর ফোন পেয়েই চলে গেল। শুধু বলল, ভাত দাও টেবিলে, দেরী হবে না। যাব আর আসবো। ভাবী…..’ কেঁদে ফেলে রিয়া। কান্নার দমকে কথা আটকে যায় ওর।

‘কেঁদো না রিয়া; একটু ধর। রাহার আব্বাকে দেই।’ তমিজ ফোন ধরে। সব শুনে চলে যায় রায়ের বাজার। সঙ্গে রফিক। রাতে ফেরে না ওরা। উৎকন্ঠিত সময় যায় সারারাত; কান্নাকাটি করছে শাশুড়ি। কি জানি কী হলো।

পরদিন শুক্রবার।

ইথিকা রুটি বেলছিল। শাশুড়ির চিৎকারে উঠে আসে ঘরে। ফোন করেছে তমিজ। হাকিমকে পাওয়া গেছে। রায়ের বাজার বধ্যভূমির কাছে। সমস্ত গায়ের চামড়া ছিলে লবণ দিয়েছে কে বা কারা। দাঁত নেই কয়েকটা। নখ নেই আঙ্গুলে। চোখ নেই; শূন্য মনিহীন শুধু গর্ত। কী বিভৎস মৃত্যু! ইথিকা শুনতে পারে না এ অপমৃত্যুর কথা। রিয়াকে কাছে টানে। কিন্তু কি বলে সাত্ত্বনা দেবে, ভাষা নেই ওর। ওদিকে শাশুড়ি বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছে; কী করবে ইথিকা। টুম্পা এখানে নেই। শ্বশুর বাড়ি। টেলিফোন করতে গেছে রফিক। ওর আসতেও সময় লাগবে। শরীফা এসেছে। সেও ভাই-এর শোকে পাগল প্রায়। আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। লাশ এখনও আসেনি। পোষ্ট মোর্টেমের পর লাশ নিয়ে আসবে ওরা। ইথিকা চোখের জল ফেলবে তার সময় নেই। কিন্তু ও জানে চোখের জল না ফেললে কথা শুনতে হবে পরবর্তী সময়ে! কিন্তু দেশটার কি হলো। শান্তি পাবে না কি দেশের মানুষ কখনও।

 

হাকিম কি কোন অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল; হাকিম যে ঘুষ নিয়ে কাজ করতো তা জানে ইথিকা। ওই ঘুষের টাকার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কিছু হয়েছে কি। হোক না ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, হাতাহাতি। তাই বলে  মেরে ফেলবে একজন মানুষকে। মানুষের জীবনের দাম কি এতোই কম; মেরে ফেলতে আগে পিছে কেউ একটুও ভাবে না আবার মেরে ফেলতে সময়ও লাগে না।

যাকে মেরে ফেলল তার ছেলে মেয়ের স্ত্রীর কি হবে। কোথায় যাবে, কি খাবে। লেখাপড়া শিখবে কি ভাবে; এসব কথা ভাবে না কেউ।

নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদের ফলে একটা অবুঝ শিশু যে পিতৃহীন হলো, স্ত্রী হলো বিধবা; এসব কথা কারো মাথায় থাকে না!

ইথিকা ভাবে, মানুষের মধ্যে দয়া মায়া মানবিকতা কমে যাচ্ছে দিনদিন। মানুষ স্বার্থপর হয়ে উঠছে। নিজের ছাড়া আর কিছুই বুঝে না মানুষ। ইথিকার চোখ দিয়ে জল পড়ে। চোখ মুছে। না, এ কান্না লোক দেখানো নয়। সত্যিকারের কান্না। এ কান্না হাকিমের জন্য নয়, ওর ছোট অবুঝ মেয়েটার জন্য, ওর বিধবা স্ত্রী রিয়ার জন্য। হাকিমের মৃত্যুর পর, কুলখানি। সব কিছুই ওকে করতে হচ্ছে। অফিস ছুটি নিয়েছে। বাড়ি থেকে বেরই হতে পারছে না। দেখতে মন চাইছে রাকিবকে কিন্তু পারছে না; ওর জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে ইথিকার। কবে যেতে পারবে ওর কাছে তাও অজানা ওর। এ কোন জীবনে আর ভালো লাগছে না ওর! যা ওর নয় তার জন্য কাজকর্ম করছে, তারই জন্য সময় ব্যয় করছে!

 

সাতদিন পর অফিসে এসেছে ইথিকা।

মাসের প্রথম। মাসের প্রথম সপ্তাহ ডিপিএস-পিপিএস এর সপ্তাহ। তাছাড়া আছে মান্থলি স্টেটমেন্টের কাজ; সময়মতো প্রধান কার্যালয়ে  না পৌঁছালে টেলিফোন আসবে। রিমাইন্ডার আসবে। এছাড়াও বাড়তি কাজ বিল সেকশনে। খুব ব্যস্ত ইথিকা। সব মিলিয়ে কাজ গুছিয়ে উঠতে পারছে না। অফিস থেকে বের হয়ে হাসপাতালেও যেতে পারছে না। আজ সকালেই ভেবেছে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হবে। হাসপাতালে যাবে। অনেক দিন যাওয়া হয়নি শুধু ফোনে খবর নিয়েছে। ওকে দেখার জন্য মনটাও খুব আনচান করছে। বের হয় চারটায়। যাওয়ার পথে বকুল ফুলের মালা, ফুলের তোড়া আর কিছু বিস্কুট ফল কিনে নেয়। শুয়ে আছে রাকিব। বই পড়ছে। ওকে দেখে বই রেখে উঠে বসে। চোখে-মুখে রাজ্যের অভিমান এসে জমা হয়। অভিমানাহত কন্ঠে কথা বলে।

‘এস এস। বহুদিন লাপাত্তা স্বামী বুঝি আসতে দেয়নি।’

‘না না, তা নয়! অফিসেই আসতে পারিনি। অফিসে কাজ। সাতদিন পর অফিসে এসেছি তারপরে মাসের প্রথম বুঝতেই তো পারছো।’ সহজভাবে উত্তর দেয় ইথিকা। এরপর হাকিমের মারা যাওয়ার কথাটা বলে ওকে। খাবারগুলো চার-পায়ার ওপরে রেখে ফুলগুলো সাজিয়ে রাখে গ্লাসে। কাছে এসে ফুলের মালাটা হাতে দেয় ওর। ফুলের মালাটা হাতে নিয়ে গন্ধ নেয় রাকিব। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে। কি যেন ভাবে। তারপর আচমকা ইথিকার গলায় পরিয়ে দেয় মালা।

‘একি করলে।’ চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যায় ইথিকা।

‘এটা কি কোন কাজ  হলো।’

‘হ্যাঁ হলো।’ হাসে রাকিব। হাসতে হাসতে বলে, ‘তোমাকে বাঁধতে পারছিলাম না কোনমতেই। আজ থেকে দেখবো কেমন করে তুমি ছাড়া পাও।’  দুই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। ইথিকা যতেœ শাড়ির আঁচলে মুছিয়ে দেয় সে অশ্রু। ওর বুকে মুখ রেখে কাঁদে রাকিব।

‘আমার কোন পথ নেই নেই রে বউ।’

‘তুমি কি পাগল নাকি।’

‘পাগল না, তবে হয়ে যাবো শীগগির।’ মালাটা গলা থেকে খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়। বলে, ‘গলায় পরাও।’

রাকিবের কন্ঠে এমন কিছু ছিল যে ইথিকা ওর কথা উপেক্ষা করতে পারে না। ওর গলায় পরিয়ে দেয় বকুল ফুলের মালা।

‘দেখ এই মালা ফাঁস হয়ে না আটকায়।’ ইথিকার কথায় রাকিব বলে, ‘নতুন করে কি আর ফাঁস হবে। ফাঁসি তো লাগিয়েই আছি। আমি তো জীবন-মৃত্যুর মাঝে লটকে আছি ত্রিশঙ্কু অবস্থায়।’

‘তুমি তো ফাঁসি দিয়ে ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে আছো কিন্তু আমি কি করবো বল। আমি যে ঘরেরও না ঘাটেরও না।’ ইথিকার খন্ঠ জলে ভারি।

‘তুমি চলে এসো আমার ঘরে।  এসো, এসো, আমার ঘরে এসো; আমি তো তোমার জন্য ১০১টা মোম জে¦লে অপেক্ষায় আছি। যেদিন তুমি আসবে সেদিন ১০১টা মোম জ¦লতে দেখবে, পায়ের নিচে দেখবে লাল গোলাপের পাপড়ি। তুমি এসেই…..’

রাকিব ঘন স্বরে কথা বলছিল। ওর কন্ঠে স্বপ্নের ছোঁয়া চোখে স্বপ্নের ঘোর। এ ঘোর কাটতে দিতে ইচ্ছে করে না ইথিকার। তবুও বলে,

‘এসো বললেই কি চলে আসা যায় রাকিব।’

‘কেন যাবে না!’

‘আমার সন্তান আছে।’

‘ তাকে নিয়েই আসবে।’ রাকিবের কথা শুনে কান্না পায় ইথিকার; কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমাকে এ কিসের মধ্যে ফেললে বলো তো। বেশ তো ছিলাম আমি। ভালো হোক মন্দ হোক ওই সংসারে তো চলে যাচ্ছিল আমার দিনকাল!’

‘ইথি আমার সোনা। আমি আর কিছুই চাই না আমি তোমার কাছে সংসার চাই না, স্বামিত্বও চাই না। আমার সঙ্গে বসবাস কর তাও চাই না শুধু একটা সন্তান চাই।’

এবারে বিস্মিত ইথিকা বলে, ‘সন্তান চাও! কি পরিচয় হবে তার জানো। ওর তমিজের পরিচয়ে পরিচিত হবে এই সমাজে!’ ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে রাকিব, ‘না. ওকে আমার পরিচয়ে মানুষ করবো, তুমি দেখে নিয়ো; কাউকে দিবো না ওকে, ও শুধু আমার হবে, শুধুই আমার। একটু দয়া করো একটা সন্তান দাও, আর কিছু না।’ একটু থেমে আবার বলে, ‘শুধুমাত্র সন্তান আর কিছু না।’

‘সন্তান তোমাকে কেমন করে দেব বলতে পারো। চলে এসো।’

‘আবার ওই এক কথা।’ এবারে বিরক্তি ঝরে ওর কণ্ঠে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘তুমি যে এমন অবুঝ তা তো জানতাম না। এমন কান্ড কেন করলে তুমি। মালা পরালে গলায়; মালা পরানোর অর্থ জানো। বিয়ে; গান্ধর্ব মতেবিয়ে। তুমি মানো বা না মানো আমি মানি।’ ওর কথা শুনে নির্মল হাসি হাসে রাকিব। বলে, ‘আমি জানি এবং মানি। তোমাকে তো আসতে বলছি না আমি, শুধু মত্র একটা…।’ আঙুল তুলে দেখায় রাকিব। ওর চোখ-মুখ-পুরো অবয়ব কথা বলে। এ মিথ্য নয়, সত্য;সত্য;সত্য।

‘একটা কথা বলো তো এখন আমাকে তমিজের সঙ্গে দেখলে খারাপ লাগবে না। রাগ হবে না তোমার।’ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে ইথিকা। ‘একি আর নতুন কথা ইথিকা। আমার অসম্ভব সহ্য শক্তি যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তাছাড়া তুমি কি মনে করো আগে কষ্ট হতো না আমার।’ ইথিকা যে সব কিছু বুঝেনি তা নয় কিন্তু সেসব কথা আগেও যেমন জানতে দেয়নি আজও  সেসব কথার ধারে কাছে যায় না।

 

চুপচাপ ফল টুকরা করে প্লেটে রাখছিল। কেবিনে ঢোকে তমিজ।

‘তুমি এখানে! অফিসে ফোন করেছিলাম। শুনলাম হাসপাতালে, তাই চলে এলাম।’ তমিজের কথার জবাব দেয় না ইথিকা। কাটা ফল এগিয়ে দেয় রাকিবের সামনে। রাকিব এক টুকরা আপেল তুলে বাটি এগিয়ে দেয় তমিজকে। ‘নিন। আপেল নিন।’

‘না-না আমি কেন। আমার জন্য তো কাটা হয়নি। তাছাড়া তুমি অসুস্থ তুমি খাও। ‘অসুবিধা কী।’

‘হাসপাতাল রুগীর জন্য ফল কাটা হয় গেস্টদের জন্য হয় না।’

‘তবুও নিন। তুমি নাও ইথিকা।’ হাতে ধরা ফলের টুকরা বাড়িয়ে দেয় ইথিকার মুখের কাছে; মুখ সরিয়ে নেয় না ইথিকা। অল্প করে দাঁতে কেটে নেয়। ‘তুমি খাও রাকিব।’

রাকিব ফুলের টুকরা মুখে পুরে দেয়। তমিজ সেদিকে তাকিয়ে জানালার বাইরে চোখ রাখে। বাইরে চোখ থাকলেও মনোযোগ থাকে ওদের দিকে। মনের মধ্যে হাজার চিন্তার ঝড়। রাগ ক্ষোভ। মনে মনে বলে, কি আদিখ্যেতা। আমি খাওয়াতে পারি না। স্ত্রী তো আমার। এতোদিন সন্দেহ ছিল তমিজের মনে। আজ দৃঢ়ভাবে মনের মধ্যে গেথেঁ যায় সন্দেহটা। শান্তি পায় না তমিজ। ব্যাপার বোধহয় অনেকদূর  এগিয়েছে এই কয় মাসে। কতদূর। কতদূর এগুতে পারে ওরা। শুধু হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট নাকি বিছানা পর্যন্ত। হায় আল্লা একি কথা মনে হলো ওর। ও আড়চোখে আবার দুজনকে দেখে। ওদের দেখতে দেখতে আচমকা লাফিয়ে উঠে বলে, ‘চল ইথিকা চল।’

‘এখনি কি যাবেন। আপনি তো আছেন, একটু দেরী হলে তো অসুবিধা নেই।’

‘না তা নেই। তবে মা চিন্তা করবে।’

মা ভাববে। ন্যাকামির আর জায়গা নেই। কতো যেন ভাবে তোমার মা। সারাদিন সারারাত না গেলেও তো ভাববে না। আর তুমিই ভাব কতো? কথাগুলো মনে মনে ভাবে ইথিকা। তমিজ তাগাদা দেয়। বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও বসে থাকে ইথিকা। উঠতে ইচ্ছা করে না ওর। মালা পরিয়ে বউ বলে ডাকার পর থেকে মনের মধ্যে অন্য রকম অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। ওর মনে হচ্ছে তমিজ কেউ না ওর। রাকিবকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না ওর। অসুস্থ রাকিব। ও যাবে কোথায়? তমিজের সঙ্গে যাওয়া কি ঠিক? ওকি যাবে না থাকবে? স্বামী হিসেবে কাকে মানবে রাকিব না তমিজ? এরকম নানা প্রশ্নে মন ভারী হয়ে থাকে ওর। নান রকম প্রশ্নে মন ভারী হয়ে থাকে। ও বসে থাকে।

রাকিব ওর এই অবস্থায় কথা বুঝতে পেরেই বলে, ‘এখন যাও ইথিকা, আবার এসো।’ রাকিবের কথায় কী যে হয়ে গেল ইথিকার মধ্যে নিজেই বুঝতে পারে না! রাগ হলো তমিজের ওপর। রাকিবের ওপর, নিজের ওপর। কাউকে কিছু না বলে বাইরে এসে রিকশা নেয়।

মায়ের বাসা। মা অবাক। ‘কী ব্যাপার তুই এখন?’

‘এলাম।’ নিষ্প্রাণ কন্ঠে কথা বলে ইথিকা।

‘ কেন এলে।’ ইথিকা এ কথার উততর দেয় না।

 

ওর পেছনে তমিজ ঢুকেছে খেয়াল করেনি ইথিকা। মাকে বলে, ‘আজ আমি এখানে থাকবো, তোমার কি অসুবিধা হবে মা।’

মা জবাব দেয় না। জবাব দেয় তমিজ। ‘কেন থাকবে। বাড়ি চল। এখানে থাকতে হবে না তোমার।’

‘আমার এখন যেতে ভাল লাগছে না।’ আর কোন কথা বলে না ইথিকা। তারপর বলে চলে যায় ওর ঘরে। ওর ঘর এখনও তেমনি আছে। নিজেদের বাড়ি তাই ঘর তেমনি রাখতে পেরেছে মা। এ বাড়িতে আসলে এ ঘরেই থাকে। এঘর থেকেই শুনতে পায় মায়ের কথা;

‘থাক না এসেছে যখন, তুমিও থাকো। তুমি বরং বাসায় একটা ফোন করে দাও।’

শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তমিজ; ন্যাকামি দেখে বাঁচি না। যেমন মা তেমন তার মেয়ে। মনে মনে কথাগুলি বললেও মুখে বলে, ‘না, আম্মা থাকবে না; থাকার প্রশ্নই আসে না। মা ভাববে। তাছাড়া রাহা আছে।’

‘রাহার জন্য চিন্তা কি। তোমরা আছো। তোমার বোন আছে। ফোন করে দাও বাবা।’

‘না আম্মা ইথিকা থাক। আমি যাই।’

মা আর পীড়াপীড়ি করে না। ‘থাকবে না যখন খেয়ে দেয়ে যাও।’

শাশুড়ির কথা পছন্দ হয় না তমিজের। ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে রাগে। কিছু বলতে পারে না। মাত্র কয়েকদিন আগে এ বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে ইথিকাকে। প্রতিজ্ঞা করেছে কিছু বলবে না। এখন থেকে সব কথা সব রাগ মনের ভেতরেই রাখবে। ব্যবহার খারাপ করবে না। আদর করবে সোহাগ করবে! মাড়ি-গয়না উপহারে দেবে ভরে। রাকিবের মতো করে কথা বলবে। তমিজ ভাবে রাকিবের মধ্যে এমন কি আছে যে রাকিবকে পছন্দ করে ইথিকা। আর ইথিকার কি আছে যা ও দেখেনি ইথিকার মধ্যে। দেখেছে রাকিব আর এক ছেলের মা হওয়া সত্ত্বেও  ঘুরঘুর করে ওর পেছনে। তমিজ আজেবাজে অনেক কথা ভাবে শুধু নিজের দোষ-ত্রুটির কথাগুলো ভাবে না।

ভাবে না বিয়ের দিন থেকে কখনই কোন সময় ভালো ব্যবহার করেনি ইথিকার সঙ্গে; এমনকি একটা শাড়ি ব্লাউজও দেয়নি ইথিকার ইচ্ছে মতো। বসে থাকে রমিজ। সেই যে ঘরে ঢুকেছে ইথিকা বের হয়নি। ওর জন্য অপেক্ষা করে আরও কিছুক্ষণ। তারপর পায়ে পায়ে ইথিকার ঘরে ঢোকে তমিজ। শুয়ে আছে ও।

 

ইথিকা এখন কী করবে। ওর মনের মধ্যে নানা রকম চিন্তা ঘোরা-ফেরা করছে। ও কি যাবে, কি যাবেনা ও কি তমিজের স্ত্রী না কি রাকিবের। এ সমাজ সংসারে ও তমিজের স্ত্রী কিন্তু মনের দিক থেকে এখন রাকিবের। ও যদি রাকিবের তবে রাকিবের কাছ থেকে চলে এলো কেন? কেন বলতে পারলো না ও যাবে না তমিজের ওখানে। ও যদি তমিজের ওখানে না যায় তবে রাহার কী হবে? ভবিষ্যৎ কী রাহার? রাহা কি থাকতে পারবে ওর কাছে; রাহাকে ছাড়া থাকবে কীভাবে, দিন যাবে কী ভাবে ওর। রাহা, ওর সন্তান! কাঁদতে ইচ্ছে করে ইথিকার। কিন্তু কান্না আসছে না। বুকের ভেতর ব্যথা করছে। ভার হয়ে আসছে বুকটা। যেন ভারী কোন কিছু আস্তে আস্তে চেপে বসছে হার্টের ওপর; নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ও এখন কি করবে। কাকে বলবে এই কষ্টের কথা; বেদনার কথা! অযাচিত, অবাি ত এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে ওকে এখন। এ কেমন জীবন শুরু হলো ওর। ও যাকে চায় তাকে পায় না যে কাছে আছে তাকে চায় না।

 

ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে কছুক্ষণ। ওর আসা টের পায়নি ইথিকা। তমিজ পায়ে পায়ে খাটের কিনারে এসে দাঁড়ায়।

‘চলো ইথিকা। এখন না যাও একটু পরে যাই। তবুও  চলো।’ তমিজের সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। কিন্তু না গিয়ে তো উপায় নেই। রাহা আছে। বারবার ও বাড়ি থেকে চলে আসলে লোকের মুখ বন্ধ করবে কীভাবে। তাছাড়া তমিজ যেরকম মানুষ কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। প্রয়োজনে কোর্টে যাবে ও। ছেলেকেও দেবে না। রাহাকে ছেড়ে থাকবে কী করে। ভাবনাগুলো তোলপাড় করে ওর মনের মধ্যে।

‘ইথিকা।’ আবার ডাকে তমিজ। তমিজের ডাকে উঠে বসে ইথিকা। কথা বলে না।

‘চলো, বাড়ি চলো। কেমন হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করো বারবার বল তো। তোমাকে রেখে আমি বাসায় গেলে লোকেই বা বলবে কি।’

‘কি আর বলবে। কাপড়-চোপড় শেকল দিয়ে বেঁধে রাখবে।’

‘প্রথমবারের কথা ভুলতে পারোনি এখনো তুমি!’

‘ওসব কথা কী ভুলে যাবার কথা। বউ বাবার বাড়ি যাবে, আর তার কাপড়-চোপড়সহ বাক্স বেঁধে রাখবে খাটের সঙ্গে; কোন মেয়ে এসব কথা ভুলে যায় বলো তো। আমি দেখে এখন আছি, অন্য কেউ হলে একদ-ও থাতো না তোমাদের কাছে।’ নিঃশ^াস ফেলে ইথিকা। এসব ভোলার কথা নয়! বাবার বাড়ি এসেছিল বলে দেয়নি কাপড় চোপড় ও আনতে যায়নি। শাশুড়িও পাঠায়নি! এসব কথা কি ভোলার। জীবন গেলেও তো ভোলা যায় না। ইথিকা উঠে বসে। মা ভাত দিয়েছে টেবিলে। খেতে পারে না ইথিকা। নাড়াচাড়া করে।

রাকিবের মুখটা ভেসে থাকে চোখে। ওই রাতেই ফিরে যেতে হয় ইথিকাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হয়।