জীবনের ফাঁকে স্বপ্নের ডাকে –  মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার

চির বিস্ময় যে জন - মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার 

বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ হলেও এখানে সম্পদের অভাব নেই। কিন্তু আফসোস কিছু অযোগ্য লোকের কারণে আমরা আমাদের সম্পদগুলো কাজে লাগাতে পারছি না। এ দেশের ব্যাংক-বাণিজ্য, নগর-বন্দর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এসব কিছু বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের শ্রমে-ঘামে সিক্ত হয়ে আজ মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

যদিও বাংলার মানুষের টাকায় তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এখন বাংলার সন্তানেরা লাখ টাকা খরচ করেও কুনোব্যঙ হয়ে থাকতে হয়। জিম্মি থাকতে হয় লেজুড়ভিত্তিক পেশীশক্তি নির্ভর রাজনীতির কাছে।  হলের সিটে এবং ট্রেনের বগিতে দখলদারিত্ব, ভর্তি বাণিজ্য, সীট বাণিজ্য, র‌্যাগ, গণরুমের বীভৎসতা ও গেস্টরুমের অত্যাচারের কবলে নুয়ে পড়ে মা-বাবার অতি আদর – স্নেহের চোখের অশ্রু ও নিত্যদিনের ঘামেভেজা সুখ-দুঃখের গল্প মোড়ানো স্বপ্নগুলো।

বার বার আঘাত হানা ট্র্যাজেডিগুলোতে বিধ্বস্ত হয়ে ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে লাল সবুজের পতাকাকে স্বচ্ছ রাখতে আপ্রাণ সংগ্রাম করেছে বাংলার মাটির গন্ধ বুকে ধারণ করা মানুষগুলো।  কিন্তু অপশক্তির হাতে লণ্ডভন্ড হয়ে যায় তাদের অতি কষ্টের ধন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলার কোন সচেতন মানুষের সেটি অজানা নেই। সে ইতিহাসের বার বার পুনরাবৃত্তি আমাদের আরো বিরক্ত করে তোলে। উত্তাল করে তোলে হৃদয়ের অভ্যন্তরের উত্তাল দাবালনকে। এরপর রাজশাহী চট্টগ্রামসহ ধারাবাহিকভাবে আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ জনপদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, কোনটি প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ, কোনটি উপকূলের অক্সফোর্ড আবার কোনটি শার্টলের ক্যাম্পাস নামে খ্যাত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো বাংলাদেশের সহস্র শিক্ষার্থীর স্বপ্নের গন্তব্য। জীবনের ফাঁকে স্বপ্নের ডাকে শিক্ষার্থীরা ঢাবি অন্তরে ও শিক্ষা জীবনের অধ্যায়ে শামিল করতে চায়। শুধু তাই নয়, ঢাকা শহরের মানুষেরা যখন গ্রীষ্মের অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যায় তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বয় প্রাণ জুড়ানো শীতল বাতাস। হাজারো শিক্ষার্থীর প্রাণের এই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নের দিক দিয়ে যেমন শ্রেষ্ঠ তেমনি ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিচারেও অতুলনীয়। ঢাবি ক্যাম্পাস সত্যিই যেন এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার। আর এর মূলে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য বৃক্ষ, পুকুর, ফুলের বাগান এবং পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন হয়ে থাকার মত সুউচ্চ বহু দালান। রাজধানী শহরের কেন্দ্রে থেকেও ঢাবি ক্যাম্পাসে যে পরিমাণ গাছপালা আছে তা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য দর্শনের জন্য কার্জন হল এলাকা একটি উপযুক্ত জায়গা। অবকাঠামোগত কিংবা প্রাকৃতিক কোন দিক থেকেই এই এলাকার তুলনা হয় না। কার্জন হল এলাকার পুকুর পাড়, লাল বিল্ডিং তথা পুরো এলাকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে সবারই জানা। কার্জন হলেই রয়েছে উদ্ভিদ বিজ্ঞান উদ্যান ও ভেষজ বিজ্ঞান উদ্যান। ভেষজ বিজ্ঞান উদ্যানে গেলে কালোমেঘ, মহাভৃঙ্গরাজ, সবুজ গোলাপের মতো বিলুপ্তপ্রায় দেশি বিদেশি উদ্ভিদের দেখা মেলে সেখানে।

কার্জন হল এলাকাতেই ঢাবির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মেহগনি গাছ। অসংখ্য ইতিহাসের সাক্ষী এই গাছটি। একাশি বছরের পুরনো এই মেহগনি গাছ দেশ বিভাগ, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমাদের অনেক ইতিহাসের নিরব সাক্ষী এই মেহগনি গাছটির অবস্থান পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সামনে।

হঠাৎ করে কিংবা অনেকদিন পর যদি কেউ প্রিয় ক্যাম্পাসে ঘুরতে যায় তাহলে নিশ্চিতভাবেই সে বিভিন্ন স্থানে ফোটে থাকা হরেক রঙের ফুলের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হবে। আর ফাল্গুনে যদি কোন আগন্তুক ভুল করে ঢাবির ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে তাহলে কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ সৌন্দর্যে তিনি মাতাল হতে বাধ্য।

হাকিম চত্বর থেকে শুরু করে কলাভবনের সামনে, শ্যাডোর পাশে, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের পাশে, উপাচার্যের ভবনের সামনে, রেজিস্টার ভবনের সামনে সবখানেই থাকে কৃষ্ণচূড়া ফুলের সমারোহ। ফাগুনের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো ক্যাম্প্যাসের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। ক্যাম্পাসের ছোট রাস্তায় পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার পাতাগুলো দেখে মনে হয় যেন শিক্ষার্থীদের পরম ভালবাসায় অভ্যর্থনা জানাচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোতাহার ভবন এবং ফার্মেসি বিভাগের সামনে দাঁড়ালে নজরকাড়া নাম না জানা নানান ফুলের সৌন্দর্যে নিমিষেই মন উজাড় হয়ে যাবে যে কারো। অসম্ভব সুন্দর হলুদ রঙের সোনালু ফুলের দিকে তাকালে যে ফুল ভালবাসে না সেও কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবে। শুধু কৃষ্ণচূড়া সোনালু ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসলে যে কেউ দেখতে পারবে জারুল, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম ,কাঠগোলাপ, মধুমালতি, স্বর্ণচাপা ইত্যাদি নজরকাড়া ফুলের অপরূপ সমাহার।

ঢাকার ভিতরে যদি কেউ ঘুরতে যেতে চান, প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে চান তাহলে অনায়াসে ঘুরে যেতে পারেন হাজারো শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে প্রাণের ক্যাম্পাসে এসে এক কাপ চা খেয়ে ঢাবির মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলে যে কারো মনে নিশ্চিত প্রশান্তি নেমে প্রাণবন্ত করে দিবে।

‘মামা আজকে কিন্তু পরীক্ষা আছে জোরে টানতে হবে’ বা ‘মামা বাস ছাড়তে দেরি কেন?’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাসের চালকদের এমন কথোপকথন রোজকার চিত্র। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে শ্যাডো, কার্জনের পুকুরপাড় থেকে টিএসসি-এসব কিছু হয়ে ওঠে তাদের জীবনের অংশ। আবাসিক শিক্ষার্থীদের সাঙ্গে ক্যাম্পাস জীবনের যোগসূত্র তৈরির প্রথম মাধ্যম যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, তেমনি অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের প্রথম স্মৃতি হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই বাস ঘিরে তৈরি হয় শত স্মৃতি, গড়ে ওঠে সম্পর্ক, তৈরি হয় নতুন বন্ধুত্ব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলে প্রবেশপথের উল্টোপাশে চোখ মেলে তাকাতেই স্বাগত জানায় লালরঙা সিঙ্গেল ও ডাবল ডেকার বাসের সারি। মানুষের মতই বাসগুলোর রয়েছে আলাদা পরিচয়- উল্লাস, ক্ষণিকা, বৈশাখী, চৈতালি, তরঙ্গ, হেমন্ত, কিঞ্চিৎসহ নানা বাহারি নামের অবয়ব।

স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি ও শহীদদের স্মরণে নির্মিত অনেকগুলি ভাস্কর্য রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রান্তে। অপরাজয়ে বাংলা, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, দোয়েল, রাজু ভাস্কর্য, স্মৃতি চিরন্তন, মধুদার ভাস্কর্য, প্রত্যাশা, স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো স্মৃতিগুলো যেকোন বাঙালির বিপ্লব ও মুক্তির চেতনাকে শাণিত করবে।

পরিশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সেখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য নয়। বাংলার মানুষের ভালোবাসা, আবেগ, গৌরব ও হৃদয় নিংড়ানো অনুরাগের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আমি সেটিতে প্রাচ্যের অক্সর্ফোড বলতে অভ্যস্ত নই। এটিতো বাংলার শ্রমজীবী কৃষকের ঘাম ও সহস্র মানুষের রক্তে সিক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।