বোন মানবিক – খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাত

বোন যখন মা হয়ে ওঠে– মমতার মাধুরী মেখে পৃথিবীকে করে তোলে  আলোময়।একাকীত্বের যবনিকা ঘটিয়ে প্রাণের হিল্লোলে ভরে তোলে ভুবনের আনাচ-কানাচ।

আনন্দমুখর এমনই একটি বোন ছিল আমার। আমার সকল সুখ-দুঃখের সর্বাঙ্গীন অংশীদার। স্মৃতির চোখ ধরে যত দূরে চলে যাই দেখি বোনের কোলে, আদরঘেঁষা মেনি বিড়াল আমি। স্নিগ্ধতার যত রূপ আমার বোনের চোখে, ভালোবাসার যত ধুপ আমার বোনের স্পর্শে।জীবনের আলপথে যত কাঁটা ছড়ানো ছিল, সংগ্রামের পথে পথে যত বাধা আগলে ছিল তা সরিয়ে দিতে আরেকটি যে হাত এগিয়ে আসত তড়িৎ কর্মময় সে আমার বোনের।

 

আমার সে বোনকে আমি হারিয়ে ফেলেছি!!!!!!

 

আমি দেশ ছেড়েছি সে অভিমানেই কি বোন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে! একা নিঃসঙ্গ বোন আমার অনেক জেদী ছিল। নিজের ঘর সংসার সবকিছুর সাথে মিলিয়ে নিত মা-বাবা-ভাইবোনদের সুখ ও বেদনা; আদরে বা  ধমকে মুছে দিত চোখের জল। নিখোঁজ হয়ে ছিলাম যখন পীরের কাছে ছুটে যেত খোঁজ নিয়ে দেবার জন্য, সুদূর লন্ডন শহরে যে চিঠি পোষ্ট করে পাঠাত, ফোনের মেসেজ চেম্বার ভরে উঠত গৃহস্থালি খবরে , কখনো সরাসরি ফোন কল সে তো আর কেউ নয় প্রিয় বোনটি আমার। ‘কেন কল করেন–লাইন কাটেন আমি করছি?’ উত্তরে হেসে বলত,‘আহা আমি বুঝি ফোন করতে পারি না!’

 

এখনো স্বপ্নে যে সান্ত্বনার প্রলেপ মেখে আশার বাণী শুনিয়ে যায়, হাসির ঝলক দিয়ে জীবনের জ্বলন, গলন ও দলন উড়িয়ে দিয়ে  প্রশান্ত করে মন।

দারুণ বইয়ের পাঠক ছিল। কি খুঁজে পেত এত পড়ে! নিঃসঙ্গতার পরতে পরতে মেখে নিত গল্পের ঘন গাঁথুনি। দিনরাত পড়তে পড়তে পুড়ে যেত তরকারী, জড়ো হতো স্বামীর গালাগাল। কেঁদে কেঁদে চলে যেতে চাইত পৃথিবী থেকে অভিমানী বোন আমার। তবেই কি বেছে নিয়ে ছিলো ক্যান্সার। এমন ঘাতক  ব্যাধি যার কোন চিকিৎসা নেই, যার থেকে কারও কোন মুক্তি নেই। রুগ্ন, শুকনো বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেঁদেছে আমার সন্তানদের যত্ন কম হচ্ছে বলে। যাদের বুকে আগলে রেখেছিল নিজের সন্তান করে।ভালোবাসা যে দেয় অঢেল সেই ভাবে কম পড়ে গেল বোধ হয়!

 

মা নেই, মাকে তো রেখে এসেছি তার অনেক আগেই জীবনের টানে। শহরের চকচকে ঝকঝকে আর কঠিন-কাঠিন্যতার বুকে সে বোনই তো ছিল একমাত্র গ্রামের উদার উদ্যান। চির সবুজ মন, মননে শিল্পকে ধারণ করে কারুকাজে ভরে রাখে পাথর জীবন। আজ শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।  কেন এ নিঃশ্বাসে এত বেদনা অনুভূত হয়! কেন এত আগে মায়া কাটিয়ে চলে গেলে! এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে না! সে স্পর্শের সুখ ভুলতে পারি না, হারিয়ে ফেলার বেদনা সইতে পারি না। বলার মতো ভাষাও খুঁজে পাই না…

 

আমি তো সে আলাভোলা ভুল আর আবেগের ঘন মিশ্রণে আজও ডুবে আছি। পুরোদিন খোলা থাকে বই আর রেকর্ডারে গান। মাথা গরম করে ফেলছি বলে বকা দাও না যে! চৈতালি রাতে উন্মাতাল হয়ে ঘর ছেড়ে দিতে বের হই তবে তুমি কেন দারুণ ধমকে থামিয়ে দিতে হাত ধরো না। সফলতার কত চূড়া স্পর্শ করেছি; পরিতৃপ্তির সুখের ভাষায় কেউ তো ফোনের ওপাশ আনন্দের লহরীতে ভাসিয়ে দেয় না। “আহা তুই সব পেলি! তোকে বাবাজান ঢেলে দিচ্ছে!” জড়িয়ে ধরে ধরে গল্পের ঘরে ঘোর তোলে না আমার গভীর নীরবতা ভেঙে দেয়ার ইচ্ছায়। দৈনিক পত্রিকা উল্টানোর মচমচ কচকচ শব্দ পাশে শুয়ে ভারী রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না।  আজ ঘুমাতে পারি না ঘুমের ঔষধ খেয়েও। রাত জাগা নিঃস্বতার পাড় বেয়ে কেউ তো ডাকে না- “এত রাত জাগিস না; শরীর খারাপ হলে কে দেখবে? করেছিস তো প্রেম এক বাউণ্ডুলের সাথে।’ কিংবা অভিমান ভাঙাতে বলে না তো কেউ ‘‘জান্নাত ঘরে আয় কেউ তোকে কিছু বলবে না।’’

 

কার কিবা আসে যায়

…………………………….

বোন চলে গেলে

শিউলি ফুলেরা ঝরে যায় অসময়ে

শীতের দারুণ দাপট এখন।

ক্ষ্যাপা শীত এক এক লাশ নেয় কাঁধে।

মায়া হরিণীরা নিস্তব্ধতা ভেঙে কেঁদে ওঠে

পাতায় বিষাক্ত কঙ্কালের ছায়া !

আশার থলিতে বিষ-পিঁপড়া কামড়-

ফিরতি পথের দিকে পারাণীরা…

ক্যান্সারের বড় বাড় বেড়েছে গো!