করোনা ও পূর্বাপর/ লেঃ কর্ণেল সৈয়দ হাসান ইকবাল (অব.)
পূর্ব কথাঃ
১। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫ ইং পর্যন্ত) সংগঠিত হওয়ার পর মানব সভ্যতায় করোনা ভাইরাস এর মত এতোবড় মানবিক সংকট আর দেখা যায়নি। তবে বর্তমান করোনা ভাইরাস (COVID-19) আক্রান্তে বিশ্ব মানবতা অবিশ্বাস্যভাবে থমকে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষ ছিল জার্মানী, ইটালী ও জাপান এবং অপরপক্ষ ছিল ফ্রান্স, গ্রেটব্রিটেন, ইউএসএ, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও আংশিকভাবে চিন। উক্ত যুদ্ধে কম/বেশি ৩০টির মত রাষ্ট্র/দেশ পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
২। উল্লেখিত যুদ্ধে আনুমানিক ৬০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তন্মধ্যে ২০ মিলিয়ন মিলিটারী বাকী ৪০ মিলিয়ন বেসামরিক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। সোভিয়েট ইউনিয়নের ২৭ মিলিয়ন তন্মধ্যে ৮.৭ মিলিয়ন মিলিটারী এবং ১৯ মিলিয়ন বেসামরিক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। জার্মানীর ৫.৩ মিলিয়ন মিলিটারী মৃত্যুবরণ করে। এশিয়া এবং প্যাসিফিকে ৩ মিলিয়ন মিলিটারী এবং ১০ মিলিয়ন বেসামরিক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। তবে তন্মধ্যে জাপানী ওকেপেশনাল ফোর্সেস দ্বারা ৭.৫ মিলিয়ন চায়নিজ মৃত্যুবরণ করে।
৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এতো বড় মৃত্যুহানির ঘটনার প্রায় ৭৫ বছর পর মাত্র ৩ মাসের মধ্যে সমগ্র বিশ্বব্যাপী ১৬৭টি দেশে COVID-19 (করোনা ভাইরাস) ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছর ডিসেম্বর চিনের ওহান প্রদেশে প্রথম COVID-19 ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হয়। বর্তমানে ওহান অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে চলে এসেছে। তবে বর্তমানে ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে ও এশিয়া দেশ সমূহে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী আজ পর্যন্ত পৌনে তিন লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় ১১ হাজারের উপর মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে। সে হিসাবে আক্রান্ত মৃত্যুর শতকরা হার প্রায় ৪%। চিনের পরেই অতি অল্প সময়ের মধ্যে ইটালিতে সবচেয়ে বেশী মৃত্যু বরণ ঘটেছে।
বাংলাদেশ প্রসংগে
৪। বাংলাদেশের আয়তন ৫৫ হাজার বর্গ মাইল। জনসংখ্যা ১৭০ মিলিয়ন (১৭ কোটি)। ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ২০ মিলিয়ন (২ কোটি) ঢাকা একটি অত্যন্ত ঘন জনবসতি শহর। সে প্রেক্ষিতে ঢাকা শহর তথা সমগ্র বাংলাদেশ একটি ঝুকির মধ্যেই রয়েছে বলে প্রতীয়মান। দেশের একজন সাধারণ সচেতন নাগরিক হিসাবে বিষয়টি নিয়ে আমি চিন্তিত তবে সংকিত নই। এদেশের জনগণের সচেতনতা এবং সরকারের প্রচেষ্টায় বিষয়টি নিরসনে সহায়তা করতে পারে বলে আমার ধারণা। সৃষ্টিকর্তা যেন আমাদের সকলের জান-মাল হেফাজতে রাখেন।
৫। বিশ্বের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের করোনা রোগীর সনাক্তের সংখ্যা কম মনে হচ্ছে। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৪ জন করোনা ভাইরাস (COVID-19) রোগে আক্রান্ত সনাক্ত হয়েছে এবং ০২ জন মৃত্যু বরণ করেছে। যাহোক আতংকিত না হয়ে সকলকে সচেতন হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। জনগণের সচেতনা এবং বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতার মাধ্যমে এই করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের কঠোর নজরদারী এবং নিয়ন্ত্রনে কর্তৃপক্ষের আরো বেশি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিত। একই ভাবে তাঁদের সাথে মানবিক আচরণ করা উচিৎ কেননা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা তাঁদের জন্য সচল।
৬। সন্মিলিতভাবে সরকার এবং জনগন করোনা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে বলে আমি আশাবাদি তারপরেও করোনা ভাইরাস (COVID-19) সম্পর্কে আমাদের কি পদক্ষেপ/করণীয় সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ধারণা নিম্নরূপঃ
ক। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত দেশ হতে ফেরৎ আসা ব্যক্তিবর্গের সঠিক তথ্যাদি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন এনজিওদের জানা উচিৎ এবং সংকট মোকাবেলায় যৌথ ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
খ। ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষনা করেছেন তবে শিক্ষার্থীদের সচেতনভাবে নিজেকে সামলাতে হবে।
গ। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন ব্যতিত ঘরের বাইরে না যাওয়াই উচিত।
ঘ। জনবহুল এলাকা বড় বড় শপিংমল, ব্যাংক পাড়ায় যথাযত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। যেমন- ঐ সকল এন্ট্রি পয়েন্টে সাবান পানি দ্বারা হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা এবং প্রতিটি এন্ট্রি পয়েন্টে থার্মাল চেক যন্ত্র স্থাপন করা।
ঙ। বড় বড় বাস স্টান্ড, গন পরিবহন, ট্রেন, লঞ্চ/স্টীমারগুলিতে থার্মাল চেক আপ এবং স্বাস্থ্য সচেতনার সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
চ। রাস্তা/ঘাটে অযথা ঘোরাঘুরি বন্ধ করা এবং যেখানে সেখানে কফ/কাশি ও থুথু ফেলা পরিহার করা।
ছ। দিনে অন্ততঃ ৫/৬ বার সাবান পানি দ্বারা ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া অভাস করা।
জ। সকালবেলা খালিপেটে গরম পানি লেবুর রসসহ খাওয়া যেতে পারে।
ঝ। সর্দি কাশির ভাব থাকলে ওয়ার্ম স্যালাইন ওয়াটার (Warm Saline Water) দ্বারা দিনে অন্ততঃ ৩ বার কুলকুচি করা।
ঞ। হাঁচি-কাশির নিয়ম মেনে চলা।
ট। কর্মরত ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীদের জীবন সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
ঠ। স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করা অর্থাৎ কর্মরত স্বাস্থ্য কর্মীর জন্য Personal Protection Equipment (PPE) সরবরাহ নিশ্চিত করা।
ড। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি দেশ তথা নিজ আত্বীয় সজন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নিরাপত্তার জন্য নিজেকে সম্পৃর্ন কোয়ারেন্টাইনে/হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।
ঢ। জেলা/উপজেলা প্রশাসন পর্যায়ে আরো বেশি নজরদারী জোরদার করা। বিশেষ করে বিদেশ হতে আগত ব্যক্তিগের প্রতি বিশেষ নজরদারী/দৃষ্টি রাখা।
ণ। প্রায় ৫০ লক্ষ গার্মেন্টসকর্মী ভাই ও বোনদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং তাঁদের এন্ট্রি পয়েন্টে থার্মাল স্ক্যানার দ্বারা চেক করা। সর্বোপরি তাঁদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ত। নিজ বাড়ীর পার্শ্ববর্তী এলাকা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বাসায় আগত মেইড ও গাড়ীর ড্রাইভারদের হাত সাবান দিয়ে ধোঁয়া নিশ্চিত করা।
থ। রেডিও/টিভি এবং অন্যান্য সোসাল মিডিয়াকে পজিটিভ সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিত করা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে তাঁদের কাজ করা।
করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনাবোধ প্রসংগে
ক। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঔষধ, চাল, ডাল ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুদ করা হতে বিরত থাকা। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কৃত্রিম সংকট কারীদের প্রতি কঠোর নজরদারী রাখা।
খ। সকল ধরণের মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশ সীমিত করা এবং পর্যটন এলাকা ভ্রমন নিষিদ্ধ করা।
গ। সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য্য নিত্য পন্য দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশেষ উল্লেখ্য ২০% লোক দিন আনে দিন খায়। তাদের প্রতি সকলের বেশি মানবিক হওয়া উচিত।
ঘ। জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রনকক্ষ গঠন করা এবং উপজেলা হতে করোনা সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহ করা।
ঙ। ভাইরাস আক্রান্ত দেশের সাথে বাংলাদেশের বিমান, নৌ ও সড়ক যোগাযোগ আপাততঃ স্থগিত করা।
চ। সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য এনজিও গুলিকে সমন্বয় এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে একসাথে মিলিত হয়ে কাজ করা।
ছ। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির বেতন/ভাতা এবং তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও করোনা সনাক্ত নিজ নিজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিশ্চিত করা।
জ। সামাজিক গনমাধ্যমগুলিকে সচেতনামূলক খবরা খবর বেশি বেশি প্রচার করা এবং আতংকিত না হওয়ার জন্য সচেতনামূলক সংবাদ সরবরাহ করা।
ঝ। সকল দলীয় রাজনৈতি ব্যক্তি/মাননীয় এমপি/মন্ত্রীমহোদয়গণ নিজ নিজ এলাকায় নজরদারী বৃদ্ধি করা এবং স্থানীয় জন প্রশাসনকে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করা।
ঞ। তৃর্ণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন/উপজেলা জনপ্রতিনিধি নিজ নিজ এলাকার মসজিদ/মাদ্রাসার ইমাম ও সুপার এবং নিজ এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ উক্ত এলাকার সাধারণ মানুষকে জনসচেতন করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ট। অহেতুক গুজব না ছড়ানো এবং সঠিক তথ্য যথাযত জায়গায় প্রেরণ করা।
৮। সুপারিশ/মতামত :
ক। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য কোয়ারেন্টাইন/হাসপাতাল চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
খ। বিদেশ হতে আগত সকল ব্যক্তিকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা।
গ। ঢাকা আন্তর্জাতিক শাহজালাল বিমান বন্দরকে আরো বেশি সুরক্ষা করা। অনুরূপ বাংলাদেশের অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরগুলিতে আগত সকল যাত্রীদের থার্মাল স্ক্যানার এর মাধ্যমে চেক করা এবং ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
ঘ। দেশের বৃহৎ নৌ বন্দর, স্থল বন্দরগুলিতে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি সনাক্ত করণ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
ঙ। বিভাগীয় পর্যায়ে সকল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত আইসিইউ এবং কোয়ারেন্টাইনের জন্য অতিরিক্ত বেড নিশ্চিত করা।
চ। ঢাকা শহরের মধ্যে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারদের এলাকা ভিত্তিক স্বাস্থ্য সেবা ও করোনা সনাক্ত নিশ্চিত করা।
ছ। করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রনে আগামী দিনের জন্য পর্যাপ্ত ভলান্টিয়ার নিয়োগ ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা।
জ। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হতে রক্ষা পেতে সরকারি নির্দেশাবলি রেডিও/টিভির মাধ্যমে প্রচার সীমিত না করে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে সম্পৃক্ততা করা একান্ত অপরিহার্য।
ঝ। শহরের তুলনায় গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষের মাঝে আরো বেশি সচেতনাবোধ সৃষ্টি করা।
ঞ। বয়ষ্ক ও শিশুদের ঘরের মধ্যে অবস্থান করাই শ্রেয়।
ট। ধূমপান হতে বিরত থাকা।
ঠ। শ্রমজীবি মানুষের জন্য (রিক্সা চালক, নিরাপত্তাকর্মী, গার্মেন্টসকর্মী, গনপরিবহনের ড্রাইভার/হেল্পার) মালিকপক্ষ বিনামূল্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাক্স সরবরাহ করা।
ড। রোহিংগা ক্যাম্পগুলির উপর প্রশাসনের যথেষ্ট নিরাপত্তা নজরদারী রাখা প্রয়োজন।
ঢ। বর্তমানে ডেংগুর সিজন শুরু হয়েছে। সে হিসাবে ডেংগুও করোনার সাথে ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে প্রতীয়মান। ডেংগু নিয়ন্ত্রনে অতিরিক্ত নজরদারী প্রয়োজন।
ণ। সকল বড় বড় শপিং মল, ট্রেন স্টেশন, বাসস্টান্ড ও জনবহুল এলাকায় থার্মাল স্ক্যানার স্থাপন করা।
ত। সকল ধর্মের বড় ধরনের প্রার্থনার স্থলে প্রবেশের পথে থার্মাল স্ক্যানার স্থাপন করা।
Facebook Comments Sync