ঈদ : অপার্থিব আনন্দ-উৎসব/ ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

নজরুল ইসলাম খান

ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

ঈদ মানে ফিরে আসা, ঈদ মানে আনন্দ ও খুশি। মুসলমানদের জাতীয় জীবনে বছরে দু’বার ঈদ ফিরে আসে আনন্দ আর খুশির বার্তা নিয়ে। আর ফিতর মানে ভঙ্গকরণ। সুদীর্ঘ একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে সিয়াম সাধনার পর এই দিনে রোযা ভঙ্গ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে আনন্দোৎসব করে বলে ‘ঈদুল ফিতর’ নামটি যথার্থ রূপে স্বার্থক। সুশৃঙ্খল আনন্দময় এ উৎসবের পথিকৃৎ হলেন আমাদের প্রিয় নবী (স)। শ্রেণী বৈষম্য, অহমিকাবোধ ও আত্ম অহঙ্কারের চির অবসান ঘটিয়ে নবী (স) এ অপার্থিব উৎসবের সূচনা করেন পবিত্র মদিনায়। হাদিস থেকে জানা যায় নবী (স) মদিনায় হিজরত করে দেখতে পান যে, মদিনাবাসী শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ ও বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মিহিরজান’ নামে দু’টি উৎসব পালন করছে। উৎসব দু’টি প্রথম দিকে ৬ দিনব্যাপী এবং পরবর্তীতে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ৩০ দিনব্যাপী পালন করতে শুরু করে। নওরোজ ছিল নববর্ষ বরণের উৎসব আর মিহিরজান ছিল পারসিকদের অনুকরণে মদিনাবাসীদের আনন্দ-উৎসব। এসব অনুষ্ঠানে অশালীন আনন্দ-উল্লাস ও কুরুচিপূর্ণ রং তামাশা ও হৈ-হুল্লর হোত। পর্যায়ক্রমে এ উৎসব পরিণত হয় অশালীন ও অশুভ আনুষ্ঠানিকতায়। দেহপসারিণীদের জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট রাখা হতো যেখানে রাজা-সম্রাট ও আমীর ওমরাহ তথা সমাজের বিত্তশালীদের আগমন ঘটতো। তারা নানা রকম অপকর্মে লিপ্ত হয়ে এ উৎসব পালন করতো। বর্ষ বরণের নামে বেহায়াপনা ও উৎসবের নামে অশ্লীলতায় ডুবে থাকতো। 

নারী পুরুষের অবাধ মিলন কেন্দ্র ছিল এসব উৎসব-অনুষ্ঠান। রাসুল (স) এসব আনুষ্ঠানিকতা দেখে দারুনভাবে ব্যথিত হলেন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। তিনি মদিনাবাসীদের জানিয়ে দিলেন, তোমরা এসব অশোভন লক্ষ্যহীন আনন্দ উৎসব ছেড়ে দাও। এর পরিবর্তে তিনি স্ব-মহিমা ও নির্মল আনন্দে ভাস্বর পবিত্র স্পর্শমণ্ডিত বহুবিধ কল্যাণধর্মী ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামে দু’টি উৎসব পালনের জন্য নির্ধারণ করে দিলেন। সে দিন থেকে জাহেলিয়াতে পূর্ণ ইসলাম পরিপন্থী নওরোজ ও মিহিরজান উৎসব চিরতরে বন্ধ হলো এবং তদস্থলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উৎসবের প্রচলন করা হলো। নবী (স) বললেন : ‘লিকুল্লি কাওমিন ঈদুন, হাযা ঈদুনা’। অর্থাৎ প্রত্যেক জাতির বাৎসরিক আনন্দ-ফূর্তির দিন আছে। ঈদের দিন হচ্ছে আমাদের সে আনন্দ উৎসবের দিন। এভাবেই হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে মুসলিম জীবনে প্রবর্তিত হয় ঈদ। 

রমজানের সিয়াম সাধনা বা সংযম পালন ও কৃচ্ছ্্র সাধনের পর শাওয়ালের এক ফালি সরু বাঁকা চাঁদের স্নিগ্ধতা বিশ্ব মুসলিমের ঘরে ঘরে নিয়ে আসে রমজানুল মোবারকের মানবীয় ঐক্য ও স¤প্রীতির আনন্দ বার্তা। রমজানের রোজার ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে মহান আল্লাহর বিশেষ বিধান পালন থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। ফলে মুমিনের মনে আনন্দ উৎসব ও স্বস্তির প্রাণ প্রবাহিত হয়। মুমিন অস্বাভাবিক জীবনধারা থেকে স্বভাবসিদ্ধ জীবনে প্রবেশ করে। তাই ঈদুল ফিতরের দিন মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। সে কারণে বান্দা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করে সম্পদের মাধ্যমে ও নামাজ আদায় করে দৈহিকভাবে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। আলকুরআনে এসেছে : ‘তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও, তাহলে তোমাদের নেয়ামত বাড়িয়ে দেয়া হবে। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে জেনে রাখ আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন’। (সুরা ইবরাহিম : ৭)

রমজানের সিয়াম পালনের মাধ্যমে বান্দার জীবন নিষ্কলুষ ও নিস্পাপ হয়। বান্দা যেন সিয়ামের মাধ্যমে তার জীবনের সকল প্রকার অন্যায়-অনাচার থেকে মুক্ত হয়ে নিরেট মুমিনে পরিণত হয় এটাই সিয়ামের মূল লক্ষ্য। তাই ঈদের আনন্দ তাদের জন্য যারা আল্লাহর এ লক্ষ্য হাসিলে সফল হয়েছে। পুরস্কার তাদের জন্য যারা আল্লাহর সকল হুকুম-আহকাম অনুসরণ করে রমজানের পূর্ণাঙ্গ হক আদায় করেছে। ঈদের আনন্দের পুরস্কার কারা পাবে তা রাসুলের (স) একটি হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। রাসুল (স) বলেন : 

“ঈদুল ফিতরের দিন অসংখ্য ফেরেশতা পৃথিবীতে আগমন করে। তারা রাস্তার বিভিন্ন গলির মুখে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে, হে মুহাম্মাদের উম্মাত! তোমরা মহান রবের জন্য বেরিয়ে পড়। তিনি তোমাদেরকে অনেক কিছু পুরস্কার দিবেন। বড় বড় গুণাহ মাফ করে দেবেন। তখন তারা ঈদগাহে বেরিয়ে আসে, আর আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতা! কোন মজদুর যখন তার কার্য সঠিকভাবে পালন করে তখন তার কী বিনিময় হওয়া উচিৎ? ফেরেশতাগণ উত্তরে বললেন, হে আমাদের রব! তার বিনিময় হলো তার পারিশ্রমিক পুরোপুরি তাকে দিয়ে দেয়া। তখন আল্লাহ বলেন, হে ফেরেশতাগণ! আমি তোমাদের স্বাক্ষী রেখে বলছি তাদের সিয়াম ও কিয়ামের পুরস্কার স্বরূপ আমি তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। অতএব, হে উম্মাতে মুহাম্মাদ! তোমরা তোমাদের বাড়িতে নিস্পাপ অবস্থায় ফিরে যাও। তোমাদের সকল গুণাহ ক্ষমা করে দেয়া হলো”।

উপরিউক্ত হাদিসে যে পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সে পুরস্কার মূলত তারা পাবে যারা দিনের বেলায় সকল প্রকার পাপাচার, কামাচার ও অন্যায় অপরাধ থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছে এবং রাতের বেলায় কিয়ামুল লাইল করে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে গমনের চেষ্টায় ব্রতী হয়েছে। শুধু নতুন জামা কাপড় আর নিছক আনন্দÑফূর্তির নাম ঈদ নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে তার শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়াটাই ঈদের তাৎপর্র্য। আরবি ভাষায় একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদ আছে :‘লাইছাল ঈদ লিমান লাবেছাল জাদীদ, ইন্নামাল ঈদ লিমান আমিনাল ওয়ায়ীদ’। অর্থাৎ নতুন পোশাক পড়ার নাম ঈদ নয়, ঈদ হচ্ছে আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপত্তা লাভ করা। তাই ঈদের আনন্দের সাথে সাথে আল্লাহর শাস্তির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টায় ব্রতী হওয়া ঈদ আনন্দের মূল বিচার্য বিষয়। ঈদ উৎসবের সন্ধিক্ষণে কে কতো দামী এবং কোন ফ্যাশন-ব্রান্ডের পোশাক পড়লো সেটা মূল বিচার্য বিষয় নয়।

ঈদ বিশ্ব মুসলিমের বাৎসরিক সম্মিলন ও আনন্দ উৎসবের দিন। ইসলামে এ দিনের মর্যাদা সমধিক। হাদিস শরিফে যে ক’টি রাতে বান্দার ইবাদত কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে তন্মধ্যে দুই ঈদের রাত অন্যতম। রাসুল (স) বলেন :‘যে ব্যক্তি পুণ্য লাভের আশায় দুই ঈদের রাতে রাত্র জেগে ইবাদতে মশগুল হবে, সে দিন তার অন্তর এতটুকু ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে না, যে দিন অন্য সবার অন্তর ভীত-সন্ত্রস্ত মৃত্যুতুল্য হয়ে পড়বে।’ অন্য একটি হাদিসে ঈদের নামাজ আদায় করাকে নবজাত নিষ্পাপ শিশুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাই আমরা যেন ঈদকে যথার্থ মর্যাদা ও কল্যাণের উৎসব হিসেবে পালন করতে পারি সেদিকে মন নিবিষ্ট করতে হবে। কেননা এ দিবসে বান্দার পাপ মোচন করা হয় এবং অন্যায়কে নেকীতে পরিণত করা হয়।

ঈদের পরশে ভ্রাতৃত্ব ও প্রেমÑভালবাসার স্বর্গীয় স¤প্রীতির বন্ধনে পরস্পর আবদ্ধ হওয়া জরুরি। ধনীর সম্পদ গরীব দু:খীদের হাতে তুলে দিয়ে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের নজির স্থাপন করতে হবে এই ঈদের মাধ্যমে। ধনীর দানে যদি গরীবের ঈদ উজ্জ্বল ও তৃপ্তিকর হয় তবেই সার্থক হবে ঈদুল ফিতরের মহান শিক্ষা। পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ, বিবাদ-বিসম্বাদ, মন-মালিন্য ভুলে গিয়ে প্রীতির ডোরে আবদ্ধ হয়ে ঈদের আনন্দের মধ্য দিয়ে শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব। কেননা ঈদ এখন ধর্মের গন্ডি অতিক্রম করে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধনী-নির্ধন, আমির-ফকির, রাজা-প্রজা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদের অনাবিল আনন্দ উপভোগ করে। এই দিনে শ্রেণী বৈষম্য, কৌলিন্যবোধ ও অহঙ্কার-অহমিকার অবসান ঘটে। ঈদ পরিণত হয় সৌহার্দের অনুপম মিলন মেলায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা ভুলে না যাই। আমরা যেন বিজাতীয় সংস্কৃতি অনুকরণের মহড়ায় ব্যস্ত না হই। ঈদ বিনোদনের নামে আমরা যেন জাগতিক ও বস্তুবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার না হই সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপোষহীন ভূমিকা পালনে ও আলোকিত পৃথিবী গড়তে এগিয়ে আসতে হবে। 

ঈদুল ফিতর দেশ ও জাতির জন্য শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধির বার্তা বয়ে আনে এবং সমাজে ঐক্য, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে। রমজান মাসে যেমন মানুষ কৃচ্ছ্রতা সাধন ও আচার অনুশীলনে পরিবর্তন ঘটায় তদ্রæপ-বছরের বাকি মাসগুলোতেও যেন রমজানের এই প্রতিক্রিয়া বজায় থাকে তার শপথ গ্রহণ করাই ঈদুল ফিতরের অন্যতম শিক্ষা। কিন্তু এবারের ঈদ আমাদের জন্য ভিন্ন বার্তা বয়ে আনবে। নভেল করোনার কারণে মানুষ দীর্ঘদিন লকডাউনে আছে। আমরা ভুলতে বসছিলাম মানবিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও একে অপরকে ভালোবাসার কথা। এই ঈদে কোভিড-১৯ আমাদের সেই ভুলে যাওয়া পাঠ আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিবে। নভেল করোনার এই শিক্ষা আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত হবে এটাই প্রত্যাশা। 

 

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ, ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কলেজ, ধানমন্ডি, ঢাকা

 এবং সভাপতি, বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতি।