বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু: এক ও অভিন্ন/  লে. কর্নেল সৈয়দ হাসান ইকবাল (অব.)

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি,  প্রধান রূপকার এবং বাঙালি জাতির স্বাধীকার আন্দোলনের অন্যতম কান্ডারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের জাতির  পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নের মণি এবং অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁরই মন্ত্রে,  তাঁরই উদ্দীপনায় পুরো বাঙালি জাতি সময়ের সাথে নিজেদের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে জেগে ওঠে এক অদম্য চেতনায়। তাঁরই বজ্রকন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার এক উদাত্ত আহবান।  বাঙালি জাতির চেতনাকে, সুপ্ত  শক্তিকে এক অভূতপূর্ব জাদুতে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলেন-এই মহান নেতা। তিনি আমাদের মাঝে এক সময়োচিত আত্মপোলব্ধির উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালি জাতিকে বীরের  জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।  পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দীর্ঘ তেইশ বছরের কল্পনাতীত দুঃশাসন, অবর্ণনীয় অত্যাচার আর অকহনীয়  দুর্ব্যবহার এবং অন্যায়ের  বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার উদাত্ত আহ্বান এসেছিল এই মহান বীরের কাছ থেকে। যার ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাসের একটি  রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে  পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম  দেশ-এই বাংলাদেশ।      

১৯৭২ সালের প্রথমদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে লন্ডনে যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনার  শক্তির উৎস কোথা থেকে এবং আপনার দুর্বলতাই বা কি?’  উত্তরে  বঙ্গবন্ধু অকপটে এবং বলা যায় কালবিলম্ব না করেই বলেছিলেন, ‘আমার শক্তির উৎস হচ্ছে, আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আর সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হচ্ছে,  আমি আমার বাংলার মানুষকে একটু বেশিই ভালোবাসি।’   আহ! কি অসাধারণ স্বীকারোক্তি, কি ঋজু  দৃষ্টিভঙ্গি। কখন একজন মানুষ এমন কথা বলতে পারে?  স্বাধীনতার পর পরই বিখ্যাত ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে বঙ্গবন্ধুকে  এক সাংবাদিক poet of politics  বা রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আসলেই তো?  রাজনীতি যে একটি অসাধারণ কাব্য হতে পারে তা তো আগে কেউ এমন করে প্রমাণ করতে পারেনি!  এক পশ্চিম  পাকিস্তানি মেজর সেই  প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর ওপর বিরোধিতা করে বলেছিলেন ‘শেখ মুজিব একজন বিশ্বাসঘাতক  এবং দেশদ্রোহী যিনি একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশকে বিভক্ত  করেছেন।’ উত্তরে অবশ্য প্রবন্ধকার বলেছিলেন, ‘যদি একজন সাধারণ মানুষ প্রত্যন্ত  অঞ্চল তথা দেশের মাটি ও শিকড় থেকে উঠে সহিংস পথে না গিয়ে সেই স্বাধীন দেশের জনগণকে দেশের অভ্যন্তর থেকে উদ্বুদ্ধ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয় তখন তাকে দেশদ্রোহী না বলে বরং দেশপ্রেমিক বলাই অধিকতর শ্রেয় এবং সমীচীন। কেননা বিশ্বে এধরনের দেশদ্রোহীর সংখ্যা খুব বেশি নাই। অপরপক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্রের এটা সীমাহীন ব্যর্থতা তাকে বুঝতে না পারা বা এই পরিণতির বিষয় মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হওয়া।’ এই হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।   

দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, রাশিয়ার লেনিন, চীনের মাও সে তুং, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ভিয়েতনামের হো চী মিন সবাই তাদের স্ব স্ব  দেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখার জন্য বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে   পাকিস্তানী স্বৈরাচার শাসক কর্তৃক নিরীহ বাঙালির ওপর অপারেশন সার্চ লাইট তথা হত্যাযজ্ঞ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শুরু হলেও বাংলার আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক পূর্বেই  যথাক্রমে ১৯৬৯ সালের ২৩ মার্চ এবং ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ এ অনুষ্ঠিত জনসভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির পিতা’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।  বলা যায় পরবর্তী যেকোনো সময় বাংলাদেশ  স্বাধীন হলেও  বা বঙ্গবন্ধু জীবিত না থাকলেও এই ‘বঙ্গবন্ধু ’ এবং ‘জাতির পিতা’র তকমাটি অন্য কারো পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হতো না। 

ফরিদপুর জেলার, তদানীন্তন গোপালগঞ্জ মহকুমার মধুমতী নদীর নিকটবর্তী  অবস্থিত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ  এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শেখ মুজিবের জন্ম।  পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা মোসাম্মৎ সাহেরা খাতুনের চার কন্যা এবং দুই পুত্র সন্তানের মধ্যে মুজিব ছিলেন তৃতীয় । গ্রামবাংলার অন্য দশটি ছেলের মতো শেখ মুজিব তাঁর শৈশব এবং কৈশোর কাটান গ্রামেই। পড়াশুনা করেন গ্রামের স্কুলে।  অন্যায় অবিচার দেখলে তাঁর মন ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী হয়ে উঠত। সেটা ফুটবল খেলা হোক বা স্কুলের অন্য কোনো ন্যায্য দাবি-দাওয়া হোক। সেই মুজিবুর রহমান, ১৯২০ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে মাত্র ৫১ বছর সময়ের মধ্যে ১২ বছরের অধিক সময় নানা ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগে পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে কারারুদ্ধ থাকার পরেও  কিভাবে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বনেতা হয়ে উঠলেন তা ভাবতেও আশ্চর্য হতে হয়। নিখাদ দেশপ্রেম, বজ্র কঠিন দৃঢ়তা, সত্য এবং  ন্যায় প্রতিষ্ঠায় একজন অনমনীয় যোদ্ধা হিসেবে যাঁরাই মুজিবের সংস্পর্শে এসেছেন তাঁরাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন তাঁর দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব এবং লক্ষ্য অর্জনে অবিচলতা । মুগ্ধ হয়েছেন এই নেতার সহজ সরল দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিরল নেতৃত্বগুণে।

বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর কারাবাসে অন্তরীণ থাকাকালীন একটি স্মরণীয় ঘটনার উল্লেখ করা যায়।  বঙ্গবন্ধু ১৯৫০ সালে রাজবন্দি হিসেবে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে  আটক। তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তখন বুঝতে  পেরেছিল বাংলার স্বাধীকার আদায়ের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অনমনীয় মনোভাব। সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালায় বঙ্গবন্ধুকে জেল জুলুম দিয়ে কাবু করতে। তারপর চেষ্টা করে নানাধরনের লোভনীয় পদের অফার দিয়ে রাজী করাতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুতো সেরকম  নয়। অন্য ধাতুতে গড়া একজন নির্লোভ মানুষ। কিন্তু না, বঙ্গবন্ধুকে কিছুতেই প্রলোভিত করা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাবও দেয়া হলো।  এতদুদ্দেশ্যে, তখন গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত নড়াইল জেলার মুন্সী হোসেন উদ্দিন ১৯৫০ সালের ১৫ জুন কারাগারে  বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন ‘মুজিব শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির চেয়ে বরং মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করে। এই গোয়েন্দা অফিসার শেখ মুজিব সর্ম্পকে সে সময় অবশ্য সঠিক তথ্যই সরকারকে দিয়েছিল। যার ফলে মুজিবের কারাগার থেকে মুক্তিতে এটা সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই বাঙালিদের প্রতি তদানীন্তন পাকিস্তানী শাসকদের বৈষম্যমূলক আচরণ, নিপীড়ন, শোষণ এবং দু:শাসনের বিরুদ্ধে সবসময় শেখ  মুজিবকে সোচ্চার থাকতে দেখা গেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের দাবি আদায়ের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক ধাঁচের রাষ্ট্রযন্ত্রের দুঃশাসন, শোষণ ও জাতি নিপীড়নের নিগড় থেকে বাঙালির জাতির মুক্তি সংগ্রামে ধারাবাহিকভাবে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ সালের শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ৬৬ সালের বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ৬ দফা, ৬৮ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ৬ দফাভিত্তিক ৭০ এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়-কোথায় নেই বঙ্গবন্ধুর পদচারণা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই ঐতিহাসিক কালজয়ী ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর  মতো উদ্দীপ্ত বক্তব্য পুরো বাঙালি জাতিকে এক অবিস্মরণীয় শক্তিতে উদ্দীপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহসী করে তোলে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিজ গৃহ থেকে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে পারতেন। অনেকে আশাও করেছিলেন তাই। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর কর্তারাও ঠিক ওঠাই চাচ্ছিলেন যাতে করে পালিয়ে যাবার সময় নিজেরা হত্যা করে মুজিবের নিজ দলের দুষ্কৃতিকারি  বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে বলে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু না, তা আর হয়নি। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিজ বাসভবন থেকে  গ্রেফতার করতে বাধ্য হয় সামরিক জান্তারা এবং এতে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও পড়ে তাদের ওপর। এদিকে বঙ্গবন্ধু সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কিন্তু থেমে থাকেনি। তাঁরই হাতে গড়া যোগ্য দেশপ্রেমিক রাজনতৈকি সহর্কমী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ,জনাব সয়ৈদ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কাম্রুজ্জামান প্রমূখ শক্ত হাতে মুক্তিযুদ্ধের হাল ধরেন।  প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ।

তারপর, ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত  মোট ২৬৭ দিনের যুদ্ধে  পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে অকল্পনীয় গণহত্যা, নির্মম অত্যাচার, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, ধ্বংস ইত্যাদির বিরুদ্ধে আপামর জনতার প্রতিরোধ, আক্রমণ, অসহযোগীতা,   ঘৃণা ইত্যাদি নানা কারণে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দ্রুত পরাজয় মেনে নেয়া ব্যতীত অন্য কোনরকম বিকল্প ছিল না। যদি ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় স্বীকার না করে পাকিস্তানী সেনারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতো তাহলে সেনাবাহিনীর সেই ৯৩ হাজারের কেউ আর জীবিত তাদের দেশে ফেরত যেতে পারত না। পৃথিবীর ইতিহাসে  এত বৃহৎ সংখ্যক প্রশিক্ষিত সৈন্য দিয়ে গঠিত একটি বাহিনী ঘটা করে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অপর একটি অপেশাদার মুক্তিবাহিনীর নিকট নিলর্জ্জ  আত্মসমর্পণ করেছে বলে কোনো নজির নেই।  এদিকে যুদ্ধকালীন সময়ে পশ্চিম  পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুকে বিচারের প্রহসন করে ফাঁসি দেয়ার নানারকম অপচেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু না, সে তো হবার নয়। বিশ্ব বিবেকের চাপ, পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় এক লাখের মতো সেনা অবস্থান এবং সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনা থেকে তারা সরে আসে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্য হয়ে বীরের বেশে স্বাধীন এই বাংলাদেশে ফেরত আসেন। 

এবার একটু সংক্ষিপ্তাকারে বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনকাল বিচার করা যাক। ১৯২০ সালে জন্ম নেয়া শেখ  মুজিব প্রথম দেখলেন ১৯৪৭ এ এক অদ্ভূত নিয়মে শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে একটি দেশের সৃষ্টি হয়েছে। আর তা হলো  পাকিস্তান। দেখা গেলো, একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোনোই মিল নেই উভয় দিক তথা পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। এটা বুঝতে কষ্ট হয় কী করে তখনকার নেতৃত্ব এটা অনুধাবন  করতে পারেনি যে একে অপর থেকে ১৬০০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত দুই প্রান্তের লোকদের ভাষা, কৃষ্টি, খাদ্যাভাস, প্রকৃতি, পোশাক পরিচ্ছদ, মননশীলতা, শিল্প সংস্কৃতি ভিন্ন হওয়ার পরেও একটি দেশই করতে হবে। শুধু ধর্মই যদি একমাত্র বন্ধন হয় তাহলে তো পশ্চিম     পাকিস্তানের সাথে যে সকল দেশের বর্ডার রয়েছে অর্থাৎ আফগানিস্তান, ইরান এদের সাথে মিশে যাওয়ার কথা। তাদেরতো সবার ধর্ম এক এবং ইসলাম ধর্ম। একটা জিনিস বুঝতে হবে, দেশ গড়ার ক্ষেত্রে নিয়ামক একমাত্র ধর্ম হতে পারে না।   একটা পুকুরে যেমন অনেক রকমের মাছ থাকে ঠিক তেমনি একটি দেশেও নানা ধর্মের মানুষের বসবাস থাকবে এটাইতো স্বাভাবিক। তদুপরি একই ধর্মের হলেওতো নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকে। অনেকক্ষেত্রে এই মতপার্থক্য বেশ মারমুখী এবং সহিংস। তাই বলা যেতে পারে ধর্ম বা   বিশেষ বিবেচ্য বিষয় নয় বরং  সর্ম্পকই হচ্ছে মূল বিষয়। যদি কোনো দেশের সাথে কোনো দেশের  সুসর্ম্পক থাকে তাহলে সেখানে ধর্ম কখনো বাধা হতে পারে না। যেমনটা সৌদি আরব এবং ইরানের ধর্ম এক হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু তাদের মধ্যকার সর্ম্পক ভালো নেই। আবার একই সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে ভালো সর্ম্পক বজায় রাখে ধর্ম ভিন্ন হওয়ার পরেও। পরস্পরের  ধর্ম  ভিন্ন ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও ইরানের সাথে ভারতের রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রীতিময় সুসর্ম্পক।    ফলে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যা হবার তাই হলো। ১৯৪৭ সালের পর পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক মোহাজের ভারত থেকে নিজেদের বাস্তুভিটা ছেড়ে  এসেছিল নতুন জীবনের আশায়। একদিকে সবকিছু হারানোর হতাশা অন্যদিকে ত্বরিত পুষিয়ে নেবার আশায় তারা প্রশাসনে, সামরিক বাহিনীতে, রাজনীতিতে, আমলাতন্ত্রে কীভাবে অপেক্ষাকৃত নিরীহ, দুর্বল এবং সহজ সরল বাঙালি তথা পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের বঞ্চিত করা যায় সে উন্মাদনায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র ১৯৪৭ সাল থেকেই মেতে ওঠে। এই হটকারিতার বিষয়টি  প্রথমদিকেই বুঝতে পেরেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মওলানা ভাসানীর মতো কিছু প্রাজ্ঞ দেশপ্রেমিক নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদেরই একজন যোগ্য শিষ্য এবং তাঁদের  নির্দেশিত পথে এবং নীতিতে পাকিস্তানী অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে হয়ে ওঠে একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা নিয়ে মতপার্থক্য, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং শেষে ১৯৭১  সালের স্বাধীকার আদায়ের জন্য যুদ্ধ কোথায় নাই শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতি।

এই রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন সময়ে ১২ বছরের অধিক সময়ের জন্য নানা প্রহসনমূলক মামলায় পাকিস্তানের কারাগারে বিনা বিচারে কারাবরণ করতে হয়েছে।  তারপর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে এসে দেখলেন এতো পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের  রেখে যাওয়া একটি  ধংসস্তূপ ছাড়া  আর কিছুই নয়। সদ্য স্বাধীন দেশেতো  কিছুই নাই। তবুও তিনি শক্ত হাতে দেশের হাল ধরার চেষ্টা করলেন। দেশের মানুষকে ধৈর্য্য ধরার এবং সাহস না হারাবার কথা বললেন। কিন্তু না, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত দল তারা কিন্তু  তাদের প্রতিশোধের বিষয়টি মাথায়ই রেখেছে ভোলেনি। দেশি-বিদেশি একাধিক চক্র এক হয়ে নানাভাবে চেষ্টা করে যেতে লাগলো কীভাবে তাদের  প্রতিশোধ নেয়া যায়। এখানে কয়েকটি দেশের নাম বিশেষ করে পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের কথা  উল্লেখ  করা যায়, কেননা তারা ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি বা স্বীকৃতি দেয়নি। ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ সাল, বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিজ দেশের কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফলে সপরিবারে নিহত হলেন।  শুধুমাত্র তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা সে সময় জার্মানীতে অবস্থান করার  কারণে প্রাণে বেঁচে যান।  এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে  এক বিশাল মহীরূহের পতন হলো, অন্ধকারে পতিত এবং কলংকিত হলো জাতি, লজ্জায় ডুবলো  মানবতা।  সেই ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারের বিষয়টিই যেন মুখ্য হয়ে উঠলো । ‘আমি আমার দেশের মানুষদের একটু বেশিই ভালোবাসি, এটাই আমার দুর্বলতা।’  তা না হলে কেন তিনি দেশের একজন রাষ্ট্রপতি হয়েও নিজের এবং পরিবারের কোনোরূপ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিলেন না। ১৯৭৫ সালের ১৫ অাগষ্টের পরেই  বাংলাদেশ হয়ে পড়ল অভিভাবকহীন, পরিচয়বিহীন একটি দেশ। ইতিহাস যেন আবার ঘুরে গেল পিছনের দিকে।

কিন্তু না, ঠিকই ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার  হাত ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের পরে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসলো। যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে শক্ত হাতে দেশের হাল ধরলেন এই নেত্রী।  দেখলেন চর্তুদিকে চাটুকারের অভাব নেই, নেই বিশ্বাসঘাতকের।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ প্রচেষ্টা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে সেই তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম থেকে দেশকে  আস্তে আস্তে নিয়ে আসলেন একটি সম্মানজনক অবস্থানে। যে যুক্তরাষ্ট্র, যে পাকিস্তান একসময় বাংলাদেশকে নিয়ে কটাক্ষ, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে দ্বিধা করতো না সেই  যুক্তরাষ্ট্রই এখন বাংলাদেশের উন্নয়নে পঞ্চমুখ। সেই পাকিস্তানই বর্তমানে অর্থনীতি, সামাজিক, মানবাধিকার  এবং মানবিকতার অনেক সূচকে বাংলাদেশের বেশ পিছনে পড়ে রইলো শুধু বিগত দিনের আক্ষেপ আর অনুশোচনা নিয়ে। আজ আমাদের  মাঝে বঙ্গবন্ধু সশরীরে উপস্থিত নেই কিন্তু তাঁর আদর্শ রয়ে গেছে। একজন মানুষ মাত্র ৫৫ বছর বেঁচেছেন তার মধ্যে আবার ১২ বছরেরও অধিক সময় ধরে কারাগারে ছিলেন। তাহলে সত্যিকার কাজের আর কত সময়ইবা পেলেন!  কিন্তু এই ক্ষণজন্মা এই রাজনীতবিদি  এই অল্প সময়ে কী কাজটাই না করে গেছেন!    সুতরাং বাংলাদেশ নামের এই দেশটি যতদিন পৃথিবীর বুকে  এবং বিশ্বের মানচিত্রে বর্তমান থাকবে ততদিন থাকবে শেখ মুজিবের নাম একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে। 

তথ্যসূত্র:

১। ‘আওয়ামী লীগ- যুদ্ধদিনের কথা, ১৯৭১’- মহিউদ্দিন আহমেদ।