তোমার সৃষ্টির পথ  রেখেছ আকীর্ণ করি/  ড.আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

দিনটি ছিল ২২ শ্রাবণ, ৭ আগস্ট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের  শেষ দিন। তাঁর জীবনের শে‘ষ এক বছর  কেটেছিল  রোগশয্যায়। জীবনের   শেষ দিনগুলো নানা রকম অসুখে ভুগছিলেন কবি।  হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি চলছিলো। কিন্তু  রোগ নিরাময় হচ্ছিলো না কিছুতেই। কবি তখন শান্তিনিকেতনে ছিলেন। মৃত্যুর আগে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে।  শেষবারের মতো ছাড়েন শান্তিনিকেতন ১৯৪১ সালের জুলাইতে। মাত্র কিছুদিন আগে কবির জন্মদিন পালিত হয়েছে। আধশোয়া অবস্থায় কবিতে নামিয়ে আনা হলো বাসভবন  থেকে। চারপাশে তাঁর প্রিয় আশ্রমিকেরা।  বোলপুর  স্টেশনে অপেক্ষায় ছিল একটি বিশেষ  ট্রেন।  ট্রেনটির মডেল রাখা হয়েছে জোড়াসাঁকোর মহর্ষি ভবনের  দোতলার। এই বিশেষ  ট্রেনের মডেলকে  বলা হয় ‘দা লাস্ট জার্নি।’

চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের কথা বলেছিলেন। কবির মত ছিল না তাতে । বলেছিলেন, ‘মানুষকে  তো মরতেই হবে একদিন। একভাবে না একভাবে এই শরীরের  শেষ হতে হবে  তো, তা এমনি করেই  হোক না  শেষ। মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি  ছেঁড়াছেঁড়ি করার কি প্রয়োজন?’

কিন্তু বড্ড বেশি কষ্ট পাচ্ছিলেন কবি।  যন্ত্রণার উপশমের জন্য অস্ত্রোপচার করতেই হবে এটাই ছিল চিকিৎসকদের অভিমত। অস্ত্রপোচার করতে হলে কলকাতা যেতে হবে। ছাড়তে হবে শান্তিনিকেতন।  তাই শান্তিনিকেতনকে বিদায় জানিয়ে কবিকে আসতে হলো কলকাতায়। ২৫ জুলাই  দুপুর তিনটা ১৫ মিনিটে রবীন্দ্রনাথ এলেন  জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।

এই বাড়িটির  ভেতরের দিকে একটি ঘরে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ অনেক বছর আগের এক ২৫  বৈশাখ।

রবীন্দ্রনাথ কলকাতা যাচ্ছেন এ খবরটা  গোপন রাখা হয়েছিল। তাই  স্টেশন বা বাড়িতে ভিড় ছিল না।  স্ট্রেচারে করে  দোতলায়  নেয়া হলো তাঁকে। মহর্ষি ভবনের  দোতলায় ‘পাথরের ঘর’-এ তিনি উঠলেন। 

এই ঘরেই রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ ঘটেছিল । পাথরের ঘরের পুবদিকের বারান্দায় কবির  অস্ত্রোপচারের জন্য রীতিমতো একটা অপারেশন থিয়েটার বানানো হয়েছিল।

সেই যুগে  জীবানুমুক্ত করে বাড়িতে অপারেশন করা হয়েছিল, এটা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার।

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ ড.আফরোজা পারভীনজীবনের  শেষ চার বছর ধারাবাহিকভাবে শারীরিক অবনতি ঘটেছিল কবির। এই সময়ের মধ্যে অন্তত দুইবার তাঁকে শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল । ১৯৩৭ সালের আগে পর্যন্ত  রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য ভালো ছিল। ১৯৩৭ সালে  তিনি একবার কিডনি সমস্যায়  ভোগেন। তিনি অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির।  সেবার   সেরে উঠেছিলেন। এরপর ১৯৪০ সালের  সেপ্টেম্বর মাস  থেকে একের পর এক শারীরিক বিপর্র্যয় শুরু  হয় কবির।  সে বছরের ১৯  শে  সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতন  থেকে পুত্রবধূ প্রতিমা  দেবীর কাছে দার্জিলিং পাহাড়ের কালিম্পং-এ গিয়েছিলেন কবি ।  সেখানেই ২৬ তারিখ রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন । দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জন বলেছিলেন তখনই অপারেশন না করলে কবিকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু ‘প্রতিমা  দেবী ও  মৈত্রেয়ী  দেবী তখনই অপারেশন না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন’। শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর শেষযাত্রা উপলক্ষে  আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে  একথা বলেছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের অধ্যক্ষ ও সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায়।

কবি একটু সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে কালিম্পং থেকে কলকাতায় আনা হয়। এরপর তিনি ফিরে যান শান্তিনিকেতনে।

কবিগুরুর অপারেশন করানো হবে কী না, তা নিয়ে একটা  দোলাচল ছিল। এ বিষয়ে বলেছেন শ্যামল চক্রবর্তী, ” সেই ১৯১৬ সাল  থেকে রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা করছিলেন  যে কিংবদন্তী ডাক্তার নীলরতন সরকার, তিনি কখনই কবির অপারেশন করানোর পক্ষে ছিলেন না। কবি নিজেও চাননি অস্ত্রোপচার করাতে। ডা. সরকার যখন স্ত্রী বিয়োগের পরে গিরিডিতে চলে  গেছেন,  সেই সময়ে আরেক বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায় শান্তিনিকেতনে গিয়ে অপারেশন করিয়ে  নেওয়ার কথা জানিয়ে  দেন।”

রবীন্দ্রনাথের অসুখটা কী ছিল, তা নিয়ে রয়েছে নানা মত। এ বিষয়ে পাঠকদেরও আগ্রহ প্রচুর। তারা জানতে চান কি অপারেশন হয়েছিল কবির, কি রোগে চলে গেলেন তিনি। কিন্তু বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। সব্যসাচী বসুরায়  চৌধুরী সেই প্রদর্শনীতে জানিয়েছিলেন, “আমাদের কাছে প্রস্টেট ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকরা সম্প্রতি প্রমাণ  পেশ করেছেন  যে রবীন্দ্রনাথ জীবনের  শেষ দিকে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রস্টেট ক্যান্সারে। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা সাধারণ মানুষের কাছে জানানো জরুরী ছিল। তবে এ নিয়ে বিতর্ক বা গবেষণা চলতেই পারে।”

অর্থাৎ এটি শেষ কথা নয়।

কবি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রয়েছেন অসুস্থ অবস্থায়। কবির ভ্রাতষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ  বেশ কিছু গল্প লিখেছেন।  সেগুলো পড়ে  খুব আনন্দ  পেলেন কবি।  উৎসাহিত করে বললেন আরও লিখতে। অবন ঠাকুর রানী চন্দকে গল্প বলে যেতেন। আর রানী চন্দ  সে গল্প শুনে লিখে  ফেলতেন। তার মাঝ থেকে নির্বাচিত   কিছু পড়তে   দেয়া হতো রবীন্দ্রনাথকে। তিনি পড়ে হাসতেন, কাঁদতেন। আর সেই তখনই রানী চন্দ রবিঠাকুরের  চোখ  থেকে জল গড়িয়ে পড়তে  দেখেছিলেন।

রানী চন্দ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত  প্রিয়ভাজন। শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ছিলেন চিত্রশিল্পী এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রী।

রবীন্দ্র গবেষক রামকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, এই অসুস্থতার মধ্যেও কবির সৃষ্টি কিন্তু বন্ধ হয়নি। “এই সময়ে তাঁর সৃষ্টিশীলতা একটা অন্য মাত্রায়  পৌঁছে যাচ্ছে। মৃত্যুটাকে মানুষ কীভাবে  দেখে,  সেই দর্শন প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর ‘ রোগশয্যায়’, ‘আরোগ্য’ ‘জন্মদিনে’ রচনার মাধ্যমে।  শেষ একবছরে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনার আরও তথ্য পাওয়া যায় প্রতিমা  দেবীর ‘নির্বান’ এবং নির্মল কুমারী মহলানবীশের ‘২২শে শ্রাবণ’-এ।”

জীবনের  শেষ দশকে (১৯৩২-১৯৪১) যেন দুহাত খুলে লিখেছেন কবি। অথচ এর মধ্যে বেশ কিছুকাল তিনি অসুস্থ ছিলেন। এসময় তাঁর পঞ্চাশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পুনশ্চ (১৯৩২),  শেষ সপ্তক (১৯৩৫), শ্যামলী ও পত্রপুট (১৯৩৬) গদ্যকবিতা সংকলন তিনটি তাঁর রচনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জীবনের এই পর্বে সাহিত্যের নানা শাখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন কবি। আর তাঁর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল একাধিক গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬;) চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২) কাব্যনাট্যের নৃত্যাভিনয়-উপযোগী রূপ), শ্যামা (১৯৩৯) ও চÐালিকা (১৯৩৯) নৃত্যনাট্যত্রয়ী। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর  শেষ তিনটি উপন্যাসও (দুই  বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪) এই পর্বে রচনা করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ ছবি জীবনের এই পর্বেই আঁকা।

একই সঙ্গে জীবনের  শেষ দিনগুলিতে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়। এই গ্রন্থে তিনি  জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলি সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পদার্থবিদ্যা ও  জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তাঁর কাব্যেও।  সে (১৯৩৭), তিন সঙ্গী (১৯৪০) ও গল্পসল্প (১৯৪১) গল্পসংকলন তিনটিতে তাঁর বিজ্ঞানী চরিত্রকেন্দ্রিক একাধিক গল্প সংকলিত হয়েছে।

জীবনের এই পর্বে ধর্মীয়  গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে  সোচ্চার হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ বিহার প্রদেশে ভূমিকম্পে শতাধিক মানুষের মৃত্যুকে গান্ধীজি “ঈশ্বরের  রোষ” বলে অভিহিত করলে, রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির  বক্তব্যকে অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করে প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করেন। কলকাতার সাধারণ মানুষের আর্থিক দুরবস্থা ও ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের দ্রুত আর্থসামাজিক অবক্ষয় তাঁকে বিশেষভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। গদ্যছন্দে রচিত একটি শত-পংক্তির কবিতায় তিনি এই ঘটনা চিত্রায়িতও করেছিলেন। এই সময়পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি ছিল মৃত্যুচেতনাকে  কেন্দ্র করে। যার মধ্যে রয়েছে অবিস্মরণীয় কিছু পংক্তিমালা।

দিন যাচ্ছে। সেদিন ২৬ জুলাই।  রবিঠাকুর ছিলেন প্রফুল্ল। ৮০ বছরের খুড়ো রবীন্দ্রনাথ আর ৭০ বছর বয়সী ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ পুরোনো দিনের নানা কথা স্মরণ  করে প্রাণখুলে হাসলেন । ২৭ জুলাই সকালে রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে একটি কবিতা বললেন। কবিতাটা টুকে নিলেন রানী চন্দ। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি হলো: ‘প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্ত¡ার নতুন আবির্ভাবে,  কে তুমি,  মেলে নি উত্তর।’ মৃত্যুর সাত দিন পূর্ব পর্যন্ত সৃষ্টিশীল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ঠিক হয়েছিল ৩০ জুলাই তাঁর অস্ত্রোপচার হবে। কিন্তু  সেটা কবিকে জানানো হয়নি। কবিগুরু  ছেলে রথীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে অপারেশন হবে’। রথীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কাল-পরশু’। এরপর রানী চন্দকে  ডেকে কবি লিখতে বললেন: ‘তোমার সৃষ্টির পথ  রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/  হে ছলনাময়ী।’ ডা. ললিত এলেন একটু পরে। বললেন, ‘আজকের দিনটা ভালো আছে। আজই  সেরে  ফেলি, কী বলেন?’ হকচকিয়ে  গেলেন কবি। বললেন, ‘আজই!’ তারপর বললেন, ‘তা ভালো। এ রকম হঠাৎ হয়ে যাওয়াই ভালো।’

রাণী চন্দের ‘গুরুদেব’ বইটিতে উল্লেখ রয়েছে  যে কবিকে বলা হয়েছিল  ‘ছোট্ট একটা অপারেশন। এটা করিয়ে নিলেই তাঁর আচ্ছন্নভাবটা ঠিক হয়ে যাবে, পরের দশ বছর আবার আগের মতোই লিখতে পারবেন। নীলরতন সরকারকে একবার জানানোও হয়নি এত বড় একটা সিদ্ধান্ত।”

বেলা ১১টায়  স্ট্রেচারে করে অপারেশন-টেবিলে  নেয়া হয় কবিকে।  লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অপারেশন করা হয় তাঁর । ১১টা ২০ মিনিটের দিকে  শেষ হয় অপারেশন।  তখনও কবি রসিক। আবহাওয়া ভারী। সেই ভারী আবহাওয়াকে হালকা করে উড়িয়ে  দেয়ার জন্য কবি রসিকতা করলেন, ‘খুব মজা, না?’

অপারেশনের সময় শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়েছিল । কবি তা বুঝতে  দেননি। ঘুমিয়ে পড়লেন কবি। ৩১ জুলাই যন্ত্রণা, গায়ের তাপ দুটোই  বাড়লো। নিঃসাড় হয়ে আছেন কবি। ১ আগস্ট।  কথা বলছেন না কবি। অল্প অল্প পানি আর ফলের রস খাওয়ানো হলো তাঁকে। চিকিৎসকেরা চিন্তিত, শঙ্কিত। ২ আগস্টও একই অবস্থা।  কিছু  খেতে চাইলেন না। তবে বললেন, ‘আহ! আমাকে জ্বালাসনে  তোরা।’ কবি কথা বলেছেন। এটুকুতেই সবাই খুশি। আশার আলো জ্বলে উঠছে যেন। ৩ আগস্ট। শরীরের  কোনো উন্নতি  নেই। ৪ আগস্ট। সকালে সামান্য কফি খেলেন। জ্বর বাড়ল। ৫ আগস্ট ডা. নীলরতন বিধান রায়কে নিয়ে এলেন। রাতে স্যালাইন  দেয়া হলো কবিকে। অক্সিজেন আনিয়ে রাখা হলো। ৬ আগস্ট বাড়িতে অনেক মানুষের ভিড়। সবাই উৎসুক কবির অবস্থা জানার জন্য। হিক্কা উঠছিল কবির। পুত্রবধূ প্রতিমা  দেবী ডাকলেন, ‘বাবা মশায়!’ একটু সাড়া দিলেন কবি। রাত ১২টার দিকে আরও অবনতি হলো কবির শরীরের। ৭ আগস্ট ছিল ২২ শ্রাবণ। কবিকে সকাল নয়টার দিকে অক্সিজেন  দেয়া হলো। কবিকে  দেখে  গেলেন বিধান রায় ও ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কবির কানের কাছে অবিরাম পড়া হচ্ছিল তাঁর জীবনের বীজমন্ত্র ‘শাস্তম, শিবম্, অদ্বৈত্যম’। তখনও আত্মীয়- স্বজন-এর অনেকে আশা করছেন অপারেশনের ধকলে কাহিল কবি ভালো হয়ে উঠবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে কমে এলো কবির শরীরের উষ্ণতা, পা ঠান্ডা হয়ে গেল। একসময়  থেমে  গেল হৃদস্পন্দন।  সেদিনের বর্ণনা দিয়ে গবেষক শ্যামল চক্রবর্তী বলেছিলেন, “অপারেশনের পরে ধীরে ধীরে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, জ্ঞান  নেই তাঁর। সকলেই যখন বুঝতে পারছে কী ঘটতে চলেছে, তখনই গিরিডি  থেকে খবর দিয়ে আনানো হয় কবির সুহৃদ ও বিশিষ্ট চিকিৎসক নীলরতন সরকারকে। তিনি এসে নাড়ি  দেখলেন, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপরে উঠে দাঁড়ালেন।  হেঁটে  বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে ডা. সরকারের দু’চোখে ছিল জল” । সময় তখন ১২টা ১০ মিনিট। দিনটা ২২ শ্রাবণ। খুলে  দেয়া হল অক্সিজেনের নল।  শেষমুহূর্ত উপস্থিত হওয়ার আগেই হাজারে হাজারে  মানুষ সমবেত হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। এসেছেন আত্মীয়, বন্ধু, ঘনিষ্ঠজন, কবি সাহিত্যিক। আর বাইরে বাধভাঙা আবেগে উদ্বেল সাধারণ মানুষ, কবির পাঠককূল, ভক্তরা। 

সাহিত্যিক ও বিশ্বভারতীর গ্রন্থনবিভাগের অধ্যক্ষ রামকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন,  কবি নিজে এই ভাবে  নিজের  শেষটা চাননি। “তাঁর ইচ্ছা ছিল  কোনও জয়ধ্বনি ছাড়া সাধারণভাবে শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির  কোলেই তিনি  যেন মিশে  যেতে পারেন। তাঁর  শেষ ইচ্ছাটা আর রাখা যায়নি।”

আসলে হয়ত রাখা সম্ভবও ছিল না । এযে এক রাজকবির মহাপ্রয়াণ। ঠাকুরবাড়ি যেন এক জনারণ্যে পরিণত হয়েছিল সেদিন।  কবিকে  সাজানো হয়েছিল  বেনারসি জোড়ে।  কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, চাদর, কপালে চন্দন, গলায় মালা দিয়ে সাজানো হয়েছিলা। রানী চন্দ কবির বুকের ওপরে রাখা হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলন পদ্মকোরক। এভাবেই কবি যাত্রা করেছিলেন চিরবিদায়ের পথে।

বিশ্বকবির জীবনের  শেষদিনগুলো জানা দরকার পাঠকদের। তিনি সেই কবি যিনি প্রকৃতি,  প্রেম ও জগৎকে  দেখার জন্য আমাদের  চোখ খুলে দিয়েছেন। বিশ্বকবি, আপনার জন্য রইল আমাদের শ্রদ্ধা।