রাপুনজেল আফরোজা পারভীন

অনেক অনেক দিন আগে দূরের এক এলাকায় এক লোক তার বউসহ বাস করত। তাদের একটা খুব চমৎকার  বাড়ি ছিল । ভালভাবে বাস করতে হলে যা দরকার তার সবই তাদের ছিল। শুধু একটা জিনিস তাদের ছিল না। একটা ছেলে বা মেয়ে । তাই তারা অখুশি ছিল।

‘যদি আমাদের নিজের একটা ছেলে বা মেয়ে সন্তান থাকত তাকে আমরা দেখেশুনে রাখতাম।  ভালবাসতাম ’ তারা বলত ।

তাদের বাড়ির পাশেই ছিল একটা পুরোনো দালান ।  সেখানে ছিল একটা খুব বড় বাগান। বাগানে না না ধরনের ফুল ফল ধরতো। লোকে বলত সেখানে একজন খারাপ  ডাইনি বাস করে। একদিন বউটা দেখল সেই বাগানে কতগুলি লেটুুস পাতা ধরে আছে।

বউটা  নিজের কাজ করছিল । তবে সে লটুস পাতাগুলোর কথা  ভুলতে পারছিলো না। সে তার বরকে বলে, ‘দেখ ওই সবুজ তরতাজা  লেটুস পাতা না খেতে পারলে আমি মারা যাবো। তুমি কি দেয়াল টপকে ওখানে গিয়ে কিছু লেটুস পাতা আনতে পারবে।’

বরটা ডাইনির কথা জানতো। তাই সে ওখানে যেতে রাজি হলো না। এদিকে বউ বলেই চলল, লেটুস পাতা না খেতে পারলে মারাই যাবে। বউএর  আহাজারিতে অবশেষে সে রাজি হল।

রাতে সে দেয়াল টপকে বাগানে নামল।   বাগানের মাটিতে পা পড়ামাত্র সে ভীত হয়ে দেখল, তার সামনে একটা  ডাইনি।

ডাইনি বলল, ‘তোর এত সাহস তুই আমার বাগানে ঢুকেছিস!’

‘ আমার বউএর জন্য কিছু লেটুস পাতা খুবই  দরকার। তার অসুখ । সে বলেছে, এই লেটুস পাতা না খেলে  মারা যাবে।’ বর বলল ।

‘ঠিক আছে লেটুস পাতা নিয়ে যাও। কিন্তু তার বিনিময়ে তোমার পয়লা ছেলে – মেয়ে  আমাকে দিতে হবে। ’ ডাইনি বলল।

বর বেচারা এতই ভীত ছিল যে সে রাজি হল।  সে হাতবোঝাই লেটুস পাতা নিয়ে বাড়ি ফিরল।

কিছুদিন পর বউএর কোল আলো করে তাদের ঘরে চমৎকার ফুটফুটে একটা  মেয়ে এলো। মেয়ে আসার সাথে সাথে ডাইনি তাদের বাড়িতে হাজির হয়ে মনে করিয়ে দিল, বর তাকে  কথা দিয়েছিল পয়লা ছেলে – মেয়ে তাকে দেবে। সে শিশুটিকে নিয়ে গেল। ডাইনি মেয়ের নাম রাখল ‘রাপুনজেল ।’ সে তার দেখাশুনা ভালভাবেই করত। যত দিন গেল ততই  মেয়েটি রূপসী হয়ে উঠল। এই রূপসী মেয়েটাকে যাতে কেউ দেখতে না পায় সেটা ভেবে ডাইনি তাকে বনের মাঝে একটা উঁচু টাওয়ারে আটক করে রাখল। সে টাওয়ারের কোন দরজা জানালা ছিল না। তবে একবারে উঁচুতে একটা জানালা ছিল ।

শুধুমাত্র ডাইনি মাঝে মাঝে  এই দুখি রাপুনজেলকে দেখতে যেত। সে যখন যেত তখন বলত

‘রাপুনজেল, রাপুনজেল,  তোমার কেশ নামিয়ে দাও’

রাপুনজেলের চুলগুলো ছিল ঝলমলে সোনালী রংএর। রোদ লেগে তা সোনার মতো লাগত।  তার চুল অনেক বড় ছিল। সে চুল টাওয়ারের চূড়ো থেকে ছেড়ে দিলে বাগানের মাটিতে পড়ত। ডাইনি সেই চুল  বেয়ে বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠত। তারপর সে জানালা গলিয়ে রাপুনজেলের কাছে যেত । এভাবে বছরের পর বছর চলে গেল । রাপুনজেল দু’চোখ দিয়ে ডাইনি ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলো না ।

একদিন এক  রাজাকুমার ঘোড়ায় চড়ে বাগানের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় রাপুনজেলের সুরেলা গলার গান শুনতে পেল।

 

‘আমি কখনই এমন সুমধুর গান শুনিনি।’ রাজকুমার মনে মনে বলল।  ‘কে এই গান গাইছে না জেনে আমি এখান থেকে যাবো না।’

রাজকুমার কাছাকাছি এক জায়গায় লুকিয়ে থাকল। একসময় সে  ডাইনিকে টাওয়ারে উঠতে দেখল।

সেদিন  ডাইনি চলে যাবার পর রাজকুমার ডাকতে লাগল,

‘রাপুনজেল, রাপুনজেল, তোমার চুল নামিয়ে দাও’

রাপুনজেল তার চুল নামিয়ে দিলো। তারপর একজন রাজকুমারকে জানালা দিয়ে উঠতে দেখে অবাক হল। রাজকুমার তার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারা অনেকক্ষণ কথা বলল ।  একসময় তারা বুঝল যে দুজন দুজনকে ভালবাসে ।

রাজকুমার কথা দিলো যে, সে পরদিন রাতে রাপুনজেলকে এই টাওয়ার থেকে নিয়ে যাবে।

পরদিন  ডাইনি এলো।  সে রাপুনজেলকে দেখেই বুঝতে পারলো, রাপুনজেল কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে ।

ডাইনি ভীষণ রেগে গিয়ে বলল ‘তুমি একটা খারাপ মেয়ে। তুমি একজনকে ভালবেসে ফেলেছ।’ ডাইনি একটা  ধারালো কাচি দিয়ে রাপুনজেলের মাথার চুল কেটে দিল। তারপর দূরের এক মরুভূমিতে তাকে একা ফেলে রেখে  এলো।

ডাইনি টাওয়ারে ফিরে এসে রাজপুকুমারের  অপেক্ষায় বসে রইল। একসময় রাজকুমারের ডাক শুনতে পেলো,

‘রাপুনজেল, রাপুনজেল, তোমার চুল নামিয়ে দাও’

ডাইনি তখন রাপুনজেলের মাথা থেকে কেটে ফেলা  সোনালি বেণী নিচে নামিয়ে দিল।

রাজকুমার বেণী বেয়ে তাড়াতাড়ি  টাওয়ারে উঠল। সে আজ খুব খুশি। আজ সে রাপুনজেলকে এই আটকখানা থেকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। উপরে উঠেই তার এই খুশি মিলিয়ে গেলো। সে  রাগি ডাইনির মুখোমুখি হল । সে ভয়ে টাওয়ার থেকে লাফিয়ে পড়ল অনেকগুলো ধারালো শিকের উপর। শিকের একটা তার চোখে ঢুকে গেল। সে আর চোখে দেখতে  পেলো না।

এরপর রাজকুমার  অনেক অনেক দিন দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ালো। কোথাও সে রাপুনজেলকে দেখতে পেলো না। তারপর একদিন এক শুনশান মরুভূমিতে সেই সুমধুর গান শুনতে  পেলো যা সে কখনই ভোলেনি।

রূপুনজেল রাপুনজেল বলে দুহাত তুলে সে চীৎকার করে উঠল। রাপুনজেলও রাজকুমারকে জড়িয়ে ধরলো। খুশিতে রাপুনজেলের  চোখের জল ঝরতে লাগল। আর সেই চোখের জল রাজকুমারের চোখে পড়ে তার চোখ ভাল হয়ে গেল।রাজকুমার আবারও তার সামনে রাপুনজেলের রূপসী  মুখ দেখতে পেল। রাজকুমার রাপুনজেলের হাত ধরল।

 

রাজকুমার রাপুনজেলকে নিজের দেশে নিয়ে গেল । এতদিন ছেলে কাছে না থাকায় রাজা-রাণীর মন খুবই খারাপ ছিলো। তারা রাজকুমারকে বুকে জড়িয়ে ধরল। রাপুনজেলকে  দেখে তারা খুবই খুশি হলো। এরপর মহা ধুমধামে রাজকুমার আর রাপানজেলের বিয়ে হলো।

আর অবশেষে তারা খারাপ  ডাইনির হাত থেকে রক্ষা পেল। রাপুনজেল এবং রাজকুমার এরপর সুখ আর খুশিতে জীবন কাটাতে লাগলো ।

 

বিদেশি গল্প অবলম্বনে পুনর্লিখন: আফরোজা পারভীন