জসীম উদ্দীন বাঙালির চিরায়ত কবি/ আফরোজা পারভীন

 

 (জসীম উদ্দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩ – ১৩ মার্চ ১৯৭৬, একজন বাঙালি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক। ‘পল্লীকবি’ উপাধিতে ভূষিত তিনি। তাঁর নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন)।

খুব ছেলেবেলায় পড়েছিলাম নিমন্ত্রণ কবিতাটি।

‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে

আমাদের ছোটো গাঁয়।

গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়…

এক বন্ধু  আরেক বন্ধুকে নিজের গাঁয়ে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করছে। তার সহজ সরল ভাষায় বন্ধুকে আকৃষ্ট করার জন্য  করছে নিজের রূপসী  গাঁয়ের বর্ণনা।  এত ভাল লেগেছিল তখন কবিতাটা! মার কাছে  জেনেছিলাম কবিতাটা জসীম উদ্ দীনের লেখা। তার উপাধী ‘পল্লী কবি।’ পল্লীকবি কেন? কারণ তিনি পল্লীর জীবন, পল্লীর মানুষ নিয়ে বেশি লেখেন। 

 সেই  থেকে আমার জসীম উদদীন পড়া শুরু। 

তিনি জন্মেছিলেন  ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি নানাবাড়িতে। নানাবাড়ি  ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে।  পৈত্রিক ভিটা  তাম্বুলখানার পাশের গ্রাম গোবিন্দপুর।  কুমার নদীর জল আর গ্রামীণ রোদ হাওয়া গায়ে মেখে গোবিন্দপুরেই কবির বাল্য ও  কৈশোরকাল কেটেছে।  কবির পিতা, পিতামহ ওই অঞ্চলের প্রভাবশালী লোক । গ্রামীণ  রাজনীতি ও ধর্মীয় ব্যাপারে এলাকায়  তাদের প্রভাব ছিল। সবাই তাদের মানতেন, সমীহ করতেন।   কবির পিতার নাম মৌলানা আনছার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায়  স্কুলশিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। কবিরা ছিলেন মোট চার ভাই।

জসীম উদ্ দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুলে (বর্তমানে ফরিদপুর জিলা স্কুল) পড়াশুনা করেন।  এই স্কুল থেকে  তিনি  প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । তিনি  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সালে । 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন তিনি ১৯৩৩ সনে। এ বছরই তার কাব্যগ্রন্থ ‘ সোজন বাদিয়ার ঘাট’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সনে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।  ১৯৪৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করে গেছেন। 

কবি ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও।  ১০,০০০ এরও বেশি লোক সংগীত সংগ্রহ করেছেন তিনি। যার কিছু অংশ তাঁর সংগীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদি গান-এ  স্থান পেয়েছে। তিনি বাংলা লোক সাহিত্যের বিশদ ব্যাখ্যা এবং দর্শন খণ্ড আকারেও লিখে গেছেন। 

জসীম উদ্ দীন খুব অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। কলেজে অধ্যয়নরত  অবস্থায়  লেখেন তাঁর সাড়া জাগানো ও বিশেষ আলোচিত কবিতা ‘কবর।’ এতে ছিল তাঁর পরিবারের এক  বিয়োগান্ত দৃশ্যের সাবলীল বর্ণনা।। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় এই কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়।

ওইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,

তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,

পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।

এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,

সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা।

 সোনালী ঊষায় সোনামুখে তার আমার নয়ন ভরি,

লাঙ্গল লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।

যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত,

এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোর তামাশা করিত শত।

গ্রাম্য জীবন এবং পরিবেশ- প্রকৃতি ফুটিয়ে তোলায় জসীম উদ্ দীন অনবদ্য। এই অনবদ্যতাই তাকে ‘পল্লীকবি’ উপাধী এনে দিয়েছে। তাঁর কাব্যের গঠনপ্রণালী এবং বিষয়বস্তুতে বাংলা লোক সাহিত্যের প্রগাঢ় আস্বাদ মেলে। যা পাঠককে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে।  ‘নকশী কাঁথার মাঠ’  কাব্যগ্রন্থকে তাঁর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর বহু  ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে।

জসীম উদ্ দীন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক গান রচনা করেছেন। বিখ্যাত লোক সংগীতের গায়ক  আব্বাস উদ্দীন তাঁর সহযোগিতায় ভাটিয়ালী ধারার কিছু অবিস্মরণীয় লোকগীতি নির্মাণ করেছেন। তিনি রেডিওর জন্য আধুনিক গান লিখেছেন।   তিনি ইসলামিক সংগীতও লেখেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে  তিনি বহু দেশাত্মবোধক গান লেখেন।

১৮ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা ‘মিলন গান’   প্রকাশিত হয় ‘ মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় । সেটা ১৯২১ সাল।  ১৯২৫ সালে ‘ক বর’  প্রকাশিত হয় প্রগতিশীল সাহিত্য পত্রিকা ‘কল্লোলে’। ১৯২৭ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ প্রকাশিত হয়। রাখালীর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ‘কল্লোল’ পত্রিকার সম্পাদক জনাব দীনেশ রঞ্জন দাশ। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয় তার আলোড়িত কাহিনি কাব্য ‘নকশীকাঁথার মাঠ।’ 

১৯৪৩ সালে তিনি  বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রীর নাম  মমতাজ।  মমতাজ তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী । মমতাজের  ডাক নাম মণিমালা।

 কবি  তার লেখনিতে পল্লীর মানুষের জীবন ও চালচিত্র, শ্রমিক দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষের কথাই শুধু লেখেননি, তুলে এনেছেন গ্রামীণ প্রকৃতি।  কুমড়োর ডগা, কচি পাতা, ছোট্টো নদীর মাঠের রাখাল,  সাপুড়ের মেয়ে কেউই বাদ পড়েনি তার কাব্যগাথা থেকে। 

তিনি পল্লীকবি নামে খ্যাত কিন্তু  তিনি যে অপূর্ব অনুপম কাব্য গাঁথা রচনা করে গেছেন তা কী শুধুই পল্লীসাহিত্য? এটা সত্যিই আজ গবেষণার বিষয়। 

তিনি আধুনিক কবি। তাঁর কবিতা আধুনিক, স্মার্ট, নির্মেদ।  শতবর্ষ পরেও যদি  এই আধুনিক কবিকে আমরা ‘পল্লী কবি’ হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সীমানারবন্দি করে রাখি, তাহলে কবির প্রতি অবিচার করা হয়। তাঁর সৃষ্টির প্রতি  অবমূল্যায়ন করা হয়।  একথা ঠিক যে, তিনি ‘পল্লীকবি’ উপাধিতে বিপুল খ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তারপরও শুধুমাত্র পল্লীকবির বৃত্তে তাকে আবদ্ধ করে রাখা ঠিক হবে না। মানছি যে, কবির কবিতায় পল্লী সাহিত্যের আখ্যানপ্রবণতা প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি  বিষয় হিসেবে পল্লী বাংলার জীবনকেই চিত্রিত করেছেন। কিন্তু তাঁর বাইরেও তাঁর অজস্র রচনা রয়েছে।

কবিতা ছাড়াও কবি যে গদ্যন্থগুলো রচনা করেছেন-তার মূল্য অনেক। কবির আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ কাহিনি রয়েছে। আছে গল্প , হাসির গল্প উপন্যাসসমূহ।  যা  অনুপম শিল্প  হিসেবে স্বকীয়  বৈশিষ্ট্যে বিকশিত। যেগুলিতে প্রতিভাত হয়েছে তাঁর আধুনিক মন, মনন, চিন্তা ও সামাজিক দর্শন।  কবি জসীম উদ দীন শুধু বড় মাপের কবি নন, একজন সুখ্যাত গল্পকার এবং গীতিকারও । তাঁর এ পরিচয়  অম্লান। একনজরে আমরা চোখ বুলিয়ে নেই তাঁর সাহিত্যসম্ভারের দিকে। তাঁর লিখিত কাব্যগ্রন্থ: রাখালী  (১৯২৭), নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯),বালুচর  (১৯৩০), ধানক্ষেত (১৯৩৩), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪), হাসু (১৯৩৮), রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), রূপবতি (১৯৪৬), মাটির কান্না (১৯৫১), এক পয়সার বাঁশী (১৯৫৬), সকিনা (১৯৫৯), সুচয়নী (১৯৬১),ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)’মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩),হলুদ বরণী (১৯৬৬)’জলে লেখন (১৯৬৯),কাফনের মিছিল ((১৯৮৮) , কবর। 

নাটক:পদ্মাপার (১৯৫০), বেদের মেয়ে (১৯৫১),মধুমালা (১৯৫১),পল্লীবধূ (১৯৫৬),গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯),ওগো পুস্পধনু (১৯৬৮),আসমান সিংহ (১৯৮৬),

আত্মকথা: যাদের দেখেছি ((১৯৫১),ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১),জীবন কথা ( ১৯৬৪),স্মৃতিপট (১৯৬৪)

উপন্যাস: বোবা কাহিনী (১৯৬৪)

ভ্রমণ কাহিনী: চলে মুসাফির (১৯৫২),হলদে পরির দেশে ( ১৯৬৭), যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮),জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫)

সঙ্গীত:জারি গান (১৯৬৮),মুর্শিদী গান (১৯৭৭)

অন্যান্য:বাঙালির হাসির গল্প, ডালিমকুমার (১৯৮৬)

  আমার সোনার ময়না পাখি, আমার গলার হার খুলে নে, আমার হাড় কালা করলাম রে,আমায় ভাসাইলি রে, নদীর কূল নাই কিনার নাই এর মতো মর্মস্পর্শী  চিরায়ত গানের তিনি রচয়িতা। এই মানুষটি বহুমাত্রিক। তারপরও তিনি শুধুই পল্লীকবি! 

মধ্যযুগের  কাব্যেও কাহিনি বা আখ্যান আছে। তার পটভূমি পল্লী ও নগর উভয়ই আছে। আমরা কিন্তু সেগুলিকে আলাদা করে পল্লী সাহিত্য বা নাগরিক সাহিত্য বলি না। কারণ  বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, শিল্পের প্রকাশশৈলীর ধরণ ও ভঙ্গি অনুযায়ী সাহিত্যের  চরিত্র নির্ধারণ হয়। আমাদের দেশে অসংখ্য ‘পথুয়া কবি’ বা পল্লী কবি আছেন।  তারাও সমকালীন ঘটনা নিয়ে  কবিতা রচনা করে থাকেন। সেই সব কবিতা স্থায়ীত্ব পায় না, কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তার পুনঃপ্রকাশ বা পুনঃপ্রচার  হয় না । তখন কবি অন্য কবিতা রচনায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।

পল্লীর জীবন কবির কবিতা রচনার একটা প্রধান ধারা। কিন্তু  একমাত্র ধারা নয়। তাঁর কবিতা সাময়িকও নয়।  কবির নকশি কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, এক পয়সার বাঁশি, সংস্করণের পর সংস্করণ হচ্ছে। এ থেকে আমরা বলতে পারি,  কবির কবিতা নির্মাণে এমন কুশলতা  আছে যা সর্বকালীন, সর্বজনীন।  পল্লী জীবনেরর সমকালীনতাকে ধারণ করেও যা চিরন্তন। সেজন্যই কবিকে পল্লীকবি না বলে বাঙালির চিরায়ত কবি হিসেবে অভিষিক্ত করা  যথার্থ এবং সম্মানজনক হবে বলে মনে করি।

এর বাইরেও কথা আছে। পল্লী কবিরা গ্রাম বাংলার মানুষের কাব্য পিপাসা  সাময়িকভাবেও মিটাতে পারলেও তা তাদের  চৈতন্যের দরজায় ধাক্কা দিতে পারে না। তাদের   চৈতন্যের  বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয়। মানুষের হৃদয়ে তা খুব একটা নাড়া দেয় না। ফলে গ্রাম বাংলার মানুষের মাঝে তা পুনঃপ্রচারিত হয় না। মানুষ সেটা আত্মার মধ্যে গেঁথে নেয় না। এখানেই কবি জসীম উদ দীনের কবিতা পল্লী কবিতা থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে আছে। পল্লী কবিদের কবিতা একঘেয়ে, গতানুগতিক,  নিয়ম এবং ছকে বাধা।

আর এক ধরনের পল্লী কবিতা আছে যার ভাব গভীর ও দার্শনিকতাপূর্ণ। এতে গ্রাম বাংলার নিজস্ব চিন্তাধারার প্রকাশ দেখা যায় । থাকে কিছু অধ্যাত্মিকতা।এই সব কবিতার ভাবুকতা যথেষ্ট উচ্চমানের! বাউল সম্রাট লালন ফকির, হাসন রাজা, রাধারমন,  সৈয়দ শাহনূর প্রমুখ কবির রচনায় এই ধারাটি সমৃদ্ধ।

জসীম উদদীনের কবিতা এর কোন ছকেই পড়ে না। উভয়  নিয়ম আর ছকের বাইরে। তাঁর কবিতায় রাখালিয়া সুর ও পল্লী জীবনের ভাববস্তু আছে। আরো আছে কথকথার ধরণ ও আখ্যান প্রবণতা!  দেশ কাল,সমাজ, মানুষ ও জীবন চিত্রিত করেছেন  তিনি। তাঁর  কবিতা সংহত, পরিপাটি ও অনুপম। যা যথার্থ শিল্প  হয়ে উঠেছে।

জসীম উদদীন সাধারণ লোক কবির নিরস আঞ্চলিক কবিতা এবং ভাবুক দার্শনিক লোক কবির ভাব-সাধনাকে একত্রিত করে   নিজস্ব একটা ধারা  তৈরি করেছেন। এটি এক ধরনের পুননির্মাণ। অপ্রধান কবিদের মাঝেও কখনও কখনও ভাল কিছুর দেখা পাওয়া যায়। যা তারা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে না।  প্রকৃত  কবি   তা থেকে তাঁর পছন্দের অংশকে আহরণ করে নিজের মেধার বলে নতুন  শিল্প সৃষ্টি করেন।

ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের নির্দেশে ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোক সাহিত্য সংগ্রহ করতে গিয়ে কবি ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রতিটি পল্লীগ্রামে অবস্থান করেছিলেন। তখন তিনি  বাংলার গ্রামীণ মানুষের ভাষা ও শব্দরীতির ব্যবহার, শব্দ নির্বাচন, প্রয়োগ  এসব বিষয়ে  আকৃষ্ট হন। তিনি নিজ  যোগ্যতায় তুলে নেন সেগুলো। যা তাঁর ভাড়ার পূর্ণ করে দেয়, তাঁর লেখনীকে সমৃদ্ধ করে।  জসীম উদদীন  নিজেই বলেছেন সেকথা,  ‘ লোক সাহিত্যকে বা লোক সঙ্গীতকে জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করার অনেক বড় ধরনের অসুবিধা আছে। কারণ প্রায়শই তা মধ্যবিত্ত শ্রেণির রুচির সঙ্গে মেলে না। তাই এ ধরনের রচনার নবায়নে আমার অনেকগুলো পদ্ধতি ছিলো। আমি কখনো একগুচ্ছ গান সংগ্রহ করে তার মধ্যে যেগুলো শহরের  লোকদের রুচির সঙ্গে খাপ খায় সেগুলোই বেছে নিতাম। গ্রাম সাহিত্য থেকে অশ্লীল বা আপত্তিকর এবং খুব অশ্লীল অংশ কেটে কুটে বাদ দিয়ে আমি তাকে ভদ্র সমাজের উপযোগী করে তুলতাম। আমি কখনো কৃষকের পর্ণ কুটিরে গিয়ে হয়তো একটি লোকগীত শিখতাম…..। যার সুর আমাকে আকৃষ্ট করতো কিন্তু এর বাণী ছিলো স্থূল এবং অস্পষ্ট। তাই আমি এতে নতুন শব্দ যোগ করে শিক্ষিত রুচির উপযোগী করে তুলতাম। কখনো এমনও হয়েছে যে গ্রামবাসী আমাকে একখানা গান দিয়েছে সে শুধু সুরটা জানে এবং গানের দু’চার লাইন মাত্র মনে রাখতে পেরেছে। আমি ওই ভাব বজায় রেখে গানের বাকি অংশটা  তৈরি করে নিয়েছি।’ জসীম উদদীনের এই আধা মৌলিক গানগুলো  খুব মূল্যবান। শিক্ষিত জনসাধারণ এগুলো গ্রহণ করেছে । আর গ্রামীণ জনসাধারণেরও পছন্দ হয়েছে। এভাবেই তা  দুই শ্রেণির কাছেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। 

তিনি  নগর ও গ্রাম, আধুনিক ও সনাতন ধারার বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়ে একটা একক জাতীয় সাহিত্য নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন। তাই তাঁকে পল্লীকবি বলে খন্ডিত না করাই শ্রেয় ।

তাঁর নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেন, ‘জসীম উদদীনের কবিতার ভাব-ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের । প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে।’ তিনি নকশি কাঁথার মাঠ কবিতাকে সুন্দর কাঁথার মতো করে বোনা বলে মন্তব্য করে বলেছিলেন,‘ আমি এটাকে আদরের চোখে দেখেছি, কেনো না এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লী জীবন আমার কাছে  চমৎকার একটি মাধুর্যময় ছবির মতো দেখা দিয়েছে।’ কবিতার জন্য অনেক পুরস্কার আর সম্মান পেয়েছেন কবি। যার মাঝে আছে, প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরমেন্স,পাকিস্তান (১৯৫৮),  রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট ডিগ্রি ভারত (১৯৬৯),  একুশে পদক ১৯৭৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৭৮ (মরণোত্তর)।

১৯৭৬ সালে কবি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী গোবিন্দপুরে তাঁকে কবরস্থ করা হয়।  কবি  যেখানে শুয়ে আছেন, তাঁর শিয়রে একটি ডালিম গাছ আছে।

আমরা এই পল্লীকবিকে নয়, বাঙালির চিরায়ত কবিকে বাঁচিয়ে রেখেছি দু’নয়নের জল আর গভীর শ্রদ্ধায়।

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন