আমার বন্ধু আবু জহির/  নাসিমা আনিস

আমার বন্ধু আবু জহির নাসিমা আনিস

খুব শীত ছিল সেই রাতে, কিন্তু আমাদের হাঁটতে হবে, না হাঁটলে বাঁচার পথ নাই, আমার যেমন তেমন, আসাদুজ্জামানের ডাক্তারি নির্দেশ। পায়ে আমাদের কেড্স, গায়ে গরম কাপড়, ভিতরের পোশাক সত্যি অর্থেই আটপৌরে। গত পঁচিশ বছর ঢাকার বাইরে থাকার সময় যেমন বলতো তেমনি এই ঢাকা বাসের প্রথম সপ্তাহে প্রথমবারের মত আসাদুজ্জামান বলে ওঠে, ‘আমা.. আ.. র বন্ধু আবু জহির’। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি আসলে একজন বন্ধুকে হারিয়ে সে কতটা কাতর। দেখি সেখানে সীমাহীন হাহাকার, শুধুমাত্র বন্ধুর জন্য এই হাহাকার আমাকে তাজ্জব করে না, তবে আমাকে ভাবায় কিছুটা বিমর্ষও করে। গত পঁচিশটা বছর তার এই হাহাকার কি কাতরতার সঙ্গে আমার পরিচয়। চট্রগ্রাম কলেজের প্রভাষক থাকার সময় আসাদুজ্জামানের বন্ধু আবু জহির আমাদের পারসিভাল হিলের বাসায় একবার গিয়েছিল আর আমার যতদূর মনে পড়ে। বিয়ের পরপর তার উর্দু রোডের বাড়িতে একবার দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম । আর খুব মজা পেয়েছিলাম তাদের পারিবারিক কথ্য ভাষা খাইসগাইস শুনে। তারপর বছর বিশ আগে একবার ঢাকায় বেড়াতে এসে তার খোঁজে উর্দুরোড গেলে আবু জহিরকে না পেয়ে এবং বাড়িতে কোচিং সেন্টার দেখে এবং সবশেষে বাড়ি বিক্রির খবর নিয়ে বড় বিষণ্ন ও হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি।  তারপর ‘আমার বন্ধু আবু জহির’ তার অন্তরে যেমন বড় পীড়া দিতো তেমনি আমার শ্রবণে। কি করা যায় বন্ধুর খোঁজ নিতে, একবার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথাও ভেবেছিলাম আমি। খসড়াটা করেছি আমি,

‘ আমার বন্ধু আবু জহির, ইতিহাস,‘৭৭, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উর্দু রোডে যার বাড়ি ছিল’। 

  আসাদুজ্জামানের জীবন থেকে আবু জহির হারিয়ে যেতে যেতে আমার কাছে তাদের গল্পের অনেকটাই জমা পড়ে। এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তাদের নানা গতিপ্রকৃতি গাঁজা, মেয়ে মানুষ আর ভাবী-দেবরের নানা গলিঘুঁপচি পর্যন্ত, যদিও আবু জহির সেখানে নিষ্পাপ, অন্তত বন্ধুপ্রাণ আসাদুজ্জামানের এই-ই বিশ্বাস। আবু জহিরের আর্থিক অবস্থা যেমনি ভালো ছিল তেমনি সুযোগ পেলে সে তা প্রদর্শন করতেও পছন্দ করতো। বন্ধুদের টাকা ধার দিতো আর অন্য বন্ধুদের তা বলে বেড়াতো বিপুল উৎসাহে। ধার দেয়া টাকা ভুলেও ফেরত না চাওয়া ছিল তার ধার দেয়ার বিশেষত্ব। আর বড় আক্ষেপ, এমন কি আসাদুজ্জামানেরও, টাকাপয়সাওয়ালা আলমগীর সদৃশ্য নায়কের মত চেহারার বন্ধু আমার মেয়েদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতো না, বেচারা! 

  তো আমি যেমন, হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় অনেক কিছু করে ফেলি, সেই স্বভাববশতঃ আমি আসাদুজ্জামানকে বলি, এটা তো লালবাগ আর আবু জহিরের নিবাস উর্দু রোডে, হাঁটলেও মাত্র পনের মিনিট, চলো হাঁটা দেই। আসাদুজ্জামান আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায়, মানে এইভাবে তুমি আমার বন্ধু জহিরের বাসায় যেতে চাও! ঘরে পরা সেলোয়ার-কামিজ, সোয়েটার আর শৈত্য প্রবাহকে নস্যাৎ করার জন্য মাথাকান মোড়ানো মাফলার, পায়ে কেড্স! ছিঃ ছিঃ না না! আমি বলি, দূুর, আবু জহিরের সাথে তো আজকে দেখাই হবে না, আজকে শুধু একে ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখবো কোনো হদিস হয় কিনা, মানে তোমার বন্ধু আবু জহির এখনো এই ধরাধামে বেঁচে আছে কিনা, থাকলে তার সাকিন নিবাস জোগাড় করবো, এই তো। কিন্তু উনি মানতে নারাজ, মহাবিরক্ত নিয়ে আমার দিকে চোখ রেখে আপাদমস্তক পরখ করে পুনরায় আবার মাথা নাড়ে। মানে, না না, যাওয়া যাবে না। ভাবটা এমন যে তার বন্ধু আবু জহির উর্দুরোডের তিনতলা বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে, ‘আমার বন্ধু আসাদুজ্জামানের জন্য’, আমরা যাওয়া মাত্র সে আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে উপরে নিয়ে যাবে তারপর আমাদের বলবে, হ্যাঁ, ত্রিশ বছর আগে তোকে যেমন যেমন বলেছিলাম সেই ভবিষ্যত বাণীই সত্যি হলো! 

  কি ভবিষ্যত বাণী? বলছি, আসাদুজ্জামানের বাপদাদারা শিক্ষক ছিলেন, তো সেও শিক্ষক হবেই, এমনকি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ভাইবা বোর্ডেও বাঘা বাঘা শিক্ষকদের একথা জোর দিয়ে বলে এসেছিল। আর আবু জহির তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিল, বস্তুত আসাদুজ্জামান যেখানে যেখানে ইন্টারভিউ দিতে যেতো সঙ্গে আবু জহিরও যেতো, বন্ধুর সান্নিধ্য ছাড়াও সম্ভবত আরো দুইটা কারণ ছিল, এক, একটা চাকরির জন্য সহপাঠিরা কতটা উদ্বিগ্ন আর কাতর তা দেখা, দুই, ফিফথ গ্রেডের ৭৫০ টাকার একটা চাকরি যে তার কাছে কতটা অপ্রয়োজনীয় বা তুচ্ছ সে কথা ভাবে বুঝিয়ে দেয়া, বিশেষতঃ যারা তার কাছ থেকে টাকা ধার নিতো আর পিঠ চাপড়ে বলতো, ‘শালা তুই তো জমিদার’ তাদের মুখে আরেকবার ঐ বাক্যটা শোনা। তো ভাইবা দিয়ে বেরুলে একজন ভবিষ্যত শিক্ষকের পরিবার কেমন হবে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবু জহির ইয়ার্কি কিংবা হয়তো সত্যি সত্যি বলেছিল, ধর তোর কলেজের চাকরিটা হয়ে গেল আর বহু বছর পর তুই গাইবান্ধা কি কারমাইকেল কলেজ থেকে ঢাকায় বেড়াতে এলি কি ডাক্তার দেখাতে এলি, তোর সাথে আমার দেখা হলো, তখন দেখবো না খেতে পেয়ে পেয়ে তোর বউটা, আজকের নাদুস নুদুস নীলা (আসাদুজ্জামানের ডালির্ং )রোগা প্যাকাটে হয়ে গেছে আর বাচ্চাগুলোও রোগা, তুইও খুবই বুড়িয়ে গেছিস, তোকে দেখে আমি চিনতেই পারবো না প্রথমে, ততদিনে মাজাটাও তো খানেক তোর বেঁকে গেছে অভাবে অপুষ্টিতে!

   আমি এবার যাওয়ার জন্য মরিয়া, এখনই যাবো, কোন কথা শুনবো না, রিক্সায় ওঠো! প্রতিহত করার শেষ চেষ্টায় আসাদুজ্জামান বলে ওঠে, আরে ভাংতি নাই, এই দেখো পাঁচ’শ টাকার নোট, রিকশাওয়ালা ভাংতি দিবে না, হাঁটতে বেড়িয়েছি, হাঁটো, আরেকদিন সেজেগুজে যাবো। 

   আমি জোর করে নোটটা নিয়ে ঔষধের দোকানে ঢুকি, নিওটেক আর প্যারাসিটামল কিনে টাকা ভাঙাই তারপর রিক্সায় উঠে বসি। আসাদুজ্জামান বিরক্ত নিয়ে পাশে বসে গজগজ করে। 

  উর্দুরোড, সন্ধ্যা পেরিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ, রাস্তায় বাতি নাই, দোকানপাটও বেশির ভাগ বন্ধ, শুক্রবার বলে হতে পারে কিংবা ওম খুঁজতে ঘরে। আকাশ ছোঁয়া বাড়িগুলোর পাশেই হঠাৎ হঠাৎ খাদ, নাকি আমারই মনে হয় খাদ, কি জানি, বিয়ের পর চট্টগ্রাম প্রথম যাওয়ার দিন সন্ধ্যায় চলন্ত বাস থেকে সীতাকুন্ড পাহাড় দেখে ( কার্তিক মাসের সামান্য কুয়াশা পড়েছিলো পাহাড়ের মাথায়) যেমন লেগেছিল সে রকমের কাছাকাছি একটা অনুভূতি আসে মনে, কেমন ধন্দ লাগে, আবার আবিষ্কারের উত্তেজনা, বাড়িগুলি গুলিয়ে যায়। এই বাড়িতে আসাদুজ্জামান পাঁচ বছরে অন্তত পাঁচ‘শবার এসেছে, কত আড্ডা কত বিরিয়ানি! এখন সেও বাড়ি হাতড়ে বেরাচ্ছে! আসাদুজ্জামান বিহবল হয়ে বহুক্ষণ ‘এ বাড়ি ও বাড়ি, নাহ্ এটা না,’ রিক্সায় বসেই এই সব করে শেষে বলে, চলো ফিরে যাই, দিনের বেলা আসবো। আসাদুজ্জামান পাঁচ’শ দিন এসেছে, মনে হচ্ছে আমিও ততদিনই এসেছি, মাঝখানে বন্ধু বিহনে একটা ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ে গেছে, সব ওলটপালট, তো চিনবো কিভাবে!

   তারপর এক দোকানদার, দোকানদার থেকে মোড়ের পান বিক্রেতা, তার কাছ থেকে বেকারি। সবারই এক কথা, ওরা সব কয়টা ভাই এখানকার বিষয়আশয় একেবারে চুকিয়ে চলে গেছে, কেউ উত্তরা কেউ গুলশান, তাও পনের বিশবছর। তারপর আশ্চর্য একটা ক্লু, ওয়ারিশ ফুপাতো ভাই শুধু মহল্লায়, এখনো মায়ের অংশটুকু আগলে রেখেছে। এবং আমরা তার বাড়ির সিঁড়িতে পা দিতে অত্যাশ্চর্যভাবে তার দেখা পেয়ে যাই, তিনি মাত্রই বাইরে থেকে এলেন। আমরা আমাদের হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুখোঁজের বৃত্তান্ত জানালে তিনি তার বাসায় যেতে অনুরোধ করেন। তারপর সিড়িতেই তার মোবাইলের ফোনবুকে গিয়ে টিপাটিপি করে আসাদুজ্জামানের কানে মোবাইল ফোনটা ছেড়ে মজা দেখতে লাগলেন। কখনো ধরায় অমরাবতী নেমে এলে যেমন অনুভূতি একজন মানুষের চোখেমুখে দৃশ্যমান হবে আমি আর আবু জহিরের কাজিন তাই প্রত্যক্ষ করতে থাকি আসাদুজ্জামানের গালে চোখে কপালে। কনকনে ঠান্ডয় হলুদ ম্রিয়মান সিড়ি ঘরের আলো ডবল টিউবলাইটের  মত ঝলমল করে ওঠে। আমার এতো দিনের প্রতীতি অসত্য নয়, এই তার প্রমাণ! গত বিশ কি তারও বেশি সময় সে আবু জহিরের জন্য সত্যি বড় অস্থির ছিল। একজন অপরিচিত মানুষের মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে সে কয়েকবার বলে, ভাই, আমার মোবাইলে বলি? ভদ্রলোক বলে, আরে না আপনে কথা বলেন, কোন অসুবিধা নাই। তারপর ফোন শেষ করে সে আমার দিকে এবং ভদ্রলোকের দিকে অপার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। মোবাইল ফোনের নাম্বারের সূত্রটুকু নিয়ে আমরা এবার হাঁটতে থাকি, চিকন চিকন ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছোলাঘুঘনি খাই, ধুপিপিঠা খাই, খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া তরুণদের মত কলকল করতে করতে রিক্স্রা খুঁজি। 

  আবু জহির বউ নিয়ে বছর দশেক কানাডা প্রবাস করে বছর খানেক আগে ফিরে এসেছে। যাওয়ার বহু আগে উর্দুরোডের পৈতিৃক বিশাল বাড়ি বিক্রির ভাগের টাকা দিয়ে ধানমন্ডি তিন কাঠা জমি কিনেছিল, এখন ডেভোলাপারদের হাতে। শীঘ্রই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিজ এ্যাপার্টমেন্টে উঠবে। কিন্তু আমাদের লালবাগে ভাড়াবাড়ি বাসের ব্যাপার নিয়ে মোবাইল ফোনেই বিরাট উষ্মা প্রকাশ করে আবু জহির। আমি পুরান্ ঢাকা ছাড়লাম আর তুই গিয়া ঢুকলি, ভাড়াই যখন তো লালবাগ কেন্? আসাদুজ্জামান বলে, ছেলে সিটি কলেজে, মেয়ে বুয়েটে, সব কিছু কাছাকাছি, যানজট এড়ানোই প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু আবু জহির বিরক্ত এবং ওর সোজাসাপটা ভাষা, আমি ছেড়ে আসলাম আর তুই গিয়া ঢুকলি, শালা!

  ফোনেই কথা হলো কয়েক দিন। আসাদুজ্জামান ঢাকায় সরকারি বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষের পদে শেষ মুহূর্তের কলম খোঁচায় না আসতে পেরে কিংবা নিজের অসুস্থতার উপর বিরক্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। আরো চার বছর তার পক্ষে সরকারের গোলামি করা সম্ভব ছিল না এই স্বাস্থ্যহীন স্বজনহীন দূরদেশে। এ সব জেনে আবু জহির উল্লাস দেখায়। এবং এখনো আসাদুজ্জামান ইচ্ছা করলে উন্নত কোন কাজ জুটিয়ে নিতে পারে এ ব্যাপারে আবু জহিরের নিঃসংশয় উক্তি বন্ধুত্বেরই প্রকাশ। 

যেহেতু আটাশ বছর চাকরি পূর্ণ করতে পেরেছে সে কারণে সরকার অবসরকালীন পুরো সুবিধা দিয়েই বিদায় করবে আসাদুজ্জামানকে।  কিন্তু টাকা পেতে তো কয়েকমাস লাগেই, সে ক্ষেত্রে আমাদের ইচ্ছা থাকুক আর না থাকুক ছোট একটা বাসায় কিছুদিন বাস করতে হয়। সেই সময়ই আমরা আবু জহিরকে খুঁজে পাই। যাক্, আবু জহির হঠাৎ একদিন বাসায় এসে হাজির, একা। বউকে নিয়ে কাছেই বিয়ে খেতে এসেছে, সুযোগমত বন্ধুর হালহকিকত জানতে এসেছে। কিন্তু তিনি আমাদের উপর খুশি নন, একই কথা, কি লালবাগ বাসা নিলি, দুনিয়ায় আর জায়গা পাইলি না! নিঃসন্তান আবু জহির আমাদের বাচ্চাদের সাথে পরিচিত হয়ে বরং অনেক খুশি। আর আমরা জানাই আসাদুজ্জামান টাকা পেলে আর আমাদের কুষ্টিয়ার বাড়িটা বিক্রি হলে ঢাকায় শীঘ্র একটা ফ্ল্যাট বুকিং দেবো। আবু জহির খুবই উৎসাহিত হয়, তার কোন ভাই-বন্ধুরা ডেভেলাপার, তাদের সঙ্গেও আমাদের শীঘ্র পরিচয় করিয়ে দেবে বলে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু আমরা হাতে টাকা পয়সা না পেয়ে এত সব হাঙ্গামা করতে চাই না এখনি। কিছুদিন পর সে নিজের বাড়িতে উঠলে আমাদের ডাকবে তার বাড়িটা কেমন হলো দেখার জন্য। সারা বিকাল দুই বন্ধু যে কত কথা হলো তার কোন হিসাব নাই। পুরো গল্পে আমি শুধু আবু জহিরকে খুঁজে পাওয়ার ইতিহাসটুকুতেই হাজির ছিলাম উজ্জ্বল। আর আসাদুজ্জামান বড় কৃতজ্ঞ চোখে আমার দিকে তাকায় বার বার, আহারে! আবু জহির কানাডা গিয়ে কি কাজ করেছে আমরা জানতে চাই না। আবু জহির নিজে বেজায় কালো হওয়া সত্ত্বেও কালো মানুষের বড় নিন্দা করে, (নিউয়র্ক প্রবাসী আমার শ্যামলা ননদও তাই করে, তার শপে ঢুকে তারা কি রকম গুন্ডামি করেছে তার কিছু নমুনা বর্ণনা করে।) আমরা ধারণা করি আবু জহির সেখানে কোন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করতো অথবা পেট্রোল পাম্পে, অথবা হয়তো দুটোতেই। বিদেশ বিভুঁই অনেক অডজব করে মানুষকে টিকে থাকতে হয় । সুতরাং কেউ আগ বাড়িয়ে না বললে জিজ্ঞাসা করা সমুচিত নয় বলেই আমরা মানি।

 আসাদুজ্জামান এবং আমি ভালো বন্ধু, অন্তত বিয়ের পর পঁচিশ বছর, বিয়ের আগে আরো ছয় বছর, মোট একত্রিশ বছর আমরা পরস্পরকে স্বামীস্ত্রীর চেয়ে বন্ধুই বেশি জানি। সংসার জীবনের বহু বহু দিন রান্নাবান্না বাদ দিয়ে আমরা কাফকা মার্কেস কিংবা খলিল জিব্রান কি রাহু চন্ডালের হাড় করে পাউরুটি চিবিয়েছি, সুযোগ পেলে দুজনে ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রাচীন ভারতের আর্য অনার্যরা কত যে জীবন্ত ছিল আসাদুজ্জামনের বয়ানে, মুগ্ধছাত্রী হয়ে বার বার পাঠ নিয়েছি তার কাছে। আমরা ভুলেই যেতাম আমরা স্বামীস্ত্রী। ঢাকা ছেড়ে আমরা দু’জনেই বন্ধু হারিয়েছি অল্প বয়সে, কিন্তু আমি আসাদুজ্জামানের মত হাহুতাশ করে বলতাম না, আমার বন্ধু মাহবুবা, আমার বন্ধু লিপি! কিন্তু ঢাকায় এলে মনে মনে খুব খুঁজতাম। তো আসাদুজ্জামান হুট করে চাকরি ছেড়ে দিলে, পরিবারটা কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় এনে শিকড় উপড়ানো বৃক্ষের নতুন করে বাঁচানোর সাধনায় নামতে হলো দু’জনকেই। আসাদুজ্জামানের হুট করে চাকরি ছাড়াটা আমি অপছন্দ করেছি বলে ওর ধারণা হয়, কি জানি, হয়তো তাই। আসাদুজ্জামানের হয়তো একজন বন্ধু এ সময় খুব প্রয়োজনও, অন্তত আমার তাই মনে হয়, যদিও ব্যক্তিজীবনে তাকে খুবই বন্ধুবৎসল বলা যাবে না। আমার বেসরকারি কলেজের চাকরিটাও সে সময় ছেড়ে আসায় বাড়িতে জ্বলজ্যান্ত দুটো বেকার মানুষ, বলা যায় নিরালম্ব, খানেক বিষাদ, খানেক কষ্টময় সময়। দুই বেকারের গল্প শুনে যে কেউ বোকা হয়ে যেতো, যদিও আমাদের এই পাগলামির দায় একলা চোখমুখ গুঁজে সইতে হয়েছে আমাদেরই। প্রেম বলো, বন্ধুত্ব বলো, মমতা বলো, এসবই আমাদের সংঘাত থেকে রক্ষা করেছে এ সময়। আর সন্তানদের মানুষ করার জন্য আমাদের কাছে বিকল্পও নাই। তো ঘন্টা কয়েকের মধ্যে আবু জহির আমাদের সংসারের যাবতীয় গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করার সুযোগ পায়। 

  মাসখানেক ছেলের এইচএসসি পরীক্ষা, পেনশানের যাবতীয় কাজ সারতে সারতে আবু জহির ঝাপসা হতে বসলে আসাদুজ্জামান একদিন ফোন দেয়। ফোন বেজে হয়রান হলেও আবু জহির ফোন ধরে না। তারপর আরেকদিন ফোন করলে আবু জহিরের স্ত্রী ফোন ধরে জানায় সে ওয়াশ রুমে। ফোন রেখে আসাদুজ্জামান আমাকে বলে, কানাডায় গোসলখানা কিংবা টয়লেটকে ওয়াশরুম বলে? আমি বলি, কেন্, ঢাকায়ও তো কোন কোন অভিজাত রেঁস্তোরার টয়লেটে তাই লেখা থাকে। তারপর দু’একদিন তাদের কথা হতে শুনি কিন্তু আসাদুজ্জামানের সেই অনাবিল মুখশ্রী অনুপস্থিত। ফোনটা শেষ হলে আসাদ অদ্ভুত স্বরে বলে ওঠে, গাধাটা মানুষ হলো না। আমি বলি, কেন কি হইছে? আসাদুজ্জামান বলে, ও সারা জীবন মানুষকে টাকা ধার দিয়ে দিয়ে এখন এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে আমি ফ্ল্যাট কিনবো আর ওর কষ্টে অর্জিত কানাডিয়ান ডলার ধার চাইবো। আমি বলি, ওকে ক্লিয়ার করো যে আমরা ধার দেনা পছন্দ করি না। বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে একটা কিছু ব্যবস্থা করবো। আসাদুজ্জামান মাথা নাড়ে হতাশায়। 

আবার প্রায় ছয়মাস কেউই ফোন দেয় না। এবার আসাদুজ্জামান নিশ্চিত যে আবু জহির ভয় পাচ্ছে। তারপর ও একটা কাজ করে, আবু জহিরকে ফোন দেয়, বলে আমি গ্রীন রোডে একটা ফ্ল্যাট বুকিং দিতে যাচ্ছি। অবাক কাণ্ড! আমি আসাদকে চিনি, সজ্জন সত্যবাদী। ওর এই আচরণে আমি ক্ষুব্ধ  হই। বলি, আবু জহির আর জীবনেও তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবে না, ও এমনিতেই ভয় পাচ্ছিল! আসাদ গম্ভীর স্বরে বলে, তাই তো এ কথা বললাম!

  গ্রীন রোড এলিফেন্ট রোড ফ্ল্যাট দেখে দেখে শেষ পর্যন্ত আমারা ফ্ল্যাট কেনার  পরিকল্পনা বাদ দেই, সিদ্ধান্ত নেই, উত্তরার গ্রামাঞ্চল বাউনিয়ায় আমার বাপের দেয়া যে অনেকটা জমি আছে তাতে ছোট্ট করে বাড়ি করবো আর কুষ্টিয়ার বাড়ির মত অনেক গাছ লাগিয়ে পাগলা করে দিব চারধার। কিন্তু এখন আসাদুজ্জামানেরর এই আচরণে আমি বিরক্ত, বন্ধু পেয়েও হারালে! আর কোন যোগাযোগ নাই। হঠাৎ আবু জহির ফোন দেয়, মোবাইল বেজে বেজে হয়রান হয়, আসাদুজ্জামান ধরে না। একি ব্যবহার! এটা তার স্বভাবের সাথে যায় না! তার দিন দুই পর আমাকে ডেকে একটা ভালো শাড়ি পরতে বলে আসাদুজ্জামান, কিনা, সে এখন আবু জহিরের বাসায় যাবে। আমি বলি কিভাবে যাবা, ঠিকানা কৈ?  ‘আছে, প্রথম দিনই কার্ড দিয়েছিল। আমি যেতে অস্বীকার জানালে আমায় বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করায়। আমি বলি, ফোন দাও, গিয়ে যদি না পাও? ও বলে, ফোন দিলে বলবে, দোস্ত আমি তো উত্তরা কিংবা টঙ্গী, তার চেয়ে একবারে কলিং বেল টিপে ঘরে ঢুকবো, শালাকে বলে আসবো আপাতত ঘরবাড়ি কেনার কোন পরিকল্পনা নাই, কোন দিন তোর কাছে টাকা ধার করি নাই, করবোও না, তুই ভয় পাস না, আর বাসা পাল্টে বড় বাসায় উঠছি, বউ নিয়া বেড়াইতে আয়। 

 আমি ভালো শাড়ি পরি, আসাদ পরে নতুন শার্টপ্যান্ট। একটা সিএনজি নিয়ে চলে যাই। দরজায় লেখা, তিনতলা ‘ মোঃ আবু জহির। কলিং বেল টিপে টিপে হাত ব্যথা করলেও কেউ দরজা খোলেনা। আমি বিদ্রুপ করে বলি, ও জানলো কিভাবে আমরা আসছি? আসাদুজ্জামান খুব হাসে, বলে, যারা ধার দেয় তাদের জানতে হয়! এবার ফোন দেয়, তুই কই? মহাখালিতে কি? আমি তোর দরজায় দাঁড়ায় রইছি বউ নিয়া, না ফ্ল্যাট কিনি নাই, বুকিং দিছি….. আচ্ছা আরেক দিন আসবো….. 

 আমি বিস্মিত হই, কথার শুরুতেই আবু জহির ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে প্রশ্ন করে, আসাদুজ্জামানেরও উত্তর  বুকিং!

  অবস্থা তো সত্যি ভীতিকর!   

  দারোয়ান বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে গেটের ছোট্ট দরজাটা খুললে আমিই কাছে গিয়ে ফিশফিশ করে জিজ্ঞাসা করি, আবু জহির সাহেব বাসায় আছেন? দারোয়ান সিগারেট লুকানোর ভান করে বলে, স্যারে তো কতক্ষণ আগে বাড়ায় গেছে।

  সিএনজিতে উঠে আসাদুজ্জামান বলে, চাকরি পেয়ে প্রথম চিটাগাং যাওয়ার সময় ভাইয়ের কাছে টাকা চাইতে খারাপ লাগছিল, আবু জহিরের কাছ থেকে চার’শ টাকা ধার নিয়েছিলাম, কিন্তু পরের মাসে বেতন পেয়ে নিজ হাতে তা শোধ করেছি। 

    আসাদুজ্জামানের চোখেমুখে বিষাদ। 

    কিন্তু কখনো ও আমাকে একথা বলে নাই। আমি স্বাভাবিক সুরে বলি, আবু জহির তোমার ফ্ল্যাট না কেনা পর্যন্ত খুব ভয়ে ভয়ে আছে, তোমার উচিত হবে তাড়াতাড়ি একটা কিছু করা। আসাদুাজ্জামান বিরস স্বরে বলে, আবু জহিরের জন্য আমি ‘বুকিং’ শব্দটিই ফাইনাল করেছি, তারপর ও আসে আসুক না আসলে নাই, জেনে শুনে বন্ধুকে বিপদে রাখা যদিও সৎ বন্ধুর কাজ না!

নাসিমা আনিস