ভাঙনে ফোটা ফুল / আফরোজা পারভীন
ভাঙনে ফোটা ফুল / আফরোজা পারভীন
রমজান সেই সাত সকালে ঘুম থেকে উঠেছে। সাতসকালে না উঠে উপায় নেই। গ্রামে আজকাল কাজ পাওযা যায় না। এখন ফসল বোনারও সময় না, ফসল কাটারও না। তাই ক্ষেতে কোন কাজ নেই। দু’ এক মাস আগেও বড় বড় গৃহস্থরা নানান ধরণের কাজ করাতো । কেউ বাগান পরিষ্কার করাতো , কেউবা ঘরদোর ঠিকঠাক করাতো, কেউ মাটি কাটাতো, কেউ কাঠ চেরাই করাতো, কেউ নতুন ঘর বাধতো। গৃহস্থ বাড়িতে কত রকম কত কাজ। কিন্তু আজকাল যেন সবই বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদিন কাঁধে কোদাল আর ঝোলা হাতে কুড়ুল নিয়ে ঘুরেও কোন কাজ পায় না। গ্রাম এখন শহর হতে চলেছে। কাঠে রান্না করে মুষ্টিমেয় দু‘চারজন। ঘরে ঘরে ইলেকট্রিসিটি। পাকা ঘরদোর উঠছে তাই ঘর বাঁধার কাজ আর নেই । বেড়া বাঁধার কাজও চলে গেছে একই কারণে । এখন সবাই বাড়ির চারধারে পাকা দেয়াল গেঁথে নিশ্চিন্ত হতে চায় । তাই কাজ অনেক কমে গেছে। তার পরেও যেটুকু কাজ আছে তাও যেন ইচ্ছে করেই করাতে চায় না গৃহস্থরা। ট্যাক থেকে পয়সা বের করতে তাদের বড়ই আপত্তি । তারপর বাড়তি হচ্ছে দুপুরের একপেট খাওয়া। ওসব ঝামেলায় যেতে চায়না গৃহস্থরা। তাই যতোটা সম্ভব নিজেদের বাধা কামলা দিয়েই কাজ সারতে চায় । বাধা কামলা হবারও অনেক চেষ্টা করেছে রমজান। কেউ নেয়নি । তার বয়স বেশি। একটু কাজ করলেই হাঁফায় , ঘামতে থাকে। অন্যরা যখন পাঁচ কোদাল মাটি তোলে ও তখন তোলে এক কোদাল । অন্যরা যখন দশটা কাজ করে ও তখন করে একটা । তাও ধুঁকতে ধুঁকতে । এমন লোককে পয়সা খরচা করে রাখবে কেন লোকে! তাই বাড়ি বাড়ি ঘুরেই কাজ করছিল রমজান। বৌ কলমিও এর ওর ঘরে ঝিগিরি করে কিছু টাকা পয়সা আনতো মাসান্তে। দিনান্তে আনতো এক থালা ভাত সাথে কিছু তরিতরকারি । কলমিকে ঝিগিরি করতে দিতে বড়ই কষ্ট হতো রমজানের । কারণ তাদেরও তো গৃহস্থী ছিল । ছিল জোত জমা ক্ষেত খোলা। চৌচালা ঘর ছিল, বার বাড়িতে ছিল বৈঠকঘর । নতুন ধান উঠলে নবান্ন হতো। কলমি নতুন শাড়ি পরে নতুন চাল দিয়ে রান্না করা পায়েস বেড়ে দিত থালায় । পরম তৃপ্তির সাথে সে পায়েস খেত রমজান। শীতে পিঠে পুলির ধূম লেগে যেত । কত রকম পিঠে যে বানাতে পারতো কলমি । এক এক সন্ধ্যায় এক এক রকম পিঠে বানাতো কলমি। সারাদিন ক্ষেতে খেটে এসে সন্ধ্যায় কলমির বানানো সে পিঠে অমৃতের মতো লাগতো। রমজান মাঝে মাঝে বলত,
: তুই সারাদিন সংসারে এতো খাটা খাটুনি করিস । তারপর সন্ধ্যায় রোজ রোজ পিঠে বানাবার দরকার কি ?
:সারা বছর তো আর বানাইনে । শীতের এই দুটো মাসই যা । আর তুমি তো একা খাও না। আমি নিজে খাই । বাবা মাকে দিই । পড়শীদের বিলাই । আমি পিঠে খুবই পছন্দ করি । যা বানাই তার অর্ধেক নিজেই খেয়ে ফেলি ।
: তোর একথা ঠিক না। তুই কয় টুকরো মুখে দিস তা আমার জানা আছে । শীতে পিঠে বানাস আর অন্যসময় বুঝি হাত গুটিয়ে বসে থাকিস। মুড়ি ভাজিস, মোয়া বানাস , চাল কুমড়োর মোরব্বা বানাস আরও কতো কি। এমন একটা সন্ধ্যে নেই যে আমি নাস্তা ছাড়া থাকি । অতো রকমারি নাস্তার দরকার নেই। মুড়ি চিড়ে হলেই চলবে । অন্য দশজন যা খায় আমিও তাই খাবো।
: তাই নাকি । সত্যি বলছ তুমি ? এই যে নানান জিনিস বানাই খেতে তোমার ভাল লাগে না?
:তা লাগে ।
: তাহলে…. খিল খিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ত কলমি। আগে পেটকে শান্তি দেবে তারপর অন্য কিছু।
কথায় পারা যেত না কলমির সাথে । কথার পিঠে কথা সাজাতে ও ছিল ওস্তাদ । বাবা মাও কলমির গুণপনায় মুগ্ধ ছিল। সংসারে কূটোটি নাড়তে দিতো না মাকে। কলমি বাড়িতে আসার পর একরকম বেকারই হয়ে গিয়েছিল মা। মাঝে মাঝে বলত,
: বউমা আমাকে টুকিটাকি কিছু কাজ দাও । বসে থেকে থেকে আমার যে শরীরে বাত ধরে গেল।
: আপনি বসে থাকবেন কেন। এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াবেন । নামাজ কালাম পড়বেন। দেখবেন কোনদিক দিয়ে যেন সময় চলে গেছে ।
এমন বউ পেলে কে না খুশি হয় । অথচ এ বউ ঘরে আনতে তাদের কতোই না আপত্তি ছিল । সে কথা মনে করে আজকাল নিজেরাই লজ্জা পান।
কলমির বাবা সোহরাব শেখ বংশ গৌরবে রমজানদের চেয়ে কিছুটা কমতি। জমি জমাও তাদের চেয়ে কম । ছেলে বিয়ে দেবেন নিজেদের চেয়ে উঁচু খানদানে , নিচুতে যাবেন কেন। তাছাড়া রমজানের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আপন চাচাতো বোন রেনুর সাথে । চাচা বাপের সূত্রে পাওয়া জমির সাথে নিজে কিনে আরও অনেক জমি বাড়িয়েছে । তার জমির পরমাণ রমজানদের দ্বিগুণ । আর রেনু বাপের একমাত্র সন্তান । কাজেই জমিজমা শেষ পর্যন্ত সবই রমজানের হবে। দোষের মধ্যে মেয়েটা একটু কালো, তবে নাক নকশা ভাল । কালো তাতে কি, রমজানতো ধবধবে ফরসা। ছেলে মেয়ে বাপের রঙ পাবে ভেবে নিশ্চিন্ত হতে চেষ্টা করেন রমজানের মা।
তবে মনটা একটু খুঁত খুঁত করে। সন্তান যদি বাপের রঙ না পেয়ে মার রঙ পায় তখন কি অবস্থা হবে! কিন্তু স্বামীকে বলে পাত্তা পান না। হেসে উড়িয়ে দেয় স্বামী। সাফ সাফ জবাব দ্যায়, শ্বশুরেরটা আর আমারটা মিলিয়ে রমজানের যা সম্পত্তি হবে তার মধ্যে যদি দু ‘একটা কালো সন্তান জন্মায় তাতে তাদের বিয়ে শাদি আটকাবে না। জমি জমা টাকা পয়সাই সব বুঝেছ।
বিয়ের দিনক্ষণ যখন ঠিকঠাক হবে এমন সময় জানা গেল পূব পাড়ার সোহরাব শেখের মেয়ের সাথে আসনাই চলছে রমজানের। সেও নাকী অনেক দিনের ব্যাপার । জানা গেল হঠাৎ করে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা চলছিল তখন। রমজান কলমিকে নিয়ে গিয়েছিল মেলায় । আগের দিন এটা ওটা কিনতে হবে বলে বেশকিছু টাকা নিয়েছিল মায়ের কাছ থেকে। সেই টাকা নিয়েই গিয়েছিল মেলায় । বহুদিনের ইচ্ছে কলমিকে এটা ওটা কিনে দেবে মন ভরে। কলমিকে কোন দিনই কিছু দেয়া হয়নি।
তিন মাইল হেঁটে কলমিকে নিয়ে গিয়েছিল রথখোলার মেলায় । কারণে অকারণে খিলখিল করে হাসছিল কলমি । আনন্দে ডগমগ করছিল । কলমিকে খুশি দেখে কী ভাল যে তখন লাগছিল রমজানের ! আর সেদিন অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। হাওয়াই মিঠেই রঙ এর শাড়ি পরণে । বেণীর ডগায় একই রঙ এর ফিতা । কপালে গোলাপী টিপ, হাত বোঝাই গোলাপী চুড়ি । সব কিছু ম্যাচ করে সেজেছিল কলমি। রমজান ফিরে ফিরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল। আর ওর সেই বিমুগ্ধ দৃষ্টির সামনে লজ্জায় লাজুকলতা হয়ে উঠছিল কলমি। সে লাজুক কলমিকে দেখতে আরও ভাল লাগছিল রমজানের। রমজান ঠিক করেছিল আজ সে কলমিকে নীল রঙ-এর একটা শাড়ি কিনে দেবে । সাথে ব্লাউজ পেটিকোট ব্রা চুড়ি ফিতে নেলপলিশ লিপস্টিক । ব্রার কথা ভাবতে নিজেই লজ্জা পায় রমজান। কলমি যা লাজুক । ওকী ওর ব্রার সাইজ বলবে ! কিছুতেই বলতে চাইবে না। তবে বলতে হবে। দু’দিন পরে ও কলমির স্বামী হবে। স্বামীর কাছে ব্রার সাইজ বলতে দ্বিধা কী । নীলাম্বরী শাড়ি কেনার স্বপ্নে বিভোর হয়ে কলমির হাত ধরে হাঁটতে থাকে রমজান। স্থান কাল পাত্র ভুলে যায় । চারপাশের মানুষ যে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর ফিসফাস করছে সেটা রমজান বা কলমির চোখেও পড়ে না। তার মধ্যে ওদের গ্রামের মানুষও আছে । আর তাদের চোখেমুখে এই ভাব, ও ব্যাপার তাহলে এই! আচ্ছা দেখি ।
স্বপ্নাচ্ছন্ন দুটো মানুষ প্রবেশ করেছিল মেলা প্রাঙ্গণে। প্রথমে ইতস্তত ঘুরেছিল কিছুক্ষণ । পাঁপড় আর কদমা কিনে খেয়েছিল। নাগরদোলায় চড়েছিল। নাগরদোলায় চড়তে কুসমির সেকী ভয় আর একই সঙ্গে কি অপরিসীম আনন্দ ! নাগরদোলা উপরে ওঠার সময় ভয়ে খামচে ধরেছিল রমজানের সার্ট । আবার নামার সময় সেই মানুষই একেবারে অন্য মানুষ। হাসছিল খিল খিল করে । বাধভাঙ্গা সে হাসিতে গলা মিলিয়েছিল রমজানও । ও সারাক্ষণ কুসমির হাতটা ধরে রেখেছিল । যেন ছাড়লেই মিলিয়ে যাবে। কুসমিও উপভোগ করছিল এ স্পর্শ । তা তার মুখের প্রসন্নতা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। সেও মাঝে মাঝে হাত রাখছিল রমজানের হাতের উপর। যেন ফাল্গুনের এক পসলা হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল রমজানের শরীরে । এ স্পর্শের কোন তুলনা নেই। সারা মেলা এক চক্কর দিয়ে রমজান এসে দাঁড়িয়েছিল শাড়ির দোকানের সামনে । শাড়ি দেখতে শুরু করেছিল । কুসমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ।
: শাড়ি দেখছ যে । চাচির জন্য কিনবে বুঝি?
কী বোকা মেয়েরে বাবা! ওকে নিয়ে মেলায় এসেছে কী মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে। কোন কিছু আশা করতেও শেখেনি মেয়েটা।
রমজান শুধু উল্টে পাল্টে নীল শাড়িগুলোই দেখছিল। একবার ভেবেছিল কুসমিকে জিজ্ঞাসা করবে নীল শাড়ি তার পছন্দ কীনা। পর মুহূর্তে বাতিল করে দিয়েছিল সে চিন্তা। তার যা পছন্দ তাই দেবে কুসমিকে । তার পছন্দেই সাজাবে। তা ছাড়া চিন্তা করে দেখেছে নীল শাড়িতে কখনও দেখেনি কুসমিকে। কুসমির বাবার অবস্থা তেমন ভালো না। খুব বেশি শাড়ি তার নেই। দু চারটে যা আছে তাও বেশ পুরোনো। চওড়া নীল জড়িপাড়ের একটা শাড়ি কিনল রমজান। পুরো শাড়িতে হাজার একটা বুটি। এ শাড়ি কুসমির দুধ রঙ এ যা মানাবে না! কুসমির মনটা একটু বিষণ্ন হয়ে গেল । তাকে সাথে নিয়ে মায়ের জন্য শাড়ি না কিনলেই পারতো রমজান। ও পুরুষ মানুষ । যে কোন সময়ই তো গঞ্জ থেকে কিনে আনতে পারে। শাড়ি কিনে রমজান গেল ব্লউজ পেটিকোটের দোকানে। কুসমির হাত কিন্তু ধরেই আছে । দোকানে যেতে যেতে বলল,
:তাড়াতাড়ি বুকের মাপটা বলে ফেল । ব্লাউজ আর ব্রা কিনতে লাগবে।
: মানে ?
কুসমি লাল । অন্য দিকে হাজার একটা ঝাড়বাতি জ্বলে ওঠে অকস্মাৎ। এ শাড়ি ও তাহলে কুসমির জন্য কিনেছে । আর ও কীনা রমজানকে মনে মনে দোষারোপ করছিল । বড় ছোট তার মন।
: অতো মানে মানে করিস না । তাড়াতাড়ি বল । সুযোগ তো দিলি না। তাহলে আর তোকে জিজ্ঞাসা করতে হতো না।
কুসমি বলতে চায় না, রমজানও নাছোড় ।
:যদি না বলিস আমি কিন্তু এই ভরা মেলায় নিজ হাতে মাপ নিয়ে নেব।
: না না
এবার আর মাপ না বলে পারে না কুসমি । ও যা পাগল ! ওর পক্ষে সবই সম্ভব । হয়তো এই মেলার মধ্যেই.. । ভাবতে গিয়ে সারা মুখে রক্ত জমা হয় । ব্লাউজ পেটিকোট ব্রা কিনেই শান্ত হয় না রমজান। শাড়ির সাথে মিলিয়ে কেনে চুড়ি ফিতে গলার মালা । আলতা লিপস্টিক নেলপলিশও বাদ যায় না। কুসমি যতো দেখে ততোই রোমাঞ্চিত হয় । এ সব কিছুই তার! শুধু তার জন্য!
বাড়ির পথে ফিরছে তারা । অনর্গল কথা বলছে কুসমি । রমজান মুগ্ধ হয়ে শুনছে । এমনিতেই মেলায় ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে দেরি হয়ে গেছে। তার উপর ঈশান কোণে কখন মেঘ জমেছে বুঝতে পারেনি ওরা। হঠাৎ করেই প্রবল বেগে হাওয়া বইতে থাকে । তার প্রথম থাবাতেই যেন সব এলোমেলো হয়ে যায় । কুসমির হাত ধরে ছুটতে ছুটতে এসে এক গৃহস্থ বাড়িতে ঢোকে । গৃহস্বামী বিপদ দেখে ওদের আশ্রয় দেয় । ওরা ভেবেছিল দু’এক ঘন্টার মধ্যে কেটে যাবে ঝড়ের তান্ডব। কিন্তু সে ঝড় চলতে থাকে সারারাত । ভয়ে ঘেমে ওঠে রমজান কুসমি । বাড়ি ফিরে বাবা মাকে কী জবাব দেবে! গৃহস্বামী তাদের স্বামী স্ত্রী ভেবে এক ঘরে থাকার ব্যবস্থা করেছিল । কিন্তু সুযোগ পেয়েও গ্রহণ করতে পারেনি রমজান। বিয়ের পরেই সে পরিপূর্ণ ভাবে চায় কুসমিকে । আজ এই ঝড়জলের রাতের সুযোগ সে নিতে চায় না। সে গৃহস্বামীকে বলে , আপনার মেয়েদের সাথেই ও থাকুক। আসলে আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি।
গৃহস্বামী বেশ খুশি হয়েছিল মনে মনে। ছেলেটা বড় সৎ। ইচ্ছে করলেই এ সুযোগটা সে নিতে পারতো।
ও বাড়ির মেয়েরা অনেক ঠাট্টা তামাসা করেছিল । কিন্তু ঠাট্টা তেমন জমেনি। ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল কুসমি। বাড়ি ফিরে কী জবাব দেবে সে। মেলা দেখার আনন্দ যে এভাবে ম্লান হয়ে যাবে তা ভাবতে পারেনি কুসমি।
পরদিন গ্রামে ফিরে দেখে সারা গ্রামে ঢি ঢি পড়ে গেছে । কুসমির হাত থেকে শাড়ি কাপড় নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল মা। ইচ্ছেমতো এলোপাথাড়ি পিটিয়েছিল । চিৎকার করে কাঁদছিল আর বলছিল,
: এর পরে আর কি তোর বিয়ে হবে। যার সাথে রাত কাটালি তার সাথে থাকলেই পারতি। ফিরে এলি কেন আবার?
রমজানকে মার খেতে হয়নি। তবে সেও পড়েছিল বাবা মার কঠিন জেরার মুখে। আর সেই জেরার মুখেই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল , কুসমিকে ছাড়া সে আর কাউকে বিয়ে করবে না। এ বিয়েতে যদি তার বাবা মা রাজী না হয় সারাজীবন সে অবিবাহিতই থাকবে ।
ছেলের এমন কঠিন কথার সামনে মুষড়ে পড়েছিল বাবা মা
: কিন্তু তোর সাথে যে রেনুর..। ওদের খানদান কতো উঁচু, কতো জমি জমা ওদের।
: ওদের না করে দাও । কুসমির বাবার জমি জমা কম, কিন্তু মেয়ে হিসেবে রেনু কি কুসমির পাশে দাঁড়াতে পারে তোমরাই বলো
এরপর অনেক দেন দরবার চলে, কথা কাটাকাটি হয়। খাওয়া বন্ধ করে দেয় রমজান । এক পর্যায়ে বাড়ি ছাড়ার উপক্রম করে।
বাধ্য হয়ে হাল ছাড়ে রমজানের বাবা মা। ছেলের জন্যই তো সব। সেই ছেলেই যদি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চায় তাহলে কী হবে জমি জমা টাকা পয়সা দিয়ে। কুসমির বাড়িতে প্রস্তাব পাঠায় । আর বিয়ে হয়ে যায় সাত দিনের মধ্যে । এ বাড়িতে এসে সারাটা বাড়ি হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় কুসমি। শাশুড়িকে অবসরে পাঠিয়ে দেয়। শ্বশুর শাশুড়ি এখন কুসমির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমন বউ লাখে একটা মেলে । তাদের কপাল ভাল তাই এমন লক্ষী বউ ঘরে এসেছে ।
দিনগুলো বহে চলেছে তর তর করে। দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল । শ্বশুর শাশুড়ির একটাই খেদ, কুসমির কোলে কোন সন্তান এলো না। কতো ডাক্তার কবিরাজ কতো পানি পড়া। এই খেদ নিয়ে এক সময় মারা গেলেন শাশুড়ি । দু‘বছরের মাথায় শ্বশুর। বড় একা হয়ে পড়ল কুসমি । এতো বড় বাড়িতে তার বুক খা খা করে । একে সন্তান না হবার যন্ত্রণা তার সাথে যোগ হলো শ্বশুর শাশুড়িকে হারানোর যন্ত্রণা। বিষণ্ন দিন কাটায় কুসমি। এর মধ্যে ঘটে গেল চরম বিপর্যয় । কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে ভাঙতে ভাঙতে নদী এগিয়ে আসছিল কাছে। সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে জেগে উঠেছিল রমজান কুসমি। চোখ ডলতে ডলতে বেরিযে এসে যা দেখেছিল তাতে হতবাক। নদীর পাড় ভাঙতে ভাঙতে এসে পড়েছে বারবাড়ি পর্যন্ত। এখনই ভেঙে পড়বে পুরোবাড়ি। চারদিকে আর্তনাদ । বাঁচাও বাঁচাও সামাল সামাল রব। রমজান কুসমির হাত ধরে ছুটতে শুরু করেছিল পেছন দিকে । যাদের অনেক ছিল, যারা ছিল ধানীপানি গৃহস্থ মুহূর্তের মধ্যে তারা পরিণত হয়েছিল পথের ফকিরে । জমিজমা আগেই অনেকটা চলে গিয়েছিল। যা ছিল এবার তাও গেছে। চোখের সামনে কুসমি শাশুড়ির অতি যত্নে গড়া ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হতে দেখেছিল। কাঁদতেও যেন ভুলে গিয়েছিল কুসমি। পরদিন আরো অনেকের সাথে রওনা হয়েছিল নিরুদ্দেশের পথে। এমন কোথাও যেতে চেয়েছিল যেখানে আশেপাশে কোন নদী নেই। দু’তিন জেলা পার হয়ে এসেছিল সুতানটি গ্রামে। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় আছে তার ভরসায়। আত্মীয় একেবারে বিমুখ করেনি । তার একখন্ড জমিতে
একখানা ঘর বেঁধে দিয়ে বলেছিল,
: থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। খাওয়া দাওয়াটা নিজেরাই খেটে পিটে করতে হবে। অসুবিধা হবে না আশা করি । দুজনই তো মানুষ তোমরা। গ্রামে অনেক ধনী গৃহস্থ আছে। তাদের বাড়িতে কাজ কাম পেয়ে যাবে ।
অসুবিধা হয়নি অবশ্য । শুধু মাঝে মাঝে বুক ভেঙে কান্না আসতো রমজান কুসমির । তাদের এতো ছিল আর আজ তারা পরের বাড়িতে ঝিগিরি করছে , কামলা খাটছে। ভাগ্যিস বাবা মা আগেই মারা গিয়েছিল। নইলে এ আঘাত তারা সইতে পারতো না। কিন্তু একসময় কাজের সুযোগ কমে এলো । এখন আর সারা গ্রাম ঘুরেও কাজ পাওয়া যায় না। ওরা তাই খুব সকালে হাঁটতে হাঁটতে যায় পার্শ্ববর্তী থানায় । সেখানে শ্রমবাজার আছে। সে বাজারে বসে থাকে। লোকজন আসে, দামদর করে তাদের নিয়ে যায়। দিন শেষে দুজন আলাদা আলাদাভাবে ঘরে ফেরে । আর সেই রাতে হাড়ি চড়ায় কুসমি। সারাদিন পরে জোটে দুটো শাকান্না।
হঠাৎ তন্ময়তা ভাঙে রমজানের । সেভাবতে ভাবতে কোথায় তলিয়ে গিয়েছিল। কতো দেরি হয়ে গেছে । আজ শ্রম বাজারে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। লোকজন যদি কামলা ঠিক করে আগেই নিয়ে যায় তাদের কাজ জুটবে না। কুসমি ততোক্ষণে পান্তা ভাতের থালা এনে নামিয়ে দেয় রমজানের সামনে ।
: তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে কাজে যাও। বেলা হয়ে গেছে। অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হবে। আজ আর আমি যাবো না। শরীরটা খারাপ লাগছে ।
হন হন করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে রমজান । আজ সত্যিই দেরি হয়ে গেছে। রোদ চড়ে গেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে । হাঁটছে আর ঘামছে। অনেকটা রাস্তা পার হয়ে এসে থামে শ্রমবাজারে।
শ্রমবাজারে বসে আছে রমজান। লোকজন আসছে। বেছে বেছে লোক নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রমজানকে পছন্দ করছে না কেউ। রমজান দু ‘একবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বলেছে , আমাকে নেন, আমি এক্সপার্ট লোক। অনেক দিন ধরে এ লাইনে কাজ করছি।
: না না বাপু তুমি রোগা লোক। নিশ্চয়ই কোন রোগ আছে। তোমাকে দিয়ে হবে না।
: বিশ্বাস করেন স্যার, আমার কোন রোগ নেই্
কেউ কর্ণপাত করলো না রমজানের কথায়। একে একে শ্রমবাজার শূন্য হয়ে পড়ল ।পছন্দের লোক নিয়ে যে যার মতো চলে গেছে। শুধু তার মতো দু একজন কাজ পায়নি। তারাও বেলা দুটো অবধি বসে থেকে চলে গেছে। এতোবেলায় আর কেউ তাদের কাজে নেবে না। কিন্তু রমজান নড়ে না । মূহ্যমানের মতো ওখানেই বসে থাকে। এইযে সে কাজ পেলো না আজ আর বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না। দুটো প্রাণীর কারোই খাওয়া হবে না। না খেয়ে থাকলে শরীর আরো দুর্বল হবে। কালও সে কাজ পাবে না। কী পরিণতি হবে তাদের দুজনের!
বেলা বেড়ে চলল। মাথার উপর তপ্তরোদ। সে রোদে তেতে উঠল সারা শরীর । ঘাম ঝরতে লাগল । রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কেউ কেউ অবাক হয়ে তাকালো রমজানের দিকে । লোকটা কি পাগল নাকী! এতো রোদে এভাবে কেউ বসে থাকে। একসময় রোদ ফিকে হয়ে এলো। ফিকে আরও ফিকে । সন্ধ্যা নামছে। রমজান ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরল । বাড়ির উঠোনে যখন সে পা ফেলল তখন অন্ধকার বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। আকাশে একটা দুটো তারাও আছে । উঠোনে পা দিয়েই বুঝল ধোয়ায় ভরে গেছে চারদিক । অর্থাৎ কুসমি চুলো জ্বালিয়েছে । কি রাঁধছে ও ? শাকপাতা। শুধু শাকপাতা দিয়ে কি মিটবে জঠর যন্ত্রণা!
রমজান উঠোনে বসে। পায়ের শব্দ পেয়ে বেরিয়ে আসে কুসমি। এক নজর রমজানের খালিহাত দেখে
: এতো দেরি হল কেন? যাকগে তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে নাও । ভাত হয়ে গেছে । আজ মাছও আছে। কতোদিন মাছ খাইনি বলতো।
: সেকী এসব পেলি কোথায় ? তুইতো আজ কাজে যাসনি।
: তুমি বেরিয়ে যাবার পর শরীরটা একটু ভাল লাগল। ভাবলাম ঘরে বসে থেকে কি হবে। আর একা একা ঘরে বসে করবই বাকি। গেলাম শ্রমবাজারে । ভাল একটা কাজ পেয়ে গেলাম। চাল ডাল মাছ কেনার পরও পয়সা আছে। কাল তোমাকে কাজে যেতে হবে না। কাল তোমার বিশ্রাম।
গোগ্রাসে ভাত খাচ্ছে রমজান । ভাত খেয়ে শরীরে শক্তি সঞ্চয় করতে চাচ্ছে । বার বার তাকাচ্ছে হাত দুটোর দিকে। হাতে কি একটু একটু করে শক্তি বাড়ছে। হাতই যে শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র সম্বল। কুসমি বলেছে, কাল তার বিশ্রাম । উহু তার কোন বিশ্রাম নেই। সে আরও খাটবে । কেটে কিনবে কুসমির জন্য চওড়া পাড় একটা নীল শাড়ী যেমন কিনেছিল রথখোলার মেলায়।
Facebook Comments Sync