nogno

নগ্ন/ মিলা মাহফুজা   

দোষটা আমারই। ভাবনা-চিন্তা না করে কথাটা বলে ফেলেছিলাম। তাই বলে রেহনুমা কথাটা এত সিরিয়াসলি নেবে? আমার সব কথা সবসময় কি সে এভাবে নেয়? আসলে রেহনুমা চান্স নিয়েছে। ওর নিজের মনেই এরকম ইচ্ছে ছিল, তা না হলে আমার মুখের কথা খসে পড়ামাত্র কাজটা করে ফেলত না। 

এখন কি করে এই ঝামেলা দূর করা যায় তা আমার মাথায় আসছে না। কারও সাথে যে আলাপ করব তারও উপায় নেই। জানি তো নিজে কিছু না করলেও অন্যকে পরোপকারের পরামর্শ দেবার লোকের  অভাব নেই। অন্যের বেলায় সবাই খুব দয়া, মহানুভবতা দেখাতে পারে। যাও তার ঘাড়ে দায়িত্বটা চাপিয়ে দিতে তখন কত সমস্যা, কত অক্ষমতার কথা বের হবে সেই মুখ দিয়েই! তাই নিজের জিভ নিজেই চিবিয়ে খাচ্ছি আমি।

রেহনুমা আমার মনোভাবটা পরিষ্কার বুঝতে পারছে। কিন্তু দিব্যি না বোঝার ভান করে যাচ্ছে। উল্টে এমন ভাব করছে যেন আমিই তার ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি। রেহনুমা হলো আমার দেখা সবচেয়ে চতুর মহিলা।

আমার ধারণা ছিল স্ত্রী চালাক-চতুর হলে সংসারের দায়-দায়িত্ব অনেকটা কম নিতে হবে আমাকে। তাই খানিকটা লেগে থেকেই বিয়েটা করেছিলাম। না রেহনুমা, না তার বাবা-মা, কারওরই আমাকে পছন্দ ছিল না। ভেবেছিলাম বিয়েটা আগে হোক তারপর দেখে নেব নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর মজা। কিন্তু রেহনুমা যে সে দড়ি আর কোনদিন খুলতেই দিল না! এখনও ঘুরেই চলেছি, কি এক অদৃশ্য শক্তি যেন আছে, ওর ইচ্ছের বাইরে খুব বেশি দূর আমি আজও যেতে পারলাম না! 

এই যেমন ওর বোন রুহিনার ছেলে পুষণকে নিয়ে ও এখন যা করছে তা আমি মেনে নিতে পারছি না, কিন্তু বারণও করে উঠতে পারছি না। হতে পারে আমি ইমোশনাল হয়ে ওকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। তাই বলে আমাকে তার আজীবনের দায়িত্ব নিতে হবে? 

রুহিনার হঠাৎ মৃত্যুর পর ছোট ছেলেটা কি রকম গুঙড়িয়ে গুঙড়িয়ে কেঁদেই যাচ্ছিল, আর রেহনুমা তার পাশে বসে ছিল কিন্তু ওর কান্না থামানোর কোনো চেষ্টাই করছিল না।  ওকে কেমন যেন প্রাণহীন পাথরের কোনো মূর্তি বলে মনে হচ্ছিল, দেখে আমার ঠিক সহ্য হয়নি। তাই বলে ফেলেছিলাম, রেহনুমা, তুমি এভাবে বসে থাকলে ছোট্ট ছেলেটাকে কে সামলায় বলো? ওর দিকে তাকাও, ওকে কাছে নাও, ওর কান্না থামাও।

মূর্তি থেকে মানুষ হতে রেহনুমার সময় লেগেছিল কয়েক সেকেন্ড, ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার কাছে নেব? সত্যি বলছ? 

আমি ওর ব্যাকুলতায় আর্দ্র হয়ে বলে ফেলি, তুমি ছাড়া আর কে আছে ওর?

ব্যাস হয়ে গেল। রেহনুমা ওকে নিয়ে তো এসেছেই, এখন তাকে আমাদের আরেকটা সন্তান বানানোর চেষ্টা করছে। বাপ-মা হারা এতিম বাচ্চার দায়িত্ব নেয়া মানে তো এই না যে তাকে নিজের সন্তান ভাবতে হবে? ভাবলেও সত্যি সত্যি তো আর সে আমাদের সন্তান হবে না। তাছাড়া এমন তো নয় যে আমাদের কোনো সন্তান নেই। আমাদের ফুটফুটে রাশমি রয়েছে। রাশমি আমার পিতৃত্বের তৃপ্তি পূর্ণ করেছে। রাশমি মেয়ে বলে আমার বা রেহনুমার কোনো অসন্তুষ্টি নেই। তাই জানতাম এতদিন, কিন্তু পুষণকে নিয়ে রেহনুমার বাড়াবাড়ি দেখে মনে হচ্ছে ওর একটা ছেলের মা হওয়া ইচ্ছে ছিল! 

পুষণকে নিয়ে রেহনুমা যা করছে করুক কিন্তু আমাকে দিয়েও তা করানোর চেষ্টাই বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে। পুষণকে এখানে নিয়ে আসতে বলা বড় একটা ভুল বলেই মনে হচ্ছে। হয়ত রেহনুমা ধরে নিয়েছে রুহিনার মতই পূষণকেও আমি একই আন্তরিকতায় নিয়ে আসতে চেয়েছি। কিন্তু রুহিনার ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। রুহিনাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসার আগে ওর সাথে আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। ও বাড়িতে ওই আমাকে সবার আগে ভালভাবে গ্রহণ করেছিল। আর ও ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত একটা মেয়ে। হাসিখুশি আর উপস্থিত বুদ্ধির জন্য ওকে আমিও ভীষণ পছন্দ করতাম। আমার আর রেহনুমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার শ্বশুরমশাই উঁচু পদের সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা। প্রচুর পড়াশোনা ছিল তার। অধ্যাপক হতে চেয়েছিলেন, বাবার অনুরোধে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। কাজের ক্ষেত্রে তার ব্যস্ততা ছিল প্রচুর, কর্মসূত্রে দেশ-বিদেশে ঘোরাঘুরি করতে হতো। বাড়িতে থাকার সময় কমই পেতেন। যখন থাকতেন তখন নিরিবিলিতে বিশ্রাম করতে ভালবাসতেন। নিজে অধ্যাপক হতে পারেননি বলেই বোধহয় একজন শিক্ষককে স্ত্রী নির্বাচন করেছিলেন। পিএইচডি করার সূত্রে রেহনুমা আর রুহিনাকে নিয়ে আমার শাশুড়ি দীর্ঘসময় ইংল্যান্ডে ছিলেন। আমার ধারণা সেখান থেকেই আমার শাশুড়ির ব্যক্তিত্বে আভিজাত্য সংক্রমিত হয়েছিল। তিনিও রানীর মতো ধীর স্থির ভাবে কথা বলতেন, চলাফেরা করতেন। খানিকটা গাম্ভীর্য তাঁর আচরণে আভিজাত্যের পালক যোগ করেছিল।

মার কাছ থেকেই রেহনুমা নিচু স্বরে কথা বলা, নিঃশব্দে চলাফেরার অভ্যাস পেয়েছে সম্ভবত। কিন্তু রুহিনা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। গলা খুলে হেসে ওঠা, দুপদাপিয়ে এঘর ওঘর করে বেড়াতে সে ভালবাসত।  কে জানে কেন আমার শাশুড়ি কিংবা রেহনুমা ওকে কিছু বলত না। রেহনুমার সাথে বিয়ের আগে আমি রুহিনাকে খুব একটা দেখিনি। যেটুকু দেখেছিলাম তাতে ওর সম্পর্কে ভিন্ন কোনো ধারণা করার সুযোগ ছিল না। রেহনুমার মা-বাবা কেউই আমাকে পছন্দ করেননি। ব্যবসায়ীর সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়া আর তাকে সমুদ্রের জলে ফেলে দেয়া বোধহয় তাদের কাছে সমার্থক ছিল। আর আমিও ঠিক আমার শিক্ষা-দীক্ষা বা জ্ঞানের খুব ভাল উদাহরণ তাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারিনি, যেটুকুও আছে। তবে বিয়েটা আমাদের মহা সমারোহেই হয়েছিল। ক্ষমতাবান শ্বশুরের কল্যাণে দেশখ্যাত বিশিষ্ট মানুষেরা আমাদের বিয়েতে আর্শীবাদ করতে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের কাছে আমার শ্বশুর এবং শাশুড়িকে একটু নিচুকণ্ঠে আমার পরিচয় বিবৃত করতে হয়েছিল। 

সেটা দেখে আমি রেহনুমার দিকে তাকিয়ে কৌতুক বোধ করছিলাম। বিষয়টা ওকে কতখানি আলোড়িত করছে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। ওর সৌম্য শান্ত চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়ার ছাপ বোঝা স্বয়ং ব্রহ্মার অসাধ্য। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানেও রুহিনার উপস্থিতি খুব সাধারণই ছিল। পার্থক্যটা টের পাই রেহনুমাকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্যে শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময়। রুহিনার আশ্চর্য প্রাণময়তায় আমি নতুনভাবে প্রণোদিত হলাম। সম্ভবত রুহিনা মাঝখানে থাকার কারণে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথেও সম্পর্কটা সহজ বা স্বাভাবিক হলো। অনির্ধারিত আনন্দভ্রমণ বা হুটহাট হোটেল-রেস্তোরায় সকলে মিলে খেতে যাওয়ার মতো কিছু স্বভাববিরুদ্ধ কাজও তারা করতে আপত্তি করতেন না। রেহনুমা আমার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকত মাঝে মাঝে। একদিন তো বলেই ফেলে, তুমি যাদু জানো।  আমি রসিকতা করি, যাদুটোনা না জানলে তোমাকে কব্জা করতাম কীভাবে? রেহনুমা ভ্রু কুঁচকায়। এখানে কব্জা শব্দটার ব্যবহার ওর কাছে অমার্জিত। ইচ্ছে করেই বলেছি। খোলস ছেড়ে একটু একটু করে আমার আসল চেহারাটা বের করার কোনো সুযোগ বাদ দিই না। বেশিদিন সদাসতর্ক হয়ে মার্জিত ভাষায় কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব না।  রেহনুমার ভ্রু সোজা হওয়ার আগেই রুহিনা সেখানে উপস্থিত হয়ে হেসে কুটি কুটি হতে হতে বলল, দারুণ শব্দটা কব্জা। কিন্তু আমার ধারণা আপনি এখনও রেহনুপাকে কব্জা করতে পারেননি। যেদিন পারবেন সেদিন আমি ঠিক বুঝতে পারব। চালিয়ে যান, ভাইজান।

রুহিনা আমাকে ভাইজান বলেই ডাকে। প্রথমদিন কি একটা কথায় ঠাট্টার ছলে ভাইজান সম্বোধন করেছিল। সেটা ওর নিজের কাছেই এত ভাল লেগে যায় যে আমার অনুমতি নিয়ে সে ডাকই চালু রেখেছে। ইদানিং রেহনুমার আড়ালে আমরা মাঝে মাঝে অমার্জিত ভাষায় কথা বলে মনের সুখ করে নিই। রুহিনা বলে, এই জন্যেই তো আপনাকে ভাইজান ডাকি। একই রকম গেয়ো ব্লাড আমাদের। 

একেবারে গেয়ো বলে দিলে? কিন্তু আমি তো না হয় একটা গেয়ো শালি অন্তত পেয়ে আড়ালে হলেও মনের সুখের কথা বলতে পারি। কিন্তু তোমার তো কোনো রাজকীয় মানে এলিট ক্লাসের পুরুষের সাথেই বিয়ে হবে। কি করবে তখন?  রুহিনা খিলখিল করে হাসে, তাকেও নামিয়ে নেব ঠিক। 

রুহিনাকে সেটা করতে হয়নি। তার এলিট ক্লাশের পুরুষের সাথে বিয়ে হবে না- এমন সেদিন ভাবা অবিশ্বাস্যই ছিল। কিন্তু এর মাত্র সাত মাস পরে একদিন হঠাৎ আমার শ্বশুর অফিসিয়াল মিটিং-্এর মধ্যে হার্ট এ্যাটাকে সেখানেই শেষনিঃশ্বাস ফেলেন। আর আশ্চর্যজনক হয়ে দেখলাম, তাঁর মৃত্যুর দু‘সপ্তাহ যেতে না যেতে রেহনুমাদের দুই চাচা গম্ভীরমুখে ঘন ঘন তাদের বাড়িতে আসতে থাকলেন, যা আগে তেমন ছিল না। একদিন বিষণ্ন রেহনুমার কাছে শুনলাম তারা আসছেন, ভাইয়ের সম্পত্তির হিসাব নিতে, তাদের প্রাপ্য অংশ বুঝে নিতে।

এতকাল সাংসারিক বা বৈষয়িক সামান্যতম ঝামেলা থেকেও দূরে থাকা আমার শাশুড়ি রেহনুমার চাচাদের এই অভব্যতায় ভীষণ মুষড়ে পড়লেন। ল ইয়ারের কাছে ছুটোছুটি করে দুই মেয়ের জন্য সম্পত্তি রক্ষা করতে চেষ্টা নিলেন। সবটাই ছিল তার জন্যে কঠিন পরীক্ষার মতো। দু-বছরের মধ্যে ফেল করলেন তিনি। বাথরুমে পা পিছলে বিশ্রিভাবে পড়ে গিয়েছিলেন, মাথার পিছনদিকটা ফেটে গিয়েছিল। হাসপাতালে নেয়া অনর্থক হয়। সে খবর পেয়ে দুই চাচা সপরিবারে বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। রুহিনার জন্যে তারা একটা কামরা অবশ্য রেখেছিলেন। ওই মুহূর্তে যে দৃশ্যটা তৈরি হয় তা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। 

রুহিনা তার বোনকে আঁকড়ে ধরে এই থরথর করে কাঁপছিল। খুব ভয় পেয়েছিল রুহিনা। রুহিনার ওই চেহারা আমার অসহ্য লাগে। ওকে নিয়ে আসি আমাদের বাড়িতে। আর তো কোনো পথও ছিল না। রেহনুমা সেদিন চোখে কান্না আর ঠোঁটে হাসি নিয়ে আমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়েছিল। 

কিছুদিন পরে, রুহিনাও ক্রমে শক্ত হয়ে উঠছিল, সে পাঠ্যবিষয় বদলে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করে। মুখে কিছু বলেনি কিন্তু সে যে তাদের বাবা-মায়ের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে নামবে ভবিষ্যতে সেটা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল।

আমাদের দিনগুলো আগের মতো হতে পারছিল না, তবে কখনও কখনও রুহিনার সাথে একটু আধটু ঠাট্টা ইত্যাদি চলত। এসময় আমাদের মেয়ে রাশমির জন্ম হলো। রুহিনা শুরু থেকেই রেহনুমার পাশে মায়ের মমতায় উপস্থিত থাকে। রাশমির জন্মের কিছুদিন পর রেহনুমার কি যে হলো কে জানে, রুহিনাকে বলল বিয়ে করে ফেলতে। রুহিনা মনে কষ্ট পেল। বোনের কথার প্রতিবাদ করল না। খালি জানাল, তার নিজের পছন্দ আছে। আর বিয়ে করার জন্যে তাকে কিছুটা সময় দিতে হবে। 

রুহিনার পছন্দ আছে! এত বড় খবর আমাকে না জানানোয় আমি একটা জোর ধাক্কা খেলাম। তাহলে আমি সত্যিই ওদের আপন হতে পারিনি? এতকিছু করার পরও!  বুকের ভেতর রাগ তিড়বিড়িয়ে উঠলো, তবু কিছু বললাম না। এরপর রুহিনার সাথে আমার সম্পর্কটা ক্রমশ দূরের হতে থাকল। আমার ভেতরে রাগ বরফের মতো জমাট বেঁধে থাকল। বছর খানেক পরেই রুহিনা আর কায়কোবাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করল রেহনুমা। রেহনুমা আমাকে কোনো আয়োজন করার জন্য বলল না, দুই বোনের এই সব অদ্ভূতুড়ে আচরণে আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। কেন ওরা এরকম করছে? অনেক ভেবেও পাইনি আমি। ভেবেছিলাম আমাকে যখন কিছু বলছে না, তখন আমারও গায়ে পড়া হয়ে কিছু করতে যাওয়া উচিত না। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমার ভেতরের গেয়ো মানুষটা জেগে উঠল। অভিভাবকের ভূমিকা নিলাম যেচেই বলা যায়। নইলে কোথায় যেন আমার মান থাকছিল না! বেশ ভালই আয়োজন করলাম বিয়ের। কায়কোবাদের সঙ্গে বিয়ের কেনাকাটার সূত্রে বেশ হৃদ্যতাও হলো। ছেলেটা বেশ, যথেষ্ট স্ট্রাগল করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বভাবে শান্ত, একটু চাপা স্বভাবের। আমি একটু ভাবিত হই, রুহিনার মতো দিলখোলা মেয়ে কায়কোবাদের মতো ছেলেকে পছন্দ করল!

গত কিছুদিন যাবৎ রেহনুমার আর রুহিনার নতুন নতুন রূপ দেখে বুঝে গেছি নারীর মনোজগৎ সত্যিই বিচিত্র এবং রহস্যময়। তাকে বোঝার চেষ্টা অনর্থক পরিশ্রম। আমি চাইলেও রেহনুমা আয়োজন যতটা ছোট করা সম্ভব তাই করবে স্থির করল। এমনিতে তাদের আত্মীয়দের অর্ধেকের সঙ্গে সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধে সম্পর্ক খারাপ হয়েই ছিল। তাই আমন্ত্রিতের সংখ্যা কমই হবে। অন্যদিকে কায়কোবাদের সামর্থ্যর কথা স্মরণ করিয়ে নিজেদেরও বেশি বাহুল্য দেখানো ঠিক না  একথা বারবার বলেই যাচ্ছিল রেহনুমা। আর আমার মনে পড়ছিল রেহনুমার বিয়ের আয়োজন তার বাবা-মা কত বর্ণিলই না করে করেছিল। কায়কোবাদকে নিয়ে রুহিনার সাথে আমার সম্পর্ক শীতল ছিল। কিন্তু আমার এও মনে পড়ছিল আমার বিয়ের সময় রুহিনার পজিটিভ ভূমিকার কথা। তাই সব মন খারাপ ঝেড়ে ফেলে, রেহনুমার ভ্রু কোঁচকানো উপেক্ষা করে, আমি আয়োজনটা বেশ জাঁকজমকের করে তুললাম।     

গায়ে হলুদের দিন সকালে রুহিনা আমার কাছে আসে, ভাইজান, চলে যাচ্ছি, আর রাগ করে থাকবেন না। ভীষণ কাতর চাহনি মেলে কথাটা বলে রুহিনা। 

আমি হেসে বলি, চলে না যেতে হলে কি আমার রাগ করে থাকাটা ঠিক হতো?

রুহিনা ম্লান হাসে। বলে, আপনার কাছে তো আমার ঋণের শেষ নেই। শেষ করতেও চাই না।  

সন্ধ্যায় পার্লার থেকে সেজে মঞ্চে বসে রুহিনা। ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ফুলের গহনায়। আমার বুকের মধ্যে কষ্ট হয়। মনে হচ্ছে কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে। রেহনুমা জোর করে আমাকে নিয়ে যায় রুহিনার কপালে প্রথম হলুদ ছোঁয়াতে। আমার হাত কাঁপে। রুহিনা মুখ নিচু করে থাকে। ও কান্না চাপার চেষ্টা করছে। কিন্তু রেহনুমা যেই ওর গালে গাল ঠেকাল তখনই অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ল রুহিনা। যেন বহু বছরের সঞ্চিত কান্নার আজ বাঁধ ভেঙেছে। সবাই বেদনাহত হয়ে পড়ে। ওদের জীবনের দুঃখকথা কারও অজানা ছিল না। অনুষ্ঠানটা আর প্রাণ ফিরে পায় না। যদিও নিয়ম মেনে সব কিছুই হয়। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে বেশ রাত হয়ে যায়। 

সেই রাতে আমার ঘুম আসছিল না। জীবনের বিচিত্র গতিপথের কথা চিন্তায় আসছিল বারবার। কারও সাথে একটু কথা বলতে পারলে ভাল লাগত, কিন্তু রেহনুমা অন্যত্র ব্যস্ত। সে সশব্দে কাঁদছে না বটে তবে তার ভেতরটা কান্নায় চুরচুর হয়ে যাচ্ছে।  দু-একবার ওর কাছে গেলাম, কিন্তু বুঝলাম ওর অতলান্ত দুঃখ-কষ্টে লাগানোর মতো কোনো মলম আমার নেই, একমাত্র সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়া ছাড়া। 

অনেকটা রাত করেই ও শুতে আসে, আমি ওর একটা হাত নিজের হাতের ভেতর ধরে রাখি। রেহনুমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ওকে বুকে টেনে নিই। একসময় রেহনুমা ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ঘুম আসে না। দরজা খুলে ব্যালকনিতে যাই, একটা সিগারেট খেলে নার্ভ শান্ত হবে। দরজা খুলে দেখি চারদিকে জ্যোৎস্নার অপার বিস্তার, এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। একটু যেন বিষণ্নতা মেশানো আজকের জ্যোৎস্না। ইচ্ছে করল রেহনুমাকে ডেকে জ্যোৎস্নার এই রূপ উপভোগ করি। কিন্তু ওর এখন ঘুম দরকার। 

আমার সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করে না। আমি ঘর ছেড়ে ছাদে চলে আসি, জ্যোৎস্নাস্নানে শান্ত হব বলে। ছাদে কিছু গাছ আছে। গাছের নিচে জ্যোৎস্নার আলো পড়েনি, অপার্থিব এক অন্ধকার সেখানে নিঃশব্দে বসে আছে। আমি চাঁদের দিকে তাকাব বলে মুখ তুলছিলাম। হঠাৎ মনে হলো ওই অপার্থিব অন্ধকার যেন বাস্তবতা, কারও অস্তিত্ব আছে। একটু গা ছমছম করে আমার, দু’পা পিছিয়ে আসি। আমার স্থির দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে ওঠে কিছু একটার নড়াচড়ায়। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে এক ছায়া। ছায়া মানুষ। স্থির হয়ে দাঁড়ায় সেখানে। আমি ধাতস্ত হয়ে দেখি সেখানে একজন নারী। এগিয়ে যাই, এখানে কী করছ তুমি, রুহিনা?

রুহিনার দু’কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে প্রশ্ন করি। রুহিনা আধিভৌতিক স্বরে বলে, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। 

আমি ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি, না, রুহিনা, না। এমন ভাবছ কেন? কী হয়েছে তোমার?

-আমি জানি না। রুহিনা কাঁপতে কাঁপতে বলে। 

এক টুকরো মেঘ জ্যোৎস্না গিলতে থাকে। ছাদ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসতে থাকে। আমি রুহিনাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে টের পাই কি যেন এক শূন্যতা আমাকেও আষ্টেপৃষ্টে জড়াচ্ছে। আমি কাতর হয়ে বলি, না, রুহিনা, না।

আমি রুহিনার মুখটা দেখার চেষ্টা করি।

 

রুহিনার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরে একদিন ওরা দুজনে আসে আমাদের বাড়িতে। কায়কোবাদ জানায়, ওরা পরদিনই চলে যাচ্ছে লন্ডন। হানিমুন তো হবেই, তবে ওরা দুজনে ওখানে পড়াশোনার জন্য থেকে যাবে। আগে থেকেই সেরকম ব্যবস্থা করা আছে।

আবার আমি ধাক্কা খাই। এ তো রীতিমত প্রতারণা! আমাকে সব গোপন করার মানে কী? বহু কষ্টে কায়কোবাদের সামনে নিজেকে সামলাই। নিজের ভেতরের ভাঙচুর সামলাতে সে রাতেই কক্সবাজার চলে যাই। 

তারপর দিন গেছে দিনের মতোই। রেহনুমা নিজেকে সামলে নিয়েছে। আমিও কাজের চাপে, সময়ের প্রলেপে ভুলে গেছি সেসব কথা। রেহনুমা কবে একদিন জানিয়েছিল- রুহিনার ছেলে হয়েছে। আমি ওদের কোনো বিষয়ে থাকতে চাইনি। 

রাশমি বড় হচ্ছে আর আমাদের সংসারে হাসি আনন্দ ফিরে আসছে। রাশমি সারাক্ষণ কলকল করে কথা বলে মাতিয়ে রাখে সবাইকে। আমিও রাশমি ছাড়া বেশিক্ষণ ভাল থাকতে পারি না। ওর টানেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি রোজ। রেহনুমাও বেশ সহজ হয়ে উঠেছে। কথা সে চিরকালই কম বলত, এখনও কম বলে, তবে তার চেহারা থেকে বিষণ্নতা, বেদনার ছাপ দূর হয়েছে। মনে হয় সেও ভালই আছে।

আমার জানাটা যে কত ভুল তা জানলাম কিছুদিন পরে, রেহনুমা একদিন বলল, রুহিনারা আসছে।

-এ খবর আমাকে দিলে কেন? 

-অন্য একটা খবর দেবো বলে।

-ওদের কোনো খবর এতদিন যখন আমাকে জানানো হয়নি তখন এখনও আমাকে জানানোর দরকার নেই। প্লিজ ক্লোজ দ্যা চ্যাপ্টার।

রেহনুমার মুখের রেখা বদলায় না। সে নির্বিকারভাবে বলে, রুহিনা ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে। শেষ কটা দিন আমাদের পুরোনো বাড়িটাতে থাকতে চায়। 

অনেক ঝড়ঝঞ্ঝার পর রেহনুমারা তাদের বাবার বাড়িটা নিজের অধিকারে পেয়েছে সম্প্রতি। সেটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাচ্ছিল রেহনুমা, জানি। আমি ওর কথার কোনো উত্তর দিলাম না।

কবে রুহিনারা আসে, তারপর কী ঘটে কিছু নিয়েই আমি আগ্রহ দেখাইনি। রেহনুমা একবার অনুরোধ করেছিল, ওর দিন বেশি নেই, একবার অন্তত দেখে এসো।

রুহিনার মৃত্যুর পর তাকে দেখতে গেলাম। ওর মৃত মুখটা একেবারেই চেনার মতো ছিল না। পুড়ে যেন কয়লা হয়ে গেছে। সরে আসি সহ্য করতে না পেরে। ওর এমন করুণ দশা আমি কল্পনাতেও চাইনি। 

দাফন ইত্যাদি শেষে কায়কোবাদ বলল, তাকে ফিরে যেতে হবে তাড়াতাড়ি।

এই সময়ই ওই ঘটনাটা ঘটে। ওদের ছেলে খুবই ছোট, বছর চারেক বয়স হবে। সে সদ্য মা হারিয়ে খুব আকুল হয়ে কেঁদেই যাচ্ছিল। ওকে মৃত্যু কি তা বোঝানো যাচ্ছিল না, আবার মার কাছেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ওর জন্যে মাতৃসম একজন কাউকে প্রয়োজন ছিল, সত্যটা সয়ে নেবার জন্যে।

সেটা ভেবেই আমি রেহনুমাকে, ছেলেটাকে নিজের কাছে নিতে বলি। 

কিন্তু রেহনুমা যে চালের বোড়ে আমার দিকেই ঠেলে দিয়ে ছেলেটাকে এবাড়িতেই এ বাড়ির সন্তান বানানোর চেষ্টা করবে তা তখন ঘুণাক্ষরেও চিন্তায় আসেনি। 

আমার বিরক্তি প্রকাশে আমি নির্দয় হতে বাধ্য হচ্ছি। আজ সকালেই যেমন রাশমিকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। ওকে স্কুলে ড্রপ করে আমি আমার অফিসে যাব। এই জার্নিটা আমার কাছে খুব আনন্দের। রাশমি প্রাণখুলে হাসে আর গল্প করে। তার জানা আর দেখা সব ঘটনা আমাকে তার বলা চায়ই। ওর বলার মধ্যে এমন এক মিষ্টতা আছে যে সাধারণ কথাও মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়।

রেহনুমা বলল, তুমি রাশমিকে তো নিয়ে যাওই, এবার পুষণকেও নাও, রাশমির আগেই ওর স্কুল। ওকে ছেড়ে রোজকার নিয়মে তুমি অফিসে চলে যেও।

আমার কাছে পুষণকে ভেড়ানো নতুন চেষ্টা, একটুও দ্বিধা না করে বললাম, পারব না।

রেহনুমা চুপ করে দেখল আমাকে। আমি সিদ্ধান্ত বদলালাম না। রেহনুমা বলল, একটা শিশুতে তোমার কিসে সমস্যা হচ্ছে বলতে পারো?

-পারি, ওকে তুমি রাশমির সমান করার চেষ্টা করছ করো, আমার কাছে প্রত্যাশা করো না। 

-ওর মতো একটা ছেলে তোমার থাকতে পারত।

-আমার ছেলে আর ও তো এক না, রেহনুমা। তুমি খুব বেশি প্রত্যাশা করছ। প্লিজ, আমাকে এ ব্যাপারে আর বিরক্ত করো না।

কদিন পরে লক্ষ্য করলাম, রেহনুমা আর পুষণকে নিয়ে নতুন কোনো ইস্যু তৈরি করছে না। তবে নিজে ওকে নিয়ে বেশ ব্যস্ত আছে। তা থাকুক, ছোট আছে একটু বড় হলে ওর বাবার কাছে পাঠিয়ে দিলেই হবে।

এর ক’দিন পরে, রাতে জ্যোৎস্না প্লাবনে ভাসল চারদিক। রেহনুমা আমাকে বলল, তুমি তো জ্যোৎস্নাস্নান করতে ভালবাস, চল আজ ছাদে গিয়ে জ্যোৎস্নায় ডুব দিই। 

আমি পুলকিত হই। রেহনুমা বলছে এমন কথা! সত্যি বিস্মিত হওয়ার মতোই। কোনো সংশয় প্রকাশ করে পরিবেশ ঘোলাটে না করে বরং ছাদে যাওয়া ভাল। জীবনে যতটুকু আনন্দ পাওয়া যায় তা গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

ছাদের চেয়ার টেবিল থাকে না, আজ ছিল। আমরা সেখানেই বসলাম। মুখোমুখি। আমার মন খুব দ্রবীভূত হয়ে আছে। কথা যোগাচ্ছে না। তাই নীরবেই বসে থাকি। জ্যোৎস্নার গলে পড়া দেখি। আর আশা করি রেহনুমা খুব রোমান্টিক কিছু কথা বলবে। এমন জ্যোৎস্নায় সবাই আপ্লুত হয়। আবেগে ভাসে।

রেহনুমা ছোট করে গলা খাকারি দেয়। যেন গলায় আটকে থাকা কোনো বাধা সরায়। আমি বিপুল আগ্রহে চেয়ে থাকি ওর মুখের দিকে, যে মুখ জ্যোৎস্নার আলোতে একটু আবছা হয়ে আছে। পলের পর পল যায়, রেহনুমা চুপ করেই থাকে। আমি ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করি। আজ নিশ্চয় বিস্ময়কর কিছু মুহূর্ত আমার জীবনের অর্জন হয়ে থাকবে।

আমি আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা রেহনুমার মুঠিবদ্ধ হাতটা ধরতে যাই। রেহনুমা একটু নড়ে উঠে টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ, যা এতক্ষণ আমার চোখে পড়েনি, তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আমার বিস্ময়কে আরও জটিলতায় ফেলে সে বলে ওঠে, রুহিনার ছেলে পুষণ যে তোমারই সন্তান তার প্রমাণ এই কাগজ।

কী শুনছি ভাবার চেষ্টা করার আগেই রেহনুমা আবার কথা বলে, সেদিনও এমনই জ্যোৎস্না ছিল, তুমি রুহিনার কাছে ওর প্রতি তোমার কতর্ব্য কর্মের প্রতিদান আদায় করেছিলে। তারই ফসল পুষণ। কায়কোবাদ সন্দেহ করেনি। কিন্তু রুহিনা জানত। তবু আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে কনফার্ম হয়েই সে আমাকে জানিয়েছিল। আর তাই পুষণকে তার নিজের জায়গায় রেখে যেতেই সে জীবনের শেষদিনগুলো এখানে কাটাতে এসেছিল। তবে তোমাকে বলতে পারেনি, তুমি  তার কাছে যাওনি বলে।

আরও কিছু কথা বলতে থাকে রেহনুমা। আমি আকাশের দিকে তাকাই, এক খন্ড মেঘ খুঁজি। 

কিন্তু আজ কোনো মেঘ আড়াল করে না চাঁদ। বরং আরো উজ্জ্বল হয়ে জ্যোৎস্নাধারা গলে গলে পড়ে আমাকে নগ্ন করে রেহনুমার সামনে। 

মিলা মাহফুজা
মিলা মাহফুজা