আমার মুক্তিযুদ্ধ / আফরোজা পারভীন
আমার মুক্তিযুদ্ধ / আফরোজা পারভীন
সেদিনের সেই রাতটা ছিলো ঘোর অন্ধকার। অমন অন্ধকার রাত আমি কমই দেখেছি । পায়ের নিচে পঁচা কাদা। সেই কাদার মাঝে কিলবিল করছে অজস্র জোঁক। তার কয়েকটা আমার পায়ের আঙুল কামড়ে রক্ত চুষে স্বাস্থ্যবান হচ্ছে। দু’চারটে রক্ত শুষে নিয়ে খসেও পড়েছে। আমার কোন বোধ নেই। চারধারে কচুঝোপ । ঝাঁঝালো দুর্দন্ধে ভারি হয়ে আছে বাতাস। না, সে বোধও নেই আমার। আমার সারাটা চেতনা জুড়ে একটাই বোধ কাজ করছে, ধরা পড়া চলবে না। আমি বসে আছি কচুঝোপের মাঝে । কতক্ষণ জানি না। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো একটা আলোর শিখা। একচিলতে আলো , বেঁচে থাকার আশ্বাস, প্রাণের স্পর্শ । তারপর সে মৃদু আলোয় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল একট পোড় খাওয়া অথচ প্রতিজ্ঞায় কঠোর মুখ । আমার মায়ের মুখ । মা ফিসফিস করে মৃদুকন্ঠে ডাকলেন ,‘ পপো কোথায় তুই, বেরিয়ে আয় । ওরা চলে গেছে ।’ সে ডাক এতটাই মৃদু ছিলো যেন শোনাই যায় না, যেন শুনতে পাবে কেউ এই ভয়ে নিবিড় সতর্কতা। আমি সন্তর্পণে বেরিয়ে এলাম কচুঝোপ থেকে। সর্বাঙ্গে কাদা । ঝাঁপিয়ে পড়লাম মায়ের বুকে। ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলাম। না, সে কান্নাতেও কোন শব্দ ছিল না। যেন কেউ শুনতে পাবে সেই ভয়ে । মায়ের হাত ধরে চলতে শুরু করলাম । আর তখনই বুঝলাম আমার পায়ের বিভিন্ন জায়গা কামড়ে ধরে আছে অনেকগুলো জোঁক।
এটা কোন নাটক সিনেমার দৃশ্য নয়, নয় কোন উপন্যাস বা ছোট গল্পের খন্ডিত কাহিনি। এটা জীবনের গল্প। যারা মুক্তিযুদ্ধের গল্প লেখেন বা সিনেমা বানান, সে গল্পের কতটা সত্য আর কতটা বানানো, কোথায় অসামঞ্জস্য আমি সহজেই তা ধরে ফেলি। কারণ আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের অংশ আমি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম কিশোরী । এমনিতেই সারা পৃথিবীব্যাপী ধরে নেয়া হয় নারী মনেই ভালনারেবল। নারীর নিরাপত্তা সঙ্কট সভ্য অসভ্য কোন দেশে নেই! তাতে আবার মুক্তিযুদ্ধকালের কিশোরী! মারত্মক ব্যাপার। চারদিকে যা চলছে । চারপাশে বিহারিদের বাস। মাঝখানে দু’একঘর বাঙালি । তার একঘর আমরা । ওরা এখন হিংস্র। কিশোরী আমি পরিবারের সাথে যশোর ছাড়লাম । চুলোয় তখন টগবগ করে ফুটছে ভাত, উঠোনে চরছে মোরগ মুরগি , দড়িতে ঝুলছে শুকাতে দেয়া কাপড় , সফেদা গাছের ডালে বসে আছে আপার পালা প্রিয় তিতির । সব ফেলে প্রাণ নিয়ে আমরা ছুটলাম জন্মস্থান নড়াইলের দিকে। সাথে শুধু আপার বিয়ের সময় পাওয়া গয়নাগাটি । বাড়তি কাপড় নেয়াও হলো না। চার পাশের বিহারীরা দুদিনেই বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে উঠেছে । তাছাড়া শেল পড়ছে । এই অবস্থায় কিছু হলে ওরা বাঁচাতে মোটেও এগিয়ে আসবে না।
বড়বোন অন্ত:সত্তা । এডভন্স স্টেজ। দীর্ঘ একুশ মাইল পথ পায়ে হাঁটতে হলো আমাদের । না খাবার, না পানি। মুমুর্ষু অবস্থায় নড়াইলের বাড়িতে পৌঁছামাত্র মা বললেন , ‘এখনই এ বাড়ি ছাড়তে হবে । শহরে আর্মি ঢুকেছে ।’ আবার সেই পথ। বাড়ি থেকে কিছুদূর যাবার পরই দেখলাম আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ স্পর্শ করেছে । চারপাশের লোকজন বলাবলি করছে, আমাদের বাড়ি পাকিস্তানিরা পুড়িয়ে দিয়েছে। পরে দেখেছিলাম আমাদের শুধু বসতবাড়ি নয়, সবকটা ভাড়াবাড়ি ওরা পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে । ওদের আমাদের বাড়ি-ঘর চিনিয়ে দিয়েছে শান্তিকমিটি আর রাজাকাররা। অপরাধ আমার আব্বা আওয়ামী লীগ করেন। তিনি নড়াইল মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আব্বা আর ভাইয়েরা দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন আগেই।
শুরু হলো আমাদের উদ্বাস্তু জীবন। আজ এখানে তো কাল ওখানে । কোথাও আমরা বেশিদিন টিকতে পারি না। কেমন করে যেন জানাজানি হয়ে যায় আমরা কোথায় আছি । ভাইয়েদের খোঁজে আর্মি হানা দেয় । মধ্যরাতে উঠেও জায়গা বদলাতে হয়েছে আমাদের। কখনও ভাত জোটে, কখনও শুধু রুটি, বড়জোর একটু শাপলা ভাজি । মা সর্বদা আমাকে নিয়ে শঙ্কিত। কোথায় লুকিয়ে রাখবেন আমাকে! শান্তি কমিটি আর রাজাকাররা চারপাশে ঘুরছে। তাদের শ্যেন দৃষ্টি অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে। কোন পরিবারে কয়টা মেয়ে আছে, তাদের কোনটা বেশি সুন্দরী, কোনটা স্বাস্থ্যবতী, পাকিস্তানীদের কোনটা ভেট দিলে তারা বেশি খুশি হবে, নেকনজরে পড়া যাবে এসবের জন্য চোরা চোখে সর্বদা ঘুরাফিরা করে ওরা। সেই যুদ্ধের দিনগুলোতে নিজেকে আমার খুব অসহায় মনে হতো। ভাবতাম আমার বয়স যদি আর একটু কম হতো কী অসুবিধা ছিল তাতে । আমার মায়ের তো আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভুগতে হতো না। আমি সারাক্ষণ গুটিয়ে থাকতাম। চেষ্টা করতাম যতটা সম্ভব লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে। নিজের জন্মটাকে বাড়তি মনে হতো, নিজেকে মনে করতাম আপদ!
আমরা যেখানেই থাকতাম মুক্তিযোদ্ধারা আসত মায়ের কাছে। বিশ্রাম নিতো, মাঝে মাঝে অস্ত্র রেখে যেত। নিজেদের খাবার না থাকলেও পরম যত্নে তাদের খাওয়াতেন মা। কত মুক্তিযোদ্ধাকে যে ভাত বেড়ে খাইয়েছেন মা আর সাথে আমরা দু’বোন, কতজনের ভাত বয়ে নিয়ে গেছি বলে শেষ করা যাবে না। অবশ্য সবই লুকিয়ে গোপনে, উভয়পক্ষের নিরাপত্তার স্বার্থে। মাঝে মাঝে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অনাচার মিথ্যাচার দেখে ক্ষেপে উঠি । ভাবি, আমরা কি মুক্তিযোদ্ধা না ! আমি. মা, আমার বোন হ্যাপী?
মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ের খবর ভেসে আসে । আমরা উল্লসিত হই । আমাদের স্বপ্ন আকাশ স্পর্শ করে। খবর আসে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের । অমরা ‘জয়বাংলা’ বলে চিৎকার করি। ভেসে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের শহিদ হবার খবর। আমরা চেনা-অচেনা ভাইদের জন্য কাঁদি। এর মাঝেই খবর আসে আমার বড় ভাই পিরোজপুরের ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ও ট্রেজারি অফিসার সাঈফ মীজানুর রহমান পিরোজপুরের ট্রেজারি খুলে দিয়েছেন। ট্রেজারির সমস্ত অস্ত্র আর গোলা-বারুদ তুলে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। ঘোষণা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্মতা। মা উদ্ভাসিত চোখে বলেন , ‘এই না হলে আমার ছেলে ! সাবাস বাবা!’ আর অল্পদিনের মাঝেই জানতে পারি শহিদ হয়ে গেছেন বড়দা। রাজাকারদের তৎপরতায় তাঁর সব খবর পৌঁছে গেছে পাকিস্তানিদের কাছে। তারা তাঁকে ধরে ফেলেছে। জিপের চাকায় বেধে মহকুমা শহর পিরোজপুরের এবড়ো থেবড়ো রাস্তা দিয়ে জিপ চালিয়ে বলেশ্বর নদীর তীরে দাড় করিয়ে বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে ফেলেছে তাকে। তার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।
মৃতদেহ যখন পাওয়া যায়নি মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস, বেচে আছেন বড়দা। এ বিশ্বাসে মা গেলেন পিরোজপুর। তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন পুরো পিরোজপুর শহর । অলি গলি কিছুই বাদ গেলো না। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে রইলেন বড়দার সরকারি বাসার বারান্দায়। তারপর খালি হাতে ফিরে এলেন গ্রামে । এরপর থেকে মা কথা বলতেন খুব কম।
অনেকবার জায়গা বদলে মা আপা আর হ্যাপী ফিরে গেলো আমাদের নড়াইলের পোড়া বাড়িতে । আপার ডেলিভারি আসন্ন, নিজেদের বাড়িতে থাকতে পারলে ভাল। কিন্তু গিয়ে দেখলেন, ও বাড়ি শান্তিকমিটির অফিস। শান্তিকমিটির চেয়রম্যান দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চাইলেন মা আর আপাকে। আপার অবস্থা দেখে চেয়ারম্যানের বৌ-এর দয়া হলো। একটা ঘরে থাকতে দিলেন। রান্নার ব্যবস্থা বারান্দায়। আব্বার মুহুরি কয়কটা বাঁশের ঝাঁপি এনে পোড়া জানালা দরজাগুলো বন্ধ করে দিলেন। সেখানেই জন্ম নিলো সৈকত । আপার ছোটছেলে ।
মির্জাপুর নানাবাড়ি থেকে শুনলাম সৈকতের জন্ম খবর। আমি আমার এক খালুকে প্রচন্ড অনুরোধ করলাম আমাকে নড়াইলে নিয়ে যেতে। আপার ছেলেটোকে একবার দেখে চলে আসব। বার বার অনুরোধ করাতে খালু কি ভেবে যেন রাজি হলেন। উনি আমাকে নিয়ে নৌকায় করে এলেন নড়াইলে । খুব সন্তর্পণে এ বাড়ির মধ্য দিয়ে, ওবাড়ির পাশ দিয়ে বাড়িতে এলাম। মা আমাকে দেখে বললেন, ‘কাজটা ভাল করিসনি পপো। তোর আসা মোটেও উচিত হয়নি। রাতে মাঝে মাঝেই আর্মি আসে তোর ভাইদের খবর নিতে । ওরা এলে বিপদ হবে। রাতটা কোনভাবে কাটিয়ে সকালে চলে যাবি।’
সেই মুহূর্তে মাকে আমার নিষ্ঠুর মনে হলো। মাঝে মাঝে আসে, আজই আর্মি আসবে তার মানে আছে নাকি! আমি আপার ছেলেটাকে অপলকে দেখলাম । আদর করলাম। রাতে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আর মাঝরাতে দরজায় করাঘাত শুরু হলো। মা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে বললেন, ‘ আর্মি এসেছে। রান্নাঘরের পোড়া জানালা টপকে চলে যা। কারো বাড়িতে যদি থাকতে পারিস ভাল, না হলে লুকিয়ে থাকিস ঝোপঝাড়ে। মরবি কিন্তু ধরা পড়বি না।’ মা টিমটিমে বাতি হাতে নিয়ে দরজা খুলতে চললেন। আর আমি রান্নাঘরের জানালা টপকে আশে পাশের দুটো বাড়িতে টোকা দিলাম, আমার বিপদের কথা জানালাম। কেউ আশ্রয় দিলো না, দরজা খুললো না। আমি ছুটলাম আর কিছুটা গিয়েই পেলাম সেই কচুঝোপ। ঢুকে পড়লাম সেখানে। সে গল্প আগেই বলেছি।
মা আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন , ‘আর্মিরা তারের ওপরে তোর পাজামা দেখে আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করছিল লেড়কিকা পাজামা। লেড়কি কাহা হ্যায় ? অমি যত বলি কোন লেড়কি নেই ওরা শোনে না। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম ওরা না টর্চ মেরে চারপাশ খুঁজতে শুরু করে দেয় । শোন কাল সকালেই চলে যাবি। আর ঝুঁকি নেয়া যাবে না। ’ বড়দা শহিদ হবার পর এত কথা মা একসাথে কখনও বলেননি। আজ বুঝি, আর একটা সন্তানকে বাঁচাতে সেদিন তিনি কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
পরদিন সকালে মায়ের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা এল। সাথে একটা গরুর গাড়ি । আর সেই গরুর গাড়ি বোঝাই ধানের বস্তা। বস্তার ফাঁকে রাইফেলও ছিল। আমি সেই ধানের বস্তা আর রাইফেলের স্পর্শ নিতে নিতে ফিরে গেলাম গ্রামে।
Facebook Comments Sync